‘মঙ্গল’ কথাটির ঘোর আপত্তি মৌলবাদী এবং অন্যান্য ইসলামিক সংগঠনগুলির। গত ৩১ বছর হল ঢাকার রমনা ময়দান থেকে পয়লা বৈশাখ উদযাপন উপলক্ষে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়। হাজার হাজার মানুষ এই শোভাযাত্রায় যোগ দেন। তাঁরা সকলে রবীন্দ্রনাথের গান গাইতে গাইতে ঢাকার রাজপথ পরিক্রমা করেন। খুব জাঁকজমক সহকারে মিছিলে যোগদানকারীরা নানা পোশাকে সজ্জিত হয়ে এই মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক ছড়িয়েছে বিভিন্ন মহলে। তাঁরা বলেন, ‘মঙ্গল’ কথাটায় আপত্তি ইসলাম ধর্মে লেখা নেই— তবে তা নিয়ে আপত্তি তোলা হচ্ছে কেন? তাঁরা আরও বলেন, বাংলাদেশ তো এখনও ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়নি যে এখনই ইসলামিক অনুশাসন মেনে চলতে হবে। কিন্তু এই মহলের মঙ্গল কথাটি নিয়ে আপত্তির কোনও কারণ দেখতে না পেলেও, একাধিক ইসলামি সংগঠন থেকে বলা হয়েছে পয়লা বৈশাখ শোভাযাত্রা হতে পারে, গানবাজনা, নাচ হতে পারে কিন্তু ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামের পরিবর্তন করতে হবে। শোভাযাত্রা থেকে মঙ্গল শব্দটি তুলে ফেলতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের আয়োজনে পয়লা বৈশাখ এই মঙ্গল শোভাযাত্রা হয়ে আসছিল। হাজার হাজার ঢাকা নগরবাসী রাস্তায় বের হন। এই শোভাযাত্রা দেখে, কেউ কেউ যোগ দেন।
সম্প্রতি ‘ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠনের তরফে সৈয়দ মহম্মদ ফয়নুল করিম একটি বিবৃতিতে মঙ্গল কথাটি বাদ দেওয়ার দাবি তোলেন। একই দাবির পক্ষে গোলা মেলায় হেফাজতে ইসলাম। ফয়রুল করিম দাবি করেছেন, কোনও শোভাযাত্রা করলে মঙ্গল হবে এমন বিশ্বাস বা ধারণা ইসলামের দিক থেকে গুনাহ অর্থাৎ পাপ। সুতরাং মঙ্গল কথাটি ইসলামধর্মের পরিপন্থী। ইসলামি আন্দোলনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে বাংলা নববর্ষ উদযাপনের কোনও অনুষ্ঠানে ইসলাম অসমর্থিত কিছু করা যাবে না। করলে বাধা আসবে। ইসলাম ধর্মের দীর্ঘ ইতিহাস এবং ঐতিহ্যকে রক্ষা করে শোভাযাত্রা করতে হবে। এবং সে শোভাযাত্রার নাম পাল্টাতে হবে— অর্থাৎ মঙ্গল শোভাযাত্রা এই নামে মিছিল করা যাবে না। চারুকলা সংস্থা ১৯৮৯ সাল থেকে পয়লা বৈশাখে এই শোভাযাত্রা করছে। কয়েকশ ঢাকির ঢাকের বাজনার তালে তালে মঙ্গল শোভাযাত্রা ঢাকার রাজপথ পরিক্রমা করে। হাজার হাজার শহরবাসী তা দেখে আনন্দ প্রকাশ করে। শুরুতে এর নাম ছিল ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’। পরবর্তী পর্যায়ে এর নামকরণ হয় ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। ১৯১৬ সালে এই মঙ্গল শোভাযাত্রার বৈচিত্র্য দেখে ইউনেস্কো সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দেয় এই মঙ্গল শোভাযাত্রার। হেফাজতে ইসলাম দাবি করেছে, বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায় জন্মাষ্টমীর দিন ঢাকার রাজপথে যে শোভাযাত্রা বের করে তার নামও মঙ্গল শোভাযাত্রা। সর্বজনীয়তার নামে সেটা সবার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। হেফাজত ইসলামের এক নেতা বলেন, আনন্দ শোভা যাত্রাকে মঙ্গল শোভাযাত্রায় রূপান্তরিত করা আসলে ভারতীয় ষড়যন্ত্র। ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পুর্নর্বিবেচনা বা ভুল সংশোধনের জন্য তিনি সরকারকে অনুরোধ করেন। তিনি বলেন, এ ব্যাপারে সরকার যেন একটি চিঠি লেখে তার জন্য তারা চাপ সৃষ্টি করবে। হেফাজতের মতে, আনন্দ শোভাযাত্রায় ফিরে যাওয়া বৈচিত্র্য অথচ আনন্দ শোভাযাত্রা পয়লা পৈশাখেবের হলেও তা স্থায়ী হয়নি। মঙ্গল শোভাযাত্রাই বের হয়েছে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়েও এই মঙ্গল শোভাযাত্রা নাম নিয়ে একাধিক মত রয়েছে। মন্ত্রণালয়ের অনেকেই চান, যা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে অর্থাৎ মঙ্গল শোভাযাত্রা নামের পরিবর্তনের বিরোধী। আবার কিছু আধিকারিক চান, মঙ্গল কথাটা তুলে দিয়ে সেখানে আনন্দ শোভাযাত্রা করা হোক। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের তদারকি সরকারের কোনও মন্তব্য জানা যায়নি। তবে বাংলাদেশের কবি, সাহিত্যিকরা বলেছেন, বাংলা নববর্ষের দিন জমকালো মঙ্গল শোভাযাত্রা প্রতি বছরই বের হয়। তখন কোনও তরফ থেকে আপত্তি জানানো হয়নি। এখন করা হচ্ছে কারণ মৌলবাদীরা চায় না শোভাযাত্রা ঢাক-ঢোল সহকারে পথে বের হোক। এটা নাকি ইসলাম ধর্মের পরিপন্থী।
বাংলাদেশে এখন ভারত বিদ্বেষ এমন চরমে উঠেছে যে পয়লা বৈশাখ উদযাপনের জন্য যে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়, তাত্ নাকি ভারতের ইন্ধন আছে। সম্প্রতি তাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বিমস্টেক সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বাংলাদেশের তদারকি সরকারের প্রধান ইউনূস খানকে বলেন, বংলাদেশে নানাভাবে ভারত বিরোধিতা যদি চলতেই থাকে, তাহলে দুই দেশের সম্পর্কে একটি ফাটলের সৃষ্টি হতে পারে। ভারত তা কখনও চায় না— বরং ভারত চায় দুই দেশের সম্পর্ক আরও নিবিড় হোক। প্রধানমন্ত্রী খান সাহেবকে আরও বলেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুরা যাতে সুখস্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারে, তার জন্য তাদের নিরাপত্তা দিতে হবে। কারণ তাঁরা বাংলাদেশেরই নাগরিস। ইউনূস খান অবশ্য প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বাস দিয়ে বলেন, বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা এখন শান্তিতেই আছেন। সরকার তাঁদের নিরাপত্তার জন্য যথোচিত ব্যবস্থা নিয়েছে।
তবে পয়লা বৈশাখের দিন বাংলাদেশে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হওয়া নিয়ে মৌলবাদীরা কী অবস্থান নেয়, তার জন্য একটা উদ্বেগ সবার মনেই রয়েছে। তবে মঙ্গল কথাটা যে ব্যবহার করা যাবে না, বাধা আসবে— তা সহজেই বোঝা যায়।