বাহ্যিক চাকচিক্য, ঔজ্জ্বল্যে ভরা নালন্দা যেন প্রদীপের নীচেই অন্ধকার

পুলক মিত্র:  প্রাচীন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসাবশেষ থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে গড়ে তোলা হয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ১৯ জুন, বিহারের রাজগীরে ১৭৪৯ কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস উদ্বোধনের পাশাপাশি সেখানে একটি চারাও রোপণ করেন।

ইতিহাস থেকে পাওয়া বিভিন্ন তথ্য অনুযায়ী, পঞ্চম শতাব্দীতে তৈরি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় একসময় গোটা বিশ্বের পণ্ডিতদের গন্তব্য হয়ে উঠেছিল। পঞ্চম শতাব্দী থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত এই বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষা লাভের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, যেমন চিন, কোরিয়া, জাপান, তিব্বত, মঙ্গোলিয়া, শ্রীলঙ্কা এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ থেকে পড়ুয়ারা আসতেন। পূর্ব ও মধ্য এশিয়ার ১০ হাজারের বেশি পড়ুয়া এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ করেছিলেন বলে জানান গবেষকরা। দ্বাদশ শতকে, অর্থাৎ ৮০০ বছর এটি ধ্বংস হয়ে যায়।

২০১৬ সালে, এই স্থানটিকে রাষ্ট্রসঙ্ঘ ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ হিসেবে ঘোষণা করে। এরপর নতুন ক্যাম্পাস তৈরির কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। তার আগে ২০১৪ সালেই মাত্র ১৪ জন শিক্ষার্থীকে নিয়ে একটি অস্থায়ী স্থান থেকে পথ চলা শুরু হয়েছিল আজকের  অত্যাধুনিক নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের।


৪৫৫ একর জায়গা জুড়ে গড়ে ওঠা নালন্দা  বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাসের বেশ কিছু বিশেষত্ব রয়েছে। এটিকে একটি ‘নেট জিরো গ্রিন ক্যাম্পাস’ হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। ১০০ একরেরও বেশি জলাশয় ক্যাম্পাসের পরিবেশের সৌন্দর্য বৃদ্ধির পাশাপাশি জল সংরক্ষণ এবং বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষার জন্য তৈরি করা হয়েছে ১০০ একরের বেশি জলাশয়। রয়েছে সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা। ক্যাম্পাসের ১০০ একরেরও বেশি জায়গা সবুজের জন্য উৎসর্গ করা হয়েছে।

আধুনিক শিক্ষার উপযোগী স্মার্ট বোর্ড এবং ডিজিটাল টুল দিয়ে ক্লাস ঘরগুলি তৈরি করা হয়েছে। রয়েছে একটি সুন্দর গ্রন্থাগার। বর্তমানে এখানে ২৬টি বিশ্বের দেশের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করছেন। স্নাতকোত্তর, ডক্টরাল রিসার্চ কোর্স, শর্ট সার্টিফিকেট কোর্স এবং আন্তর্জাতিক ছাত্রদের জন্য ১৩৭টি বৃত্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ক্যাম্পাসে মোট ৪০টি ক্লাসে প্রায় ১,৯০০ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করতে পারেন। অতিরিক্তভাবে, এখানে দু’টি অডিটোরিয়াম রয়েছে, প্রতিটিতে রয়েছে ৩০০টি করে আসন। আর রয়েছে একটি হস্টেলও, যেখানে যা প্রায় ৫৫০ জন পড়ুয়ার থাকার ব্যবস্থা রয়েছে।

অত্যাধুনিক এই ক্যাম্পাসের উদ্বোধনের পর প্রধানমন্ত্রী বেশ কয়েকটি ট্যুইটও করেন। ২০১৬ সালে এই মোদি সরকার নালন্দার স্বশাসনকে অস্বীকার করায় এর আচার্য পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন সিঙ্গাপুরের বিদেশমন্ত্রী জর্জ ইয়ো।  আন্তর্জাতিক ফ্যাকাল্টি সদস্যরা একে একে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যেতে থাকেন, কিংবা তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে বাধ্য করা হয়।

২০০৭ সালে, ফিলিপাইনসের মান্দাউয়ে পূর্ব এশিয়া শীর্ষ সম্মেলনে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুনরুজ্জীবনের প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। থাইল্যান্ডের হুয়া হিনে ২০০৯ সালের পূর্ব এশিয়া শীর্ষ সম্মেলনে এই অনুমোদনের সিদ্ধান্ত ফের গৃহীত হয়। ওই সম্মেলনে ভারত ছাড়া মোট ১৭টি দেশ – অস্ট্রেলিয়া, বাংলাদেশ, ভুটান, ব্রুনাই দারুসসালাম, কম্বোডিয়া, চিন, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, মরিশাস, মায়ানমার,  নিউজিল্যান্ড, পর্তুগাল, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড এবং ভিয়েতনামের প্রতিনিধিরা ছিলেন। এই বিশ্ববিদ্যালয় তৈরিতেও সাহিত্য মিলেছে এই দেশগুলির। 

গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী কোনও উপাচার্য নেই। গভর্নিং বডির সদস্যদের অধিকাংশই সরকারি আমলা, শিক্ষা জগতের লোক রয়েছেন হাতে গোনা মাত্র কয়েকজন।

বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য পদে রয়েছেন অর্থনীতিবিদ অরবিন্দ পানাগেরিয়া এবং উপাচার্য হলেন অভয় কুমার সিং। দুজনেই বিজেপি ঘনিষ্ঠ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে যে তথ্য রয়েছে, তাতে  অধিকাংশ ফ্যাকাল্টি সদস্যের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। তাঁদের ডিগ্রি, প্রকাশনা, পুরস্কার এবং স্বীকৃতি, সবকিছু নিয়ে সঠিক স্পষ্ট কোনও তথ্য নেই। স্বচ্ছতার অভাবই মোদি জমানার বিশেষত্ব। ফ্যাকাল্টি সদস্যদের অধিকাংশই অস্থায়ী, বা চুক্তির ভিত্তিতে নিযুক্ত।

২০১৪ ও ২০১৫ সালে বিভিন্ন দেশের বহু উচ্চ শিক্ষিত স্কলার এবং ফ্যাকাল্টি নালন্দায় পা রেখেছিলেন। স্বচ্ছতার অভাব, চুক্তিভঙ্গ এবং কর্তৃত্ববাদী মানসিকতার কারণে এর “প্রতিষ্ঠাতা ফ্যাকাল্টি”দের অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে গিয়েছেন।

২০১৭-সালে মোদি সরকারের উপাচার্য নিয়োগের পর থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে গিয়েছেন বহু পড়ুয়া। বর্তমানে ভালো ছাত্রছাত্রীরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আগ্রহী নন। শুধুমাত্র তাকলাগানো ক্যাম্পাস বানালেই ছাত্রছাত্রীরা পড়তে আসেন না। শিক্ষার মানও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যা গড়ে তুলতে বহু সময় লাগে। নালন্দায় এখনও ভালো ফ্যাকাল্টি সদস্য নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাগত পরিবেশেরও অবনতি ঘটেছে। ওয়েবসাইটে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান থেকেই তা স্পষ্ট। বিহারের ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে নালন্দার স্থান ১৯তম। অর্থাৎ, অর্থাৎ কম অনুদানে চলা বিহারের ১৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়েও পিছিয়ে রয়েছে নালন্দা।

যদি এই সমীক্ষা সত্যি হয়, তবে বলতেই হয়, পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এই পরিস্থিতিতে কোনও পড়ুয়া নালন্দায় পড়তে চাইবেন না, এটাই কি স্বাভাবিক নয়? তবে ভুটান, মায়ানমার, কাম্বোডিয়া এবং লাওস থেকে বেশ কয়েকজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী এখানে রয়েছেন।

কম ছাত্রছাত্রীর অভিযোগ যাতে না ওঠে, সেজন্য এই বিশ্ববিদ্যালয়ে রাখা হয়েছে বেশ কয়েকটি ডিপ্লোমা ও সার্টিফিকেট কোর্স। যদিও নালন্দায় মূলত স্নাতকোত্তর এবং গবেষণামূলক শিক্ষার ওপর বেশি জোর দেওয়ার কথা। শুধুমাত্র ডিপ্লোমা ও সার্টিফিকেট প্রদান করা হলে, দেশের নানা প্রান্তে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে নালন্দার ফারাক থাকবে কোথায়? দুভার্গ্যজনক হলেও সত্যি যে, শুধুমাত্র সার্টিফিকেট দেওয়ার অর্থ, দেশে তরুণ বেকারের সংখ্যা বাড়ানো। যদিও গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা অনেকেই মনে করেন, বেকারত্ব দেশের কোনও সমস্যাই নয়।

সম্ভবত মোদি মডেলের একটি আদর্শ উদাহরণ হল, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। আপাতদৃষ্টিতে বাহ্যিকভাবে চাকচিক্য, ঔজ্জ্বল্যে ভরা, অথচ পিছনে লুকিয়ে রয়েছে অন্ধকার। এ যেন প্রদীপের নীচেই অন্ধকার। নালন্দায় প্রথম ব্যাচের পড়ুয়ারা স্নাতক হয়েছিলেন ২০১৬ সালে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কেন সমাবর্তন হল না? সমাবর্তন হল একটি প্রকাশ্য অনুষ্ঠান। এই বিশ্ববিদ্যালয় যে ভালো সংখ্যক পড়ুয়াদের টানতে ব্যর্থ, তা সমাবর্তন হলেই ধরা পড়ে যেত।

২০১০-১১ অর্থবর্ষে ১০ বছরের জন্য ২,৭১০ কোটি মঞ্জুর করেছিল ইউপিএ সরকার। দেশের করদাতা হিসেবে সাধারণ মানুষের অবশ্যই জানার অধিকার রয়েছে, এই বিশ্ববিদ্যালয় এ পর্যন্ত ২৭১০ জন পূর্ণাঙ্গ সময়ের পড়ুয়াকে কি শিক্ষাদান করতে পেরেছে?

২০১২ সালে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনকে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম আচার্য করা হয়েছিল। আচার্য হিসেবে তাঁর মেয়াদ শেষ হয় ২০১৫ সালের জুলাই মাসে। কিন্তু তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের গভর্নিং বোর্ডের সদস্য ছিলেন। ২০১৬ সালে তিনি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ সম্পর্ক পুরোপুরি ছিন্ন করেন।