চিন্তা আমার আপনার সবার, শারদোৎসব নির্বিঘ্নে কাটবে তো?

আশঙ্কা আপনার, আমার সবারই। আসন্ন উৎসবের দিনগুলি আনন্দে কাটবে তো? শারদোৎসবের আর বেশি দেরি নেই। প্রস্তুতি তুঙ্গে। এবারও ছোট বড় এবং মাঝারি সর্বজনীন পুজোগুলি নতুন নতুন থিম এনে দর্শনার্থীদের আনন্দ দেবে। কিন্তু সাধারণ মানুষ দুশ্চিন্তায় ঊর্ধ্বে উঠতে পারছেন না কারণ শহরের একটি বড় সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল আরজি করের নারকীয় ঘটনাকে কেন্দ্র করে তিলোত্তমার বুকে যে আন্দোলনের পর আন্দোলনের ঢেউ উঠেছিল, তা এখনও মিলিয়ে যায়নি। শহর, শহরতলি এবং রাজ্যের জেলাগুলির মানুষ এখনও এই হাসপাতালের ঘটনার বিচার চাইছে আন্দোলনে নেমে। চাইছে যারা দোষী, অর্থাৎ ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তাদের কঠোরতম আইনানুগ শাস্তি হোক।

ইতিমধ্যেই একটি নামকরা পুজোর তৃণমূলের কর্মকর্তার দুর্ভাবনা, এবার পুজোর দিনগুলি ভালোয় ভালোয় কাটবে তো? কারণ, আরজি করের ঘটনা নিয়ে যেভাবে জুনিয়র চিকিৎসকরা সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছিল প্রতিবাদ জানিয়ে এবং ‘জাস্টিস ফর আরজি কর’ চেয়ে তা এক কথায় নজিরবিহীন। আরজি করের জুনিয়র চিকিৎসকদের আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে শহরের পথে দাপিয়ে বেড়িয়েছিল অন্যান্য সরকারি হাসপাতালের জুনিয়র চিকিৎসকরা— এমনকি সিনিয়র চিকিৎসকরাও তাঁদের পাশে থেকে স্লোগান তুলেছিলেন ‘জাস্টিস ফর আরজি কর’। রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর তার ভূমিকা ঠিকমতো পালন করেনি বলে অনেকেরই আফসোস। করলে আন্দোলনের বিস্তার এত ব্যাপক আকার ধারণ করত না।

তিলোত্তমা এখন অনেকটাই শান্ত। কিন্তু পুজোর মুখে যে কোনওসময় অশান্ত হয়েও উঠতে পারে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি এই হাসপাতলের ঘটনাকে বর্বরোচিত ও ঘৃণ্য বলে আখ্যায়িত করে দোষীদের ফার্স্ট ট্র্যাক কোর্টে বিচার এবং ফাঁসি চেয়েছিলেন। আন্দোলনরত জুনিয়র চিকিৎসকদের মূল দাবিগুলি মিটিয়ে দিয়েছেন। তারা কাজেও যোগদান করেছেন। সুতরাং আর তাদের মনে কোনও ক্ষোভ থাকার কথা নয়। কিন্তু তবুও জানা যায়, ওই চিকিৎসকরা আবার নতুন করে আন্দোলনে নামতে পারে, তার হুঁশিয়ারি দিয়েছে সম্প্রতি। আজজি করের ঘটনার দ্রুত ন্যায়বিচার এবং এই ধরনের ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না হয়— সে দাবি জানাল ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টর্স ফ্রন্ট। এই দাবির পথে যে তারা আন্দোলনে নামবে না তা বলা যায় না।


মহালয়ার দিন জুনিয়র ডাক্তাররা আরজি করের যে চিকিৎসক মহিলাকে ধর্ষণ ও খুন করা হল, তার জন্য তর্পণ করবেন। আবার ওই ‘ভুয়ো’ খবরের প্রতিবাদ করে বলা হয় এই কর্মসূচির সঙ্গে আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারদের সম্পর্ক নেই। সুতরাং সবকিছুই একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। তবে আন্দোলনরত চিকিৎসকরা যেমন কাজে যোগ দিয়েছেন, তেমন অপেক্ষা করবেন মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের মূল দাবিগুলি যা মেনে নিয়েছেন— তার যথাযথ বাস্তবায়ন হয় কিনা। তার জন্য তাঁরা অপেক্ষা করে থাকবেন— নইলে আবার আন্দোলনের কথা চিন্তা করতে হবে। অনেকেই আরজি করের ঘটনায় গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে মনে করেন।

তবে এটা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই, জুনিয়র চিকিৎসকরা যে ব্যাপক আন্দোলন করলেন আরজি করের ঘটনা নিয়ে, তা পুজো কর্তাদের মনে একটি সংশয়ের সৃষ্টি করেছে। তাঁরা স্বস্তি পাচ্ছেন না এই বেবে যে আবার যদি আন্দোলনে নামেন তাঁরা, তাহলে পুজোর আনন্দ নিরানন্দে পরিণত হবে। কিন্তু শহরের বিশিষ্টজনের আশা, তা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারণ পুজোর দিনগুলিতে কোনও আন্দোলনই, সাধারণ নাগরিকদের সমর্থন পবে না। কারণ এই শারদোৎসবের জন্য বাঙালি যেখানেই থাকুক না কেন, সাগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে। সুতরাং এমন কিছু হওয়া উচিত নয়, যা পুজোর আনন্দকে ম্লান করে দেয়।

শহরের একটি নামকরা পুজোর কর্মকর্তা বললেন যে পুজোর কিছুদিন আগে শহরে যে মিছিল, মিটিং, মোমবাতি হাতে মহিলাদের মধ্যরাতে শহরের বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ, তাদের মনে অস্বস্তি এনেছিল এবার পুজো শান্তিপূর্ণ হবে কিনা? কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী জুনিয়র চিকিৎসকদের প্রধান প্রধান দাবি মেনে নেওয়ার ফলে তাদের মনে আর ক্ষোভ থাকার কথা নয়। তেমনই তারা যে আবার আন্দোলনমুখী হবেন, তা মনে হয় না। তাঁরাও নিশ্চয়ই চান পুজো আনন্দে কাটুক— শহরবাসী পুজোর আনন্দ উপভোগ করুন।

তবুও এবার অনেকেরই মনে একটা ভয়-ভীতি থেকেই যায়, আবার কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটবে না তো? তবে তিনি জানালেন, শহর ও শহরতলিময় মিছিল-মিটিংয়ের জন্য পুজোর আয়োজন বাধআপ্রাপ্ত হয়েছে। কারণ একটি বড় পুজোর প্যান্ডেল তৈরি হওয়া শুরু হয় পুজোর চার-পাঁচ মাস আগে। কিন্তু এবার তা হতে পারেনি আন্দোলনের কারণে। গ্রামগঞ্জ থেকে অনেক কর্মীরা আসেন পুজোর প্যান্ডেল তৈরির কাজ করতে। কিন্তু এবার তাঁরা ঠিক সময়ে আসতে পারেননি। তবে এখন তাঁরা দিনরাত এক করে কাজ করছেন, যাতে প্যান্ডেল এবং অন্যান্য সাজসজ্জার কাজ সময়ে শেষ হতে পারে।

গতবছর মুখ্যমন্ত্রী একটি বড় পুজোর উদ্বোধন করেছিলেন দেবীপক্ষ পড়ার আগেই। এবারও মুখ্যমন্ত্রী পুজোর উদ্বোধন অনেক আগেই করবেন বলে মনে হয়। তিনি সবাইকে পুজোর উৎসবে যোগদান করার আহ্বান জানিয়েছেন। এদিকে অন্যবারের মতো এবারও রেড রোডে কার্নিভালের ঘোষণা করল রাজ্য প্রশাসন। রাজ্য তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের থেকে বলা হয়েছে, কলকাতা ও তৎসংলগ্ন এলাকা, জেলা এবং বিদেশের পুজোগুলির মধ্যে থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেরা পুজোগুলিকে বেছে নেওয়া হবে ‘শারদ সম্মানের জন্য’। ১৫ অক্টোবর রেড রোডে দুর্গোৎসবের কার্নিভালের আয়োজন করবে সরকার। আরজি করের ঘটনা নিয়ে জুনিয়র চিকিৎসকদের প্রবল আন্দোলনের সময় মুখ্যমন্ত্রী তাদের আন্দোলন পরিহার করে পুজো ও উৎসবে যোগদানের আহ্বান জানিয়েছিলেন। তারপরই মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের দাবিদাওয়া নিয়ে পর্যালোচনা করে তাঁদের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনা করার জন্য আহ্বান জানান। তিনি নিজে ধর্নামঞ্চেও গিয়ে আন্দোলনরত ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলেন এবং আলোচনার জন্য নবান্ন সভাঘরে আসার জন্য অনুরোধ জানান। তাঁদের বলেছিলেন, তিনি তাঁদের দিদি হয়ে এসেছেন, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে আসেননি।

এত সব সত্ত্বেও মুখ্যমন্ত্রীকে কয়েক ঘণ্টা নবান্ন সভাঘরে বসে থাকতে হয় জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিনিধিরা আসবেন বলে। কিন্তু দীর্ঘ সময় অক্ষো করার পর যখন দেখা গেল চিকিৎসকদের প্রতিনিধিরা এলেন না, তখন মুখ্যমন্ত্রীকে সভাঘর ছেড়ে বাড়ি চলে যেতে হয়। জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন একটা বড় মাত্রা নেয়, যখন আন্দোলনকারীরা ছাড়াও সমাজের বিশিষ্ট জন, বিশেষ করে মহিলারা মধ্যরাতে রাস্তায় বের হন। আন্দোলন অতীতেও হয়েছে, কিন্তু জুনিয়র চিকিৎসকদের আন্দোলন একটি বড় মাত্রা পেয়ে ইতিহাস রয়ে রইল।

এখন শহরবাসী সহ সাধারণ মানুষের চিন্তা, আন্দোলন আবার পুজোর প্রাক্কালে নতুন করে শুরু হবে না তো? কারণ জুনিয়র চিকিৎসকদের প্রতিনিধিরা বলেছেন, তাদের সব দাবি পূরণ হয়নি, তাই তাঁরা কাজে যোগ দিয়েছেন বটে, তবে আন্দোলন চলবে। বিজেপি সহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল তাঁদের নানা দাবিদাওয়ার সমর্থনে রাস্তায় নামবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে। এই সব আন্দোলনের ঘোষণার পর কলকাতা পুলিশ পুজোর আগে যাতে কলকাতার প্রাণকেন্দ্র ধর্মতলা থেকে ভিক্টোরিয়া হাউস পর্যন্ত ১৪৫ ধারা জারি করেছে। নতুন পুলিশ কমিশনার বলেছেন যে করেই হোক শহরে শান্তিশৃঙ্খলার অবনতি হতে দেওয়া যাবে না। আরজি করের মর্মান্তিক ঘটনার পর স্বাস্থ্য দফতরের অনেক বড় কর্তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

আরজি করের ঘটনায় কলকাতা পুলিশের ভূমিকার সমালোচনা হয়েছে— পুলিশ ঠিক সময়ে সক্রিয়তার পরিচয় দেয়নি। তদানীন্তন পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলের সমালোচনা করে তাঁর পদত্যাগ দাবি করেছেন আন্দোলনকারীরা। অবশেষে তাঁকে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে, চিকিৎসকদের দাবি মেনে। এখন আন্দোলনকারী চিকিৎসকরা কাজে যোগ দিয়েছেন, সুতরাং নতুনকরে যদি তাঁরা আবার দাবি তুলে শহরের বুকে আন্দোলনে নামেন পূজোর প্রাক্কালে, তা মোটেই যুক্তিসঙ্গত হবে না— এবং শহরবাসীও তাঁদের সমর্থন করবে না।

সুতরাং পুজো আনন্দে কাটবে এবং জুনিয়র চিকিৎসক এবং অন্যান্য বিরোধী দল যাতে তাদের ঘোষিত আন্দোলনের নানা কর্মসূচি পরিহার করে নেন, সেটাই সবাই চান। কারণ বছরভর বাঙালিরা যে যেখানেই থাকুন না কেন এই শারদোৎসবের জন্য অপেক্ষা করে থাকেন। আরজি করের ঘটনার প্রতিবাদে কয়েকটি ক্লাব সরকারের ঘোষিত অনুদান বর্জন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এবার ক্লাবগুলি ৭৫ হাজার টাকা করে পাবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে।