বাংলাদেশের কথা অমৃত সমান। এমন সব ঘটনা প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে বলে ভারত কী পদক্ষেপ নেবে তার জন্য দিল্লির সাউথ ব্লক অঙ্ক কষছে। কীভাবে এই নিকটতম বন্ধু প্রতিবেশীকে বোঝানো যায় সেখানকার তদারকি সরকার ভুল পথে চলছে। শেখ মুজিবুর রহমান এই বাংলাদেশ চাননি। এই যেমন সম্প্রতি বাংলাদ্শের সরকার ভারতে অবস্থানরত সে দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফেরত চাইল। এ ব্যাপারে একটা কূটনৈতিক বার্তা পাঠাল বাংলাদেশ। কিন্তু চাইলেই তো ভারত হাসিনাকে যে সে দেশের হাতে তুলে দিতে পারে না। হাসিনা ভারতে একজন অতিথি। ভারত অতিথিকে ফেরায় না। ‘অতিথি দেবো ভব’। ভারত অতিথিদের সম্বন্ধে এই ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। যেমন তিব্বতের ধর্মগুরু দালাই লামা অনেকদিন হল ভারতে একজন মহান অতিথি হিসেবে বাস করছেন। শেখ হাসিনাকে ঢাকার হাতে তুলে দিতে হলে সেই ঐতিহ্যে লহ্ঘন করা হয়। ভারত তা কখনও করবে বলে মনে হয় না।
তদারকি সরকারের পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্র ভারতের কাছে একটি ‘ভার্বাল নোট’ (কূটনৈতিক বার্তা) পাঠিয়ে বলেছেন, শেখ হাসিনাকে বিচারের সম্মুখীন হতে হবে, সেই কারণে ভারত অবিলম্বে তাঁকে যেন ঢাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা করে। এই বার্তা পৌঁছনোর পর সাউথ ব্লক এখনই এ ব্যাপারে কোনও প্রতিক্রিয়া দেওয়ার পথে হাঁটছে না। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রকের এক মুখপাত্র জানালেন, ‘বাংলাদেশের হাই কমিশনারের মাধ্যমে প্রত্যার্পণের অনুরোধ সংক্রান্ত একটি কূটনৈতিক বার্তা আমরা পেয়েছি। তবে এ ব্যাপারটি নিয়ে এখনই কোনও মন্তব্য করতে চাই না। ভার্বাল নোটে কারও সই থাকে না। সবে বার্তাটি এসেছে। ভারতের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা বিষয়টি দেখবেন। তাই তাড়াহুড়ো করার মতো বিষয়টি নয়।’ বাংলাদেশে কয়েকমাস আগে যে গণ অভ্যুত্থান হয়েছিল, সেই সময় প্রধানমন্ত্রী হাসিনার সরকারি বাসভবন গণভবনে ঢুকে পড়ে দুষ্কৃতীরা তাণ্ডব চালায়। হাসিনা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেখান থেকে বের হয়ে আসেন এবং বাংলাদেশেরই একটি বায়ুযান তাঁকে দিল্লি পৌঁছে দেয়। তখন থেকেই হাসিনা ভারতে। ভারতে তিনি একজন অতিথি হিসেবেই সমাদৃত হচ্ছেন। এখান থেকে বিবৃদি দিয়ে তিনি বাংলাদেশের তদারকি সরকারের কাজকর্মের নিন্দা করছেন।
তবে কূটনৈতিক সূত্রে বলা হয়েছে এই মুহূর্তে হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর কোনও সম্ভাবনা নেই নয়াদিল্লির। এই ব্যাপারে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে যে প্রত্যার্পণ চুক্তি রয়েছে তার উল্লেখ ঢাকা করলেও কোনও লাভ হবে না। এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল ২০১৩ সালে একটি বিশেষ প্রয়োজনে। উভয় দেশের মাটিতে জঙ্গিদের ঘাঁটিগাড়া বন্ধ করতে এই চুক্তি হয়েছিল। হাসিনার ক্ষেত্রে এই চুক্তি পড়ে না। প্রত্যার্পণের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করা যায় যদি তার চরিত্র রাজনৈতিক হয়। রাজনৈতিক তালিকায় পড়ে না এমন অপরাধে তালিকা দীর্ঘ। সেই তালিকায় খুন, দাঙ্গা-হাঙ্গামায় যোগ দেওয়া বিস্ফোরণ ঘটনা, সম্পত্তি নষ্ট করা, আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা, ইত্যাদি।
প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশ হাসিনাকে ফেরত চাওয়ার পর ভারত কি পদক্ষেপ নিতে পারে? পুরোপুরি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হাসিনা ভারতের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় চাইতে পারেন। তাঁর বিরুদ্ধে এমন সব অভিযোগ আনা হয়েছে, যা রাজনৈতিক অপরাধের বাইরে। তাই ঢাকা চাইলেই কি ভারত হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে বাধ্য? একেবারেই নয়। কারণ এই চুক্তির আওতায় তিনি পড়েন না। তিনি ভারতের অতিথি হিসেবেই বাস করছেন, এবং থাকবেনও।
হাসিনা ঢাকায় ফিরে গেলে তাঁকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য কারাবাসে থাকতে হবে। বিচারের নামে প্রহসন হবে। তাঁকে হত্যাও করা হতে পরে— এমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যেমন ইসকনের প্রধান সন্ন্যাসী চিন্ময়কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে জেলে ভরা হয়েছে। তাঁর কেস যখন চট্টগ্রাম আদালতে উঠল, তখন কোনও আইনজীবীকে তাঁর হয়ে সওয়াল করতে কোর্ট কক্ষে দাঁড়াতে দেওয়া হয়নি। ফলে তাঁকে জেলে হেফাজতে পাঠানো হয় এক মাসের জন্য। তাঁর কেস আবার উঠবে ২ জানুয়ারি। তাঁর হয়ে সওয়াল করতে সুপ্রিম কোর্টে একজন বর্ষীয়ান আইনজীবী রবীন্দ্রনাথ ঘোষ উঠলেও, বিচারক, তাঁর বক্তব্য না শুনে জামিন পাওয়ার তারিখ এগিয়ে আনার দাবি খারিজ করে দেন।
এই আইনজীবী তাঁর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আদালতে তাঁর হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর জন্য তাঁকে কিল, ঘুষি সহ নানাভাবে হেনস্থা করা হয়। জীবনের ঝুঁকি আছে জেনেও এই আইনজীবী ২ জানুয়ারি তাঁর হয়ে সওয়াল করতে আবার কোর্টে দাঁড়াবেন। বাংলাদেশেরই একজন কবি তদারকি সরকারের প্রধানকে জানান তাঁর সঙ্গেচিন্ময়কৃষ্ণ দাসের কথা হয়েছে। তাঁর কথায় আমার মনে হয়নি তিনি একজন রাষ্ট্রদ্রোহী।
কুমিল্লায় একজন বর্ষীয়ান মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাইকে হেনস্থা করে তাঁর গলায় জুতোর মালা পরিয়ে দেওয়া হয়। তাঁর অপরাধ তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বীরত্বের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ‘বীর’ উপাধিতে ভূষিত করে। তাঁকে যাঁরা হেনস্থা করল তাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস জানে না। তাদের ফতোয়া তিনি যেন নিজেকে আর মুক্তিযোদ্ধা বলে নিজেকে জাহি না করেন— করলে তাঁকে হত্যা করা হবে। মুক্তিযোদ্ধা সংগঠনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে আবুল হাই একজন সাহসী যোদ্ধা।
সুতরাং বাংলাদেশের এখন একটি নৈরাজ্যের দেশ। সেখানে সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দুদের ওপর অত্যাচার থেমে নেই। থেমে নেই মন্দির ধ্বংস করা, মূর্তি ভাঙা এবং তাঁদের বাড়িঘরে আগুন জ্বেলে পুড়িয়ে দেওয়া। বাংলাদেশের বর্তমান প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’র দাবি অবিলম্বে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করতে হবে তদারকি সরকারের। কিন্তু তদারকি সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, সংস্কারের কাজ সম্পূর্ণ করেই বাংলাদেশে নির্বাচন হবে। সরকারের প্রধান ইউনূস খান বলছেন, ২০২৫ শেষে অথবা ২০২৬ শুরুতে নির্বাচন হতে পারে।
এদিকে ইউনূসের সরকার যমুনা নদীর উপর নির্মীয়মান সেতুর নাম বঙ্গবন্ধু সেতু ছেঁটে দিয়ে যমুনা রেল সেতু রাখা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নাম কেউ করলেই, তাঁকে হেনস্থা করা হচ্ছে।