মৃণাল সেন : ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের বিতর্কিত পরিচালক

রাজু পারাল

তাঁর ভাগ্যে যতটা প্রশংসা ও নিন্দা জুটেছে আজ পর্যন্ত অন্য কোনও বাঙালি তথা ভারতীয় চিত্র পরিচালকের অদৃষ্টে তা ঘটতে দেওয়া যায়নি৷ বরাবরই চিরাচরিত প্রথার বিরুদ্ধে গিয়ে প্রচলন করেছেন স্বতন্ত্র একটা স্টাইলের যা খুব সামান্য জিনিস নয়৷ সত্যজিৎ রায়ের সমকালীন পরিচালক হয়েও তিনি ছিলেন শ্রেণি-সচেতন ও প্রগতিশীল শিল্পী৷ অনেক পরিশ্রম ও উত্থানপতনের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে বিশ্বের চলচ্চিত্র মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছিলেন বিতর্কিত চিত্র পরিচালক মৃণাল সেন৷ বোধয় তিনিই প্রথম বাঙালি পরিচালক যিনি বুঝেছিলেন অন্য ভাষায় অন্য প্রদেশে গিয়ে ছবি তৈরির কথা৷ শিল্পী জীবনের সূচনাপর্ব থেকেই চলচ্চিত্রকে শুধু বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে চিহ্নিত করেননি মৃণাল সেন, বরং তিনি চেয়েছিলেন অন্য স্বাদে, অন্য মাত্রায় আমাদের চারপাশের বহুমাত্রিক বাস্তবতাকে দর্শকের দরবারে হাজির করতে৷ মধ্যবিত্ত শ্রেণির জীবনের নানা দ্বন্দ্ব, সংশয়, অনিশ্চয়তার খণ্ডচিত্র মৃণাল সেন তুলে ধরেছেন তাঁর ছবিগুলিতে৷ অনেকটা জাঁ লুক গদারের পরীক্ষিত পদ্ধতিতে৷ অবশ্য গদারের ভঙ্গী বা শৈলী কোনওটাই তিনি অন্ধের মতো অনুসরণ করেননি৷ জীবনের চারণভূমিতে মৃণাল সেন বিচরণ করেছেন একান্ত নিজস্ব ভঙ্গিতে৷ সমকালীন জীবন ও সমাজের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাতকে মূল প্লট হিসেবে চিহ্নিত করে মৃণাল সেন বর্জন করলেন চিরাচরিত কাহিনি বিন্যাসের প্রথাগত প্রকরণকে৷

বিতর্কিত পরিচালক মৃণাল সেনের জন্ম বর্তমানে বাংলাদেশের ফরিদপুরে ১৯২৩ সালের ১৪ মে৷ পিতা দীনেশচন্দ্র সেন ছিলেন পেশায় উকিল৷ আর মা সরযূবালা সেন ছিলেন গৃহবধূ৷ দেশের বিপ্লবীদের জন্য তাঁর অবদান ছিল স্মরণযোগ্য৷ জাতীয়তাবাদী নেতা বিপিনচন্দ্র পাল তাঁকে ‘মেয়ে’ বলে ডাকতেন৷ ছ’বছর বয়সে ফরিদপুরের ‘ঈশান ইনস্টিটিউশনে’ পড়াশোনার পর্ব শুরু করেন মৃণাল সেন৷ পরে কলকাতার স্কটিশচার্চ কলেজে পড়াশোনা করেন৷ এই সময়ে তিনি থাকতেন কৈলাস বোস স্ট্রিটের একটি মেসে৷ ওখানে থাকতে থাকতেই জড়িয়ে পড়েন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে৷ ১৯৪১ সালে মেস থেকে মৃণাল সেনকে গ্রেফতার করে পুলিশ, কারণ তিনি ব্রিটিশ সরকার নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টিকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করতেন৷ সে সময় সাত দিনের হাজতবাসও হয় তাঁর৷


১৯৪৫ সালে মৃণাল সেন ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরিতে (এখনকার জাতীয় গ্রন্থাগার) পড়াশোনা করতে করতে হাতে পেলেন চলচ্চিত্র সংক্রান্ত কিছু বইপত্র৷ মন দিয়ে খুঁটিয়ে পড়লেন বইগুলি৷ রালফ ফকসের ‘দ্য নভেল অ্যান্ড দ্য পিপল’-এর দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে চলচ্চিত্র নিয়ে প্রবন্ধ লিখলেন ‘দ্য ফিল্ম অ্যান্ড দ্য পিপল’৷ যা প্রকাশ পেয়েছিল ইন্দো-সোভিয়েত জার্নালে৷

১৯৫২ সালে মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভের চাকরিতে যোগ দিলেও মৃণাল সেনের মন পড়ে থাকত চলচ্চিত্রের জগতে৷ এ সময়ে কলকাতায় বসে তিনি ভারতের প্রথম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের ছবিগুলি প্রত্যক্ষ করেছিলেন৷ তখন থেকেই উৎসাহিত হয়ে পড়েন ছবি পরিচালনার কাজে৷ ১৯৫৫ সালে ‘রাতভোর’ (স্বরাজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে) ছবিটির মুক্তির মধ্যে দিয়ে মৃণাল সেনের চলচ্চিত্র জীবনের শুরু যা শেষ হয় ২০০২ সালে ‘আমার ভুবন’ ছবিটি দিয়ে৷ সুদীর্ঘ ৪৬ বছর ধরে অসংখ্য ছবি করেছেন মৃণাল সেন৷
মৃণাল সেন তাঁর ‘রাতভোর’ (১৯৫৫) ছবিটি দিয়ে চলচ্চিত্র জীবনের শুরু করলেও তা নিতান্তই ব্যর্থ হয়৷ ছবিটি সেভাবে সাড়া না ফেলায় তিনি কিছুটা আত্মবিশ্বাসও হারিয়ে ফেলেন৷ তিন বছর পরে অবশ্য তিনি নতুন উদ্যমে আর একটি ছবির কাজে হাত দেন৷ ছবির নাম ‘নীল আকাশের নীচে’ (১৯৫৯)৷ মহাদেবী ভার্মার একটি হিন্দি ছোট গল্প অবলম্বনে নির্মিত এই ছবিটিতে কলকাতা-প্রবাসী এক চিনা ফেরিওয়ালার সুখ-দুঃখের কাহিনি ধরা হয়েছে অত্যন্ত আন্তরিকতা ও মমতার সঙ্গে৷ এই ছবিটির মাধ্যমেই তিনি দেশবাসীর কাছে পরিচালক হিসেবে স্বীকৃতি পান৷ স্বনামধন্য গায়ক-সংগীত পরিচালক হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ছবিটির প্রযোজনা করেছিলেন৷ অভিনয় করেছিলেন কালী বন্দ্যোপাধ্যায়, মঞ্জু দে, স্মৃতিরেখা বিশ্বাস, বিকাশ রায়, সুরুচি সেনগুপ্ত প্রমুখ৷ তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ছবিটির যথেষ্ট প্রশংসা করেছিলেন৷

মৃণাল সেনের তৃতীয় ছবি ‘বাইশে শ্রাবণ’ (১৯৬০) অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ছবি হয়েছিল নানা কারণে৷ কানাই বসু রচিত মূল কাহিনিকে কেন্দ্র করে এই ছবিটিতে দেখা যায় সুগভীর বাস্তবতাবোধ ও নিঃস্ব ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের অন্তর্বেদনার সহানুভূতিশীল, শিল্পসম্মত প্রকাশ৷ পরিচালক এখানে গ্রামীণ পরিবেশে পুরুষশাসিত সমাজের একটি দম্পতির করুণ কাহিনি তুলে ধরেছেন৷ এই ছবিটি থেকেই মৃণাল সেন নিজের চলার পথ খুঁজে পান৷

১৯৬৯ সালে বনফুলের কাহিনি অবলম্বনে হিন্দি ছবি বানান মৃণাল সেন৷ ছবিটির ধারাভাষ্য দেন অভিনেতা অমিতাভ বচ্চন৷ ছবিটিতে দেখানো হয়েছে একটি রূপান্তরের ছবি৷ এই ছবিটির মাধ্যমেই মৃণাল সেন ভারতীয় (হিন্দি) ছবিকে নতুন পথে হাঁটতে শিখিয়েছেন৷

‘ভুবন সোম’ ছাড়াও মৃণাল সেন তঁর একাধিক ছবিকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে যান৷ যেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্যের দাবি রাখে— ‘বাইশে শ্রাবণ’ (১৯৬০), ‘পুনশ্চ’ (১৯৬১), ‘অবশেষে’ (১৯৬৩), ‘আকাশ কুসুম’ (১৯৬৫), ‘মাটির মনিষ’ (১৯৭২), ‘পদাতিক’ (১৯৭৩), ‘কোরাস’ (১৯৭৪), ‘মৃগয়া’ (১৯৭৬), ‘আকালের সন্ধানে’ (১৯৮০), ‘খারিজ’ (১৯৮২), ‘একদিন অচানক’ (১৯৮৯), ‘আমার ভুবন’ (২০০২) প্রভৃতি৷ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রকার পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন কিংবদন্তী পরিচালক মৃণাল সেন৷ পেয়েছেন ‘দাদা সাহেব ফালকে’ ‘স্বর্ণকমল’ ও ‘রজতকমল’ পুরস্কার৷ আন্তর্জাতিক উৎসবে সম্মানিত হয়েছেন ভেনিস, বার্লিন, মস্কো, শিকাগো, মন্ট্রিল, নেপলস (ইতালি), কলম্বো, দিল্লি থেকে৷ এছাড়াও অন্যান্য সম্মানে সম্মানিত হয়েছেন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র বিচারকমণ্ডলীর সদস্য, পুণে ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউটের সর্বাধ্যক্ষ৷ ন্যাশনাল ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের পরিচালকমণ্ডলীর সদস্য, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অফ ফিল্ম সোসাইটির এককালীন সভাপতি, সহ সভাপতি এফএফএসআই৷