আলোক সোম
আদালতের নির্দেশে এক দশক ধরে তালাবন্ধ হয়ে পড়ে থেকে থেকে আজ যা খণ্ডহার, কেমন ছিল এমপিএসের সেই দহিজুড়ি বহুমুখী কৃষিখামার, কীভাবে বেড়ে উঠেছিল দেশদুনিয়ার সাড়া জাগানো এই প্রকল্পটি, সিপিএমের দৈনিক মুখপত্র এবং সেই সময়ের সিপিএম সুহূদ এক দৈনিকে প্রকাশিত বিজ্ঞাপন এবং প্রতিবেদন থেকে তার একটা আন্দাজ দেওয়ার চেষ্টা করব৷ শত শত পাতার বিজ্ঞাপন আর প্রতিবেদনের নির্যাসকে একটা নিবন্ধে অাঁটানোর চেষ্টা এক সমুদ্র জলকে একটা অাঁজলায় ধরতে যাওয়ার মতো দুরূহ কাজ৷ প্রিয় পাঠক, আশা করি লেখার এই সীমাবদ্ধতার দিকটা খেয়াল রাখবেন৷
লালমাটির রুখাসুখা জমিতে গড়ে ওঠা কৃষি ও সহায়ক শিল্পের মেলবন্ধন ঘটানো যে প্রকল্পটি বাংলার আর্থিক পুনরুজ্জীবন তথা কর্মসংস্থানের এক মডেল হয়ে উঠেছিল, বামফ্রন্টের নেতা-মন্ত্রীদের, এমনকী সরকারি আমলাদের পৃষ্ঠপোষকতায় যে প্রকল্পের উৎপাদন বাংলার কোণে কোণে ছড়িয়ে পড়েছিল, সেই প্রকল্পটিকে ধ্বংস করে দেওয়া আত্মঘাতী বাঙালির আত্মহননের এক কদর্য ইতিহাস৷ প্রথমে চোখ রাখব সৃষ্টির ইতিহাসের পাতাগুলোয়, তার মধ্যে অধুনা কয়েকটি পাতায় মাত্র৷
২৬.০২.২০০৫ সিপিএম দৈনিকের প্রথম পাতায় কোয়ার্টার পেজ বিজ্ঞাপন৷ শিরোনাম ‘পশ্চিম মেদিনীপুরের লালমাটির অঙ্গনে মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে স্বাগতম৷’ ‘আদিবাসী জনজাতি সম্প্রদায়ের উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগ সফল করার স্বার্থে এমপিএস গ্রুপ নিরলস প্রয়াসে ব্রতী৷’
‘পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে জৈব সার উৎপাদন এবং প্রয়োগের মাধ্যমে এমপিএস গ্রিনারি ডেভেলপার্স লিমিটেড ঝাড়গ্রামের রুক্ষ অনুর্বর পতিত জমিতে এনেছে সবুজের স্পন্দন৷’
‘পশ্চিম মেদিনীপুরে গড়ে উঠেছে রাজ্যের বৃহত্তম লাইভস্টক ব্রিডিং অ্যান্ড অ্যানিম্যাল হাজব্যান্ড্রি ফার্ম৷’
‘দেশের সীমানা অতিক্রম করে চিন, জাপান ও মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি দিচ্ছে প্রক্রিয়াজাত কৃষিভিত্তিক শিল্পসম্ভার৷’
‘খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের অগ্রদূত এমপিএস ফুড প্রোডাক্টস লি. এনেছে নতুন প্রভাত৷’
‘মিশ্র মৎস্যচাষ, পশুখাদ্য ও বায়োগ্যাস উৎপাদনের বহুমুখী প্রকল্প গড়ে তুলেছে এমপিএস অ্যাকোয়া মেরিন প্রোডাক্টস লি.৷’
‘গ্রামীণ পর্যটনে শাল পিয়াল মহুয়ার আবেশ জড়ানো পরিবেশে আসুন এমপিএস রিসর্টস অ্যান্ড হোটেলের বিলাসবহুল কটেজে৷’
‘এই সবেরই সমাহার এমপিএস গ্রুপ অফ কোম্পানিজ৷’
১৮.০৫.২০০৫ তারিখের কোয়ার্টার পেজ বিজ্ঞাপনের শিরোনাম ‘দশম বর্ষ পুর্তি উপলক্ষ্যে সবাইকে জানাই শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন৷’
নীচে দশ বছরের কর্মকাণ্ড এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা৷
০৫.০৭.২০০৫ তারিখের বিজ্ঞাপনের শিরোনাম, ‘মাননীয় শ্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মুখ্যমন্ত্রীত্বের ৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে এমপিএস গ্রুপ অফ কোম্পানিজ-এর সাদর অভিনন্দন৷’
নীচে আরও নানা সাফল্যের মাঝে ঘোষণা ‘এমপিএস ফুড প্রোডাক্টস প্রা. লি. প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে পেল সর্বভারতীয় সম্মান— জাতীয় আম মহোৎসব ২০০৫-এ সর্বশ্রেষ্ঠ শিরোপা৷’ সঙ্গে একটি ট্রফির ছবি৷
২১.০৬.২০০৬ তারিখের মুখপত্রের সংবাদ শিরোনাম ‘শ্রমজীবীদের অনুকূল বিকল্প খোঁজাই লক্ষ্য’— সঙ্গে মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সচিত্র সাক্ষাৎকার৷ পাশে ‘বামফ্রন্ট সরকার আজ পা দিচ্ছে তিরিশে’— ঘোষণা৷
নীচে কোয়ার্টার পেজ বিজ্ঞাপনের শিরোনাম, ‘১৯৭৭ থেকে ২০০৬— ৩০ বছরে পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়নের সফল কাণ্ডারী বামফ্রন্ট সরকারকে অভিনন্দন৷’
‘১৯৯৪ থেকে ২০০৬— বারো বছরে গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নের ইতিহাস সৃষ্টি করেছে এমপিএস গ্রুপ অফ কোম্পানিজ৷’
‘এমপিএস গ্রুপ অফ কোম্পানিজ গ্রামীণ কৃষিভিত্তিক শিল্প, পশুপালন, গ্রামীণ পর্যটন ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে এনেছে নতুন দিগন্ত এবং প্রস্ত্তত করেছে আন্তর্জাতিক মানের মূল্যযুক্ত জৈব ও ভেষজ গুণসমৃদ্ধ খাদ্য সম্ভার৷’
‘কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ— এই প্রত্যয়কে সফল করতে পশ্চিম মেদিনীপুরের রুক্ষ অনুর্বর জমিতে বিকল্প কৃষিকাজে অনন্য নজির সৃষ্টি করেছে এমপিএস গ্রিনারি ডেভেলপার্স লি.’৷
‘গ্রামীণ কর্মসংস্থান ও আদিবাসী জনজাতির কর্মনিযুক্তিতে এমপিএস গ্রুপ অফ কোম্পানিজ নিরন্তর কাজ করে চলেছে৷’
ওই একই দিনে বাম-সুহূদ দৈনিকটি ‘প্রত্যয়ী ৩০’ শিরোনামে একটি ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছিল৷ সেই ক্রোড়পত্রের সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞাপন ক্রোড়পত্রের একটি পাতা বরাদ্দ ছিল এমপিএসের জন্য৷ সেই পাতার ওপরে ‘কে বলে রাজ্য সরকারের কাজে গতি নেই?’ শিরোনামে প্রমথনাথ মান্নার একটি সাক্ষাৎকার৷ তার এক পাশে মান্নার ছবি, অন্য পাশে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ছবি৷
সচিত্র সাক্ষাৎকারের নীচে ‘এমপিএস ওঁদের প্রশংসাধন্য’ শিরোনামে বামফ্রন্ট সরকারের চার মন্ত্রীর ছবি, সঙ্গে তাঁদের সার্টিফিকেট৷
প্রমথনাথ মান্না কী করেছিলেন, কী করতে চেয়েছিলেন এবং তাঁর স্বপ্ন সফল করতে বামফ্রন্ট সরকার কতখানি সচেষ্ট ছিল, এই সাক্ষাৎকার তার এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ৷ তাই সেটি হুবহু তুলে ধরা হল— ‘‘হর্টিকালচার ও ফুড প্রসেসিং দফতরের প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারি এস এস আহুজা সেদিন গিয়েছিলেন ঝাড়গ্রামে আমাদের এমপিএস গোষ্ঠীর কাজ দেখতে৷ প্রকল্প পরিদর্শন করার পর উনি সেখান থেকেই ফোন করে বললেন, মান্না সাহেব, আমাদের আরও আগে আসা উচিত ছিল৷ দারুণ কাজ হয়েছে৷ সরকার এটাকে যাতে তুলে ধরে সে চেষ্টা করব আমরা৷ পরে একদিন অফিসে ডেকেছিলেন৷ অনেক আলোচনা হল, উনি বললেন, এমপিএস শুধু রাজ্যের গর্ব নয়, ভারতের গর্ব৷ কর্মসংস্থানও হচ্ছে৷ ওঁর সঙ্গে আরও লোকজন গিয়েছিলেন৷ উনি ফিরে এসে সকলকে, এমনকী মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীরাও বলেছেন৷ পশ্চিমবঙ্গের পতিত জমিতে প্রথম আঙুর চাষ হচ্ছে৷ ভালো জাতের আম ফলিয়েছি আমরা৷ যেমন আলফানসো, চৌসা, নীলম…৷ এসব ভাল জাতের আম অনেকদিন থাকে৷ উনি সব ঘুরে দেখেছেন৷ শুধু তাই নয়, আরও অনেকেই গেছেন ওখানে৷ কৃষি দফতরের সচিব ডক্টর কোনার গিয়েছিলেন৷ বললেন, যে কোনও প্রয়োজনে আপনি আমাদের সাহায্য চাইবেন৷ সরকার বিকল্প চাষের ওপর জোর দিচ্ছে এখন৷ আলু, পাট, ধান, গম— এসব প্রচলিত চাষ থেকে উপার্জন কম৷ উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে কিন্ত্ত কৃষিকাজ কমছে৷ ওদিকে রয়ে গেছে বিপুল পতিত জমি৷ এইসব জমিতে বিকল্প চাষ করতে হবে৷ আমাদের গোটা প্রকল্পই বিকল্প জমিতে বিকল্প চাষের৷ পশুপালন, মৎস্যচাষ, ফুল-ফল-সবজির চাষ৷ ড. কোনার আমাদের জৈব ভেষজ খাদ্য নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন৷ আমরা বললাম, আমাদের জমির টাটকা ফলের সঙ্গে ভেষজ উপাদান মিশিয়ে অভিনব খাবার তৈরি করেছি৷
অত্যাধুনিক কারখানায় প্রক্রিয়াকরণের পর বাজারে ছেড়েছি৷ প্রচুর অর্ডার পেয়েছি৷ এসব এলাকায় যে সব সবজি বা ফল হয় তাতে রাসায়নিক সার প্রয়োগ হয় না৷ আমরা পতিত জমির উন্নয়ন করেই কাজ করে যাব৷ পশ্চিমবঙ্গে কিছুই হয় না, এই ধারণা বদলে দিতে হবে৷ অনেকের সঙ্গেই আলোচনা হল৷ পশ্চিমবঙ্গে শিল্পপতিরা বিনিয়োগ করবেন তাঁদের নিজেদের স্বার্থে৷ পশ্চিমবঙ্গের বাজার, পূর্বাঞ্চলের বাজার যাচাই করে৷ আমরা গবেষণা চালাচ্ছি৷ পশ্চিমবঙ্গে কীভাবে ভালো জাতের আম উৎপাদন করা যায় তার চেষ্টা হচ্ছে৷ কারণ আমাদের রাজ্যে মালদায় যে আম হয় তার স্থায়িত্ব পনেরো দিনের৷ বড়জোর একমাস৷ এমন একটা সময় বাজারে ওঠে যাতে পচে যায় অনেকটা৷ আমাদের এখানে আম হচ্ছে ৫৫ প্রজাতির৷ আমের ভালো চারা ব্যবহার করি আমরা৷ আমি ড. কোনারকে বললাম, আমাদের রাজ্য ফল-ফুলে ভরে যাবে ভালো চারা ব্যবহার করলে৷ উদ্যান বিশেষজ্ঞদের দিয়ে চারা তৈরি করাতে হবে৷ আমি প্রস্তাব দিয়েছি সম্পূর্ণ পরিকাঠামো আছে এমন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সরকার যদি চারা নিয়ে চাষিদের বিলি করে তাহলেই এটা সম্ভব৷ আমার মনে হয় এ ব্যাপারে উনি একটা উদ্যোগ নেবেন৷ নিয়েওছেন৷ কারা যেন বলে পশ্চিমবঙ্গে কোনও কাজ হয় না৷ আমলারা কাজ করেন না৷ উনি সঙ্গে সঙ্গে অফিসার পাঠিয়েছেন৷
আমার প্রস্তাবটা ছিল হর্টিকালচার নার্সারি রেজিস্টার থাকা উচিত৷ যে কেউ হলে হবে না, যাঁদের সঠিক চারা তৈরির পরিকাঠামো এবং সঠিক মানের মাদার প্ল্যান্ট রয়েছে, সরকার সেই সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে নির্ধারিত চারা সরবরাহ করার স্কিম দেবে৷ প্রগতিশীল চাষিরা সেই নির্দিষ্ট ফার্ম থেকে চারা গাছ সংগ্রহ করে চাষ করবে৷ তাহলে উন্নতি সম্ভব৷ ১৩ জুন বিজ্ঞানীরা আমার প্রোজেক্ট পরিদর্শনে গিয়েছিলেন৷ এবং পরিদর্শন করার পর মেদিনীপুরের হর্টিকালচার অফিসে কাগজপত্র জমা দিতে বললেন৷ রেজিস্টার তৈরির ব্যাপারে যথাসাধ্য চেষ্টা করার আশ্বাসও দিলেন৷
পশ্চিমবঙ্গে সবচেয়ে বেশি হয় ফজলি আম, সবচেয়ে বেশি রফতানি হয় বাংলাদেশে৷ গরিব দেশ৷ সেখানে উৎপাদন খরচের থেকেও কম দামে বিক্রি হচ্ছে৷ এভাবে পশ্চিমবঙ্গের উন্নতি হবে না৷ আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত ইউরোপ, শিল্পোন্নত দেশ৷ কী করতে হবে? চাই ভালো জাতের আম৷ তাই আমরা ৫৫ প্রজাতির আম উৎপাদন করছি৷ পশ্চিমবঙ্গে এখন আলফানসো হয়, নীলম হয়৷ দেখুন বিদেশের বাজারের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ দেশের বাজার৷ আজ পশ্চিমবঙ্গের বাজারে নিজস্ব আম পাওয়া যায় এক মাস৷ এপ্রিল-মে মাসে যে আমটা পাওয়া সেটা কিন্ত্ত অন্য রাজ্যের৷ ব্যবসাটা অন্য রাজ্য করে বেরিয়ে যাচ্ছে৷ আমরা যদি শুধু প্রজাতি বদলে দিই তাহলে এপ্রিল মাসেই আম থাকবে৷ রাজ্যের বাজারটা দখল করতে পারলেই তো বিরাট লাভ৷ এপ্রিল, মে, জুন, জুলাই— আমরা ব্যবসা করতে পারব৷ কোনার সাহেবের সঙ্গে আঙুর চাষ নিয়েও কথা হল৷ আঙুল পশ্চিমবঙ্গে হবে না কেন? তার পরিকাঠামো গড়তে হবে৷ ১২ জুন বিদেশি প্রতিনিধিরা আমাদের আঙুর চাষ দেখে গেলেন৷ আমরা কিন্ত্ত পারি পশ্চিমবঙ্গে মাছ আমদানি বন্ধ করতে৷ এমপিএস তার একটা উদাহরণ৷ আমরা ওখানকার জলবায়ুতে, অল্প জলে মাছ উৎপাদন করছি৷ প্রজনন হচ্ছে, মাছের খাদ্যের অভাব যাতে না হয় দেখা হচ্ছে৷ (এমপিএস গোষ্ঠীর কর্ণধারের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখন : শহজি সরকার)৷’’
এই সাক্ষাৎকারের নীচে ‘এমপিএস ওঁদের প্রশংসাধন্য’ শিরোনামে চার মন্ত্রীর ছবি৷ ছবির নীচে তাঁদের দেওয়া সার্টিফিকেট৷ প্রথম ছবি ভূমি ও ভূমি সংস্কার মন্ত্রী আবদুর রেজ্জাক মোল্লার৷ নীচে তাঁর সার্টিফিকেট, ‘এমপিএস মানে মাল্টিপারপাস স্কিম৷ ওদের কর্ণধার প্রমথনাথ মান্না আমার কাছে এসেছিলেন৷ ওঁরা লালমাটির দেশ ঝাড়গ্রামে, যেখানে কিছুই হত না, সেখানেই কাজ শুরু করে কৃষি, ফুল ও ফলের চাষ শুরু করে পশুপালন, দোহ উন্নয়ন— সবই ওঁরা করছেন৷ মৎস্য চাষও আছে৷ লালমাটির বুকে বন্ধ্যা জমিকে উন্নত করে যে কাজটা হচ্ছে, সেটা দেখার মতো৷ সবুজে সবুজ করেছেন৷ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অনেক কর্মসংস্থানও হয়েছে৷ সুসংহত বহুমুখী খামারের একটা ভাল দৃষ্টান্ত প্রমথনাথ মান্নার এমপিএস গ্রুপ৷’
দ্বিতীয় ছবি অগ্নিনির্বাপন ও জরুরি বিষয় দফতরের মন্ত্রী প্রীতম চ্যাটার্জির৷ ছবির নীচে তাঁর সার্টিফিকেট—‘এমপিএস গ্রুপ অফ কোম্পানিজ-এর ঝাড়গ্রামের সেই প্রোজেক্টে আমার যাওয়া হয়ে ওঠেনি৷ তবে যেটা জানতে পেরেছি সেটা হল, প্রমথনাথ মান্না (বাবু) সারা পশ্চিমবঙ্গে একটা দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন৷ প্রমথবাবু তাঁর ছোট ছোট পা দিয়ে কী করে এরকম এগিয়ে চলেছেন সেটা সত্যিই আশ্চর্যের বিষয়৷ প্রমথবাবুর এই উল্লেখযোগ্য ভূমিকার প্রশংসা না করে পারছি না৷ আমি চাই, তিনি এই ছোট ছোট পা নিয়ে আরও জোরে দৌড়ন৷ আমরা সবরকম সাহায্য করার জন্য তৈরি৷’
পাশের ছবি পরিবেশ, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ এবং উদ্যানপালন দফতরের মন্ত্রী মোহন্ত চ্যাটার্জির৷ তাঁর সার্টিফিকেট— ‘ঝাড়গ্রামের মতো প্রত্যন্ত এলাকায় এমপিএস গ্রুপ যে বহুমুখী খামার গড়ে তুলেছে, তেমনই ভারত সরকারও কৃষিভিত্তিক শিল্পকে গুরুত্ব দিচ্ছে, নানারকম ভর্তুকি দেওয়ার ব্যবস্থা আছে৷ আমরা তাদের এমপিএস-এর দৃষ্টান্তের কথা বলব৷ সম্ভাবনা আছে, সুযোগও আছে৷’
এর পাশের তথা শেষ ছবিটি প্রাণীসম্পদ বিকাশ দফতরের মন্ত্রী আনিসুর রহমানের৷ নীচে তাঁর সার্টিফিকেট— ‘এমপিএস গ্রুপ সম্পর্কে আমার ভালো ধারণা আছে৷ কোম্পানির কর্ণধার প্রমথনাথ মান্না আমার কাছেও এসেছিলেন৷ যেখানে কিছুই হত না, সেই লালমাটির দেশ ঝাড়গ্রামেই ওঁরা কাজ শুরু করেন৷ সব রকমের কাজ করেন৷ এককথায় বহুমুখী কাজ৷ ফল, ফুল থেকে আমার দফতরের সব কাজ ওঁরা করেন৷ অসাধারণ কাজ৷ আমি ঝাড়গ্রামে মান্নাবাবুর প্রোজেক্টে গিয়েছিলাম৷ দেখে অভিভূত হয়েছি৷ ভীষণ ভালো লেগেছে আমার৷ সবাই অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন ওই লালমাটির দেশে সবুজে সবুজ দেখে৷ এমপিএস গ্রুপ হচ্ছে সারা রাজ্যে একটা উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত৷’
২৬.০৫.২০০৬ সিপিএম সহযোগী দৈনিকে আবদুর রেজ্জাক মোল্লার পাতাজোড়া সাক্ষাৎকার৷ শিরোনাম ‘কৃষির ভিত দৃঢ় হবে কৃষিভিত্তিক শিল্পেই’৷
পাতার একপাশে আবদুর রেজ্জাক মোল্লার ছবি৷ অন্য পাশে তাঁর সঙ্গে বিমান বসুর ছবি৷ বসুর চোখ তাঁর হাতে ধরা সম্ভবত এমপিএসের একটি ব্রোশিয়ারে৷
ওই সাক্ষাৎকারে মোল্লা এমপিএসকে আগে যে সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন সেটারই পুনরুক্তি করেছেন৷ তার সঙ্গে সংযোজিত অংশটি— ‘‘…তবে শুধুমাত্র নিজেদের খামার নয়, স্থানীয় চাষিদের সঙ্গে সংহতি গড়ে তুলতে হবে৷ এখান থেকে যেসব ভালো ভালো কাজ হবে, তার সুফল স্থানীয় মানুষের কাছে পেঁৗছে দিতে হবে৷ আর স্থানীয়রা যা উৎপাদন করছেন, তা বিপণনের ব্যবস্থা করতে হবে ওঁদের৷ ওঁরা তো ফলের রস, পানীয় তৈরি করছেন৷ সব নিজেরা করতে পারেন না, কিছুটা কাজ স্থানীয়দের দিয়ে করানো যেতেই পারে৷ সুসংহত খামার একটা নতুন ভাবনা, সুসংহত বহুমুখী খামারের একটা ভালো দৃষ্টান্ত হল এমপিএস, আরও কাজ চলছে৷ মেদিনীপুরের শালবনিতে ৫০ একর জমিতে একটা বড় প্রকল্প গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই৷ সেখানে ডেয়ারি হবে৷ তারা চাষিদের সঙ্গে সমন্বয় রেখে এগোবে৷ স্থানীয় মানুষের উৎপাদন কিনে নেবে৷ অর্থাৎ চুক্তির মাধ্যমে চাষ হবে৷ এখানে উৎপাদিত পণ্য বিদেশে রফতানি হবে৷ স্থানীয় বাজারও দখল করবে৷ আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক সমুন্নতি যে ঘটছে এবং আগামী দিনে আরও ঘটবে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই৷’
ওই সাক্ষাৎকারেই রেজ্জাক মোল্লা জমি অধিগ্রহণ নিয়ে তাঁর অনেক ভাবনার কথা বলেছেন৷ তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, ‘জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে বর্গাদার আইনের কি কোনও পরিবর্তন বা সংশোধন হবে? হলে কীরকম?’
মোল্লার জবাব, ‘হঁ্যা, এই আইনের অবশ্যই সংশোধন করতে চাই৷ বর্গাদারদের ক্ষেত্রে জমি নেওয়া হলে তাঁরা এখন সারা বছর যে ফসল ফলাতেন, তার আর্থিক মূল্যের ছয়গুণ ক্ষতিপূরণ বাবদ পেতেন৷ এবার তাঁরা জমির মূল্যের অর্ধেক ক্ষতিপূরণ হিসেবে পাবেন৷ এর জন্য বিধানসভা অধিবেশনে আইন সংশোধন করা হবে৷’
প্রশ্ন : ‘আগে বলেছিলেন কৃষিকে সংহত করে শিল্পায়নের কথা৷ কিন্ত্ত জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে কৃষির কাজ কি ব্যাহত হবে না?’
মোল্লার উত্তর, ‘ব্যাহত খানিকটা হবে৷ তবে উৎপাদন বৃদ্ধি করে আরও বেশি অর্থ সংস্থানের ব্যবস্থা হলে, অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রি, অ্যাগ্রো বিজনেসের পরিকল্পনাকে সম্পূর্ণ করতে পারলে, ব্যাহত হওয়ার কোনও প্রশ্নই থাকবে না৷ বিভিন্ন জায়গার মাটির দিকে লক্ষ্য রেখে নতুন কিছু করার ভাবনা তো অবশ্যই রয়েছে৷ কোথাও হর্টিকালচার, কোথাও মেডিসিনাল প্ল্যান্ট ইত্যাদি৷ এছাড়াও বিনিয়োগকারী শিল্পসংস্থাগুলি কোথায় শিল্প গড়বে, কোথায় গড়লে বেশি কার্যকরী হবে, তাও পরিকল্পনা অনুসারেই নির্ধর্ারিত হবে৷’
প্রশ্ন : ‘কৃষি ও অকৃষি জমির ক্ষেত্রে কি একইরকম পুনর্বাসন প্যাকেজ চালু হচ্ছে?’
মোল্লার জবাব, ‘এক্ষেত্রে কতকগুলি বিষয়ের ওপর নজর দেওয়া হয়েছে৷ প্রান্তিক কৃষকদের একমাত্র আয়ের উৎস যদি শুধুমাত্র চাষই হয়, সেক্ষেত্রে তাঁর জমি নেওয়া হলে জমির দাম দেওয়ার সঙ্গে ওই কৃষক বা তাঁর পরিবারের একজনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে৷ যারা সেই জমি নিচ্ছে, তাদেরকেই এই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে৷ দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাসকারী কৃষকের জমি নেওয়া হলে তিনি জমির দাম তো পাবেনই, উপরন্ত্ত বাস্ত্তচু্যত হওয়ার জন্য তাঁকে ঘর তৈরি করে দেওয়া হবে৷ যিনি জমি নিচ্ছেন, তাঁকেই বাসস্থান তৈরি করে দিতে হবে৷’
প্রশ্ন : ‘যাদের নিজস্ব জমি নয় অথচ দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছে, তাদের ক্ষেত্রে কী ভাবনাচিন্তা রয়েছে?’
মোল্লার উত্তর, ‘যাদের নিজস্ব জমি নয় অথচ দীর্ঘদিন ওই জায়গায় বাস করছে, এমন এলাকার জমি নেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে৷ উন্নয়নমূলক কাজের জন্য ওই জমি থেকে তাদের উচ্ছেদ করতে হলে এককালীন ১০ হাজার টাকা দেওয়া হবে৷’
প্রশ্ন হচ্ছে, জমি অধিগ্রহণ নিয়ে সরকারের পরিকল্পনার কথা জানতে এমপিএস প্রতিনিধির এত ঔৎসুক্য কেন, তাঁর ঔৎসুক্য নিরসনে মোল্লারই বা এমন সাতকাহন কেন? এমপিএসের বিজ্ঞাপনে সরকারি পরিকল্পনার সেই সাতকাহন এত গুরুত্ব দিয়ে ছাপাই বা হল কেন? এইসব প্রশ্নের জবাব আছে স্বয়ং প্রমথনাথ মান্নার উক্তিতে৷ তবে সে কথা আগামীতে৷