মোদির ‘হেয়ার কাট’

আপনি-আমি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে ১০০ টাকা ঋণ নিলে তা সময়মতো সুদসহ ফেরত দিতে হবে। সময় পেরিয়ে গেলে সঙ্গে যোগ হবে জরিমানাও। কিন্তু মোদি-ঘনিষ্ঠ আদানির ক্ষেত্রে এই নিয়ম খাটবে না। মোদি-ঘনিষ্ঠ আদানি গোষ্ঠীর নতুন কেনা দশ সংস্থার অনাদায়ী ঋণের ৭৫ শতাংশ মকুব করে দিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক। অল ইন্ডিয়া ব্যাঙ্ক এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়েশন (এআইবিইএ) প্রকাশিত তালিকায় এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। মোদি ঘনিষ্ঠ হওয়ায় মোট ১০টি বেসরকারি সংস্থার ৬২ হাজার কোটি টাকার অনাদায়ী ঋণের মাত্র ১৬ হাজার কোটি টাকা দিয়ে রফা করে নিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক। এভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে সাধারণ মানুষের সঞ্চয়ের অর্থ মোদির ঘনিষ্ঠ আদানির ঋণ মেটাতে তোফা হিসেবে ব্যয় হচ্ছে। এই আদানির দেদার ঋণ মকুবকে আবার একটি বর্ণময় শব্দবন্ধ দিয়ে বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রক আদানির ১০টি সংস্থার বকেয়া ঋণের ৭৫ শতাংশ ছাড়কে বলছে ‘হেয়ার কাট’। হেয়ার কাটের নামে এখন দেদার মকুব হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কর্পোরেট ঋণ।

এআইবিইএ প্রকাশিত তালিকায় আদানির ১০টি সংস্থার নাম ও ঋণ মকুবের পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে। আদানির নতুন কেনা সংস্থাগুলি হল্: ১) এইচডিআইএল (প্রোজেক্ট বিকেসি), বকেয়া ঋণ ৭ হাজার ৭৯৫ কোটি টাকা, মকুব হয়েছে ৯৬ শতাংশ, ২) রেডিয়াস স্টেট ডেভলপমেন্ট, বকেয়া ঋণ ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা, মকুব হয়েছে ৯৬ শতাংশ অর্থ, ৩) ন্যাশনাল রেয়ন কর্পোরেশন, বকেয়া ঋণ ১ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা, মকুব হয়েছে ৮৬ শতাংশ অর্থ, ৪) এসার পাওয়ার এমপি লিমিটেড, বকেয়া ঋণ ১২ হাজার ১৩ কোটি টাকা, মজুব ৭৯ শতাংশ, ৫) ডিঘি পোর্ট, বকেয়া ঋণ ৩ হাজার ৭৫ কোটি টাকা, মকুব হয়েছে ৭৭ শতাংশ অর্থ, ৬) ল্যানকো অমরকণ্টক পাওয়ার, বকেয়া ঋণ ১৫ হাজার ১৯০ কোটি টাকা, মকুব হয়েছে ৭৩ শতাংশ অর্থ, ৭) কোস্টাল ইঞ্জিন লিমিটেড, বকেয়া ঋণ ১২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা, মকুব হয়েছে ৭২ শতাংশ অর্থ, ৮) আদিত্য স্টেটস, বকেয়া ঋণ ৫৯৩ কোটি টাকা, মকুব হয়েছে ৫৫ শতাংশ অর্থ, ৯) করাইকল পোর্ট, বকেয়া ঋণ ২ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকা, মকুব ৪৩ শতাংশ অর্থ, ১০) কোরবা ওয়েস্ট পাওয়ার লিমিটেড, বকেয়া ঋণ ৫ হাজার ৩২ কোটি টাকা, মকুব ৪২ শতাংশ অর্থ।

মোদি সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাঁর ঘনিষ্ঠ আদানিদের দেদার মুনাফার সুযোগ করে দিচ্ছেন। আদানির নতুন ১০ সংস্থার দেদার ঋণ মকুব মুনাফা বাড়ানোর অন্যতম কৌশল। ছোট শিল্পের ঋণ মকুবের সুযোগ না মিললেও আদানির মতো বড় শিল্পে দেদার কর মকুবের সুযোগ মিলছে।


গত পাঁচ বছরে ১০.৫ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ মকুব করা হয়েছে। শুধু গত বছরেই ১.৭৫ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ মকুব হয়েছে। এর মধ্যে ৩৯.৮ শতাংশ হলো বড় কর্পোরেট সংস্থার ঋণ। সবচেয়ে বেশি ঋণ মকুবের সুযোগ মিলেছে আদানির শিল্প সংস্থাগুলির।

উল্লেখ্য, ২০২১ সাল থেকে মোট ২.০৩ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ মকুব হয়েছে। তার মধ্যে ৬২.৩ শতাংশ হলো বড় কর্পোরেট সংস্থার ঋণ।

ঋণের টাকা না দিতে পারায় দেউলিয়া আদালতে থাকা ১০টি সংস্থার ৬১,৮৩২ কোটি টাকার বকেয়া ঋণ মাত্র ১৫,৯৭৭ কোটিতে রফা করেছে ঋণদাতা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি। অর্থাৎ মকুব করেছে বেশির ভাগ বকেয়া। জানা গেছে, এই ১০টি সংস্থাকেই কিনেছিল গৌতম আদানির গোষ্ঠী। বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রকে বিঁধেছে বিরোধী শিবিরও। প্রতিবাদে সরব হয়েছে ব্যাঙ্কের কর্মী ইউনিয়নগুলিও। কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক জয়রাম রমেশ বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী মোদির প্রিয়পাত্র আদানি ঋণগ্রস্ত ১০টি সংস্থাকে হাতে নেওয়ার পরই ব্যাঙ্কগুলি বহুলাংশে ঋণ মকুবের সিদ্ধান্ত নেয়।

অন্যদিকে ধারাভি পুনর্গঠন প্রকল্পের নামে বৃহন্মুইয়ের ১৫০০ একর লবণাক্ত জমি মহারাষ্ট্র সরকার আদানি গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়ার চক্রান্ত করছে বলে অভিযোগ এনেছেন কংগ্রেস সাংসদ বর্ষা গায়কোয়াড়। তাঁর দাবি, মুম্বইয়ের সাধারণ মানুষের ওই জমি পরিবেশের স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ। সেই জমি দখল করতে চাইছে আদানি গোষ্ঠী। দুর্নীতিগ্রস্ত এনডিএ পরিচালিত রাজ্য সরকার আদানিদের সুবিধা পাইয়ে দিতে সব কিছু করতে পারে।

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কর্মী ইউনিয়ন এআইবিইএ বিভিন্ন সূত্রের তথ্যের ভিত্তিতে ১০টি সংস্থার ঋণ মকুবের কথা প্রকাশ্যে এনে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। তাদের অভিযোগ, আদানিদের প্রতি উদার হয়ে বকেয়া ঋণের ৭৪ শতাংশ টাকা ছাড়লেও ব্যাঙ্কগুলি সাধারণ গ্রাহকদের প্রতি সদয় নয়। সেভিংস অ্যাকাউন্টে ন্যূনতম টাকা না থাকলে মানুষকে জরিমানা করে ব্যাঙ্কগুলি। গত পাঁচ বছরে ব্যাঙ্কগুলি ‘মিনিমাম ব্যালেন্স’ না থাকার কারণে ৮৫০০ কোটি করে ধনীদের বিলিয়ে দেওয়ার নীতিই অবলম্বন করেছে মোদি সরকার। তাই বিপুল পরিমাণ ঋণ মকুবকে ‘হেয়ার কাট’ বলে উল্লেখ করতে পারে কেন্দ্রর অর্থ মন্ত্রক।