ক্ষমা চাইতে হবে মোদীকে

মণিপুরে সংঘর্ষ রোধে কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়ছে কেন্দ্রীয় বাহিনী। ফাইল চিত্র

মণিপুরে জাতিদাঙ্গা চলছে প্রায় ২০ মাস ধরে। তা নিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মাত্র একদিন মুখ খুলেছিলেন লোকসভায়। ২০২৪-এর ৩ জুলাই রাজ্যসভায় বলেছিলেন, ‘রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে শান্তি ফিরিয়ে আনতে হবে।’ এর পর আর কিছুই শোনা যায়নি তাঁর মুখে। বিরোধীরা বারবার একই প্রশ্ন তুলেছেন। উত্তর-পূর্বের ওই রাজ্যে যেতে মোদীর এত আপত্তি কেন? মোদী কি মণিপুরকে দেশের অংশ বলে মনে করেন না? উনি কোনও উত্তর দেননি। মোদীর এই দীর্ঘ নীরবতার পরেই আচমকা মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং রাজ্যের মানুষের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চান। অতীত ভুলে সকলকে শান্তি স্থাপনের জন্য এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। সেদিনই কংগ্রেস প্রশ্ন তোলে, মোদী কেন মণিপুরে গিয়ে একথা বলতে পারলেন না।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর প্রিয়পাত্র মণিপুরের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং বছরের শেষ দিনে সরাসরি রাজ্যবাসীর কাছে রাজ্যেরও রাজ্যবাসীর দুঃসহ পরিস্থিতির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। আর এই ক্ষমা চাওয়ার মধ্য দিয়ে তিনি নিজেই কার্যত স্বীকার করে নিলেন রাজ্য সরকার পরিচালনায় তিনি নিতান্তই অযোগ্য ও অপদার্থ। আর সে কারণেই নিজের যোগ্যতা সম্পর্কে আত্মোপলব্ধি হতে ১৯ মাস সময় কেটে গেছে। এই ১৯ মাসে গোটা মণিপুর তছনছ হয়ে গেছে। জাতি দাঙ্গার আগুনে ঝলসে মণিপুর আড়াআড়িভাবে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেছে। একদিকে ইম্ফল উপত্যকার সমতলে মেইতেই, অন্যদিকে পাহাড়ি অঞ্চলে কুকি জনজাতিরা। এতকাল উভয় গোষ্ঠীর মানুষই সমতল ও পাহাড়ে বিশেষ করে পাহাড়-সমতলের সংলগ্ন এলাকায় বসবাস করলেও বীরেন সিংয়ের নেতৃত্বে বিজেপি সরকার তাদের ভাগ করে আলাদা করে দিয়েছে। উভয় গোষ্ঠীকে পরস্পরের শত্রু বানিয়ে দিয়েছে।

আরএসএস-বিজেপির বিভাজনের রাজনীতির পথ ধরে সংখ্যাগুরু মেইতেইদের কুকিদের বিরুদ্ধে মেরুকরণ করে ভোটে জেতার জমি উর্বর করেছে বীরেন সিংয়ের সরকার। সেই জন্য হিংসাদীর্ণ রাজ্যে খুন-সন্ত্রাসের অবাধ রাজত্ব প্রতিষ্ঠা হলেও শত শত মানুষের জীবনহানি হলেও, হাজার হাজার মানুষ ভিটেমাটি ছাড়া হলেও মোদী-শাহর কাছে বীরেনের নম্বর কমেনি। সমস্ত বিরোধী, রাজ্যের মানুষ, এমনকি বিজেপির ভেতর থেকেই বীরেনের অপসারণের জোরালো দাবি উঠলেও তিনি মুখ্যমন্ত্রী পদে বহাল রয়ে গিয়েছেন শুধুমাত্র মোদী-শাহর সৌজন্যে। আসলে বীরেন সিং রাজ্য সরকার চালানোর ক্ষেত্রে যতটা উপযুক্ত তার থেকে অনেক বেশি যোগ্য কাঠের পুতুল হয়ে মোদী-শাহর সুতোর টানে নাচতে। বীরেন সিং ছালা আর কেউ নেই যার উপর মোদী-শাহরা ভরসা করতে পারেন। তাই রাজ্য রসাতলে গেলেও বীরেন সিং বহাল তবিয়েতে থেকে গেছেন মুখ্যমন্ত্রী পদে। বীরেনের আযোগ্যতা ও অপদার্থতার দায় তাই মোদী-শাহর উপরই বর্তায়। বীরেন সিংয়ের ক্ষমা চাওয়া প্রকারান্তরে মোদী-শাহদের ক্ষমা চাওয়ারই শামিল। মোদী-শাহরা বীরেন সিংকে দিয়েই নিজেদের দায় ঝেড়ে ফেলার ব্যবস্থা করলেন।


প্রকৃতপক্ষে মণিপুরে গত ২০ মাস ধরে যা চলছে তাতে সেখানে কোনও সরকার বা প্রশাসনের অস্তিত্ব আছে বলেই মনে হয় না। সমস্ত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান অকেজো হয়ে গিয়েছে। এক বছরে বিধানসভার অধিবেশন বসেছে মাত্র একবার, তাও মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য। রাজ্য সরকারের বেশির ভাগ মন্ত্রকেরই কোনও কাজ নেই। অনেক মন্ত্রীই দপ্তরে আসাই বন্ধ করে দিয়েছেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। সরকারের উপর আস্থা নেই শাসক দলেরই একাংশের। রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে মন্ত্রী ও বিধায়করাই নিরাপদ নন। খোদ মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতেই হামলা হয়েছে একাধিকবার। এমন একটি ব্যর্থ ও অপদার্থ সরকারের অধীনে ব্যর্থ রাজ্য মণিপুর ধ্বংসের কিনারায় এসে পৌঁছেছে। ১৯ মাস ধরে হিংসার আগুনে মণিপুর জ্বলতে থাকলেও মোদীরা নীরব। চোখের সামনে মণিপুরের মানুষ বিপন্নতায় ডুবতে থাকলেও কেন্দ্র কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। মণিপুরকে হিংসার উন্মত্ততায় ছেড়ে দিয়ে বীরেন সিংকে সামনে রেখে মণিপুর ছাড়া অন্যসব বিষয়ে বড় বড় কথা বলেন মোদী। দেশের সর্বত্র ঘুরে বেড়ালেও এবং পরপর বিদেশ ভ্রমণ করলেও ১৯ মাসে তাঁর কয়েক ঘণ্টাও সময় হয়নি মণিপুরে পা রাখার। মণিপুরে শান্তি প্রতিষ্ঠায় মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস ফেরানোর দায়িত্ব কেন্দ্রেরই। তাই প্রধানমন্ত্রী মোদীকেই ক্ষমা চাইতে হবে।