ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার একতরফা আগ্রাসন ২০২২ সালের মে মাসে শুরু হওয়ার পরে ৯০০ দিনের বেশি অতিবাহিত হয়েছে। দীর্ঘ এই সময় ভারত এক নিরপেক্ষ বিদেশ নীতি অবলম্বন করেছে। গত জুলাই মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী রাশিয়া সফরে যাওয়ার পরে আগস্টে পোল্যান্ড সফর শেষে গত ২৩ আগস্ট ইউক্রেনে গিয়েছেন এবং সেই দেশের রাষ্ট্রপতি জেলেনস্কির সঙ্গে যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি জেলেনস্কিকে রাশিয়ার সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনার টেবিলে বসার পরামর্শ দিয়েছেন। অতি সম্প্রতি রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণের অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়ে পৃথকভাবে জেলেনস্কির সঙ্গে আলোচনা করেছেন মোদী। দীর্ঘকালীন নিরপেক্ষতা এবং নিষ্ক্রিয়তার নীতি ভেঙে হঠাৎ এই সক্রিয় ভূমিকা কেন? এর পিছনে অমোঘ কারণ কী?
গত ৫ আগস্ট অভূতপূর্ব ছাত্র এবং গণ আন্দোলনের কারণে নাটকীয়ভাবে বাংলাদেশের আওয়ামি লিগ সরকারের পতন হয়। গত ৯ আগস্ট রাতে কলকাতার আরজি কর হাসপাতালের ভিতরে নৃশংসভাবে ধর্ষিতা এবং খুন হন এক মহিলা ডাক্তার। এর বিরুদ্ধে অভূতপূর্ব ঐক্য দেখা গিয়েছে জনসাধারণের আন্দোলনে। এই দুই স্বতঃস্ফূর্ত ঘটনার ঠিক মাঝে ৬ আগস্ট ঘটে আর একটি অভূতপূর্ব অভিযান। ইউক্রেন সেনা অতর্কিতভাবে এবং সম্পূর্ণ গোপনভাবে রাশিয়ার খনি অঞ্চল কুর্স্কে প্রবেশ করতে শুরু করে। এই কুর্স্কেই সংঘটিত হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে বৃহৎ ট্যাঙ্ক যুদ্ধ, নাজি জার্মানি এবং রাশিয়ার মধ্যে ১৯৪৩ সালে।
এর আগে ৩১ জুলাই পর্যন্ত যুদ্ধে ইউক্রেনের ১১,৫২০ জন মানুষ নিহত হয়েছেন এবং ২৩,৫৪০ জন মানুষ আহত হয়েছেন। এর মধ্যে শিশুর সংখ্যা যথাক্রমে ৬৩৩ এবং ১,৫৫১ জন। ইউক্রেনের দাবি অনুযায়ী কুর্স্কের প্রায় ১০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা তাদের দখলে এসেছে, যা পুনরুদ্ধারের মতো বিশেষ কিছু রাশিয়া এখনও করতে পারেনি। আইএসডব্লু-এর অনুমান অনুযায়ী রাশিয়ার সেনাবাহিনী এই বছরের শুরু থেকে ইউক্রেনের প্রায় ১১৭৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা দখল করেছে। যদি সত্যি হয়, তাহলে বিগত আট মাসে রাশিয়া ইউক্রেনের যত পরিমাণ এলাকা দখল করেছে, ইউক্রেন তার প্রায় সমতুল এলাকা ৬ আগস্ট থেকে মাত্র দুই সপ্তাহে দখল করেছে।
পঁচিশ মাস একতরফা যুদ্ধের পরে হঠাৎ রাশিয়ার আগ্রাসি যুদ্ধনীতিতে কিছুটা ঢিলেঢালা ভাব কেন? নির্ভরযোগ্য সূত্রের খবর, ইউক্রেন বাহিনী রাশিয়ার ব্যবহৃত ড্রোনগুলির কর্মদক্ষতাকে ড্রোন-বিরোধী ‘বাবল’ সৃষ্টি করে হ্রাস করতে পেরেছে। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রাশিয়ার পক্ষে রণাঙ্গণে আছে সীমান্ত রক্ষী, রাষ্ট্রীয় রক্ষী, এফএসবি এবং নিয়মিত ও স্থানীয় আঞ্চলিক বাহিনীর সেনাদের এক মিশ্রণ। ফলে রাশিয়ার তরফে এক অবিস্ময়কর বিশৃঙ্খলার ভাব দেখা যাচ্ছে। এর একটা কারণ রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি পুতিনের বক্তব্যেই বোঝা যায়। তিনি বলেছেন যে, যুদ্ধের প্রথম দিকে বাধ্যতামূলক নবনিযুক্ত সেনাদের সমরাঙ্গনে পাঠিয়ে ক্ষতি হয়েছে। ২০২৪ সালের মার্চ মাসে তিনি বাধ্যতামূলক নবনিযুক্ত সেনাদের মায়েদের উদ্দেশ্যে দেওয়া এক টেলিভিশন বার্তায় বলেছিলেন যে নবনিযুক্ত সেনারা যুদ্ধের প্রতিকূল পরিবেশে সক্রিয়া দেখাচ্ছে না। তাই আর সংরক্ষিত বাহিনী থেকে সেনা পাঠানো হবে না। এর আগে তিনি ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিস বা এফএসবি’কে দায়িত্ব দিয়েছিলেন অনিয়মিত সেনাদের নিযুক্ত করার, যা কিনা আইনত বিতর্কিত বিষয়।
‘কমিটি অফ সোলজারস মাদারস’ (পরবর্তীতে ‘ইউনিয়ন অফ কমিটি অফ সোলজারস মাদারস’) ছত্রচ্ছায়ায় অতীতে রাশিয়ান সেনাদের মায়েরা সামাজিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন। ১৯৮০ দশকের শেষে এবং ১৯৯০ দশকে প্রথমে মায়েরা বাধ্যতামূলক সেনাবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে মিছিল করে সোভিয়েত বাহিনীতে অধিকতর স্বচ্ছতার দাবি করেছেন। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রথম দিকে পুতিন বাধ্যতামূলক সেনাদের পরিবারকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে, পেশাদার সেনারাই যুদ্ধের সামনেরক সারিতে থাকবে।
কিন্তু, বিশেষ বাহিনী এবং অন্যান্য অভিজ্ঞ বাহিনীতে প্রভূত হতাহতের কারণে পুতিন অভিবাসি এবং অ-রাশিয়ান নবনিযুক্ত সেনাদের উচ্চতর বোনাস দিয়ে রণাঙ্গণে যেতে বাধ্য করেছেন। রাশিয়ার এক স্বাধীন সংবাদ প্রকাশনা সংস্থা ওকনো লিখেছে, ‘কুর্স্ক অঞ্চলে এক বাধ্যতামূলক সেনার মা ওকসানা দিভা তিন হাজার সেনার স্বাক্ষরিত রণাঙ্গন থেকে প্রত্যাগমনের আবেদন প্রকাশ করেছেন।’ অতএব পরিষ্কার যে পুতিন সেনাবাহিনী বিস্তারে সমস্যায় আছেন। এছাড়া দীর্ঘ ছাব্বিশ মাস ধরে চলা আমেরিকা এবং ইউরোপীয় দেশগুলির নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার অর্থনতিতে বিশেষ প্রতিকূল প্রভাব পড়েছে। উল্লেখযোগ্যভাবে রপ্তানিযোগ্য তেলের দাম অনেক কমে গেছে।
ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার সুসম্পর্কের ভিত্তি হল উভয় দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত ১৯৭১ সালের শান্তি, বন্ধুত্ব এবং সহযোগিতার চুক্তি। এছাড়া ভারতের অস্ত্র আমদানির ৮৫ শতাংশ আসে রাশিয়া থেকে। সাম্প্রতিক কালে ভারত, ফ্রান্স, ইউকে এবং আমেরিকাতে অস্ত্র রপ্তানি শুরু করলেও, ভারতীয় সেনাবাহিনী এখনও প্রধানভাবে রাশিয়া থেকে আমদানিকৃত অস্ত্রশস্ত্রের উপর নির্ভরশীল। ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ উদ্যোগে ভারতের মাটিতে রাশিয়ার সহযোগিতায় খুচরো যন্ত্রাংশ, এমনকি কালাশনিকভ রাইফেল উৎপাদিত হচ্ছে। রাশিয়ার উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার ফলশ্রুতিতে রাশিয়ার তেলের দাম অনেক কমে গেলে ভারত রাশিয়া থেকে তেল আমদানি দ্বিগুণ করেছে।
এতে যুগপৎ রাশিয়া এবং ভারতের উপকার হয়েছে। তাই বাস্তবিক ভাবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ভারতের নিরপেক্ষ না থাকা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। ভারত আশানুরূপ ভাবে রাষ্ট্রসংঘে যুদ্ধবিরতির আলোচনাতে গরহাজির থেকেছে। ভারতের কাছে মানবাধিকারের থেকে অগ্রাধিকার পেয়েছে নিজের দেশের মানুষের স্বার্থ। সে সময় আনুষ্ঠানিকভাবে পুতিন বা জেলেনস্কিকে যুদ্ধবিরতির আবেদন জানানোর বাস্তবিক কি কোনও মূল্য ছিল?
জুলাই মাসের ৯ তারিখ অর্থাৎ নরেন্দ্র মোদী রাশিয়ার মাটিতে পা ফেলার দিন রাশিয়ার হামলায় ইউক্রেনের একটি স্কুলের ৪১ জন ছাত্র মারা গিয়েছে। সরকারিভাবে প্রচারিত পুতিনের সঙ্গে মোদির আলোচনার বিষয়ে আমরা যাই জেনে থাকি না কেন, ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের বিষয়ে পুতিন নিশ্চয়ই কিছু বার্তা দিয়েছেন মোদীকে। আর সেই বার্তার ফলশ্রুতিতেই ঠিক পরের মাসেই মোদীর (বাস্তবিক অর্থেই প্রথম কোনও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর) ইউক্রেন সফর।
এছাড়া কুর্স্কের ঘটনাপ্রবাহের কারণে পুতিন মোদীকে বাড়তি কিছু বার্তা দিয়ে থাকতে পারেন। কারণ এ অবস্থায় পুতিন চাইবেন এক যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে নিজের ঘর গুছিয়ে নিতে। জেলেনস্কির পিঠে হাত রেখে মোদীর কী আলোচনা হল এবং তার ফলশ্রুতিতে যুদ্ধবিরতির বিষয়ে অচিরে রাশিয়া এবং ইউক্রেন আলোচনার টেবিলে বসবে কিনা, তা ভবিষ্যৎই বলবে। আর পটভূমিকা সেই দিকে এগোলে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কপালে হয়তো নোবেল শান্তি পুরস্কার জুটে যেতে পারে।