সত্যকে ধামাচাপা দেওয়া যায় না। কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল, সংক্ষেপে ‘ক্যাগ’ এবং পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি বা পিএসি— সরকারি অর্থ আয়-ব্যয়ের হিসাবরক্ষক, এই দুই কেন্দ্রীয় সংস্থা গত ষোলো মাসের ব্যবধানে যে রিপোর্ট সামনে এনেছে, তাতে ‘না খাউঙ্গা’র সদম্ভ ঘোষণার দফা রফা অবস্থা।
২০১৯-২০ সালের অর্থবর্ষে রেলে ডিজেল ইঞ্জিন উৎপাদন বন্ধ করে ইলেকট্রিক লোকোমেটিভ তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ডিজেল ইঞ্জিন তৈরির অন্যতম উপাদান ছিল ‘চ্যানেল এয়ার বক্স’। ২০১৬ সালের মে মাসে একটি বেসরকারি সংস্থাকে ৬৬০টি বক্স তৈরির বরাত দিয়ে ৯ মাসের মধ্যে তা সরবরাহের নির্দেশ দিয়েছিল রেলমন্ত্রক। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তা সরবরাহ করতে না পারায় বরাত বাতিল করে দেওয়া হয়। অথচ দেখা যায় কোনও এক অজ্ঞাত কারণে ২০১৮ সালের জুলাই মাসে রেল তার সিদ্ধান্ত বদলে ৬৬০টি চ্যানেল এয়ার বক্স কেনে। এজন্য ক্ষতিপূরণ হিসাবে ওই সংস্থাকে প্রায় ৭ কোটি টাকা দিতে বাধ্য হয় রেল। গত ১২ ডিসেম্বর সংসদে এই রিপোর্ট পেশ করে ক্যাগ জানিয়েছে, কার নির্দেশে কেন সময়সীমার পরেও বাড়তি গুণাগার দিয়ে এই কাজ করা হল, তা জানতে কোনও পদক্ষেপ নেয়নি রেলমন্ত্রক।
এর চেয়েও বেশি চাঞ্চল্যকর দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল গত বছরের আগস্ট মাসে। সেবারও সংসদে রিপোর্ট পেশ করে ক্যাগ। সেই রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশে ৩৪ হাজার কিমি সড়ক করিডোর তৈরির জন্য ৫ লক্ষ ৩৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিল মোদীর মন্ত্রিসভা। দেখা যায়, ২৬ হাজার কিমি রাস্তা তৈরি করতেই বরাত দেওয়া হয়েছে ৮ লক্ষ ৪৬ হাজার কোটি টাকার। এছাড়া দ্বারকা এক্সপ্রেসওয়ের প্রতি কিমি নির্মাণে সরকারি অনুমোদন ছিল ১৮ কোটি টাকা। কিন্তু বরাত দেওয়া হয় ২৫০ কোটি টাকা।
রাস্তার পাশাপাশি মোদীর স্বপ্নের ‘আয়ুষ্মান ভারত’ প্রকল্পে দেখা যায়, একটি মোবাইল নম্বরের সঙ্গে প্রায় সাড়ে ৭ লক্ষ মানুষের নাম যুক্ত রয়েছে। এদের মধ্যে অনেক ‘মৃত’ ব্যক্তির নামে অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। ক্যাগ-এর রিপোর্টে হ্যাল-এর বিমান সড়কের নিয়ম ভেঙে টোল ট্যাক্স আদায়ের মতো গুরুতর অভিযোগের কথাও উঠে এসেছে।
দুর্নীতির তালিকায় মোদীর কেন্দ্রীয় সরকারের পাশাপাশি বিজেপি পরিচালিত একাধিক ডাবল ইঞ্জিন সরকারের নামও রয়েছে। মোদীর ঘনিষ্ঠ এক শিল্পগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে দুর্নীতি, ফ্রান্স থেকে রাফাল বিমান কেনা নিয়ে ঘোটালা, ব্যাপম কেলেঙ্কারি সহ বহু দুর্নীতিও নয়ছয়ের অভিযোগ শোনা গিয়েছে গত এক দশক ধরে। দুর্নীতির প্রশ্নে মোদীর ‘না খাউঙ্গা’ স্লোগান বিদ্রূপের মতোই শোনাচ্ছে। আরএসএস-বিজেপির মতাদর্শ মেনে দেশকে ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ বানাতে হিন্দুত্ববাদীদের আগ্রাসী তৎপরতা, সংখ্যালঘু বিদ্বেষ প্রচার নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়ালেও সেক্ষেত্রে মুখে কুলুপ এঁটে থাকেন নরেন্দ্র মোদী।
মোদী জমানায় প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে দুর্নীতি কীভাবে মাথাচাড়া দিয়েছে, সংসদে ও সংসদের বাইরে তা নিয়ে বারবার সরব হতে দেখা গিয়েছে বিরোধীদের। কোনও অভিযোগকেই অবশ্য প্রকাশ্যে গুরুত্ব দেয়নি শাসকগোষ্ঠী। গত দশ বছরে এই দুর্নীতির অভিযোগেই একের পর এক বিরোধী নেতাকে জেলে পুরেছে মোদী সরকার। কংগ্রেস আমলের একাধিক দুর্নীতির অভিযোগকে সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে নিয়ম করে ধারা বিবরণীর মতো প্রচার করে চলেছেন নরেন্দ্র মোদী। প্রচারসর্বস্ব মোদীর অধিকাংশই প্রচারেই যে কোনও সারবস্তা নেই, সবই ‘ফ্লপ’ তা বারে বারে প্রমাণিত হচ্ছে।
‘দেশবাসী এখন অনলাইন লেনদেনে অভ্যস্থ’— মোদীর এই প্রচারের সাফল্যে প্রশ্ন উঠেছে। এই ধরনের যুগান্তকারী উদ্যোগের সাফল্য নির্ভর করে সমাজের ভিতের উপর। অর্থাৎ শিক্ষা। দেশের সিংহভাগ স্কুলেই পৌঁছয়নি ইন্টারনেট। সংসদে কেন্দ্রীয় সরকারই জানিয়েছে, দেশের ৭৬ শতাংশ সরকারি স্কুলে ইন্টারনেট সংযোগ নেই। সংখ্যার বিচারে তা ৭ লক্ষ ৭৫ হাজার ৩৮৬। সমাজ গড়ার কারিগর তৈরি হয় বিদ্যালয়ে। আর সেখানেই ন্যূনতম ইন্টারনেট পরিষেবা দিতে সরকার ব্যর্থ। মোদীর ‘ডিজিটাল ভারত’ সম্পূর্ণ ফ্লপ। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ডিজিটাল ইন্ডিয়া নিয়ে প্রবল ঢাকঢোল পিটিয়ে যাচ্ছে, অথচ গেরুয়া শিবিরের রাজ্যগুলিতে তা বাস্তবায়িত করতে হিমশিম খাচ্ছে।
অচ্ছে দিন। নতুন ভারত। ডিজিটাল ইন্ডিয়া। শব্দের পর শব্দ চয়নই করে যাচ্ছেন মোদী। অথচ সবটাই সেই প্রত্যেকের অ্যাকাউন্টে ১৫ কোটির মতো। ব্যাপারটা মোদীর তৈরি আরও এক জুমলা।