• facebook
  • twitter
Friday, 25 April, 2025

প্রতিদিন হোক ভালোবাসাময়

'ভ্যালেন্টাইন্স ডে' কে 'ফিস্ট অব সেন্ট ভ্যালেন্টাইন' নামে অভিহিত করা হয়। এই দিনটি প্রেমিক যুগলের কাছে পরম কাঙ্ক্ষিত।

‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ বাংলায় যার অর্থ ‘ভালবাসা দিবস’ বা ‘প্রেম দিবস’ পালিত হয় ১৪ ই ফেব্রুয়ারি। পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে এই ‘প্রেম দিবস’ ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অনুকরণে ভারতেও বাড়ছে ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’ উদযাপনের উন্মাদনা। ফেব্রুয়ারি এলেই ভ্যালেন্টাইন্সের লু এখানেও প্রবাহিত হয়। আর তার দাবদাহে পুড়ে মরে তরুণ প্রজন্ম। ‘প্রেম দিবস’ উপলক্ষে চারিদিকে সাজ সাজ রব। সোশ্যাল মিডিয়াতে কত মেসেজ, ভিডিও, পোস্টের ছড়াছড়ি। এক অভূতপূর্ব উন্মাদনায় মেতে ওঠে তরুণ প্রজন্ম।
ভালোবাসা মানবমনের একটি অপূর্ব অনুভূতি বা অভিব্যক্তি। এটি একটি পবিত্র বন্ধন। ভালোবাসা পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্লভ, আকাঙ্ক্ষিত আবেদন। হৃদয়ের উষ্ণতা, বিশুদ্ধতা, নিঃস্বার্থপরতার সমন্বয়ে এক অপূর্ব মায়াবী অনুভূতির নাম ভালোবাসা। সৃষ্টির সেই প্রথম প্রভাত থেকে মানুষের জীবন ও প্রেরণার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে গেছে ভালোবাসা। এক অজানা, অদেখা, চাপা কষ্টের অব্যক্ত অনুভূতিকে মহিমান্বিত করতে বছরের একটি বিশেষ দিনকে ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ কে ‘ফিস্ট অব সেন্ট ভ্যালেন্টাইন’ নামে অভিহিত করা হয়। এই দিনটি প্রেমিক যুগলের কাছে পরম কাঙ্ক্ষিত। প্রেম নিবেদনের প্রতিক‌ হিসাবে দিনটিকে বেছে নেওয়া হয়েছে। এর পিছনে রয়েছে ইতিহাস। একজন রোমান খ্রিস্টান পাদ্রির নাম ছিল সেন্ট ভ্যালেন্টাইন। তার জীবনকাহিনীর উপর ভিত্তি করে জন্ম হয়েছে প্রেম দিবসের। ২৭০ খ্রিস্টাব্দের কথা। সেন্ট ভ্যালেন্টাইন ছিলেন একধারে গির্জার পাদ্রি ও চিকিৎসক। খ্রিস্টধর্ম প্রচারের অভিযোগে রোমের সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াসের আদেশে তাকে কারাবন্দী করা হয়। জেল থেকে তিনি টিনএজ ছেলেমেয়েদের প্রচুর ভালোবাসার চিঠি পেতেন। কথিত আছে, এই জেলেই তিনি চিকিৎসা করে কারারক্ষীর এক অন্ধ মেয়ের দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে আনেন। এই ঘটনায় তার জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। রাগে-ক্ষোভে-হিংসায় অন্ধ রোমান সম্রাট তাকে হত্যা করেন। সেই হত্যার দিনটি ছিল ১৪ই ফেব্রুয়ারি। মৃত্যুর আগে সেন্ট ভ্যালেন্টাইন মেয়েটিকে একটি চিঠি লিখে যান। তাতে লেখা ছিল – ‘ফ্রম ইওর ভ্যালেন্টাইন’। সেই ঘটনার সূত্রে সম্রাট প্রথম জুলিয়াস সিজার ৪৯৬ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইন ডে’ হিসাবে ঘোষণা করেন।

‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ নিয়ে আর একটি গল্প আছে। সেন্ট বা সন্ত ভ্যালেন্টাইন নামে এক ক্যাথলিক রোমান ধর্মযাজক ছিলেন। সেসময় রোমান সম্রাট ছিলেন দ্বিতীয় ক্লডিয়াস। রোমানরা বিশ্বজুড়ে একের পর এক রাষ্ট্র জয় করতে থাকে। এজন্য শক্তিশালী সেনাবাহিনীর প্রয়োজন ছিল। সমস্যার বিষয় হল, সেসময় তরুণীরা তাদের পছন্দের পুরুষদের যুদ্ধে যেতে দিতে চাইতো না। ক্লডিয়াস ভাবলেন, পুরুষদের বিয়ে বন্ধ করলেই সমস্যার সমাধান হবে। ভাবনা মত তিনি বিবাহ নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন। সেন্ট ভ্যালেন্টাইন প্রেমে আবদ্ধ তরুণ-তরুণীদের একত্রিত করে বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। সম্রাট জানতে পারলেন ভ্যালেন্টাইনের গোপন কার্যকলাপের কথা। তাকে বন্দী করা হল। নতুন সমস্যা হল,তার অনুগামীরা অনেকেই তাকে জেলে দেখা করতে আসতেন। তারা তাকে নানা ধরনের ফুল উপহার দিতেন। তার মধ্যে এক অন্ধ মেয়েও ছিল। ভ্যালেন্টাইন তার অন্ধত্ব দূর করেন। তাকে ভালবেসে বিয়েও করেন। সম্রাট খবর পেয়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন। ফাঁসির দিন প্রিয়াকে পাঠানো চিঠিতে লেখেন – ‘লাভ ফ্রম ইওর ভ্যালেন্টাইন’। সে দিনটি ছিল ১৪ই ফেব্রুয়ারি। পোপ গেলাসিয়াস দিনটিকে ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ হিসাবে পালনের ঘোষণা দেন। ৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে প্রথম পালিত হয় এই দিবস।

একসময় ইংল্যান্ডের রাজ পরিবার ও অভিজাত সমাজে সীমাবদ্ধ ছিল এই দিনটি। ক্রমেই তা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ক্রমে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশে তা সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়। প্রিয়জনকে ফুল, গ্রিটিংস কার্ড, চকলেট, অলংকার ইত্যাদি নানা উপহার দেওয়া ও একান্তে সময় কাটানোর রীতি চালু হয়। ভালবাসার দিনকে কেন্দ্র করে কেনাকাটা, বাজার সংস্কৃতি প্রসার লাভ করে। ‘ভালবাসা দিবস’ বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে উদযাপিত হয়। চিনে এই দিনটি ‘কিক্সি ফেস্টিভ্যাল’ হিসেবে উদযাপিত হয়। ফিনল্যান্ডে এটি ‘বন্ধুত্বের দিন’ হিসাবে পালিত হয়। ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে এটা ‘বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার দিন’ হিসাবে উদযাপিত হয়। যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, পর্তুগাল, গ্রিস, জাপান প্রভৃতি দেশে মহাসমারোহে দিনটি পালিত হয়।

সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশেও ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ নিয়ে অভূতপূর্ব উন্মাদনা লক্ষ করা যাচ্ছে। অনেকের মনে প্রশ্ন, এই দিনটি নিয়ে কেন এত মাতামাতি ? পাশ্চাত্যের ভোগবাদী মানসিকতার বিকাশ ও বিস্তার এর অন্যতম কারণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বর্তমানে ভালোবাসাও বাজার তথা পণ্য-সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে বিবেচিত হচ্ছে। ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ কে কেন্দ্র করে দোকান-বাজারে কেনাকাটার ধূম লেগেছে। বিভিন্ন ধরনের উপহার, ফুল, গ্রিটিংস কার্ড কিনে মনের মানুষকে উপহার দেওয়ার উচ্ছ্বাস ও উন্মাদনা লক্ষ করা যাচ্ছে। পশ্চিমাদের অনুসরণ করতে গিয়ে আমরা নিজেদের সর্বনাশ ডেকে আনছি না তো ? প্রশ্ন উঠছে। ভালবাসার নামে অবাধ মেলামেশার সংস্কৃতি ঢুকে পড়েছে আমাদের চেতনায়। এমনিতেই নানা কারণে অবক্ষয়ের অতল তিমিরে হাবুডুবু খাচ্ছে যুবসমাজ। ভ্যালেন্টাইনস এর উন্মাদনা তাদের অধঃপতনকে আরও ত্বরান্বিত করবে। প্রশ্ন হচ্ছে, পশ্চিমাদের কেন এই অন্ধ অনুকরণ ? পশ্চিমারা নৈতিকতা বিসর্জন দিলে আমাদেরও কি সেই পথে হাঁটতে হবে ? লক্ষ-লক্ষ যুবক-যুবতী ‘ভালোবাসা দিবস’ পালনের নামে পার্ক-হোটেল-রেস্টুরেন্টে নানাবিধ অপকর্ম তথা খোলামেলা যৌনতা, উদ্যাম বেলেল্লাপনায় লিপ্ত হচ্ছে যা আমাদের জীবন চেতনা, সংস্কৃতি, মূল্যবোধের সঙ্গে সম্পূর্ণ বেমানান‌। আমরা যদি বিষয়টি ভেবে না দেখি, প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না করি ভোগবাদের ভরা জোয়ারে একদিন সব শেষ হয়ে যাবে – সেদিন কিন্তু হাজার হাত কামড়ালেও কিছু করার থাকবে না।

আরও একটি বিষয় উল্লেখ না করলে নয় – ভালোবাসা প্রদর্শনের জন্য শুধু একটি দিন কেন ? দিনটি পালনে উন্মাদনা ও মাতামাতি দেখে মনে হচ্ছে, সারা বছরের ভালোবাসা বুঝি এ দিনটির জন্য জমিয়ে রাখা ছিল! বিশেষ মানুষের জন্য ভালোবাসা বুঝি শুধু ওই একটি দিন উজাড় করে দিতে হয় ! ভালোবাসা বছরের শুধু একটি দিন নয়, প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত উদযাপনের বিষয়। বছরের যে কোন দিনই প্রিয়জনকে উপহার দিয়ে হৃদয়ের গোপন অনুভূতিকে ব্যক্ত করা যায়। মানুষের জীবনে প্রতিটি দিনই হোক ভালোবাসাময়।