১৯ মে শিলচর : ১১ ভাষা শহিদ স্মরণে অসমে অস্তিত্বের সংকটে বাঙালিরা

ড. কুমারেশ চক্রবর্তী

পশ্চিমবঙ্গের বাইরে ত্রিপুরাকে বাদ দিয়ে যে রাজ্যটিতে সবচেয়ে বেশি বাঙালিরা বাস করেন তার নাম অসম৷ বিশেষ করে কাছাড় এবং বরাক উপত্যকায় বাঙ্গালীদের বাস সর্বাধিক৷ তার কারণ এইসব অঞ্চল এককালে এই সমগ্র অঞ্চল ছিল বাংলার অধীন৷ রাজার শাসন ধরলে প্রায় ৪০০ বছর ধরে সমগ্র অসমে সরকারি কাজে রাষ্ট্রভাষা ছিল বাংলা, বাংলাতেই সমস্ত কিছু বাণিজ্যিক, প্রশাসনিক এবং বিচারবিভাগীয় কাজ সম্পন্ন করা হতো৷ বিচারকরা বাংলায় রায়দান করতেন৷ তারপর আধুনিক যুগে ব্রিটিশ শাসনের ১৮৩৭ সালে ইংরেজ সরকার বাংলা সহ সমগ্র আসামে বাংলাকেই সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করেন৷ আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ, বাণিজ্যিক কাজ, পড়াশোনা এবং বিচার বিভাগের সব কাজ বাংলাতেই শুরু হয়৷ সেই বাংলা ভাষা আজ কোণঠাসা এবং বাঙ্গালীদের ওপর অত্যাচার স্বাধীনতার পর থেকে ধারাবাহিকভাবেই চলে আসছে৷ অপ্রিয় সত্য এটাই যে, মহামান্য গোপীনাথ বরদলই এর আমল থেকেই এই বাঙালি বিরোধী ষড়যন্ত্রের সূচনা হয়৷ এর কারণ মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ ঘোষণা করেছিলেন আসাম শুধু অসমীয়াদের জন্য৷ তখন মহাত্মা গান্ধী বেঁচে আছেন৷ ফলে তিনি এই ঘৃণ্য প্রাদেশিক কথার প্রতিবাদ করেন নিন্দা করেন৷ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ গান্ধীজীর কথায় গুরুত্ব দিলেও স্বাধীন ভারতের রাজনীতিবিদরা, তা দিতেন না ফলে মুখ্যমন্ত্রী মহাশয়ের ঘোষণার পর থেকেই নেমে এলো বাবাঙালিদের ওপর নির্যাতন, এখান থেকেই বাংলা খেদাও আন্দোলনের প্রাথমিক সূচনা৷ তারপর থেকেই কয়েক বছর অন্তর নিয়মিত বাঙালিদের উপর নেমে এসেছে নির্মম নির্যাতনের খড়গ৷ কখনো সেটা ভাষার নামে কখনো সেটা নাগরিকতার নামে কখনো বিদেশি অভিযোগে৷ বর্তমানে আসামে থাকা বাঙালিরা অস্তিত্বের সংকটে ভুগছেন৷

১৯৬১ সালে ১৯ শে মে বাংলা ভাষার মর্যাদার দাবিতে শিলচর স্টেশনকে কেন্দ্র করে যে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল যেখানে ১১ জন বাঙালি পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিল৷ সারা বিশ্বে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে যা বিরল ঘটনা বলে আজও প্রতিষ্ঠিত ৷ তবে আন্দোলনের পথে বাঙালিকে ঠেলে দেয়ার পেছনে মূল কারণ ছিল কংগ্রেসের অন্তর্দ্বন্দ্ব৷ প্রকৃতপক্ষে ১৯৫১ সালের জনগণনা থেকেই এই ষড়যন্ত্রের সূত্রপাত৷ সেই জনগণনা অনুসারে বাংলা ভাষাভাষীর সংখ্যা অসমীয়াদের থেকে অনেক বেশি ছিল ফলে তখন আসামে কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ অনেক রকমের কারচুপি করে রাতারাতি অসমিয়া ভাষার সংখ্যা বাডি়য়ে দেখানো হলো৷ বাঙালির সংখ্যা কমিয়ে দেয়া হল৷ ১৯৬০ সালে মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চালিয়াকে বিপদে ফেলার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর বিরোধী কংগ্রেস নেতা বিষ্ণুরাম হঠাৎ বিধানসভায় প্রস্তাব নিয়ে এলেন , বাংলার পরিবর্তে অসমিয়া ভাষাকে একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করতে হবে৷ কংগ্রেসের অনেকেই এই প্রস্তাবের বিরোধী ছিলেন৷ এমনকি কাছাড় ও বরাক এলাকার কংগ্রেসী বিধায়করা এই প্রস্তাবের বিরোধী ছিলেন৷ কাছারের বিধায়ক নন্দকিশোর সিংহ প্রকৃতপক্ষে অবাঙালি ছিলেন৷ তিনিও পদত্যাগ করলেন৷ কারণ এটা অন্যায়৷ ঐতিহাসিকভাবেই শত শত বছর ধরে বাংলা অসমের প্রধান সরকারি ভাষা হিসেবে কাজ করেছে৷ তাছাড়া ৩৪৭ নম্বর ধারা অনুসারে বাংলা ভাষা অবশ্যই সহকারি সরকারি ভাষা হিসেবে মর্যাদা পাওয়ার যোগ্য৷ কিন্ত্ত এই সমস্ত কিছু উপেক্ষা করেই ১৯৬০ সালের ২৪ শে অক্টোবর বিধানসভায় অসমিয়া ভাষা আসামের একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে প্রস্তাব পাস হয়ে গেল৷ বিষ্ণুরাম এবং আরো কিছু কংগ্রেসের নেতার নেতৃত্বে শুরু হয়ে গেল ভাষাদাঙ্গা৷ হাজার হাজার বাঙালীকে অসম থেকে তাডি়য়ে দেয়া হলো৷ যা বাঙালি খেদাও আন্দোলন নামে পরিচিত৷


অবশেষে শুরু হলো বাংলা ভাষা আন্দোলন৷ এই আন্দোলনে শামিল হলেন বাঙালিরা ছাড়াও খাসিয়া, জয়ন্তী, বোর, মণিপুরী প্রভৃতি ছোট ছোট বহু ভাষাভাষী মানুষেরা৷ ঐক্যবদ্ধ এই আন্দোলনের মুখ্য দাবি ছিল মাতৃভাষাকে যথাযোগ্য মর্যাদা দান৷ অসমিয়া ভাষা আসামের সরকারি ভাষা হোক, তার উন্নতি, তার মর্যাদা বৃদ্ধি হোক এতে আমাদের কোন আপত্তি নেই৷ কিন্ত্ত তাই বলে বাংলা ভাষাকে সম্পূর্ণ মুছে ফেলা হবে কেন?

১৯৬১, ১৯ শে মে এই দিন আন্দোলন চরমে পৌঁছায় ৷এই দিনে যেমন একদিকে ধর্মঘট ডাকা হয় তেমনি একই সঙ্গে শিলচর স্টেশনে সত্যাগ্রহ শুরু হয়৷ সকাল থেকেই একটি ট্রেন সেখান থেকে ছাডে় নি ,সবচেয়ে বড় কথা এই স্টেশন থেকে সেই দিন একটি টিকিটও বিক্রি হয়নি৷ হাজার হাজার মানুষ স্টেশন চত্বরে সত্যাগ্রহ শুরু করলেন৷বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হল পুলিশি নির্যাতন ,লাঠিপেটা গ্রেপ্তার প্রভৃতি কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল আশেপাশের সমস্ত জেলখানা, থানা সত্যাগ্রহীদের ভিডে় ভর্তি হয়ে গেছে৷ তাই তারা সত্যাগ্রহীদের গ্রেফতার করে অনেকটা দূরে নিয়ে গিয়ে ছেডে় দিতে লাগলেন৷ দুপুরের দিকে হঠাৎ রটনা করা হলো যে পুলিশের বন্দুক খোয়া গেছে৷ পুলিশকে মারা হয়েছে৷ এবং এই মিথ্যা ভাষণ গৌহাটি রেডিও থেকে বারবার প্রচার করা হলো৷ তারপরেই শুরু হয়ে গেল পুলিশের বেদম নির্যাতন৷ এই মিথ্যা প্রচার গৌহাটি রেডিও স্টেশন থেকেও বার বার প্রচার করা হলো৷ কিছুক্ষণের মধ্যেই আসাম রাইফেলস বিনা প্ররোচনায় গুলি চালাতে শুরু করল এবং একদিনেই ১১ জন মানুষ শহীদ হয, যেখানে ১৬ বছরের কিশোরী কমলা, ১৪ বছরের বালক সুনীলও ছিল৷

আসাম সরকারের এই নৃশংস গণহত্যায় সমগ্র ভারত চমকে উঠল৷ বিচলিত হলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু, তিনি আসাম সরকারকে শুধু নিন্দা করলেন না পাঠিয়ে দিলেন তার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীকে৷ ওখানে বসে সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে সরকারকে বাধ্য করলেন বাঙ্গালিদের কিছু দাবি মেনে নিতে৷ যার মধ্যে ছিল কাছাড় অঞ্চলে বাংলা ভাষা হবে সরকারি ভাষা, বাংলাতেই পরীক্ষা দেয়া যাবে, পড়াশোনা করা যাবে এবং সরকারি চাকরিতে বাংলা ভাষায় লেখা যাবে৷ এই দাবিগুলোর মধ্যে আসাম সরকার দ্রুত কার্যকরী করলেন বাংলায় সরকারি চাকরি পরীক্ষা দেয়ার সিদ্ধান্তটি৷ কারণ অলিখিত সরকারি নির্দেশ হলো সরকারি পরীক্ষায় যারা বাংলায় লিখবে তাদের পাশ করানো হবে না৷ গত ৬০ বছর ধরেই এই প্রহসন চলে আসছে৷ এর সর্বশেষ উদাহরণ হল সম্প্রতি কাছাড় এলাকায় ২৬ হাজার সরকারি কর্মচারী নিযুক্ত হয়েছে তার মধ্যে তিনটি জেলা মিলিয়ে মাত্র ২২ জন বাঙালি সরকারি চাকরি পেয়েছেন৷
১৯ শে মে ভাষা আন্দোলনে নিহত শহিদেরা হলেন ১. কমলা ভট্টাচার্য, দরিদ্র পরিবারের কিশোরী, সবে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছে৷ বাবার নাম রাম রমন ভট্টাচার্য৷ ২. কুডি় বছরের যুবক শচীন্দ্র পাল৷ মেট্রিক পরীক্ষার্থী গানপাগল খেলাধুলা করা এই তরুণ শহিদের বাবা ছিলেন গোপেশচন্দ্র পাল ৩. সুনীল সরকার ১৪-১৫ বছরের এই কিশোর নরসিংহ হাইস্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র, এর বাবার নাম সুরেন্দ্রনাথ সরকার৷ ৪.বীরেন্দ্র সূত্রধর৷ ২৪ বছরের ছেলে সবে বিয়ে হয়েছিল, মাত্র এক বছর না মাস আগে, ঘরে ছিল একটি ফুটফুটে মেয়ে নাম রানী, এ কিন্ত্ত ওই এলাকার ছেলে ছিল না ও সবে আইজল থেকে এসেছিল৷ ১৭তে এসেছে ১৯ তারিখেই শেষ৷ বন্ধু চন্ডীও শহিদ হয়েছিল৷ ৫. কানাইলাল নিয়োগী, পরিচিত শ্রমিক নেতা এবং রেল কর্মী৷ এর বাবার নাম দ্বিজেন্দ্রলাল নিয়োগী, ইনি ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন৷ ৬. সুকমল পুরাকায়স্থ, এর বাবার নাম সঞ্জীব চন্দ্র৷ নরসিংহ হাই স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র৷ ৭. চণ্ডীচরণ সূত্রধর, ৩৫ বছর বয়স বিয়ে করেছিলেন সবে,এমই পাস দরিদ্র পরিবার৷ এর বাবার নাম চিন্তাহরণ সূত্রধর৷ ৮. সত্যেন্দ্র দেব, মনিমোহন দেবের পুত্র এই যুবক অবিবাহিত ছিলেন, তিনি ত্রিপুরা থেকে এসেছিলেন কাজের সন্ধানে! ৯. হিতেশ বিশ্বাস ওই এলাকায় এর একটা দোকান ছিল এদের আদি বাডি় শ্রীহট্ট, ইনি ত্রিপুরা হয়ে শিলচরে বাস করছিলেন, পিতা হরিশচন্দ্র বিশ্বাস৷ ১০. কুমুদ রঞ্জন দাস অতি দরিদ্র পরিবার, বাবা ছিলেন কুঞ্জ মোহন দাস মামার বাডি় শিলচরে বসবাস করতেন৷ মামার দোকানেই কাজ করতেন৷ পড়া এম ই পর্যন্ত৷ ১১. তরণী দেবনাথ৷ শিলচর পাবলিক স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র৷ প্রবেশিকা পরীক্ষা পাস করেছিল, বাবা যোগেশ চন্দ্র দেবনাথ৷

বাঙ্গালিদের উপর অত্যাচারের স্টিম রোলার কিন্ত্ত এখনো চলছে সেই ট্রাডিশন বজায় রেখেছে বর্তমান সরকার৷ শিলচর থেকে ভাষা আন্দোলনের অন্যতম নেতা জানালেন যে, এখনে বাঙালিরা অস্তিত্বের সংকটে ভুগছেন৷ তারা জানালেন বাঙ্গালিদের সরকারি চাকরি দেয়া হয় না, বাংলা ভাষায় লিখলেই তাদের ইচ্ছাকৃতভাবে ফেল করানো হয়৷ বাছাই করে অবাঙ্গালিদের চাকরি দেয়া হয়৷ যার প্রমাণ এই ২৬ হাজার চাকরির কথা, একটু আগেই বলেছি যেখানে মাত্র ২২ জন বাঙালি চাকরি পেয়েছেন৷ তাছাড়া কাছাড় এলাকায় বাংলা ভাষাকে ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য, বাঙালি সংস্কৃতিকে ধুলোয় মিসিয়ে দেওয়ার জন্য সুপরিকল্পিতভাবে ষড়যন্ত্র আজও চলছে৷ এখানে সমস্ত সরকারি প্রচার পত্র থেকে শুরু করে লিফলেট বা দেয়াল লেখা, ফ্লেক্স, বোর্ড প্রভৃতি সবই অসমীয়া ভাষায় হয়, বাংলা ভাষায় করা হয় না৷ সরকারের অর্থে যে সমস্ত বই পত্র ইস্কুলে বা কলেজের সরবরাহ করা হয় সেগুলি সবই হচ্ছে অসমীয়া, বাংলার কোন বই সেখানেই সরবরাহ করা হয় না এমনকি এখানকার লাইব্রেরী গুলিতে বাংলা বই কেনা হয় না ৷বাঙালি বিদ্বেষ এমন জায়গায় পৌঁছেছে যার সীমা অনেকদিন আগেই পার হয়ে গেছে৷ অসম সরকার জেলা মারফত সব এলাকাতেই লেখক শিল্পী সাহিত্যিক সাংবাদিকদের সম্মান দেন পুরস্কৃত করেন এমনকি অনুদান দেয়া হয় কিন্ত্ত এগুলি কোন বাঙালি লেখক বা সাংবাদিক পান্ না, মাঝেমধ্যে বাঙালিকে দেয়া হয়, দেখা যায় তিনি শাসকদলের ঝান্ডা ধরা লেখক অর্থাৎ রাজনীতির বাইরে কোন বাঙালিকে পুরস্কৃত করা হয় না৷ বর্তমানে বিজেপি পরিচালিত হিমন্ত সরকারের আরেকটি বিষয় ভয়ংকর আকার ধারণ করেছে তা হচ্ছে লাচিত সেনা৷ এরা অত্যন্ত উগ্রবাদী বাঙালি বিদ্বেষী৷ প্রকৃতপক্ষে হিমন্ত সরকার এখন এই লাচিত সেনাদের নির্দেশ ও পরামর্শেই পরিচালিত হচ্ছে যার প্রধান লক্ষ্য বাঙালি ও বাংলা ভাষা ধ্বংস করা৷

প্রকৃতপক্ষে ১৯ মে ভাষা আন্দোলনকে বাঙালিরা কাজে লাগাতে পারেনি৷ এর জন্য দায়ী অনেক অংশে পশ্চিমবঙ্গের দুধে ভাতে থাকা বাঙালি৷ অথচ ঢাকার বাঙালিরা একুশে ফেব্রুয়ারির পরে একাত্তরে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল৷ আর আমরা শুধু ওই একুশে ফেব্রুয়ারি হই হই করে উদযাপন করি৷ যেখানে আন্তরিকতার পরিবর্তে জাঁকজমক প্রদর্শন করাই থাকে মুখ্য উদ্দেশ্য৷ অথচ উনিশে মে আমরা পালন করি না বললেই চলে৷ তাই বাঙালি আজ অস্তিত্বের সংকটে৷