• facebook
  • twitter
Monday, 14 April, 2025

২২ মার্চ বিশ্ব জলদিবস: জলাভূমি রক্ষার দায় কার?

আজকাল বছরের বেশির ভাগ দিনকেই নানান গুরুত্বপূর্ণ দিবস হিসেবে ভূষিত করা হয়েছে। উদ্দেশ্য, সাধারণ মানুষের মধ্যে দিনটি নিয়ে সচেতনতা গড়ে তোলা।

প্রতীকী চিত্র

প্রবীর মজুমদার

পথ চলতে গিয়ে প্রায়ই আমাদের চোখে পড়ে, রাস্তার ধারের ট্যাপ থেকে অবিরাম জল পড়ে অপচয় হচ্ছে পানীয় জল। অপচয় হচ্ছে প্রকাশ্য দিবালোকে। কিংবা, কোনো পুকুরের পার্শ্ববর্তী বাসিন্দারা পুকুরেই বাড়ির আবর্জনা বিসর্জন দিয়ে চলেছে। কোথাও বা অন্যায়ভাবে পুকুর বুজিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে সুউচ্চ ইমারত। আমাদের অস্বস্তি হয়, এড়িয়ে যাই, কিন্তু কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করার কথা সচরাচর ভেবেই দেখি না কখনো। আমরা খোঁজই রাখি না যে, বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়েও সমগ্র পৃথিবীর ২০০ কোটিরও বেশি সংখ্যক মানুষ বিশুদ্ধ জল পান বা এর ব্যবহারের অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। আর সে তালিকায় যে কোনো দিন জুড়ে যেতে পারে আপনার আমার নাম। বর্তমানে ভূ-গর্ভস্থ জলের পরিমাণ দ্রুত কমে চলেছে। কলকারখানা, কৃষিকাজ ও অন্যান্য গৃহস্থালী সংক্রান্ত প্রয়োজনে মাটির নীচের জল তুলে আনা হয়। ফলে আমাদের অজান্তেই তীব্রতর হয়ে চলেছে জল সংকট।

আজকাল বছরের বেশির ভাগ দিনকেই নানান গুরুত্বপূর্ণ দিবস হিসেবে ভূষিত করা হয়েছে। উদ্দেশ্য, সাধারণ মানুষের মধ্যে দিনটি নিয়ে সচেতনতা গড়ে তোলা। এমনই একটি বিশেষ দিন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে ২২ মার্চ তারিখটিকে। এদিন বিশ্বজুড়ে সাড়ম্বরে পালিত হয় ‘বিশ্ব জল দিবস’। ১৯৯২ সালের ২২ ডিসেম্বর ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিও-তে রাষ্ট্রসঙ্ঘের পরিবেশ বিষয়ক আলোচনার মাঝে উঠে এসেছিল ‘বিশ্ব জল দিবস’ পালনের প্রস্তাব। আর তা অতি তৎপরতার সঙ্গে গৃহীতও হয়েছিল। আগামী দিনের জন্য ভবিষ্যৎ পৃথিবীকে আরও নিরাপদ একটি বাসস্থান হিসেবে গড়ে তুলতে রাষ্ট্রসঙ্ঘের তরফে কয়েকটা লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছিল, যার মধ্যে অন্যতম জরুরি স্থান দখল করেছিল, জল ও তার সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি।

কৃষিজমি এবং মাছ উৎপাদনের সাথে সাথে জলাভূমিকে এই গ্রহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জীবন সহায়ক ব্যবস্থা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। জলাভূমি হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ। এগুলি জাতীয় এবং বিশ্বব্যাপী বাস্তুতন্ত্র এবং অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। উত্তরোত্তর বেড়ে চলা বিশ্ব উষ্ণায়ন ও পরিবেশ দূষণের প্রকোপে নদী, পুকুর, খালবিলের মতোই অস্তিত্ব সঙ্কটে ভুগছে বাংলার জলাভূমিগুলি। এই জলাভূমিগুলি বাংলার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভারমাস্য বজায় রাখে। অথচ সাধারণ মানুষের এগুলি এখন স্রেফ ময়লা ফেলার আগার অথবা মশাদের বাসা।
বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা জলাভূমিগুলিকে সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ১৯৭১ সালে স্বাক্ষরিত হয় একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি, যার নাম ‘দ্য রামসার কনভেনশন অন ওয়েটল্যান্ডস অফ ইন্টারন্যাশনাল ইম্পরট্যান্স’। ইরানের রামসার শহরের বুকেই এই সম্মেলন আয়োজিত হয়েছিল। ‘রামসার কনভেনশন’ অনুযায়ী, জলা, বিল, ঘাসের চাপড়া সহ নানাবিধ জলাধার সমূহ ‘জলাভূমি’ হিসেবে গণ্য হতে পারে, তা সে প্রাকৃতিক হোক কিংবা মনুষ্যসৃষ্ট। প্রকৃতিতে জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষা করতে এবং বিবিধ রকমের তাৎপর্যপূর্ণ পরিবেশগত সমতা রক্ষার্থে জলাভূমির প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম গুরুত্বের দাবী রাখে।

পূর্ব কলকাতা জলাভূমি (২০০২ সালে ‘রামসার সাইট’ হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত) ও সুন্দরবন (২০১৯ সালে ‘রামসার সাইট’ হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত) ছাড়াও, পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু জায়গায় জলাভূমি চোখে পড়ে। যেমন, মুর্শিদাবাদের আহিরন বিল, কোচবিহারের রসিক বিল, রায়গঞ্জের কুলিক পাখি অভয়ারণ্য ইত্যাদি।

একাধিক তৃণবহুল পশুচারণভূমি, পয়ঃনিষ্কাশন খামার ও প্রায় বুজে যাওয়া কিছু পুকুর নিয়ে গড়ে ওঠা পূর্ব কলকাতা জলাভূমিটি ১২৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে। এই জলাভূমিটি কলকাতার জন্য প্রাকৃতিক বন্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে। হুগলি নদী ও কলকাতার মাঝে বেশ খানিকটা দূরত্ব থাকার কারণে, নিষ্কাশন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে পূর্ব কলকাতা জলাভূমির উপরে অনেকখানি নির্ভর করতে হয় সমগ্র কলকাতা শহরটিকে। অপেক্ষাকৃত নিচু জায়গায় অবস্থিত হওয়ার কারণে প্রতি বর্ষাতেই উপচে পড়ে কলকাতার পথঘাট। আর ঠিক এই সময়েই পূর্ব কলকাতা জলাভূমি তার সর্বশক্তি দিয়ে বন্যার সম্ভাবনা যথাসম্ভব কমিয়ে দেয়। এছাড়াও এই জলাভূমিতে নানা ধরনের মাছ জন্মায় যা বাজারে মাছের যোগান দেয়। পরিবেশ দফতরের পরিসংখ্যান বলছে, পূর্ব কলকাতা জলাভূমি থেকে প্রতি বছর গড়ে ২০ হাজার মেট্রিক টন মাছ পাওয়া যায়। সবজি আসে অন্তত পঞ্চাশ হাজার মেট্রিক টন। ২৫০টির বেশি জলাশয়ে ফি বছর ৩৬ রকমের পরিযায়ী পাখির দেখা মেলে। লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জলাভূমি থেকে উপকৃত হন। শহরের ৬০ ভাগ বিষাক্ত কার্বন শুষে নেয় এই জলাভূমি। সিএজি নিজের রিপোর্টে এই বিষয়টি স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, পূর্ব কলকাতা জলাভূমির উপরে শহরের পরিবেশের ভারসাম্য অনেকটাই নির্ভর করছে। কিন্তু, অচিরেই সেই ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে যদি পূর্ব কলকাতা জলাভূমি রক্ষা করা না যায়। প্রশাসনকে এই ব্যাপারে আরও বেশি সক্রিয় হতে হবে বলে মত ওয়াকিবহাল মহলের।এই রামসার স্থানের অধীনে এলাকাটি কেবল আশেপাশের দরিদ্র মানুষের জীবিকা নির্বাহ করে না বরং এই অঞ্চলে জীবন সহায়ক ব্যবস্থা হিসেবেও কাজ করে।

মুর্শিদাবাদের আহিরন বিল একটি প্রস্তাবিত ‘পাখির অভয়ারণ্য’, যেখানে প্রতি শীতকালে জমায়েত হয় হাজার হাজার পরিযায়ী পাখি। এই ১৭-১৮ প্রকার ভিন্ন ধরণের পাখির মধ্যে রয়েছে রেড-ক্রেস্টেড পোচার্‌ড, ফেরুজিনাস পোচার্‌ড, লেসার হুইসলিং ডাক, গ্যাডওয়াল, কমন মুরহেন, গ্রে হেডেড ল্যাপউইং ইত্যাদি। আনুমানিক ৬৫ একর জমি জুড়ে বিস্তৃত এই বিলটি। একইভাবে কোচবিহারের রসিক বিলকে কেন্দ্র করে পানকৌড়ি, সারস, মাছরাঙা, স্পুনবিলদের মতো পাখিদের আনাগোনা লেগেই থাকে। বিল ও বিল সংলগ্ন গাছপালাই এই পাখিদের আসবার মুখ্য কারণ। অন্যদিকে আবার রায়গঞ্জের ‘কুলিক পাখি অভয়ারণ্য’টি পাখি পর্যবেক্ষককের স্বর্গ নামে আখ্যা পেয়েছে। প্রতি বছর নির্দিষ্ট সময়ে ৭০ থেকে ৮০ হাজার পরিযায়ী পাখি এই ১.৩০ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত অভয়ারণ্যে ভিড় জমায়। ইংরেজি ‘ইউ’ আকৃতির একটি কৃত্রিম খালকে ঘিরেই পাখিগুলির আসা যাওয়া শুরু হয়। এছাড়াও এখানে আবাসিক হিসেবে রয়েছে আনুমানিক ১৬৪টি পাখি। মনোরম পরিবেশ ও পাখিদের কারণে, ক্রমে এই এলাকাগুলি ঘিরে পর্যটন শিল্প নতুন করে প্রাণ ফিরে পাচ্ছে।

প্রকৃত অর্থেই জীববৈচিত্র্যের কেন্দ্রবিন্দু রূপে আত্মপ্রকাশ করার কারণে স্থানীয় মানুষদের ভালো থাকা ও স্বচ্ছন্দে জীবিকা নির্বাহের ক্ষেত্রে জলাভূমি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভূ-গর্ভস্থ জলের পরিমাণ বৃদ্ধি, উপকূলরেখার স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি, ও বন্যার সম্ভাবনা হ্রাস করবার ক্ষেত্রে গ্রীষ্মপ্রধান ঘনবর্ষণ অরণ্যগুলির পরেই দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে জলাভূমিগুলি। নানান বিপন্ন প্রজাতিকে ঠাঁই দেওয়া ছাড়াও, জলাভূমিগুলি রাজ্যকে ব্যয়বহুল ‘ওয়েস্ট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট’ তৈরি ও তার রক্ষণাবেক্ষণ থেকে অব্যহতি দেয়।

২০২৩ সালে ভারত সরকারের জলশক্তি মন্ত্রকের প্রকাশিত রিপোর্টে দেশের সরকারি-বেসরকারি জলাশয়ের নিরিখে প্রথম পাঁচটি রাজ্যের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ শীর্ষস্থান দখল করে নিয়েছিল। শহরাঞ্চল, গ্রামাঞ্চল, ব্যক্তিগত অধিকারে থাকা জলাশয় ও মৎস্যচাষের ক্ষেত্রে প্রথম সারির পাঁচটি রাজ্যের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের স্থান প্রথম। সেচ-এর ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের স্থান চতুর্থ। এ সত্ত্বেও কেবলমাত্র সাধারণ মানুষের সচেতনতার অভাবের কারণে ধীরে ধীরে বাংলায় জলাভূমির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। অন্যায় উপায়ে সেগুলিতে মাটি ফেলে বুজিয়ে দিয়ে তার উপর বাড়ি তৈরি করা হচ্ছে। ‘বিশ্ব জল দিবস’-এর মতোই জলাভূমিগুলির গুরুত্ব অনুধাবন ও তা উদযাপনের জন্যেও ধার্য হয়েছে একটি বিশেষ দিন; যেদিন স্কুলপড়ুয়াদের নিয়ে শিক্ষকেরা র‍্যালি অথবা ক্যাম্পেনের আয়োজন করেন। আর তারপরেই বাকি সবকিছুর মতো অন্ধকারে চাপা পড়ে যায় বাংলার জলাভূমিগুলির প্রয়োজনীয়তা সংক্রান্ত যাবতীয় উদ্বিগ্নতা।

কেবল পানীয় জল নয়, জলাভূমিদের স্বার্থেও সম্মিলিত হতে হবে মানুষকেই। সোচ্চারে জানান দিতে হবে এই সংকীর্ণ জলাধারগুলির গুরুত্বের কথা। নিজের মতোই পাশের মানুষটিকেও বোঝাতে হবে যে, আজ একটি জলাভূমির দূষিত হওয়া বা সেটিকে বুজিয়ে দিয়ে ফ্ল্যাটবাড়ি গড়ে তোলাই পরোক্ষে কোনো ভবিষ্যৎ বন্যার কারন হয়ে দাঁড়াবে। বাংলা তথা বিশ্বের সমস্ত প্রকার জলাধারের সুরক্ষাই হয়ে উঠুক এই বছরের ‘বিশ্ব জল দিবস’-এর মূলমন্ত্র।