অর্থনীতিবিদ হিসাবে জীবন শুরু। সেখান থেকেই তাঁর রাজনীতির আঙিনায় প্রবেশ। অত্যন্ত শান্ত, মৃদুভাষী প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। প্রচারের বাইরে থেকেই সেই ‘লো প্রোফাইল’ এবং ‘অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার’ মনমোহন সিং ৯২ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন ২৭ ডিসেম্বর। বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার কারণেই চলে গেলেন ভারতীয় অর্থনীতির উদারীকরণের মূল রূপকার মনমোহন।
১৯৯১ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিমা রাও সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসাবেই তাঁর রাজনীতিতে প্রবেশ। সেই বছরই তিনি রাজ্যসভার সদস্য হন। এর আগেই অবশ্য শিক্ষাজগৎ সহ দেশের আর্থিক প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে তিনি পরিচিত নাম ছিলেন। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ হিসাবে সুনাম কুড়ানোর পাশাপাশি ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর পদ সামলেছিলেন। যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যানও ছিলেন। তবে রাজনীতির জগতে প্রবেশের পর সুনাম অর্জনের পাশাপাশি সমালোচিতও হয়েছিলেন তিনি। দেশে উদার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করার পদক্ষেপ তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত বলা হয়। দেশের অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যায় মনমোহন সিংয়ের নাম।
অর্থনীতির অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে পুরোদস্তুর সরকারি নিয়ন্ত্রণ সরিয়ে বেসরকারি পুঁজি, ক্ষেত্রবিশেষে বিদেশি পুঁজিকেও জায়গা করে দেওয়ার রাস্তা তৈরি হয়েছিল তাঁর হাত ধরেই। দক্ষিণপন্থী অর্থনীতির সমর্থকরা দু’হাত তুলে তাঁর আর্থিক সংস্কারের নীতিকে প্রশংসা করতেন। আবার তাঁর কড়া সমালোচক ছিলেন বামপন্থীদের পাশাপাশি মধ্যপন্থীরাও, যাঁরা বিশ্বাস করেন দেশের মৌলিক ক্ষেত্র থেকে রাষ্ট্রের হাত গুটিয়ে নেওয়া মোটেই দেশের পক্ষে সুখকর নয়। বস্তুত, তাঁর সময়েই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়।
২০০৪ সালে কিছুটা আচমকাই ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন তিনি। এর আগে ১৯৯৮ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত তিনি বিরোধী দলনেতা ছিলেন। ২০০৪ সালের ২২ মে তিনি প্রথম প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ নেন। এই বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা পরপর দু’বার প্রধানমন্ত্রীর পদে ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি ২০০৯ সালে ফের প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেন। নেহরু-গান্ধি পরিবারের বাইরে একমাত্র কংগ্রেস নেতা, যিনি টানা দু’দফায় দশ বছর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন।
পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৮ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি। অত্যন্ত নিম্নবিত্ত পরিবারে বড় হয়ে ওঠা তাঁর। কিন্তু চিরকালই মেধাবী ছাত্র হিসাবে সুনাম ছিল তাঁর। দেশভাগের সময় তাঁর পরিবার পাকিস্তান থেকে এদেশে চলে আসে। পড়াশোনার জন্য তিনি ব্রিটেনের কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৭ সালে অর্থনীতিতে প্রথম শ্রেণিতে অনার্স সহ উত্তীর্ণ হন। ১৯৬২ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নুফিল্ড কলেজ থেকে অর্থনীতিতে ডিফিল হন। তিনি পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় এবং দিল্লি স্কুল অফ ইকোনমিক্স-এ শিক্ষকতা করেছিলেন। তিনি ১৯৮৭ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত জেনিভায় সাউথ কমিশনে মহাসচিব হিসাবেও কাজ করেছিলেন।
‘হীরে’ চিনতে ভুল হয়নি ইন্দিরা-ঘনিষ্ঠ সাংসদ তথা বৈদেশিক বাণিজ্যমন্ত্রী ললিতনারায়ণ মিশ্রের। তিনিই মন্ত্রকের পরামর্শদাতা হিসেবে নিয়োগ করেন মনমোহনকে। তারপর একে একে অর্থমন্ত্রকের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, অর্থসচিব এবং যোজনা কমিসনের সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৮২ সালেই ইন্দিরা সরকারের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় তাঁকে রিজার্ভ বাঙ্কের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ করেন। মেয়াদ শেষে মনমোহন চলে যান সুইৎজারল্যান্ড। যোগ দেন জেনিভার ইকনমিক থিঙ্ক ট্যাহ্ক সাউথ কমিসনের মহাসচিব পদে। দেশে ফেরেন ১৯৯০ সালের নভেম্বরে। প্রথমে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখরের আর্থিক উপদেষ্টা, তারপর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান। ওই বচরের জুন মাসেই নরসিমা রাওয়ের মন্ত্রিসভায় তাঁকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে বলা হল। দায়িত্ব নিতেই জন্ম নিল রাও-মনমোহন মডেল। দেশে এলো উদার অর্থনীতি। জন্ম নিল নতুন ভারত।
২০০৪ থেকে ২০১৪— এই দশ বছরে দেশের প্রধানের পদ অলঙ্কৃত করে একের পর এক সামাজিক সংস্কার করেছেন। তথ্য জানার অধিকার আইন, ১০০ দিনের কাজ, শিক্ষার অধিকার, খাদ্য সুরক্ষা বিল প্রমুখ বহু জনমুখী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন মনমোহন সিং। কৃষিঋণ মকুব করেছেন। বিশ্বজুড়ে চরম মন্দার সময়েও আগলে রেখেছিলেন দেশের অর্থনীতিকে। অনড় অবস্থান বজায় রেখে আমেরিকার সঙ্গে পরমাণু চুক্তিও সম্পন্ন করেন।
সহজ-সরল জীবনযাপনে অভ্যস্থ, প্রচারবিমুখ, ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি দায়বদ্ধ মানুষটি চলে গেলেন ইতিহাসের পাতায় নাম লিখে।