অপুষ্টি ও বর্ণ, লিঙ্গ, পরিচয়ের যোগ

প্রতীকী চিত্র

শোভনলাল চক্রবর্তী

রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রতিবেদনে ‘জ়িরো হাঙ্গার-২০৩০’ বা এই নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব গড়ে তোলার ডাক দেওয়া হয়েছে। ভারত যখন ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি অর্জনের লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে, তখন এই প্রশ্নটি নিঃসন্দেহে জাগে— ক্ষুধা ও অপুষ্টির শিকার হওয়া অসংখ্য দুঃস্থ-অভুক্ত দেশবাসীর ক্ষুন্নিবৃত্তির বিষয়ে কল্যাণকামী রাষ্ট্রটির আদৌ কি কোনও পরিকল্পনা আছে? চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কোনও খাদ্যই পায়নি, এমন শিশুর সংখ্যা ভারতে সাতষট্টি লক্ষ। যা ভারতের স্থান নির্ধারণ করেছে দক্ষিণ এশিয়ার সব ক’টি পড়শি দেশের পিছনে। কার্যত স্বাধীনতার ৭৭ বছর পার করে ‘অমৃতকাল’ পর্বে এ দেশের ক্ষুধা ও অপুষ্টির এমন গ্লানিকর চিত্রটি কবি মণীন্দ্র গুপ্তের কবিতার লাইনকে মনে করিয়ে দেয়— “শব্দ অধোবদন হয়ে আছে লজ্জায়।”

কেন্দ্রীয় মন্ত্রক বৈশ্বিক ক্ষুধাসূচকের মাপকাঠির ভিতর যে পদ্ধতিগত ত্রুটিই খুঁজে পাক, এই আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানে ক্রমাগত নেমে ২০২৪ সালে ১২৭টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান হয়েছে ১০৫-এ। তীব্র আর্থিক দুর্দশায় ধুঁকতে থাকা শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানও ওই ক্ষুধাসূচকে ভারতের আগে। তালিকায় এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ, নেপালের মতো প্রতিবেশী দেশও। ভারতের স্কোর ২৮.৭ পয়েন্ট, যা ক্ষুধার মাত্রায় ‘গুরুতর’। সূচক অনুযায়ী, শিশুদের উচ্চতার সঙ্গে ওজনের অনুপাতেও দেশগুলির মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে ভারত, ১৮.৭ শতাংশ। ২০২১ সালের অক্টোবরে সরকারি পোষণ ট্র্যাকার অ্যাপ-এ কিন্তু উল্লেখ ছিল, এ দেশে ৩৩ লক্ষেরও বেশি শিশু অপুষ্টিতে আক্রান্ত। পঞ্চম জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষাতেও উঠে আসে, এ দেশে অপুষ্টির কারণে ৩২ শতাংশ শিশুর ওজন কম, আর দীর্ঘস্থায়ী ও মারাত্মক অপুষ্টির কবলে যথাক্রমে ৩৫ শতাংশ ও ১৯ শতাংশ শিশু। বৈশ্বিক ক্ষুধাসূচক নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সর্বদা কেন তবে এত উষ্মা বা অসন্তোষ?


অপুষ্টির সঙ্গে স্বাস্থ্যরক্ষার বিষয়কে জড়িয়ে সরকারের রাজনৈতিক চর্চার বিস্তর অভিযোগ থাকলেও শোচনীয় বিষয় এটাই যে, ভারতে বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় যখন বর্তমানে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) মাত্র ২.১ শতাংশ ধার্য হয়েছে, বৈশ্বিক ব্যয়ের গড় সেখানে প্রায় ৯ শতাংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-র বিধি অনুযায়ী, হাসপাতালে যেখানে ১০০০ জনের জন্য অন্তত ৩.৫টি শয্যা থাকা প্রয়োজন, এ দেশে এখন মাত্র ১.৪টি। দীর্ঘ কালের এই অনিবার্য সমস্যার আজও কেন যথোপযুক্ত সুরাহা করা সম্ভবপর হল না? কার্যত, কেন্দ্র এই ক্ষুধাসূচককে যতই অস্বীকার করুক, নীতি ও উন্নয়ন উপদেষ্টা সংস্থার গবেষণায় উঠে এসেছে, শিশু-অপুষ্টির কারণে ভারত তার মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ৪ শতাংশ এবং উৎপাদনশীলতার ৮ শতাংশ হারায়। সমীক্ষা বলছে, ভারতের রোগ-ব্যাধির ১৫ শতাংশের জন্য দায়ী শিশু ও মায়ের অপুষ্টি। ক্ষুধা ও অপুষ্টির আরও একটি বাস্তব কারণ সমীক্ষায় উঠে আসে— এ দেশে ২০১১ সালের জনশুমারির উপর ভিত্তি করে জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা আইনের অধীনে গ্রামীণ ও শহুরে জনসংখ্যার যথাক্রমে ৭৫ শতাংশ ও ৫০ শতাংশ এর আওতাধীন। যে-হেতু, ২০২১ সালের জনশুমারি এখনও ধার্য হয়নি, ফলে সঠিক ভাবে বিপুল দারিদ্রপীড়িত অনাহারক্লিষ্ট লোকসংখ্যার হিসাবটি এখানে আওতার বাইরে বা বাদই থেকে যায়। ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচার অর্গানাইজ়েশন-এর (ফাও) ২০২৩ সালের জুলাইয়ের এক রিপোর্টে জানা যায়, ভারতের তিন-চতুর্থাংশ দরিদ্র মানুষ নিম্ন আয়ের কারণে সুষম খাদ্য জোগাড় করতে পারেন না। এর সঙ্গে রয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি।

দলিত-জনজাতির শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির হার উচ্চবর্ণদের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি। এই তথ্য আবার দেখিয়ে দিল যে, এক ভারতের মধ্যে বাস করে একাধিক দেশ। এ ক্ষেত্রে কথাটা আক্ষরিক অর্থেই বলা চলে, কারণ সাহারা মরুভূমির দক্ষিণের দেশগুলি, অর্থাৎ আফ্রিকার দরিদ্রতম দেশগুলির সঙ্গে ভারতের পুষ্টিচিত্রের তুলনা করে একটি প্রশ্ন দীর্ঘ দিন সকলকে ভাবিয়েছে— আর্থিক উন্নয়নে ভারত আফ্রিকার দেশগুলির চেয়ে এগিয়ে থাকলেও, অপুষ্টির নিরিখে ভারতীয় শিশুরা কী করে আফ্রিকার দরিদ্রতম অঞ্চলের শিশুদের চেয়েও পিছিয়ে? শিশুদের দীর্ঘমেয়াদি অপুষ্টির প্রকাশ ‘স্টান্টিং’, অর্থাৎ শিশুর বয়সের গড় উচ্চতার তুলনায় খর্বাকৃতি। এই ‘স্টান্টিং’-এর হার সাহারার দক্ষিণের উনিশটি দেশের শিশুদের মধ্যে ৩৪%, অথচ ভারতে ৩৬%। সম্প্রতি ২০১৯-২১ সালের জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার পরিসংখ্যানকে জাতের ভিত্তিতে বিশ্লেষণ করে দুই গবেষক দেখিয়েছেন, ‘বিকশিত’ ভারতের মধ্যে রয়েছে আফ্রিকার অনুন্নত দেশগুলির চেয়েও দরিদ্র এক জনসমাজ, যার অধিবাসীরা তফসিলি জাতি ও জনজাতির মানুষ। একবিংশ শতকের দুই দশক পার করেও যে জাতিগত পরিচিতি ভারতের শিশুদের ভাগ্য নির্ধারণ করে দিচ্ছে, তা আরও এক বার স্পষ্ট হয়ে গেল।অপুষ্টির সঙ্গে বর্ণ-লিঙ্গ পরিচয়ের যোগ অপ্রত্যাশিত নয়। কিন্তু উচ্চবর্ণের শিশু এবং দলিত-জনজাতির শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির হার কতখানি বেশি, সে তথ্য আঘাত না করে পারে না। ভারতের উচ্চবর্ণ শিশুদের তুলনায় সাহারার দক্ষিণের দেশগুলির শিশুদের স্টান্টিং-এর শিকার হওয়ার সম্ভাবনা ২০% বেশি। যেখানে দলিত-জনজাতিদের সন্তানদের ক্ষেত্রে সেই সম্ভাবনা আফ্রিকার শিশুদের চেয়েও বেশি। দু’টি দেশের মধ্যে যত পার্থক্য, তার চাইতেও বেশি দূরত্ব ভারতের সমাজের দুই অংশের মধ্যে। ভারতে আর্থ-সামাজিক বৈষম্য যে এখনও প্রধানত জাতিগত ধারাতেই প্রবাহিত হচ্ছে, সে বিষয়ে সংশয় নেই। শিক্ষার স্তর, জমির মালিকানা, কর্মনিযুক্তির সুযোগ, ব্যবসায় রোজগারের অঙ্ক— এ সব কিছুর সঙ্গেই জাতি-পরিচিতির ঘনিষ্ঠ যোগ রয়েছে।

গত কয়েক দশকে নানা সমীক্ষায় তা প্রকাশিত হয়েছে। দলিত-জনজাতির মধ্যে দারিদ্র তীব্র— তফসিলি জনজাতির দু’জনে এক জন, তফসিলি জাতির তিন জনে এক জন দারিদ্রসীমার নীচে। পাশাপাশি, দলিত-জনজাতির উপরে হিংসার ঘটনাও সমানে ঘটে চলেছে; তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ স্থান পাচ্ছে দলীয় রাজনীতির প্রচারেও। ২০১৪ সালের একটি সমীক্ষা দেখিয়েছিল যে, চার জন ভারতীয়ের এক জন এখনও কোনও কোনও জনগোষ্ঠীকে ‘অচ্ছুত’ বলে মনে করেন। পাশাপাশি রয়েছে বিভিন্ন সরকারি নীতির ব্যর্থতার আক্ষেপ। শ্রেণি-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে সব ভারতীয় শিশুর জন্য সমান সুযোগ তৈরি করতে ভারত সরকার দায়বদ্ধ। এই উদ্দেশ্যে খাদ্যের অধিকার (২০১৩), শিক্ষার অধিকার (২০০৯)-এর মতো আইনও পাশ করেছে ভারত।

অপুষ্টির সঙ্গে বর্ণ-লিঙ্গ পরিচয়ের যোগ অপ্রত্যাশিত নয়। কিন্তু উচ্চবর্ণের শিশু এবং দলিত-জনজাতির শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির হার কতখানি বেশি, সে তথ্য আঘাত না করে পারে না। ভারতের উচ্চবর্ণ শিশুদের তুলনায় সাহারার দক্ষিণের দেশগুলির শিশুদের স্টান্টিং-এর শিকার হওয়ার সম্ভাবনা ২০% বেশি। যেখানে দলিত-জনজাতিদের সন্তানদের ক্ষেত্রে সেই সম্ভাবনা আফ্রিকার শিশুদের চেয়েও বেশি। দু’টি দেশের মধ্যে যত পার্থক্য, তার চাইতেও বেশি দূরত্ব ভারতের সমাজের দুই অংশের মধ্যে। ভারতে আর্থ-সামাজিক বৈষম্য যে এখনও প্রধানত জাতিগত ধারাতেই প্রবাহিত হচ্ছে, সে বিষয়ে সংশয় নেই। শিক্ষার স্তর, জমির মালিকানা, কর্মনিযুক্তির সুযোগ, ব্যবসায় রোজগারের অঙ্ক— এ সব কিছুর সঙ্গেই জাতি-পরিচিতির ঘনিষ্ঠ যোগ রয়েছে। গত কয়েক দশকে নানা সমীক্ষায় তা প্রকাশিত হয়েছে। দলিত-জনজাতির মধ্যে দারিদ্র তীব্র— তফসিলি জনজাতির দু’জনে এক জন, তফসিলি জাতির তিন জনে এক জন দারিদ্রসীমার নীচে। পাশাপাশি, দলিত-জনজাতির উপরে হিংসার ঘটনাও সমানে ঘটে চলেছে; তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ স্থান পাচ্ছে দলীয় রাজনীতির প্রচারেও। পাশাপাশি রয়েছে বিভিন্ন সরকারি নীতির ব্যর্থতার আক্ষেপ। শ্রেণি-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে সব ভারতীয় শিশুর জন্য সমান সুযোগ তৈরি করতে ভারত সরকার দায়বদ্ধ। এই উদ্দেশ্যে খাদ্যের অধিকার (২০১৩), শিক্ষার অধিকার (২০০৯)-এর মতো আইনও পাশ করেছে ভারত।

অপুষ্টি এমন এক অবস্থা, যেখানে শিশু প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদানগুলি যথাযথ ভাবে গ্রহণ করে না। পর্যাপ্ত পুষ্টির অভাবে শারীরিক এবং আচরণগত ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি ব্যাধি দেখা দিতে পারে। প্রতি বছর এক বড় সংখ্যার শিশু অপুষ্টির শিকার হচ্ছে, যা বিশ্বব্যাপী গুরুতর উদ্বেগের কারণ।বিশ্বে প্রতি বছর ৫০ লক্ষেরও বেশি শিশু মারা যাওয়ার নেপথ্যে আছে মায়ের গর্ভবতী থাকাকালীন স্বাস্থ্যহানি, জটিল রোগ-ব্যাধির প্রকোপ, সুষম খাদ্য ও চিকিৎসার অভাব, পরিবেশ, অশিক্ষা, কুসংস্কার, ধর্মীয় অনুশাসনের পাশাপাশি পুষ্টিহীনতা, দারিদ্র, অর্থনৈতিক সমস্যা ও অজ্ঞতা। সন্তান জন্মের পর থেকেই তার প্রতিপালনের গুরুদায়িত্ব মা অথবা পরিবারের মহিলাদের উপরেই ন্যস্ত হয়। কিন্তু ভারতে মহিলাদের একটা বড় অংশই সংসারের সমস্ত দায়দায়িত্ব পালন করার পরেও চাষবাস-সহ অন্য বহু কষ্টসাধ্য কাজ বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে গিয়ে করে থাকেন। মজুরির বৈষম্যের কথা ছেড়ে দিলেও শিশুদের প্রয়োজনীয় দেখাশোনা এবং শিশুর অপুষ্টিজনিত কারণের জন্য মূলত মায়েদের এই সময় দিতে না পারার ঘটনাটি একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।

অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র বা সমজাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলি সারা দিনে অন্তত ছয় থেকে সাত ঘণ্টা যদি শিশুসন্তানদের দেখাশোনা, খাওয়াদাওয়া এবং লেখাপড়ার দায়িত্ব নেয়, তা হলে হয়তো এই মহিলারা নিশ্চিন্তে তাঁদের কাজে যেতে পারেন এবং সন্তানরাও শিক্ষা ও অপুষ্টির হাত থেকে অনেকটা রেহাই পেতে পারে। তবে এর পরও যে বিষয়টি উঠে আসে, তা হল এই শিশুদের অপুষ্টিজনিত কারণের জন্য প্রয়োজনীয় সচেতনতা। এখনও বহু পরিবার আছে, যেখানে দিনে দু’বেলা ঠিক ভাবে খাদ্যের সংস্থান না হলেও, কেব্‌ল টিভির দামি প্যাকেজ এবং মোবাইল ফোনে প্রতি মাসে রিচার্জ বাদ যায় না। বহু পরিবারেই পুরুষ মানুষটি সারা দিন খেটে যা রোজগার করেন, তার একটা বড় অংশ নেশার দ্রব্য ও লটারির টিকিট বা সমজাতীয় জুয়ার পিছনে খরচ হয়ে যায়। ফলত খাদ্যের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থে টান পড়ে। তাই সরকারি ব্যবস্থাপনা আরও ভাল না হলে শিশুদের এই অপুষ্টির হাত থেকে বাঁচানো যাবে না।