• facebook
  • twitter
Friday, 24 January, 2025

নেতাজি : কালে ও কালোত্তরে

বর্তমানে তিনি শারীরিকভাবে আমাদের কাছে না থাকলেও ভারতের জাতীয় মানসিকতায় তিনি 'নেতাজি' হিসাবেই ভাস্বর ও অমর হয়ে আছেন এবং থাকবেনও।

একজন ব্যক্তির মৃত্যুর দীর্ঘদিন পরেও যখন প্রজন্মের পর প্রজন্ম সেই ব্যক্তির সমগ্র জীবনের ক্রিয়াকান্ড ও চিন্তা ভাবনা দ্বারা একটা দেশের জনগণ প্রভাবিত হয় তখন অনায়াসেই তাকে একজন মহৎ নেতা ও পথপ্রদর্শক হিসেবেই চিহ্নিত করা যায়। সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর সময়কালীন এবং পরবর্তী সময়ে মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় সেই আসনটি দখল করে আছেন এবং তাঁকে এক নামে ‘নেতাজি’ হিসাবেই পরিচিতি দিয়েছেন আপামর জনসাধারণ। ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের দুই কুশীলব মহাত্মা গান্ধী এমনকি নেহরুও এই অভিধায় ভূষিত হতে পারেননি। বর্তমানে তিনি শারীরিকভাবে আমাদের কাছে না থাকলেও ভারতের জাতীয় মানসিকতায় তিনি ‘নেতাজি’ হিসাবেই ভাস্বর ও অমর হয়ে আছেন এবং থাকবেনও। এর কারণ– তিনি যে বুদ্ধিমত্তা ও ঔদার্য, সাহস ও প্রকৃত দৃষ্টিভঙ্গি, পরাধীন মানুষের জন্য যে সহমর্মিতা ও তাদের যোগ্য নেতৃত্ব দিয়েছিলেন– জাতি, বর্ণ, ধর্ম নির্বিশেষে অহংকে বিসর্জন দিয়ে, তার জন্যই তিনি ভারতীয় জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে অত্যন্ত সঠিকভাবেই নেতাজী রূপে যে গণ্য হবেন এই বিষয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ থাকে না, থাকার কথা নয়।

ইংরেজ বা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ভারতীয় স্বাধীনতার সংগ্রামের যে ইতিহাস, সে ইতিহাস বহুকৌণিক এবং শত ধারায় তা বিকশিত হয়ে উঠেছিল। নরমপন্থী, চরমপন্থী, গান্ধীবাদী, নেতাজির বিপ্লবী আন্দোলন থেকে শুরু করে বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক, নিম্নবর্গীয় মানুষের বিভিন্ন আন্দোলনের এক যোগফল হল ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে গান্ধীবাদী আন্দোলনকে। এটা প্রকৃত ইতিহাসকে অস্বীকার করা ও এড়িয়ে যাওয়ার মানসিকতা ছাড়া আর কিছুই নয়। অন্যান্য আন্দোলনকে তুচ্ছ ও অকিঞ্চিৎকর মনে করে দূরে সরিয়ে রাখা ইতিহাসের প্রতি এক প্রবলতর অন্যায়। তার মধ্যে নেতাজির নির্দেশিত পথ ও মতকে গুরুত্বহীন করে রাখা একটা চক্রান্ত ছাড়া আর কিছু না।

ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতাজির ভূমিকা নিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাঁকে সঠিকভাবে পাঠ্য ইতিহাসে গুরুত্ব সহকারে ও যথাযথ মর্যাদায় স্থান দেওয়া হয়নি। যদিও স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর অবদান কিছু কম ছিল না। অথচ “নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নামে একটি সর্বজনীন আবেদন ও আকর্ষণ আছে। শুধু ভারতে নয়, দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং পূর্ব এশিয়ায় সুভাষচন্দ্রের কর্মকাণ্ড সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে শিক্ষিত শ্রেণী এবং দেশ-বিদেশের গবেষকদের কাছে বিস্ময়ের বিষয়। এমনকি কোনো কোনো প্রাক্তন সেনাধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বলেও দেখা গেছে তাঁরা কি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে নেতাজির কথা স্মরণ করেন। ১৯৪৭ সালের ভারতবর্ষের দ্বিখন্ডিত হওয়া অনিবার্য ছিল কিনা সে নিয়ে তর্ক-বিতর্ক, মতানৈক্য থাকতেই পারে কিন্তু যে বিষয়ে মুক্তবুদ্ধির মানুষ মাত্রই একমত হবেন তা হল ১৯৪৭ সালে গান্ধীজীর পাশে (তিনি) থাকলে ভারত ভাগ করতে হতো না। অধৈর্য, ক্ষমতালোভী নেতাদের দেউলিয়াপনা প্রকাশ হয়ে পড়তো না এবং স্বাধীনতা লাভের বিনিময়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে দেশ ছাড়া হতে হতো না এবং মনুষ্যত্বের চরম লাঞ্ছনা ভোগ করতে হতো না।।”

ঠিক এই জায়গা থেকেই আমাদের মূল আলোচনা সূত্রপাত। ‘১৯৪৭ সালে গান্ধীজীর পাশে থাকলে ভারত ভাগ করতে হতো না।’ এই বাক্যটি অনেক ফেলে আসা ইতিহাসের প্রতি প্রশ্ন তুলে দেয়। নেতাজির মতো একজন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন অসাম্প্রদায়িক সাহসী এবং দেশমাতৃকার জন্য বলি প্রদত্ত মানুষ যিনি অন্তর থেকে গান্ধীজিকে শ্রদ্ধা করতেন সে কেন সেই সংকটকালে গান্ধীজীর পাশে ছিলেন না? তিনি কি ছিলেন না? নাকি গান্ধীর পাশে থাকার মত অবস্থায় যাতে তিনি না থাকতে পারেন সেই অবস্থারই সৃষ্টি করা হয়েছিল?

সুভাষচন্দ্র নিজেই তারা আত্মজীবনী মূলক গ্রন্থ ‘দ্য ইন্ডিয়ান স্ট্রাগলে’ এ জানিয়েছেন যে তিনি আইসিএস-এর চাকরি ত্যাগ করে বিলাত থেকে ফিরে বোম্বাই নেমে গান্ধীজীর সঙ্গে দেখা করেন। এবং এক বছরেই স্বরাজ আনার সম্ভাবনা সম্পর্কে গান্ধীজির উত্তর তাঁকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি, তা সত্ত্বেও তিনি চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে আইন অমান্য ও অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়ে জেলে যান। গান্ধীজির নেতৃত্ব মেনে নিলেও তাঁর মত ও পথ সম্পর্কে সুভাষ চন্দ্রের দ্বিধা ছিলই। আসলে নেতাজীর ছিল একটি গভীর দূরদৃষ্টি, যে দৃষ্টিতে ভবিষ্যৎ ভারতের স্পষ্ট ছবি তিনি দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি দেখতে পেয়েছিলেন যে যদি গান্ধীবাদী পথে ভারতবর্ষে জাতীয় আন্দোলন হয় তবে তা সব বর্ণ, জাতি, ধর্ম, শ্রেণীর পক্ষে কখনোই আনন্দের হবে না। প্রকৃতপক্ষে ” Bose had a prophetic vision, and political foresight,”

গান্ধীজীর সঙ্গে নেতাজির মতপার্থক্যই পরবর্তীকালে নেতাজিকে ব্রাত্য করে দিয়েছিল রাষ্ট্রীয় ইতিহাস প্রণেতারা— এবং আজও তার বিচ্যুতি ঘটেনি। নেতাজি ‘Militant Nationalism’ এ বিশ্বাস করতেন। এক বিপুল জনসমর্থন তখন নেতাজির পিছনে। এই কারণেই তিনি দু-দুবার কংগ্রেসের সভাপতি পদে নির্বাচিত হন তবুও তাঁকে পদত্যাগ করতে হয় গান্ধীজির রাজনৈতিক, গোষ্ঠীগত, ব্যক্তিগত, প্রাধান্যের কাছে পরাজিত হয়ে। তার কারণ ছিল মত ও পথের পার্থক্য। যদিও দুজনেই চেয়েছিলেন ভারতের স্বাধীনতা । নেতাজি তাঁর ব্যক্তিগত পলিটিক্সকে পরিহার করে মানুষের জন্যই রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে দেশের জন্য বলিপ্রদত্ত হয়েছিলেন।

সভাষ চন্দ্রের সভাপতি নির্বাচন গান্ধীজি যে মেনে নিতে পারেননি তা আমরা সবাই জানি, ত্রিপুরী কংগ্রেসে সুভাষের কাছে পট্টভি সিতারামাইয়ার পরাজয় গান্ধী নিজের পরাজয় বলেই মনে করেছেন। এক প্রবল অহংকার কেন্দ্রিক মানসিকতা এখানে কাজ করেছিল বলেই অনেকে মনে করেন। শুধু কি তাই? নাকি নিজের পায়ের তলাকার মাটির কম্পন অনুভব করেছিলেন? বলতে দ্বিধা নেই গান্ধী নেতাজির দূরদৃষ্টিকে অনুধাবন করতে পারেননি। আর পারলেও তাতে ভীত হয়ে পড়েছিলেন। সেই কারণেই কালজয়ীদ্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গান্ধীজিকে এক তারবার্তায় অনুরোধ করলেন নেতাজির উপর থেকে ‘নো কনফিডেন্স মোশনের’ মাধ্যমে যে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তা যেন প্রত্যাহার করা হয়। গান্ধীজি রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে কোনো কর্ণপাত তো করলেই না বরং উল্টে দীনবন্ধু অ্যান্ড্রুজ সাহেবের পত্রের উত্তরে লিখলেন “I feel Subhas is behaving like a spoilt child of the family.”

গান্ধীর এই উক্তি আহত করল আপামর বাঙালি ও ভারতীয় জাতীয় সত্তাকে। রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত ব্যথিত হলেও তিনি তাঁর ভাবনা থেকে এক চুলও সরলেন না। তাই ১৯৩৯ সালে কলকাতায় মহাজাতি সদনের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনকালে নেতাজি রবীন্দ্রনাথকে বেছে নিলেন। তাঁকেই দিলেন এই ভবনের নামকরণের দায়িত্ব। রবীন্দ্রনাথ সাগ্রহে এই আবদার মেনে নিয়ে প্রেক্ষাগৃহের নামকরণ করলেন ‘মহাজাতি সদন’। শুধু তাই নয়, ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করালেন রবীন্দ্রনাথকে দিয়েই। তাঁর কাছে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ভারতের প্রকৃত ‘আত্মা’। তিনি তাঁর ভাষণে রবীন্দ্রনাথকে উদ্দেশ্য করে বললেন “… যে স্বপ্ন দেখে আমরা বিভোর হয়েছি তা শুধু স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন নয়। আমরা চাই ন্যায় ও সাম্যের উপর প্রতিষ্ঠিত এক স্বাধীন রাষ্ট্র— আমরা চাই এক নতুন সমাজ ও এক নতুন রাষ্ট্র যার মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠবে মানব জীবনের শ্রেষ্ঠ ও পবিত্রতম আদর্শগুলি, গুরুদেব! আপনি বিশ্ব মানবের শাশ্বত কন্ঠে আমাদের সুপ্তোত্থিত জাতির আশা আকাঙ্ক্ষাকে রূপ দিয়েছেন। আপনি চিরকাল মৃত্যুঞ্জয়ী যৌবনশক্তির বাণী শুনিয়ে আসছেন। আপনি শুধু কাব্যের বা শিল্পকলার রচয়িতা নন– আপনি বিশ্বকবি। আমাদের স্বপ্ন মুক্ত হতে চলেছে দেখে যে সমস্ত ভাব আজ আমাদের অন্তরে তরঙ্গায়িত হয়ে উঠছে— তা আপনি যেমন উপলব্ধি করবেন তেমন কে আর করবে? যে শুভ অনুষ্ঠানের জন্য আমরা এখানে সমবেত হয়েছি তার হোতা আপনি ব্যতীত আর কে হতে পারে?”

সুভাষের ভাষণের প্রত্যুত্তরে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভাষণে বলেন, “সুভাষচন্দ্র, বাঙালি কবি আমি বাংলাদেশের হয়ে তোমাকে দেশনায়কের পদে বরণ করি । গীতায় বলেন সুকৃতের রক্ষা ও দুষ্কৃতীর বিনাশের জন্য রক্ষাকর্তা বারবার আবির্ভূত হন।” গান্ধীজী না বুঝলেও রবীন্দ্রনাথ ঠিক বুঝতে ও চিনতে পেরেছিলেন ভবিষ্যৎ ভারতবর্ষের প্রকৃত নেতাকে।

ত্রিপুরী কংগ্রেসের ঘটনায় নেতাজি প্রবল আঘাত পেয়েছিলেন এবং সেখান থেকে ফিরে দাঁড়াবার এবং ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণের বিষয়টি একটু দেখে নেওয়া যাক। এই ব্যাপারে শিশির কুমার বোস লেখেন, “The mental agony that Subhash Chandra experienced at Tripuri made his recovery all the more difficult… His mental state at this particular time can be assessed from what he himself wrote sometime latter.” এই মানসিক যন্ত্রণা ও সেখান থেকে বেরিয়ে আসার সম্বন্ধে কি লিখলেন সুভাষচন্দ্র? তিনি লিখলেন, “Owing to the moral sickening atmosphere at Tripuri I left that place with such a loathing and disgust for politics as I have never felt before during the last nineteen years… inspite of what I had experienced in tripuri how could I lose my fundamental faith in man ? To distrust man was the distrust the divinity in him…to distrust one’s very existence.” এই হল সুভাষচন্দ্র। যিনি মানুষকে তাঁর দেশের জনগণকে তাঁর সামগ্রিক চিন্তা, মতাদর্শের কেন্দ্রবিন্দুতে স্থাপন করেছিলেন। এবং স্বপ্ন দেখেছিলেন ভারতীয় জনগণের জন্য এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের, যে ভবিষ্যৎ মানুষের স্বাধীনতার কথা বলে। তাই ভারতের স্বাধীনতার এক মহান স্থপতি তিনি ভিন্ন আর কে?

এক বিকল্প নেতৃত্ব: গান্ধীজির মত ও পথের যখন অনেক ভ্রান্তি ও অহং জাতীয় কংগ্রেসে চোরা স্রোতের মতো কাজ করছিল এবং সর্বোপরি তার অহিংস আন্দোলন (যা শেষ পর্যন্ত টিকিয়ে রাখা গান্ধীর নিজের পক্ষ সম্ভব হয়নি), রাজনীতিতে বর্ণাশ্রমের এর বিতর্ক, সহিংস অথবা সংগ্রামী বিপ্লবকে হেয় করে দেখার প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছিল, মানুষের সংগ্রামী চেতনাকে রুদ্ধ করে দিয়ে ব্রিটিশ শক্তির তাঁবেদারির পথ সুগম করে দিচ্ছিল এবং সর্বোপরি কংগ্রেসের বিভিন্ন ষড়যন্ত্র ও অপকীর্তি কংগ্রেসকে ভিতর থেকে দুর্বল করে দিচ্ছিল এক আপসকামী মানসিকতা, ঠিক তখনই ভারতের জাতীয় আন্দোলনে এক বিকল্প নেতৃত্বের প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। এই অবস্থায় হাল ধরেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। এই বিকল্প নেতৃত্ব প্রসঙ্গে এসে পড়ে সুভাষচন্দ্রের রাজনৈতিক মতাদর্শের দিকটি। তিনি সমাজতান্ত্রিক ধারার অনুরক্ত ছিলেন। তার প্রমাণ পাই হরিপুরা কংগ্রেসে তিনি তাঁর সভাপতির ভাষণে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলেন, “I have no doubt in my mind that our national problems relating to eradication of poverty, illiteracy and diseases and scientific production and distribution can be effectively tackled only along socialistic lines”

কিন্তু তিনি ইউরোপীয় ধাঁচের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে গ্রহণ করেননি, শুধু তাই নয়, মার্কসবাদের প্রতিও তাঁর আগ্রহ ছিল না। কারণ মার্কসবাদ শুধুমাত্র অর্থনৈতিক বিষয়ের উপরেই সব থেকে বেশি জোর দিয়েছিল। নেতাজির রাজনৈতিক মতাদর্শটি গড়ে উঠেছিল ভারতীয় ঐতিহ্যের উপর ভিত্তি করেই।” আসলে সাধারণভাবে রাজনৈতিক চিন্তা এবং বিশেষ সমাজতান্ত্রিক মতবাদ গঠনে সুভাষচন্দ্র বহুবিধ তাত্ত্বিক আদর্শগত ধারার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। বিবেকানন্দ, অরবিন্দ এবং চিত্তরঞ্জন এর জীবন দর্শন তাঁকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। একই সাথে তাঁর উপর হিটলার, মুসোলিনি, কামাল পাশা এবং লেনিনের প্রভাব লক্ষণীয়, যদিও মতাদর্শগতভাবে এঁদের কারো সাথে তিনিসম্পূর্ণ একাত্মবোধ করেননি।

“ছাত্র জীবনে সুভাষচন্দ্র বিবেকানন্দ- ভাবাদর্শে দীক্ষিত হন। তাঁর রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক চিন্তার মর্মমূলে ছিল স্বামীজীর প্রেরণা…. সুভাষ চন্দ্রের সমাজতান্ত্রিক ভাবনা এর দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিল”।

তাঁর কাছে স্বাধীনতা ও সমতা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ছিল। পূর্ণ স্বাধীনতাই ছিল তাঁর আত্মার সঙ্গীত এবং স্বাধীনতা ছিল সাম্যের দ্যোতক। এই জায়গা থেকেই তদানীন্তন ভারতীয় যুবকরা খুঁজে পেল তাদের মনের মত এক নেতাকে সমকালীন ভারতবর্ষে সুভাষচন্দ্রই হয়ে উঠলেন যুব সমাজের নয়নের মনি। তথাকথিত গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের পরিবর্তে এক বিকল্প রাজনৈতিক ভাবনার জাগরণ ঘটল সুভাষের হাত ধরেই। এবং জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রেও এক বিকল্প নেতৃত্বের সূচনা হলো।

নব অভিযান: আমরা জানি যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইংরেজকে গান্ধীর নির্দেশে সহায়তা দেবার মোট ফল হয়েছিল শূন্য। সুতরাং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ১৯৪০ সালে ফরওয়ার্ড ব্লকের দ্বিতীয় অধিবেশন (নাগপুর, ১৮ জুন) সাফল্যের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হলো এই সময়টাই ছিল ব্রিটিশের উপর চরম আঘাত হানার উপযুক্ত সময় ওই অধিবেশন মঞ্চ থেকে সভাপতি সুভাষচন্দ্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের চরমপত্র দিয়ে দাবী জানালেন— অচিরে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে যেতে হবে এখন থেকে আমাদের একটা দাবি “All powers to the Indian people..” কিন্তু গান্ধীজি বা তার অনুগামীরা কেউই কর্ণপাত করলেন না… তাই স্বাভাবিক কারণেই সংগ্রামে আস্থাশীল জনতা বিশেষভাবে হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়েছিল। গান্ধীজী ও দক্ষিণপন্থী অনুগামীদের উপর অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও চঞ্চল হয়ে উঠেছিল দেশের যুবশক্তি গান্ধীজীর সংগ্রাম বিমুখতায়।”
এর আগে ১৯৩৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর মাদ্রাজের সমুদ্র তীরে এক বিশাল জনসভায় যখন তিনি ভাষণ দিচ্ছিলেন তখনই খবর আসে যে জার্মান ও ব্রিটেনের মধ্যে যুদ্ধ লেগে গেছে এবং তখনই সুভাষচন্দ্র ঘোষণা করলেন যে এই হচ্ছে এক মহৎ সুযোগ। ইংরেজের এই সংকটে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে জোর ধাক্কা দিতে হবে। কিন্তু কংগ্রেস সে পথে এগোলো না, উল্টে ব্রিটেনকে সাহায্য করার জন্য উঠেপড়ে লেগে গেল। এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগানোর সুবর্ণ সুযোগ সুভাষচন্দ্র হাতছাড়া করতে রাজি হলেন না। তিনি নেপোলিয়নের তত্ত্ব “শত্রুর শত্রু আমার মিত্র” এই নীতিকেই অবলম্বন করলেন । এই বিশ্বযুদ্ধ ছিল সাম্রাজ্যবাদীদের মধ্যে এক আত্মকলহ– এ আত্মকলহের সুযোগ নিয়ে স্বদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিকে ত্বরান্বিত করা একটি রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ছাড়া আর কিছু নয়। আদর্শবাদের অজুহাতে একটি মুক্তিকামী রাষ্ট্রের পক্ষে ভিন্ন পদ্ধতি গ্রহণ অস্পৃশ্য বলে বিবেচিত হতে পারে না। লেনিনেরও একই কথা ছিল। তাঁর মতে সাম্রাজ্যবাদী, পুঁজিবাদী প্রত্যেকেই আমাদের বিরুদ্ধে ছুরি শানাচ্ছে।” আমাদের যদি তাদের মেনে নিতে বাধ্য করানো হয় তাহলে তারা যাতে করে একে অপরের বিরুদ্ধে ছুরি তুলে ধরে তার জন্য ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে— এটা আমাদের প্রত্যক্ষ দায়িত্ব” লেলিন কথাগুলি একটু কৌশল করেই বলেছিলেন। কিন্তু এর সত্যতা অস্বীকার করা যায় না।
“আমারে বাঁধবি তোরা সেই বাঁধন কি তোদের আছে?”

এই অবস্থায় নেতাজি ১৯৪১ সালের ১৭ ই জানুয়ারি রাতের অন্ধকারে গৃহে অন্তরীণ থাকাকালীন অবস্থাতেই গৃহত্যাগ করে বিদেশে পাড়ি দিলেন, বিদেশী শক্তির সাহায্য নিয়ে ভারতকে স্বাধীন করার উদ্দেশ্যে। রাশিয়া, জার্মান, জাপান সর্বত্র তিনি পরিভ্রমণ করেন এবং সেইসব দেশনায়কদের সাহায্য প্রার্থী হন। তিনি দেখলেন যে জাপান ভারতকে স্বাধীন করার জন্য উৎসুক হয়ে আছে । জাপানের এই বন্ধুত্বমূলক আচরণকে তিনি কাজে লাগিয়ে নিজের কার্যকে সিদ্ধ করার জন্য একে “God given opportunity” হিসেবে ব্যাখ্যা করেন। ১৯৪১-এর ৪ ডিসেম্বর সেখানে গঠন করা হয় ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি। এই জাতীয় বাহিনীর নেতৃত্ব দেওয়া হলো রাসবিহারী বসুর উপর। ১৯৪৩ এর জুনে জার্মানি ও ইটালির সাফল্যে উল্লসিত হয়ে ভারতীয় জাতীয় বাহিনীর নামকরণ করেন। “আজাদ হিন্দ ফৌজ” নামে এবং উদাত্ত কণ্ঠে ডাক দিলেন “দিল্লি চলো”। তিনি ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’কে নিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে মনিপুর পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে সেখানে ভারতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। এই ঘটনায় ভারতবর্ষের মধ্যে এক প্রবল উল্লাস নেতাজিকে ঘিরে দেখা যায়। কিন্তু এই প্রচেষ্টা সফলতা পেল না। সুভাষের এই অভিযান সফলতা না পেলেও আমরা বলতে পারি যে, সুভাষচন্দ্র যুদ্ধ চলাকালীন অবস্থায় ব্রিটেনের বিপক্ষে সুযোগ নিয়ে ব্রিটিশ বিরোধী দেশ প্রথমে জার্মানি এবং পরে জাপানের সহায়তায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে চরম আঘাত হানতে চেয়েছিলেন,যার ফলেই এলো স্বাধীনতা। আমাদের এই বক্তব্যের সত্যতা যাচাই হয়ে যায় ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের লেখাতে। ব্রিটিশদের কাছ থেকে যার হাত দিয়ে ভারতবর্ষের ক্ষমতা হস্তান্তর হয়েছিল তিনি ছিলেন তদানীন্তন ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী লর্ড এ্যাটলী। ১৯৫৬ সালে কলকাতার রাজভবনে বসেই তখনকার অস্থায়ী রাজ্যপাল এবং কলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি ফনীভূষণ চক্রবর্তীর সঙ্গে কথোপকথনে এ কথা জানা যায়। ফনীভূষণ চক্রবর্তী প্রশ্ন করেছিলেন, ১৯৪৭ সালে কেন ব্রিটিশ তাড়াহুড়ো করে ভারত ছেড়ে চলে গেল, যদিও সে সময়ে ভারতে তেমন কোনো অশান্তির পরিবেশ ছিল না। রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন, “In reply Atlee cited several reasons, the most important of which were the activities of Netaji Subhash Chandra Bose which weakened the very foundation of the attachment of the Indian land moral forces to the British Government. Towards the end I asked Lord Atlee about the extent to which the British dicision to quit India was influenced by Gandhiji’s activities. On hearing this question Atlee’s lips widened in a smile of disdain and uttered slowly, putting emphasis on each single letter — mi–ni–mal”

স্বাধীনতা উত্তর ভারতে নেতাজি: ১৯৪৭ সালে ভারত দ্বিখন্ডিত হয়ে, সাম্প্রদায়িক মানসিকতার কাছে মাথা নত করে, সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের সুচতুর নীল নকশার কাছে আত্মসমর্পণ করে স্বাধীনতা (?) লাভ করল। প্রথমেই যে প্রশ্ন উঠেছিল অর্থাৎ স্বাধীনতার সময় যদি নেতাজি গান্ধীর পাশে থাকতেন তবে হয়তো এই দ্বিখন্ডিত স্বাধীনতা আমাদের দেখতে হতো না— কিন্তু কেন যে তিনি গান্ধীজীর পাশে থাকতে পারলেন না তা আমাদের আগের আলোচনাতে স্পষ্ট হয়ে গেছে। নেতাজির অন্তরে দেশের জন্য যে গভীর আত্মত্যাগের ইচ্ছা ছিল এবং কার্যত যে তাঁকে শেষ পর্যন্ত প্রাণত্যাগ করতে হয়েছিল (?) তা আমরা জানি। তাই তিনি বলেছিলেন, “দেশবাসীর পক্ষ হইতে লোক চক্ষুর অন্তরালে তিলে তিলে জীবন দিয়া প্রায়শ্চিত্ত করিয়া যাইব। তারপর মাথার উপর যদি ভগবান থাকেন, পৃথিবীতে যদি সত্যের প্রতিষ্ঠা হয়, তবে আমার হৃদয়ের কথা দেশবাসী একদিন না একদিন বুঝবেনই”।

শুধু ভারতবর্ষ নয়, সমগ্র বিশ্ববাসীর কাছে তিনি স্বাধীনতার জাতীয় আন্দোলনের যে বিকল্প নেতৃত্বের পথ দেখিয়েছিলেন তা বিশ্ববাসীকে শুধু মুগ্ধই করেনি; তার ভাবনা, আদর্শ, আত্মত্যাগের মহান দৃষ্টান্ত এখনো আমাদের উজ্জীবিত করে। স্বাধীনতা উত্তর ভারতবর্ষে তিনি আরো ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছেন। আমাদের বুঝতে হবে যে, “ভারতবর্ষের ইতিহাসে নেতাজি একটি বিচ্ছিন্ন পুরুষ নন। তাঁর ক্রিয়াকাণ্ড কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। নেতাজি ভারতীয় ঐতিহ্যেরই সার্থক অবদান। বাংলার ভূমিতে শ্রীচৈতন্যের কাল থেকে যে রেনেসাঁর সূত্রপাত তাকে একদা রামমোহন ,রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, নিবেদিতা, বিদ্যাসাগর, মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র, দীনবন্ধু, গিরিশচন্দ্র, অরবিন্দ, বিপিনচন্দ্র, সুরেন্দ্রনাথ, জগদীশচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, প্রফুল্লচন্দ্র, ব্রজেন্দ্র নাথ, দেশবন্ধু, শরৎচন্দ্র, অবনীন্দ্রনাথ, নজরুল প্রমুখ কালজয়ী প্রতিভাধর মানববৃন্দ এবং যতীন্দ্রনাথ, সূর্যসেন ও শৌর্যবান শহিদ গোষ্ঠী প্রচন্ড প্রবাহে প্রবাহিত— তারই মহান সৃষ্টি এই নেতাজি সুভাষ চন্দ্র”।

প্রকৃতপক্ষেই তিনি কোন অনৈতিহাসিক ও আকস্মিক এক ব্যক্তি নন। তিনি তো জাতীয় সংগ্রামের প্রতিটি ধাপ পেরিয়ে আসা একজন ঐতিহাসিক পুরুষ ও নেতা। তিনি বিশ্ব স্বীকৃত সর্বজন শ্রদ্ধেয় বীর, রাজনৈতিক সংগঠক ও একজন প্রকৃত জাতির স্রষ্টা পুরুষ। তিনি শুধু ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতীক নন, তিনি সমগ্র নিপীড়িত এশিয়ার মানুষের মুক্তি সংগ্রামের প্রতীক। এক আন্তর্জাতিক বিপ্লবের ভিত্তিভূমি রচিত হয় তাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজের মধ্য দিয়েই— একে অস্বীকার করা যায় না। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক মাইকেল এডওয়ার্ডস তাই বলেন যে, ভারতের স্বাধীনতার জন্য ভারতবাসী নেতাজি বসুর নিকট সর্বাধিক ঋণী, যদিও আপাত দৃষ্টিতে তাকে ব্যর্থ বলে মনে হয়। তিনি ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি যার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল দ্ব্যর্থহীন ও বস্তুনিষ্ঠ। সুভাষচন্দ্র প্রাণ প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ কর্মদ্যোগেরর প্রতীক।

কালোত্তরে নেতাজি: কালোত্তীর্ণ এই বিশ্ব বরেণ্য মহান বিপ্লবী, সংগঠক ও জননেতার প্রাসঙ্গিকতা বর্তমান জাতি-বর্ণ-লাঞ্ছিত, সাম্প্রদায়িক মানসিকতার ঘন অন্ধকারে আচ্ছাদিত, অনৈতিকতা ও অর্থলোলুপতায় জীর্ণ, সামাজিক নীতিহীনতায় দীর্ণ, রাজনৈতিক দিশাহীনতায় আকীর্ণ ভারতবর্ষের যুব সমাজের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির নির্ভেজাল দূরদর্শিতাই তাঁকে আমাদের বর্তমান ভারতে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে। এই কারণে এই ধর্মের ভেদাভেদ অতিক্রম করে তিনি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং এই কারণেই বর্তমান বিভাজনের এই দুঃসহ সময়ে ও দুনিয়াতে নেতাজির সমন্বয়ের আদর্শ অত্যন্ত জরুরী। এই সমন্বয়ই পারে ভারতবর্ষকে রক্ষা করতে, শুধু তাই নয়, আজ যুবশক্তিকে ভিন্ন পথে, বলা ভালো, বিপথে চালনা করছেন রাজনৈতিক নেতারা তাদের কার্যসিদ্ধির জন্য। তারাই যুবসমাজকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন সাময়িক কিছুর প্রলোভন দেখিয়ে নিজেদের ব্যক্তিগত ও দলের স্বার্থে। এই যুব সমাজকে নষ্ট করে দিতে পারলে তাদেরই লাভ। এরা আর তখন প্রশ্ন করবে না। শাসকদেরও কোন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে না। এই যুবসমাজের যে তেজ ও সাহস তা সঞ্চয় করতে হবে নেতাজির জীবন আদর্শ ও সংগ্রামী যে প্রতিজ্ঞা– সেখান থেকেই। এখানে নেতাজি কালোত্তরেও যুব সম্প্রদায়ের শুধু নয় সমগ্র জাতির প্রেরণার একমাত্র উৎস স্থল। এর সাথে যুক্ত করতে হবে একসাথে পথ চলার সাথীর প্রতি সহমর্মিতা যা নেতাজির নেতৃত্বের এক প্রধান ও মৌলিক বৈশিষ্ট্য ছিল।

ভারতবর্ষ আজও জাতিভেদ প্রথা, সাম্প্রদায়িকতা, লিঙ্গবৈষম্য, অশিক্ষা প্রভৃতি দুষ্ট ক্ষতে জর্জরিত। এই ভেদাভেদের বিরুদ্ধে ছিলেন নেতাজি। ভারতবর্ষে হিন্দু মুসলমানের সাম্প্রদায়িক অনৈক্যের জন্য ইংরেজকে দায়ী করা হয়। বস্তুত আমাদের নিজেদের মধ্যেই ছিল অনৈক্যের এক চোরাস্রোত– তাকে অস্বীকার করা যায় না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আত্মসমালোচনা করে লিখেছিলেন, “আজ আমরা সকলেই এই কথা বলিয়া আক্ষেপ করিতেছি যে ইংরেজ মুসলমানকে যে, হিন্দুর বিরুদ্ধে উত্তেজিত করিয়া দিতেছে, মুসলমানকে যে হিন্দুর বিরুদ্ধে লাগানো যাইতে পারে এই তথ্যটাই ভাবিয়া দেখার বিষয়। কে লাগাইল সেটা ততো গুরুতর বিষয় নয়। শনি ছিদ্র না পাইলে প্রবেশ করিতে পারেনা। অতএব শনির চেয়ে ছিদ্র সম্বন্ধেই সাবধান হইতে হইবে।”

এই একই সুর ধ্বনিত হয় সুভাষচন্দ্রের কন্ঠে । তিনি হিন্দু মুসলমান সমস্যাকে ধর্মের ভিত্তিতে নয়, অর্থনৈতিক প্রেক্ষিতেই ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন। তিনি মনে করতেন একজন মুসলমান কৃষক এবং একজন হিন্দু ও মুসলমান জমিদারের মধ্যে যতটা মিল ছিল তার চেয়ে ঢের বেশি মিল ছিল একজন মুসলমান কৃষক ও একজন হিন্দু কৃষকের মধ্যে। তিনি আজীবন হিন্দু মুসলমানের সাম্প্রদায়িক ঐক্যের উপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। এর সাথে সাথেই ভারতীয় জনগণের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য, সামাজিক বৈষম্য, লিঙ্গ বৈষম্যের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার। এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই ছিল অবিসংবাদিত। এক জাতি-বর্ণ, লিঙ্গ ও সম্প্রদায় ভিত্তিক বৈষম্যহীন সমাজ ও রাষ্ট্রের স্বপ্ন তিনি আমাদের দেখিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এখনো সেই স্বপ্নের সফল রূপায়ণ আমাদের দেশে হয়নি। যতদিন পর্যন্ত এই বৈষম্যের বিষে জর্জরিত সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা থাকবে ততদিন পর্যন্ত নেতাজি কালোত্তরেও আমাদের কাছে ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক থাকবেন। এই প্রাসঙ্গিকতাকে অস্বীকার করা যায় না।

যুগান্তরে এসে আমরা এ কথা অনায়াসেই বলতে পারি যে নেতাজি শুধু তাঁর সময়কালেই নয়, কালোত্তরেও এখন আরো প্রবল ভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছেন বর্তমান ভারতের ক্ষেত্রে। তাই সব শেষে এ কথাই বলব যে তিনি নতুন যৌবনের কাছে যে জাগরণী মন্ত্র দিয়ে গিয়েছিলেন—- তাকে আশ্রয় করেই আমাদের এগোতে হবে— এর কোন বিকল্প পথ এখনো তৈরি হয়নি।

ঋণ স্বীকার:
১.আশিষ কুমার মুখোপাধ্যায়, স্বাধীনতার রূপকার নেতাজি সুভাষ।
২. C.. Mukhopadhyay & K.C.Pal, Main Currents of Social and Political Thought in India.
৩.Dr. A.K.Sutar, (ed), Indian Political Tradition.
৪. Sisir k. Bose, Netaji Subhash Chandra Bose
৫.R.C.Majumdar, History of Freedom Movement, Volume-3
৬. সত্যব্রত চক্রবর্তী (সম্পা), ভারতবর্ষ: রাষ্ট্র ভাবনা
৭. S.C Bose, Fundamental Question of Indian Revolution.
৮. পশ্চিমবঙ্গ পত্রিকা,১৯৯৫