গণতন্ত্র ফিরে আসুক

রাষ্ট্রভাষা বাংলা থেকে বাংলা ভাষার রাষ্ট্র চাই দাবিকে সামনে রেখে বহু রক্ত ও অসীম সাহসে ভরা লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় বাংলাদেশ রাষ্ট্র। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টি। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় জন্ম নিল এক স্বাধীন রাষ্ট্র। পৃথিবীর ইতিহাসে বাংলাদেশ এমনই এক বিরল ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী।

বিগত এক দশকে বাংলাদেশে গণতন্ত্র হরণ করা হয়েছে সর্বস্তরে। মুজিব কন্যা শেখ হাসিনা এর জন্য দায়ী। আজকের বাংলাদেশের এমন ভয়াবহ পরিণতির নেপথ্যে মূল চালিকাশক্তিই হল ছাত্র-যুব সহ সাধারণ মানুষের হাসিনা-বিরোধিতা। শাসক শ্রেণির অবাধ দুর্নীতি, বিপুল মূল্যবৃদ্ধি আর বেকারত্বের চরম জ্বালায় ভুগতে থাকা তরুণ প্রজন্মের ক্ষোভ ঘৃণা হয়ে ঝরে পড়েছিল বাংলাদেশের বুকে। সরকারি অফিসে আগুন জ্বালানো, মন্ত্রী-নেতা-আমলাদের বাসস্থানে হামলা, আইন নিজেদের হাতে তুলে নেওয়ার পরবর্তী ফল হল দু’শোর অধিক ব্যক্তির প্রাণহানি। চাকরিতে সংরক্ষণজনিত রায় বা আন্দোলনকারী ছাত্রদের প্রতি হাসিনার ‘রাজাকার’ মন্তব্য বা পুলিশ ও গুলি দিয়ে বিক্ষোভ মোকাবিলা করার রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা বিগত এক-দেড় মাস ধরে সংগঠিত আন্দোলনে ঘৃতাহুতি দিয়েছে। দেশব্যাপী প্রসারিত এই বিক্ষোভের ক্ষেত্র হাসিনা নিজেই তাঁর কর্মপদ্ধতির মধ্য দিয়ে প্রস্তুত করে দিয়েছিলেন। সামগ্রিক ঘটনার অভিঘাত এ সত্যই প্রতিষ্ঠিত করেছে।

এই বিক্ষোভ-আন্দোলনের মাত্র কয়েক মাস আগেই বিপুল গরিষ্ঠতায় জয়ী হয়ে সরকার গড়েন শেখ হাসিনা। নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বিকৃত করে কারচুপির মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে হাসিনা। কতটা জনবিচ্ছিন্ন হলে, সাধারণ মানুষের দ্বারা কতটা ঘৃণিত হলে মাত্র এক-দেড় মাসের একটা আন্দোলনকে মোকাবিলা করতে না পেরে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন একজন রাষ্ট্রপ্রধান তা দেখা গেল বাংলাদেশে। অথচ এই রাষ্ট্রপ্রধান সরাসরি ঐতিহাসিক গণ আন্দোলনের মূল নায়ক এবং একই সঙ্গে সেই লড়াইয়ের ফলে সৃষ্ট স্বাধীন রাষ্ট্রের স্থপতির প্রথম প্রজন্ম।


কিন্তু এরপর যা হলো বা এখনও পর্যন্ত যা হচ্ছে, তা কোনও সুস্থ, সভ্য সমাজে, বিশেষত এমন গৌরবময় ইতিহাসের উত্তরাধিকার অর্জনকারী কোনও রাষ্ট্রে কল্পনা করা যায় না। এই বাংলাদেশের মাটিই রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারের রক্তে ভেজা মুক্তিযুদ্ধের লড়াই থেকে ২০১৩ সালের শাহবাগের গণজাগরণ যেমন দেখেছে আবার এ সত্যও অনস্বীকার্য গত জুন মাস থেকে সংগঠিত কোটা বিরোধী আন্দোলনের সূত্রধরও। শত শত রক্তস্নাত ছাত্র যারা স্বৈরাচারী শাসকের দুর্বিনীত ঔদ্ধত্যকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে মুক্তির স্বাদ অর্জন করতে চেয়েছিল। কিন্তু হাসিনার পদত্যাগের পরবর্তী বাংলাদেশের তাৎক্ষণিক ছবি প্রমাণ করছে যে কোনও প্রগতিশীল বা গণতন্ত্র অভিমুখী শক্তি নয়, দেশজোড়া দখল নিয়েছে এক লুম্পেন, সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী শক্তি। রাষ্ট্রের জনকের মূর্তির মূর্তির গলায় জুতোর মালা পরানো থেকে উন্মত্ত জনতার মূর্তি ভেঙে উল্লাস, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন থেকে প্রধান বিচারপতির বাসভবন লুঠ, বঙ্গবন্ধুর আবাসস্থলে তাঁর নামাঙ্কিত সংগ্রহশালা পুড়িয়ে দেওয়া, অভিনেতা-প্রযোজকদের পরিবার সহ অগণিত মানুষকে প্রকাশ্য হতা, বহু প্রগতিশীল অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর বর্বরোচিত আক্রমণের যেসব খবর সামনে এসেছে, তা নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে স্বৈরাচারী হাসিনাকে উৎখাতের অছিলায় আগামীর বাংলাদেশ এক গভীর খাদে ডুব দিয়েছে।

গণতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষতার যে রেশটুকু হাসিনা জমানায় অবশিষ্ট ছিল, তাও খসে পড়েছে সংগঠিত সামগ্রিক ঘটনাপ্রবাহে। যে চূড়ান্ত নৈরাজ্যের এক ভয়াবহ ধারাবাহিক চিত্রপট ইতিমধ্যে প্রকাশিত, তা আমাদের স্বাভাবিক বুদ্ধি, বিবেক ও চেতনাকে প্রতি মুহূর্তে আক্রান্ত করে তুলেছে। বাঙালি হিসাবে আমাদের দায়িত্ব উভয় দেশের সংখ্যালঘু সহ সাধারণ মানুষ যেন নিশ্চিন্তে তাদের জীবন-জীবিকা রক্ষা করতে সমর্থ হয়, সেই পরিবেশকে সুনিশ্চিত করা। বাংলা ও বাঙালির গর্বের বাংলাদেশে গণতন্ত্র, স্বাধীনতা আর অসাম্প্রদায়িকতা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হোক স্বমহিমায়। রবীন্দ্র-নজরুলের বাংলাদেশে শান্তির বাতাবরণ তৈরি হোক।