মানব সেবায় নিবেদিত প্রয়াত সমাজকর্মী শোভনা রানাডে

সমাজকর্মী শোভনা রানাডে। ফাইল চিত্র

ড. বিমলকুমার শীট

সমাজে এমন মানুষ রয়ে‍ছেন যারা নিজের কথা কখনও ভাবেন না। পরহিতে নিজেকে উৎস্বর্গ করেন। পরের জন্য তাঁদের অন্তরাত্মা কেঁদে ওঠে। এমনই একজন ব্যক্তি হলেন প্রবীণ গান্ধীবাদী শোভনা রানাডে। যিনি নারীর ক্ষমতায়ন, উন্নয়ন এবং শিক্ষা নিশ্চিত করতে অন্যান্য সমাজকর্মী অমলপ্রভা দাস, শকুন্তলা চৌধুরী, চিত্রা জয়ন্ত নায়েক, শালিনা মোঘের ন্যায় তাঁর জীবন ও শক্তি উৎসর্গ করেছেন। ৪ আগষ্ট ২০২৪ সালে তিনি বার্ধক্যজনিত কারণে ৯৯ বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছেন। প্রায় অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে নারী ও শিশুদের উন্নতির জন্য নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। দুর্ভাগ্যের ব্যাপার শোভনা রানাডের সংবাদটি পশ্চিমবাংলার কোন সংবাদপত্রে জায়গা পায়নি। নিঃশব্দে তিনি চলে গেলেন।

শোভনা রানাডে ২৪ অক্টোবর ১৯২৪ সালে পুনাতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জীবনে একটি ঘটনা জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তাঁর বয়স যখন ১৮ বছর তখন ১৯৪২ সালে গেলেন বোম্বের ঐতিহাসিক আগা খান প্রাসাদে। সেখানে তিনি এক বৈঠকে গান্ধীজীর সঙ্গে মিলিত হন। এখানে তিনি গান্ধীজীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে, সুবিধাবঞ্চিত, বিশেষ করে নারী ও শিশুদের সেবায় তাঁর জীবন উৎসর্গ করেন। স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে যোগ দেন। তিনি বিনোবাভাবের (১৮৯৫-১৯৮২) দ্বারাও প্রভাবিত হয়েছিলেন। বিনোবাভাবে তাঁকে শোভনিয়া বলে ডাকতেন। ১৯৫৫ সালে বিনোবাভাবে আসামের লখিমপুরে পদযাত্রা শুরু করলে শোভনা রানাডে তাতে অংশ গ্রহণ করেন। সেখানে তিনি প্রথম মৈত্রী বৈদিক ভিলেজ ও শিশু নিকেতন প্রতিষ্ঠা করেন। উত্ত্র-পূর্ব ভারতে নাগা মহিলাদের ক্ষমতায়নের জন্য, তিনি আদিম জাতি সেবাসংঘের মাধ্যমে তাঁদের চরকা শেখানোর ও বুননের জন্য একটি কর্মসূচী চালু করেন। কোহিমাতে খাদি ভাণ্ডার গড়ে তুলেছিলেন। সমাজসেবার কাজে প্রত্যন্ত গ্রামে বাস করেছেন। ১৯৭৯ সালে শোভনা রানাডে পুনায় ফিরে আসেন। এখানে তিনি গান্ধী ন্যাশনাল মেমোরিয়াল সোসাইটি এবং আগা খান প্রাসাদে একটি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেন। নিঃস্ব মহিলাদের বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য ১৯৯৮ সালে তিনি কস্তুরবা মহিলা খাদি গ্রামোদ্যোগ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি পুনার পুরন্দর তালুক সাসওয়াদে বালগ্রাম এবং বালসদন শিশুকল্যাণ প্রকল্পগুলি শুরু করেন। এখানে ৬০ জন অসহায় মেয়ে আশ্রয় পেয়েছে। ১১ একর জায়গা জুড়ে ছিল এই আশ্রম। এর মধ্যে ৫ একর জায়গা আশ্রমের বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হত। বাকি ৬ একর জায়গায় চাষবাস হত।


এই আশ্রমে বেকারি ইউনিট, কৃষিকাজ প্রভৃতির মাধ্যমে নারীদের ক্ষমতায়ন করা হয়। এছাড়া ২০টি বেশী গ্রামীণ শিল্প, বাণিজ্য এবং বৃত্তিমূলক শিক্ষায় দক্ষতা বৃদ্ধি করা হয়। যেমন প্রশিক্ষিত করা হয় সেলাই, ময়দা তৈরি, খাদ্য সামগ্রী প্রক্রিয়াকরণ, গহনা তৈরি প্রভৃতির ক্ষেত্রে। শোভনা রানাডের প্রতিষ্ঠিত পুনার শিবাজিনগরে অবস্থিত হারমান গেইনার সোশ্যাল সেন্টার পথ শিশুদের শিক্ষা, পুষ্টিকর খাবার, স্বাস্থ্যসেবা, কাউন্সিলিং এবং পুনর্বাসন প্রদান করে। প্রায় ৬০ জন শিশু যারা অপরিষ্কার, অনিয়ন্ত্রিত, অপুষ্টি এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে আসক্তিপ্রবণ ছিল তাদের প্রাথমিক ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি শেখানো হয়। তাঁদের প্রত্যেককে জিনিসপত্র রাখার জন্য এক সেট লকার সরবরাহ করা হয়। তিনি পাভনারে নারী জাগরণের আহ্বায়ক হিসাবে এবং মহারাষ্ট্রে ‘ভূদান’ ‘গ্রামদান’ বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

শোভনা রানাডে মহারাষ্ট্রে এসওএস চিলড্রেন্স ভিলেজ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এটি এখন ১৬০০ জন অনাথ শিশুকে আশ্রয় দিয়েছে। মহারাষ্ট্রে ৩টি এসওএস গ্রাম রয়েছে পুনা, লাতুর ও আলিবাগে। প্রথম বালসদন শুরু হয় বিনোবাভাবের পৈতৃক গ্রামে রায়গড়ের গাগোদাতে। এসওএস ভিলেজ বালগ্রামে একজন মাকে দশ জন শিশুর একটি দলের সামগ্রিক বিকাশের যত্ন নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়। নারী ও শিশুদের শিক্ষা ও সামাজিক কল্যাণের জন্য পুনাতে মার্গারেট কাজিন্স যে সর্ব ভারতীয় মহিলা সম্মেলন (AIWC) প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন, শোভনা রানাডে তাঁর সভাপতি (১৯৯১-১৯৯৫) পদ অলংকৃত করেছিলেন। তাছাড়া সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে নদীর দূষণও বাড়ছিল, তাই শোভনা রানাডে গঙ্গা বাঁচাও অভিযানে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন এবং গঙ্গা নদীকে দূষণ থেকে বাঁচাতে আন্দোলন করেন। তিনি রাজস্থানে ১০০০টিরও বেশী গ্রামে ৮০০০টিরও বেশী জলের ট্যাঙ্ক তৈরি করতে সাহায্য করেছিলেন।

শোভনা রানাডে বিরামহীন মানবসেবার জন্য ভারত সরকার ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাঁকে ‘পদ্মভূষণ’ পুরস্কার, জামুনালাল বাজাজ পুরস্কার, রাজীব গান্ধী মানবসেবা পুরস্কার, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পুরস্কার, শিশুকল্যাণ কাজের জন্য জাতীয় পুরস্কার, গান্ধী সম্মান পুরস্কার (মধ্যপ্রদেশ), অহল্যাবাঈ হোলকার পুরস্কার (মহারাষ্ট্র) প্রভৃতি অসংখ্য মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারে ভূষিত করেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তিনি গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। শোভনা রানাডে প্রতিটি সেবিকাকে ব্যক্তিগতভাবে পরামর্শ দেতেন, তিনি নিজে প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে তাঁদের সাথে দেখা করতেন, তাঁদের সাথে থাকেন এবং তাঁদের মানসিক সমর্থন দিয়ে আর গান্ধীবাদী দর্শনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য পথ দেখাতেন।

শোভনা রানাডের জীবন ও কাজ অনুপ্রেরণা হিসাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করবে। তিনি ছিলেন আধুনিক ভারতের একজন স্থপতি এবং সামাজিক কাজের প্রতিষ্ঠানের একজন নির্মাতা। গান্ধীবাদী নীতির প্রতি তার অটল অঙ্গীকার এবং সমাজ কল্যাণের জন্য তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টা মানব ইতিহাসে চিরকাল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।