স্নেহাশিস সুর
চার লক্ষ চল্লিশ হাজার পাঁচশো পঁচানব্বই কোটি টাকার নতুন বিনিয়োগের অঙ্গীকার নিয়ে শেষ হলো এবারে রাজ্য সরকার আয়োজিত দুদিনের অষ্টম বিশ্ব বাণিজ্য সম্মেলন। আর সবকটা বিশ্ব বাণিজ্য সম্মেলন মেলালে রাজ্যে বিনিয়োগের প্রস্তাব এসেছে প্রায় নব্বই লক্ষ কোটি টাকার। এর থেকে তেরো লক্ষ কোটি টাকার বিনিয়োগ ইতিমধ্যেই রূপায়িত হয়েছে। আরও ছয় লক্ষ কোটি টাকার বিনিয়োগ রূপায়নের কাজ এখনও চলছে। এবারের সম্মেলনে বিনিয়োগের অঙ্গীকারের পরিমান আগের সবকটা সম্মেলনকে ছাড়িয়ে গেছে। স্বাভাবিকভাবে এর মূল কান্ডারী মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখে দিনের শেষে তৃপ্তির একটা বহি:প্রকাশ।
মুখ্যমন্ত্রীর ভাষণে তাঁর গলায় স্বস্তির আভাষ পাওয়া গেল যখন তিনি ঘোষণা করলেন রাজ্যে এক কোটি বাহাত্তর লক্ষ মানুষ দারিদ্র সীমার ওপরে উথতে সক্ষম হয়েছে। এটা তাঁর সরকারের একটা বড় সাফল্য বলে তিনি মনে করেন। সমাপ্তি ভাষণে তাঁর বক্তব্য ছিল শুধু শিল্পের কথা বলললে হবে না সাধারণ মানুষের কল্যাণ হচ্ছে কিনা সেটা দেখা খুব জরুরি। তিনি বলেন রাজ্যে নতুন বিনিয়োগ প্রকল্পে এক কোটি তিরিশ লক্ষ মানুষের কাজের সংস্থান হবে। সেইসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা রাজ্যে বেকারের সংখ্যা কমছে।
সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা ছিল উত্তর চব্বিশ পরগনার অশোক নগরে ভূগর্ভস্থ খনিজ তেল উত্তোলনের জন্য অয়েল অয়ান্ড ন্যাচারাল গ্যাস কর্পোরেশন (ওএনজিসি) কে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে পনেরো একর জমি বরাদ্দের ঘোষণা। এটা নি:সন্দেহে ঐ এলাকার স্থানীয় অর্থনীতিকে চাঙ্গা করবে। রাজ্যেরও লাভ হবে।
সম্মেলনের প্রথম দিন যদি হয় বৃহৎ শিল্পপতিদের তাহলে দ্বিতীয় দিন অবশ্যই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের। সম্মেলনের সমাপ্তি অধিবেশনে শিল্পের যে আলাদা আলাদা ক্ষেত্র ভাগ করে আলোচনা হয়েছে তার কি ফল হল তা তুলে ধরেন প্রতিটি ক্ষেত্রের কো-চেয়ারম্যানরা। আর রাজ্যের বরিষ্ঠ আধিকারিকরা প্রতিটি ক্ষেত্রের চেয়ারম্যান হলেও কো চেয়ারম্যান হয়েছেন সেই ক্ষেত্রের একজন ধিল্পপতি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিনিয়োগের সম্ভাবনার উল্লেখ ছিল ক্ষেত্র ওয়াড়ি প্রতিবেদনে।
একান্ত আলাপচারিতায় মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে ছিল কলকাতায় এখন হয়েছে বড় সম্মেলন এবং মেলা বা প্রদর্শনীর জন্য অত্যাধুনিক পরিকাঠামো। অত্যাধুনিক মানে যথার্থভাবেই সারা পৃথিবীতে যে বিশ্বমানের পরিকাঠামো আছে কলকাতাতেও তাই আছে। আর কলকাতায় এগুলো আছে রাজ্য সরকারের পরিচালনাতেই। আর সকলের যে ধারণা হয় যে সরকার তৈরি করলেও তার রক্ষণাবেক্ষণ ঠিকমত হয় না। সেটাও আবার ভুল প্রমাণিত হল।
একদিকে নিউ টাউনের বিশ্ব বাংলা কনভেনশন সেন্টার। বিশাল বিভিন্ন মাপের অত্যাধুনিক প্রেক্ষাগৃহ। সঙ্গে আনুসঙ্গিক সুযোগ সুবিধের ব্যবস্থা। পাশে বিশ্ব বাংলা এক্সজিবিশন সেন্টার। আরেকটি বিশ্বমানের পরিকাঠামো। এখানে রয়েছে বড় বড় ঘর যেখানে প্রদর্শনী বা অন্য কোন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যায়। এর বাইরেই বাংলার হাট নামে সরকারি সংস্থার পসরা সাজিয়ে বিক্রয় কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে বলে মুখ্যমন্ত্রী এদিনই দিদ্ধান্ত নেন। এখানের একটা বিক্রয় কেন্দ্রে পালটে পালটে বিভিন্ন জেলার কুটির শিল্প সামগ্রি বিক্রির ব্যবস্থা থাকবে। আর এর উল্টোদিকেই ইকো পার্ক। এটি এখন শহরের অন্যতম বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
রয়েছে আলিপুরের ধনধান্য প্রেক্ষাগৃহ। এটাও বিশাল এবং অত্যাধুনিক। তাছাড়া উত্তীর্ণ। সেখানেও এই পরিকাঠামো। আর নতুন দিল্লির হায়দরাবাদ হাউসের মত পরিকাঠামো, যস্র নাম সৌজন্য। যেখানে বিশ্ব নেতারা মিলিত হন সেই ধরণের ব্যবস্থা রয়েছে সৌজন্ন্য-তে।
এছাড়া পার্ক সার্কাসে সাইন্স সিটির উল্টো দিকে বিশ্ব বাংলা মেলা প্রাঙ্গণ। যেখানে যেকোন প্রদর্শনী করার বিশ্ব মানের ব্যবস্থা আছে। দুটো বড় বড় হলের মধ্যে তৈরি করা যায় অসংখ্য স্টল। এবারে বিশ্ব বাণিজ্য সম্মেলন উপলক্ষে এখানে দুটি হলে তৈরি হয়েছে বেশ কিছু প্যাভেলিয়ন। এর একেকটাতে হচ্ছে এক এক বিষয়ের আলোচনা। তবে মাইক্রোফোন থাকলেও নেই কোনও লাউড স্পিকার বক্সের ব্যবস্থা। সকলকে দেওয়া হচ্ছে কর্ডলেস হেডফোন। তাতে হলের নম্বরে গেলেই সেই হলের আলোচনা শোনা যাবে। এতে কোথাও শব্দ দূষণ নেই। হইচই চিৎকার চেঁচামেচি নেই। একসঙ্গে পায়াপাসি অনেক হলে একসঙ্গে সভা চলছে।
শিল্প বাণিজ্য সম্মেলন মানেই আর বড় শিল্প, মাঝারি বা ক্ষুদ্র শিল্প এইসবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। হল বি এর তেরো নম্বর প্যাভেলিয়ানে আলোচনার বিষয়বস্তু ক্রিয়েটিভ ইকনমি। মানে চলচ্চিত্র, ডিজিটাল মিডিয়া, এনিমেশন এইসব শিল্পের সম্ভাবনা। বলছিলেন ফিল্ম ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ার সর্বভারতীয় সভাপতি ফিরদাউসুল হাসান। তিনি জানালেন, ডিজিটাল চলচ্চিত্র নির্মাণ এবং ভিডিও এফেক্টস নির্মাণের যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে এরাজ্যে। পশ্চিমবঙ্গে চলচ্চিত্রের স্যুটিং এর নয়নাভিরাম বহু কেন্দ্র আছে। সেসম্বন্ধে সকলকে অবহিত করা দরকার। পশ্চিমবঙ্গকে সূচনা কেন্দ্র বা অরবেশ দ্বার করে উত্তরপূর্বাঞ্চলেও চলিচ্চিত্রের সম্ভাবনা বাড়তে পারে। তাছাড়া পুরনো চলচ্ছিত্রের কপি নষ্ট হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচানো ও তার পুনর্নির্মাণের জন্য কেন্দ্র হওয়া উচিত এখানে। চলচ্চিত্রের জন্য কর ছাড়ের সুবিধারও প্রস্তাব করেন তিনি। ওটিটির নতুন প্ল্যাটফর্ম তৈরিতে সরকারের সহায়তার দাবি করেন ফিরদাউসুল হাসান। তিনি আরও বলেন চলচ্চিত্র নির্মাণে তরুণ তরুণীদের দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। আরেকটা বিষয় তিনি উত্থাপন করেন তা হল এই পেশায় যারা আসছে তাদের কেরিয়ারের উন্নতি এবং রোজগারের নিশ্চয়তার ব্যবস্থা করা দরকার।
এইরকম শিল্পের প্রতিটি ক্ষেত্রেই আলাদা আলাদা আলোচনা হয়। যা ছিল বিশ্ব বঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনের গুরুত্ব এবং বৈশিষ্ট।