• facebook
  • twitter
Saturday, 20 December, 2025

ভাষার কোনও ধর্ম নেই

বিচারপতিরা আরও বলেছেন, এখনও দেশের সাধারণ মানুষের ব্যবহৃত ভাষা উর্দু শব্দে ভরে আছে। যদিও তাঁরা এ বিষয়ে ততোটা ওয়াকিবহাল নন।

ফাইল চিত্র

‘ভাষা কোনও জনগোষ্ঠী এলাকা, মানুষের হয়। কোনও ধর্মের নয়। ভাষার ধর্ম হয় না। ভাষা কোনও ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করে না।’ স্পষ্ট ভাষায় একথা জানিয়ে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। মহারাষ্ট্রের আকোলা জেলার পাটুর নগর পরিষদে মারাঠি ভাষার সঙ্গে উর্দুর ব্যবহার হয়। উর্দুর ব্যবহার কেন হবে, তাকে চ্যালেঞ্জ করে মামলা দায়ের হয়। সেই মামলা খারিজ করার সময় এই কথাগুলি বলেছে সুপ্রিম কোর্ট। বিচারপতি সুধাংশু ধুলিয়া এবং বিচারপতি কে বিনোদ চন্দ্রন ওই মামলা খারিজ করতে গিয়ে বলেছেন, উর্দু কোনও বিদেশি ভাষা নয়। ভারতের মাটিতেই উর্দুর জন্ম। এদেশেই উর্দুর প্রসার হয়েছে। বিচারপতিরা বলেছন, এটা বলা ভুল হবে না যে, উর্দু শব্দ বা উর্দু থেকে উৎপন্ন শব্দের ব্যবহার ছাড়া হিন্দিতে দিন-প্রতিদিনের কথোপকথনই হতে পারবে না। ‘হিন্দি’ শব্দটাই ফারসি শব্দ ‘হিন্দবী’ থেকে এসেছে। শব্দাবলীর এই আদান-প্রদান উভয় তরফেই হয়। কারণ, উর্দুতেও সংস্কৃত সহ অন্য ভারতীয় ভাষার বেশ কিছু শব্দ রয়েছে।

সঙ্ঘ পরিবার এবং রাজনৈতিক দল হিসাবে বিজেপি অনেক দিন ধরেই উর্দুকে মুসলমানের ভাষা বলে প্রচার করে চলেছে। সেই হিসেবে অন্য সবকিছুর মতোই উর্দুর উপরও আক্রমণ নেমে এসেছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসেই উত্তরপ্রদেশ বিধানসভায় ভাষা নিয়ে এক বিতর্কে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ সমাজবাদী পার্টির বিধায়কদের লক্ষ্য করে বলেছিলেন, ‘আপনারা নিজেদের সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ান আর অন্যদের বাচ্চাদের উর্দু পড়াতে চান। উর্দু পড়ে তারা কি মৌলবী হবে? দেশকে কোথায় নিয়ে যেতে চান?’ মুখ্যমন্ত্রীর ইঙ্গিত নিয়ে সেই সময় তুমুল বিতর্ক হয়। বিরোধী দলনেতা মাতাপ্রসাদ পাণ্ডে জবাবে বলেছিলেন, মুখ্যমন্ত্রী নিজের বক্তৃতাতেও উর্দু শব্দ ব্যবহার করেছেন। আপ সাংসদ সঞ্জয় সিং সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখেন, উর্দুর বিরুদ্ধে ৪ মিনিট ২৮ সেকেন্ড ভাষণের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী যোগী মোট ৯টি উর্দু শব্দ বলেছিলেন। ৯টি শব্দেরও উল্লেখ নির্দিষ্ট করে বলে দেন সঞ্জয় সিং। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের পর্যবেক্ষণেও এই মূল সুরটি উঠে এসেছে। তবে এটা শুধু আদিত্যনাথের একার বিষয় নয়, হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির পুরো কাঠামোরই সুর এটাই যে, উর্দু মুসলমানের ভাষা। সেই দিক থেকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের পর্যবেক্ষণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

Advertisement

সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা বলেছেন, ভাষা, মতামত আদানপ্রদানের একটা মাধ্যম। যা বিভিন্ন ধারণা এবং বিশ্বাসের মানুষকে কাছাকাছি আনে। সেটাকে বিভাজনের কারণ বানানো অনুচিত। আমাদের ভুল ধারণা, কোনও ভাষার প্রতি হয়তো আমাদের কোনও বিরূপ ধারণা আছে, তা সাহস এবং সত্যের উপর দাঁড়িয়ে বাস্তবের সঙ্গে পরখ করতে হবে। আমাদের দেশের মহান বৈচিত্র্য আছে। আমাদের শক্তি কখনও আমাদের দুর্বলতা হতে পারে না। উর্দু এবং প্রতিটি ভাষার সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাতে হবে।

Advertisement

বিচারপতিরা আরও স্পষ্ট করে বলেছেন, উর্দুর প্রতি বিরূপ ধারণা এই থেকে তৈরি হয়েছে যে, উর্দু ভারতের জন্য বিদেশি। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। মারাঠি এবং হিন্দির মতো উর্দুও একটি ইন্দো-আর্য ভাষা। এ এমন এক ভাষা, যার জন্ম এই ভূমিতেই হয়েছে। উর্দু ভারতের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিবেশে যুক্ত লোকেদের প্রয়োজনের কারণেই বিকশিত হয়েছে, প্রসারিত হয়েছে। যাঁরা নিজেদের মধ্যে মতাদর্শের আদান-প্রদান করে মত বিনিময় করতে চাইতেন, তাঁরা সমৃদ্ধ করেছেন ভাষাটিকে। এইভাবেই অনেক প্রশংসিত কবির ভাষা হয়ে উঠেছে উর্দু।

বিচারপতিরা আরও বলেছেন, এখনও দেশের সাধারণ মানুষের ব্যবহৃত ভাষা উর্দু শব্দে ভরে আছে। যদিও তাঁরা এ বিষয়ে ততোটা ওয়াকিবহাল নন। মজার কথা হলো, দেওয়ানি এবং ফৌজদারি আদালতের দুই ধরনের ভাষার ক্ষেত্রেই উর্দু শব্দের গভীর প্রভাব আছে। আদালত থেকে হলফনামা পর্যন্ত ভারতের ভাষায় উর্দুর প্রভাব স্পষ্ট দেখা যায়। দীর্ঘ পর্যবেক্ষণে বিচারপতিরা স্পষ্ট করে বলেছেন, ভাষার কোনও ধর্ম হয় না। ভাষা একটি সংস্কৃতি। ভাষা কোনও সম্প্রদায় ও তার লোকেদের সভ্যতার যাত্রাকে পরিমাপ করার মানদণ্ড। উর্দুও তাই। উর্দু গঙ্গা-যমুনী তহজিব বা হিন্দুস্তানি সংস্কৃতির অসাধারণ উদাহরণ। যা উত্তর এবং মধ্য ভারতের মিশ্র সংস্কৃতির প্রভাব। বিচারপতি সুধাংশু ধুলিয়া রায় দিতে গিয়ে মৌলুদ বেঞ্জাদীর একটি উক্তি দিয়ে শুরু করেন। উক্তিটি হলো, ‘যখন আপনি কোনও ভাষা শেখেন, তখন আপনি একটি নতুন ভাষা বলা এবং লেখাই শেখেন না। আপনি খোলা মনের, উদার, সহিষ্ণু, দয়ালু এবং সমস্ত মানবজাতির প্রতি চিন্তাশীল হতে শেখেন।’

Advertisement