হীরক কর
শেষ নভেম্বর। ভোরবেলা। প্রথম সূর্য গায়ে মাখার কথা। কিন্তু , তেনার দেখা নেই। রুবি, থুড়ি রবি ঠাকুরের মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি। অনতি দূরে আক্রোপলিশ মলের বহুতল দৃষ্টি গোচর হয় না। গাড়ি গুলো চলেছে হেডলাইট আর ফগলাইট জ্বেলে। কুয়াশায় ঢেকেছে শহর। কুয়াশার থেকে ধোঁয়াশাই দখল নিয়েছে প্রাণের শহরের। বাতাসে ধূলিকণা, কার্বন -ডাই-অক্সাইড, জিঙ্ক ঘুরে বেড়াচ্ছে। শ্বাসকষ্টের অব্যার্থ উপকরণ।
কলকাতা শহরের জনসংখ্যা ১৪ মিলিয়নেরও বেশি। ঘন জনসংখ্যা সহ বৃহত্তম ভারতীয় মেট্রোগুলির মধ্যে একটি। ক্রমবর্ধমান বায়ু দূষণ সংকটের কবলে রয়েছে৷ কলকাতা আবার ভারতে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে, দিল্লির পরে। এবং এটি বিশ্বব্যাপী চতুর্থ-সবচেয়ে দূষিত শহর ছিল। খারাপ বাতাস ২০২৪ পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। কলকাতা প্রতি বছর বিপজ্জনকভাবে উচ্চ মাত্রার বায়ু দূষণের বিরুদ্ধে লড়াই করে। বিশেষ করে শীতকালে। যখন বায়ুর গুণমান “খুব অস্বাস্থ্যকর” স্তরে পৌঁছায়। কলকাতায় বর্তমান রিয়েল-টাইম কলকাতা ‘এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স-এর (AQI) এই লেখার সময় স্তর হল ২৬৮। যা অত্যন্ত ‘অস্বাস্থ্যকর’।
সেন্ট্রাল পলিউশন কন্ট্রোল বোর্ডের রিপোর্ট অনুসারে এই নভেম্বরে, শহরের এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স ৪০০ ছাড়িয়েছে। যা বাতাসের গুণমানকে বিপজ্জনক হিসাবে চিহ্নিত করেছে। কলকাতায় প্রতি দুই শিশুর মধ্যে একজন বায়ু দূষণের কারণে কোনো না কোনো ধরনের শ্বাসকষ্টে ভুগছে। বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন যে এমনকি নার্সারিগুলোতেও নবজাতক এবং শিশুরাও বায়ু দূষণের প্রভাব থেকে রেহাই পাচ্ছে না। চিকিৎসকরা বৃহত্তর সচেতনতা, প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ এবং সতর্কতার আহ্বান জানাচ্ছেন।
নভেম্বর মাস শুরু হতেই বাতাসের মান পড়তে থাকে। দূষণ বাড়তে থাকে। অন্য শহরের মতই কলকাতা ও রাজ্যের বিভিন্ন শহরের পরিস্থিতি একই রকম হয়। বৃষ্টি না হওয়া ও বাতাসে গতি না থাকার কারণে ধুলিকনা, গ্যাস ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি চলে আসে। আর এই পরিস্থিতিতে দীপাবলি ও ছট উৎসব ঘিরে দেদার বাজি ফাটানোয় দূষণের মাত্রা আরও বাড়িয়ে তোলে। বায়ূ দূষণের মাত্রা লাফিয়ে বাড়তে থাকলেই সাধারণ মানুষের মধ্যে শারীরিক সমস্যা বাড়তে থাকে। বিশেষ করে যাদের শ্বাসকষ্ট জনিত সমস্যা আছে। পাশাপশি চর্মরোগ। আরও নানা ধরনের সমস্যার মুখে পড়তে হয় মানুষকে।
কলকাতা-সহ দেশের ১০ শহরের বাতাসে বিষ! রাজধানী-সহ দেশের ১০টি বড় শহরের বাতাসের গুণগত মান নিয়ে উদ্বেগ ছড়াল। ভারতের ১০টি গুরুত্বপূর্ণ শহরে বায়ু দূষণের কারণে দৈনিক মৃত্যুর হার ৭ শতাংশের থেকেও বেশি। এই তালিকায় রয়েছে কলকাতাও। ‘দ্য ল্যানসেট প্লেনেটারি হেলথ জার্নালে’র এক সমীক্ষায় এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। সমীক্ষায় দাবি করা হয়েছে, কলকাতা-সহ দেশের ১০ শহরে প্রতি বছর বায়ু দূষণের কারণে ৩৩ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়।
ভারতে বায়ুদূষণ মাত্রা লঙ্ঘিত হয়, এমন শহরগুলোর মধ্যে এক্কেবারে প্রথমে যদি দিল্লির নাম আসে। তাহলে তার পরেই কলকাতার নামও বলতে হয়। তালিকায় আছে পটনাও । দিল্লি, পটনা দুই শহরে দূষণ রুখতে পরিবেশবান্ধব বাজি পর্যন্ত পোড়ানো নিষিদ্ধ করেছে প্রশাসন। যদিও কলকাতায় সে সব উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না। রাজ্যেই কলকাতা ছাড়াও বায়ুদূষণ মাত্রা লঙ্ঘিত হয়, এমন শহরের তালিকায় আছে হাওড়া, দুর্গাপুর, আসানসোল-সহ বেশ কয়েকটি নাম। সম্প্রতি কলকাতা কর্পোরেশনের একাধিক ব্যবস্থা নেওয়ার ফলে কিছুটা হলেও বাতাসে দূষণের পরিমাণ কম থাকছে। তবে ,অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সন্তোষজনক থাকছে না।
পরিবেশ বিষেশজ্ঞদের কথায়, লাগাতার গাছে জল দিয়ে পাতা ধুইয়ে দেওয়া, বাতাসে জল ছিটানো, রাস্তায় জল দেওয়ার ফলে ধূলিকণা, গ্যাস বাতাসে ভূপৃষ্ঠের কাছে সেই অর্থে ভাসমান অবস্থায় থাকছে না। কিন্তু, খেয়াল রাখতে হবে নির্মাণ কাজের দিকে, আর রাস্তায় চলাচল করা যানবাহনে। কারণ, জ্বালানি তেলের ধোঁয়া বাতাসে দূষণের মাত্রা বৃদ্ধি করে। পাশাপশি, এই সময় মাস্ক ব্যবহার জোর দিতে বলা হচ্ছে।
কলকাতা কর্পোরেশনের প্রতি বোরোতে ওয়াটার স্প্রিংকলার গাড়ি আছে, যার মাধ্যমে রাস্তা ধোয়া হয়, মাঠে জল দেওয়া হয়। বিশেষ গাড়ি করে গাছ ধোয়া হচ্ছে। এছাড়াও, জঞ্জাল সাফাই বিভাগের কাছে দুটি মিস্ট ক্যানন আছে, যার মাধ্যমে বাতাসে জলীয় কনা ঝরানো হয়। যাতে বাতাসে ভাসমান ধূলিকণা বেশিক্ষণ বাতাসে থাকতে না পারে।
ভারতের যে ১০টি শহরে বায়ু দূষণের কারণে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে, সেই তালিকায় রয়েছে আহমেদাবাদ, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই, দিল্লি, হায়দরাবাদ, কলকাতা, মুম্বই, পুনে, সিমলা, বারাণসী।’দ্য ল্যানসেট প্লেনেটারি হেলথ জার্নালে’র সমীক্ষায় দাবি করা হয়েছে যে, বায়ু দূষণের কারণে মৃত্যুর নিরিখে ওই ১০ শহরের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে দিল্লি।
সমীক্ষায় জানা গেছে, বায়ু দূষণের কারণে দিল্লিতে বছরে ১২ হাজার জনের মৃত্যু হয়। মুম্বইয়ে এই সংখ্যা ৫ হাজার ১০০। কলকাতায় বছরে বায়ু দূষণের কারণে মৃত্যুর সংখ্যা ৪ হাজার ৭০০। চেন্নাইয়ে ২ হাজার ৯০০, বেঙ্গালুরুতে মৃত্যুর সংখ্যা ২১০০। বারাণসীতে এই সংখ্যা ৮৩০। তালিকায় সবচেয়ে নীচে রয়েছে সিমলা। সেখানে বায়ু দূষণের কারণে বছরে মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে কম। সিমলায় এই সংখ্যা ৫৯।
দিল্লি, প্রতি বছরই ধোঁয়াশায় ঢেকে যায়। বাতাসে দূষণের কারণে প্রতিবছরই নাজেহাল হতে হয় দিল্লিবাসীকে। এমনকী, দিল্লির রাস্তায় ধোঁয়াশার কারণে দৃশ্যমানতাও কমে যায়। বায়ু দূষণের কারণে প্রতি বছরই দিল্লিতে অসুস্থ হয়ে পড়েন অনেকে।
অন্য দিকে, কলকাতার বাতাসেও বিষ ছড়াচ্ছে। কলকাতায় বাতাসের গুণগত মান নিয়েও উদ্বেগ ছড়াচ্ছে। এই সমীক্ষার ফল রীতিমতো উদ্বেগ বাড়িয়েছে। ‘গ্লোবাল এয়ার কোয়ালিটি’র ২০২২ সালের রিপোর্ট অনুসারে , শহরের জনসংখ্যা অনুপাতে কলকাতা ২০১৯ সালে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বাধিক দূষিত শহর ছিল। ২০২৩ সালের নভেম্বরে এবং পুরো শীত জুড়ে, কলকাতার বাতাসের মান বিপজ্জনক এবং অস্বাস্থ্যকর ছিল।
অন্যান্য ভারতীয় শহরগুলোর ক্ষেত্রে যখন বায়ু সমানভাবে দূষিত হয়, এবং কখনও কখনও তার চেয়েও বেশি দূষিত হয় তখন একই জরুরীতার অনুভূতি হারিয়ে যায়। কলকাতা, ১৪ মিলিয়নেরও বেশি জনসংখ্যা নিয়ে ভারতের বৃহত্তম মেট্রোগুলির মধ্যে একটি। এমন একটি শহর যা সাম্প্রতিক সময়ে মারাত্মক বায়ু দূষণের সাথে ভুগছে৷ ২০২৩ সালের শেষের দিকে, দীপাবলির চার দিন আগে ৮ নভেম্বর, কলকাতা দিল্লি এবং পাকিস্তানের লাহোরের পরে বিশ্বব্যাপী তৃতীয়-দূষিত শহর ছিল। তারপরে, ১১ নভেম্বর, দিওয়ালির একদিন আগে, কলকাতার বায়ু সমস্ত ভারতীয় মেট্রোগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দূষিত ছিল বলে জানা গেছে। ১৩ নভেম্বরের মধ্যে, কলকাতা আবার দিল্লির পরে ভারতে দ্বিতীয় স্থানে ছিল এবং এটি বিশ্বব্যাপী চতুর্থ-সবচেয়ে দূষিত শহর ছিল।
‘সুইচন ফাউন্ডেশন’, কলকাতায় অবস্থিত একটি পরিবেশ সংরক্ষণ গোষ্ঠী। তাদের মতে, শহরের গড় এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স্ সাম্প্রতিক সময়ে ওঠানামা করেছে৷ অন্যান্য মান অনুসারে, কলকাতার বাতাসের গুণমান “খুব অস্বাস্থ্যকর”। ইউএস এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন এজেন্সি -র মতে , এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স ০ থেকে ৫০-এর মধ্যে পড়লে বাতাসের গুণমান “ভাল” বলে বিবেচিত হয়। ৫১-১০০-এর এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স “মাঝারি”। ১০১-১৫০ হল ‘‘সংবেদনশীল”। ১৫১-২০০, লাল রঙে উল্লিখিত, “অস্বাস্থ্যকর” হিসাবে বিবেচিত হয়। এবং ২০১-৩০০ “খুব অস্বাস্থ্যকর” হিসাবে এবং ৩০১ বা তার বেশি “বিপজ্জনক” হিসাবে চিহ্নিত হয়।
‘সুইচন ফাউন্ডেশন’-এর ডেটা দেখায় যে জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে কলকাতার বায়ুর গুণমান পুরো সপ্তাহে ১৯৫ থেকে ২৭১-এর মধ্যে ওঠানামা করেছিল । রেটিং-এ অনুসারে এটিকে বেগুনি “খুব অস্বাস্থ্যকর” বিভাগে রাখবে৷
‘ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ’- এ প্রকাশিত ২০২২ সালের একটি সমীক্ষা অনুসারে , উত্তর-পূর্বের বাইরের ভারতীয় শহরগুলোর (যেখানে চিকিৎসা সুবিধার অভাব রয়েছে) ফুসফুসের ক্যান্সারের সর্বোচ্চ হার কলকাতায় রয়েছে। পুরুষদের মধ্যে, দিল্লির ১১ দশমিক ৮, চেন্নাইয়ের ১১.৮ এবং মুম্বাইয়ের ৯.৫-এর তুলনায় কলকাতায় ফুসফুসের ক্যান্সারের হার ২২ শতাংশ ছিল। মহিলাদের জন্য, এটি ছিল ৭দশমিক ০ শতাংশ, যেখানে দিল্লির হার ছিল ৪.০৷ চেন্নাই এবং মুম্বাইতে এই সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৪.৭ এবং ৬.০ শতাংশ ৷
ফুসফুসের ক্যান্সারের ঘটনা শুধু রাজধানী শহর কলকাতাতেই সীমাবদ্ধ নয়। পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত ক্যান্সারের ক্ষেত্রে ফুসফুসের ক্যান্সার প্রায় ১৪ শতাংশ। যা একটি “উদ্বেগজনকভাবে উচ্চ” হার। যা জাতীয় গড় ৬% এর সাথে তুলনীয়।
কাউন্সিলর সুশান্ত ঘোষের ওপর গুলি চালানোর ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, জলাভূমি বুজিয়ে, গাছ কেটে, আমারা নিজেরাই নিজেদের মৃত্যুপুরী তৈরি করছি। পাশের দেশ থেকে লোক ডেকে এনে জনসংখ্যার ঘনত্ব বাড়াচ্ছি। তাদের নষ্টামি করার নাগরিক অধিকার দিচ্ছি। আর তা সকলের অগোচরে তা করে চলেছেন আমাদেরই ভোটে গদিতে বসা শাসকদলের নেতারা। আর আমরা দিনের পর দিন ইভিএম বক্সে প্রতিবাদ না করে, আমাদের ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনিদের ঠেলে দিচ্ছি উদ্বেগজনকভাবে দূষিত এক শহরের দিকে। পরবর্তী প্রজন্ম পায়ে পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে ‘গ্যাস চেম্বার-এর দিকে। হ্যাঁ, ঠিকই ভেবেছেন, ‘ধোঁয়াশার ঘোমটা পরা হিটলারের গ্যাস চেম্বার’।