বিমলকুমার শীট
শান্তিনিকেতনে কবিগুরুর প্রাণের বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেই প্রতিষ্ঠানটিকে দাঁড় করাতে হলে যথেষ্ট অর্থের প্রয়োজন। তাই তিনি সঙ্গীসাথী নিয়ে দেশে বিদেশে বেরিয়ে পড়লেন। এক সময় পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারত এবং প্রতিবেশী দেশ সিংহল হয়ে কবি ত্রিবাঙ্কুরে এলেন ৯ নভেম্বর ১৯২২ সালে। রবীন্দ্র জীবনীকার লিখেছেন, সিংহল পরিভ্রমণান্তর কবি ত্রিবাঙ্কুরে আসিলেন (৯ নভেম্বর)। কবি আসিয়া দেখেন বিরাট জনসংঘ তিরুবন্দরমে তাঁহার প্রতীক্ষায় রহিয়াছে, তিনি সবিনয়ে বলিলেন, ‘সম্মান আমি আপনাদের নিকট চাহি না, আমি চাহি প্রীতি, আমি আপনাদের নিকট আসিয়াছি একজন ব্যক্তি হিসাবে, কোনো বাণী আমার দিবার নাই।’ কিন্তু এ কথা বললেও রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতী সম্বন্ধে তাঁর আদর্শ ব্যাখ্যা করলেন। কুইলন যাবার পথে তিরুবন্তপুরম থেকে ২০ মাইল উত্তরে বরকাল নামক স্থানে কবি নিম্ন সম্প্রদায়ভুক্ত অস্পৃশ্য থিয়া জাতির গুরু শ্রীনারায়ণগুরুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এই সাক্ষাৎ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
উনবিংশ শতকে কেরালা জাতপাত ও অস্পৃশ্যতার কঠিন শৃঙ্খলে এতটাই আবদ্ধ ছিল যে স্বামী বিবেকানন্দ কেরালাকে ভারতের ‘উন্মাদ আশ্রম’ বলে অভিহিত করেছেন। এহেন রাজ্যে শ্রীনারায়ণগুরু (১৮৫৬-১৯২৮) ছিলেন নিম্নসম্প্রদায়ভুক্ত এজহাবা পরিবার ভুক্ত। সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে তিনি ছিলেন একাধারে সন্ত, দার্শনিক ও সংস্কারক। শ্রীনারায়ণগুরু যে অচ্ছুত এজহাবা সম্প্রদায়ে জন্মগ্রহণ করেন সেই সম্প্রদায়ের পোশাক-পরিচ্ছদ, শিক্ষাদীক্ষা, ধর্মচর্চা প্রভৃতি সব বিষয়েই বর্ণহিন্দুদের বিভিন্ন বিধিনিষেধ চেপে বসেছিল। এজহাবারা হিন্দু দেবদেবী মন্দিরে প্রবেশ করতে পারত না, এমনকি এজহাবাদের নিজস্ব মন্দিরেও হিন্দু দেবদেবীর ছবি বা বিগ্রহ রাখা যেত না।
এরকম পরিস্থিতিতে শ্রীনারায়নগুরু কেরালার সর্বত্র ভ্রমণ করে এই জাতি ও বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলেন। তাঁর মুল আদর্শ ছিল ‘এক জাতি, এক ধর্ম এবং এক ঈশ্বর’। এজহারা সম্প্রদায়ের মধ্যে শিক্ষার প্রসার এবং তাদের অন্যান্য সামাজিক বিষয়ের উন্নতির জন্য তিনি সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাঁর উদ্যোগে কেরালার বিভিন্ন স্থানে বেশ কিছু মন্দির, মঠ ও বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সব প্রতিষ্ঠানের দরজা নিম্নবর্ণের মানুষদের জন্য খুলে দেওয়া হয়। মন্দিরগুলিতে উচ্চবর্ণের আরাধ্য দেবদেবীর মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সেগুলির রন্ধনশালায় অস্পৃশ্যদের নিয়োগ করা হয়। ১৯১৬ সাল নাগাদ প্রতিষ্ঠিত ‘কোচিন ইজহাবা সভা’ কোচিনের মহারাজের কাছে এক স্মারকলিপিতে জানায়, ‘আমরা প্রার্থনা করি শুধু সেই সব অধিকার ও সুবিধার জন্য যেগুলি আমরা খ্রিস্টানধর্ম গ্রহণ করলে ভোগ করতে পারি।’ এই সভা ব্রিটিশ সরকারের কাছেও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার জন্য আর্জি জানায়। শ্রীনারায়ণগুরুর এই অসাধারণ পদক্ষেপ ছিল এককথায় এক সমাজিক বিপ্লব যা হাজার বছরের জাতপাতের ভাবনার মূলে কুঠারাঘাতা করেছিল।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থিয়া জাতির গুরু শ্রীনারায়ণগুরুর সহিত সাক্ষাৎ করেন। তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলে কবি তৃপ্ত হন। এই সাধু চরিত্র কিভাবে পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিবর্তন করেছেন তা দেখে কবি আশ্চর্য হলেন। বাংলার কবির সম্মানের জন্য আশ্রমের চারদিকের লোকেরা রাজকীয় সংবর্ধনার আয়োজন করেন। কয়েকটি হাতি সংগৃহীত হয় এবং বিবিধ বাদ্যযন্ত্র সহ শোভাযাত্রা করে কবিকে আশ্রমের শৈল-পাদমূল পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। কবি উপস্থিত হলে শ্রীনারায়ণগুরু তাঁর বাসস্থানের বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন এবং তিনি আশ্রমের সব চেয়ে ভালো কার্পেটখানি কবি যেখানে বসলেন তার পায়ের নীচে বিছিয়ে দিতে নির্দেশ দিলেন। জনতা কবির সঙ্গে গুরুর কথোপকথন শুনবার জন্য ভিড় জমাল। দু-জনেই নমস্কার বিনিময় করে পরস্পরের মুখোমুখি স্তব্ধ হয়ে বসলেন। নীরবতার পর কবি শ্রীনারায়ণগুরুকে তাঁর সামাজিক সেবাকাজের জন্য অভিনন্দিত করলেন।
এর্নাকুলামে ভাষণ দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ এই সাক্ষাৎকারের উল্লেখ করে বলেন, শ্রীনারায়ণগুরু যে আদর্শের জন্য কাজ করেছেন তার সঙ্গে তাঁর নিজের কাজের সাদৃশ্য আছে। এই বিষয়ে মাদ্রাজের Swarajya পত্রিকা লিখেছে— কবির ত্রিবাঙ্কুর ভ্রমণের সম্ভবত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল স্বামী নারায়ণগুরুর বারকালের আশ্রমে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ। তিনি স্বামী নারায়ণগুরুর সাধু সুলভ চরিত্র ও ধর্মীয় সত্য সম্পর্কে গভীর অভিজ্ঞতা দেখে অভিভূত হয়েছিলেন। পাশাপাশি কিভাবে শ্রীনারায়ণগুরুর ধর্মীয় উপদেশ ত্রিবাঙ্কুর, মালাবার ও কোচিনে সাধারণ জনগণকে প্রভাবিত করে অস্পৃশ্যতা দূরীকরণে উদ্বুদ্ধ করেছিল তা দেখে তিনি আপ্লুত হয়েছিলেন। তিনি শ্রীনারায়ণগুরুর আলওয়ের আশ্রমে গিয়েছিলেন এবং সেখানে শিষ্যদের শ্রীনারায়ণগুরু যে মন্ত্রোচ্চারণ শিখিয়েছিলেন তা তাঁর হৃদয়কে গভীরভাবে ছুঁয়ে গিয়েছিল। স্বামীজীর আসাধারণ প্রচেষ্ঠায় সমগ্র ‘থিয়া’ সম্প্রদায় সামাজিক ও আধ্যাত্মিক মানদণ্ডে এক অনন্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বারংবার কবি অস্পৃশ্যতা ও জাতিভেদের কুফলের উল্লেখ করেন এবং সার্বিক ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধের পক্ষে সওয়াল করেন।
শ্রীনারায়ণগুরুর আশ্রম থেকে ফেরার পথে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করেন পি আর রামানুজম। এরপর আলেপ্পির জনসাধারণের অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ সেখানে যান। কোচিনের রাজকীয় অতিথিশালায় জনসাধারণের পক্ষে তাঁকে অভিনন্দন পত্র ও বিশ্বভারতীর সাহায্যে কিছু অর্থ দিয়ে সংবর্ধনা জানানো হয়। এইদিন তিনি আলওয়ে রওনা হয়ে সেখানে পৌঁছান। শ্রীনারায়ণগুরু প্রতিষ্ঠিত অদ্বৈতাশ্রমে তাঁকে সংবর্ধনা জানানো হয়। তারপর টাটাপুরম হয়ে কবি ১৯ নভেম্বর ১৯২২-এ মাদ্রাজে ফিরে আছেন।
মাদ্রাজ ও সিংহলে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ প্রচুর অভ্যর্থনা পেলেও অর্থ প্রচুর পাননি। পেয়েছিলেন বক্তৃতার টিকিট বিক্রির টাকা এবং এককালীন দান সামান্যই পান। মাদ্রাজে কবির বক্তৃতা ও সাক্ষাতের রিপোর্ট যে একেবারে সমালোচিত হননি তা নয়। গান্ধিজীর চরকা সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধ মতপোষণ নিয়ে একদল গান্ধীভক্ত তাঁকে তীব্র আক্রমণ করে। এর আগে ১৯১৯ সালে যখন কবি মাদ্রাজে গিয়েছিলেন, সে সময়ও তিনি হিন্দুদের অন্তর্বিবাহের সমর্থক বলে তখনকার গোঁড়া সমাজের দ্বারা নিন্দিত হয়েছিলেন। আয়ার ও আয়েঙ্গার ব্রাহ্মণরাই তখন সমাজ ও রাজনীতিতে প্রবল ছিল। অবশেষে রবীন্দ্রনাথ এবং শ্রীনারায়ণগুরুর সাক্ষাৎ সমাজকে এই বার্তাই দিয়েছিল যে সমাজে অস্পৃশ্যতার কোন স্থান নেই। মানবতাই হল সমাজের মূল। কবির প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী সেই পথের পথিক।