কণিকা-সুচিত্রা, সুচিত্রা-কণিকা

‘অণিমা’ নাম বদলে ‘কণিকা রেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং। তাঁর কাছেই রবীন্দ্রসংগীত শেখা শুরু। গানের পাশাপাশি রবীন্দ্র-নাটকে অভিনয়। লালমাটির দেশের ‘মোহর’-কে নিজের হাতেই যেন গড়ে-পিটে নিচ্ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯৩৭ সালে কলকাতায় ‘বর্ষামঙ্গল’। সেখানে মোহরও গাইবে। সঙ্গে কলকাতার শিল্পীরা। কলকাতার মতো বড় শহরে প্রথম অনুষ্ঠান। তেরো বছরের মেয়েটির ভয়-ভয় লাগে।

আর, জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে রিহার্সালের সময় সে অবাক হয়ে অবাক হয়ে দেখে কলকাতার মহিলা শিল্পীদের। তাদের গা থেকে ভেসে আসে সেন্টের গন্ধ, বাহারি শাড়ি, পায়ে চটাস-চটাস আওয়াজের নামতা তোলা চপ্পল। আর মোহরের গায়ে শ্রীনিকেতনের আটপৌরে শাড়ি, খালি পা। কেতাদুরস্ত হয়ে ওঠার শিক্ষাটাই যে পায়নি মেয়েটি। এতদিন সে নিজের খেয়ালে গেয়েছে, লালমাটির ভুবনডাঙায় অবাধে ঘুরে বেড়িয়েছে, গুরুদেব ডাকলে ছুটে গেছে, তার খাতায় নিজের হাতে গান লিখে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, গুরুদেবের নির্দেশনায় মেয়েটি অভিনয়ও করেছে। কিন্তু শহুরে আদবকায়দার পাশে সে যে বড়ই বেমানান। তার গায়ে ভুবনডাঙার লালমাটির গন্ধ লেগে। জন্মও বাঁকুড়ায়। সেখানেও লালমাটি।

‘বর্ষামঙ্গলে’ রবীন্দ্রনাথের চেয়ারের হাতল আঁকড়ে মেয়েটি গেয়েছিল, ‘ছায়া ঘনাইছে বনে বনে’। সেই গানে গলা মিলিয়েছিলেন ‘গুরুদেব’ নিজেও। এর তিন বছর পর বোলপুর স্টেশন কেন্দ্রে প্রথমবার রেডিওতে গাইবে সে। বেতার-মারফত তাঁর গান পৌঁছে যাবে অনেকের কাছে। তাঁর পৃথিবীটাও বড় হতে থাকবে ক্রমশ। কলকাতা থেকে শুরু করে ক্রমে গোটা বাংলায়, এমনকি দেশে ছড়িয়ে পড়বে তার নাম। কিন্তু, এতকিছুর পরেও ‘শহুরে’ হওয়া যায় না সহজে। শহুরে মেয়েদের দেখে তাই কুণ্ঠা জাগে।
যেমন লেগেছিল সুচিত্রাকে দেখে। সুচিত্রা মিত্র। তখন রবীন্দ্রনাথ চলে গেছেন সদ্য। চিনা ভবনের সান্ধ্য-আসরে প্রথম সাক্ষাৎ কণিকা-সুচিত্রার। শান্তিনিকেতনে গান শিখতে আসা সুচিত্রা গাইছেন, ‘ওই যে ঝড়ের মেঘে’। ফর্সা, স্মার্ট সুচিত্রাকে আড়চোখে দেখেন কণিকা। তাঁর তামাটে গায়ের রং, সাদামাটা সাজ। যদিও বন্ধুত্ব হতে সময় লাগল না। গানে, গল্পে, রান্নায় কণিকার মন জয় করলেন সুচিত্রা। ‘চিত্রাঙ্গদা’-য় একজন কুরূপা তো আর অন্যজন সুরূপা। আদবকায়দায়, গড়নে, সজ্জায় দুজনে যেন ভিন্ন মেরুর দুই মানুষ। সুচিত্রা আর কণিকার সম্পর্কও বৈপরীত্যে ভরা। টানাপোড়েন, বন্ধুত্ব, ভালোবাসা সেখানে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। আর দুজনের এই বৈপরীত্যের মাঝে সেতু বুনেছেন রবীন্দ্রনাথ।


দুজনের রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখার ঘরানাও আলাদা। সুচিত্রা গড়ে উঠেছেন শান্তিদেব ঘোষের ছত্রছায়ায় আর কণিকা সেখানে শৈলজারঞ্জন মজুমদারের ঘরানা ধরেই হেঁটেছেন মূলত। যদিও শান্তিদেব ঘোষও তাঁর শিক্ষক। তাঁর সম্পর্কে লিখতে গিয়ে শ্রদ্ধায় নুয়ে আসে কণিকার কলম। কিন্তু সেখানে শ্রদ্ধার মধ্যেও যেন মিশে একটা ভয়ের দূরত্ব। “কোমলে, কঠোরে গড়া মানুষ শান্তিদেব ঘোষ। তিনি একসময় আমাকে গান শিখিয়েছেন, সাইকেলের পেছনে চাপিয়ে কখনো পৌঁছে দিয়েছেন গুরুপল্লীতে।… তবে চুপি-চুপি বলি, ছোটোবেলা থেকেই শান্তিদাকে ভয় পেতাম খুব। এখনও সে-ভয় পুরোপুরি কেটেছে, জোর ক’রে বলতে পারি না।” অথচ, ‘কঠোর’ শৈলজারঞ্জন যেন তাঁর অনেক কাছের মানুষ। যিনি অনায়াসে কণিকাকে ‘মাথামোটা’ বলতে পারেন, অবাধ সমালোচনা করতে পারেন। তবু, তাঁর কাছে নির্দ্বিধায় নতজানু হন কণিকা।

এই বৈপরীত্য থেকেই দ্বন্দ্ব ঘন হয়। সুচিত্রা-কণিকার মধ্যে ক্রমে মনোমালিন্য বাড়ে। কবিপক্ষে রবীন্দ্রসদনে একই দিনে দুজনের অনুষ্ঠানে দুজন বসলেন দুই প্রান্তে। সুচিত্রা অনুষ্ঠানে ১২ হাজার টাকা নিলে, এক টাকা হলেও বেশি সাম্মানিকের জেদ ধরে বসলেন কণিকা।

কলকাতায় ‘মায়ার খেলা’ হবে। দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় ঠিক করেছেন, কণিকা ‘প্রমোদা’ আর সুচিত্রা ‘শান্তা’র চরিত্র করবেন। প্রস্তাব পেয়েই সুচিত্রা বললেন, ‘‘আমি শান্তা করলে মোহর প্রমোদা করবে না।’’ কিন্তু কণিকা ছাড়া তো অনুষ্ঠান হবে না। তাঁকে রাজি করাতে দ্বিজেন ছুটলেন শান্তিনিকেতন। কণিকা যথারীতি জানতে চাইলেন, শান্তা কে করবে। দ্বিজেন ভেঙে কিছু বলেন না। কণিকা অনুষ্ঠানের আগে কলকাতায় রিহার্সালে এসে দেখেন, শান্তা করছেন সুচিত্রা। কণিকা তো রেগে আগুন। তিনি গাইবেন না। অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাঁকে রাজি করান দ্বিজেন। কলকাতার অসংখ্য মানুষ শুধুমাত্র কণিকা আর সুচিত্রাকে একসঙ্গে পাবেন জেনেই টিকিট কেটেছেন। থমথমে মুখে অনুষ্ঠান শুরু হয়। গান শেষ। দেখা যায় দুজনকে জড়িয়ে দুজনেই হাপুস নয়নে কাঁদছেন। বাঁধ ভেঙে গেছে মুক্তধারার। মিলিয়েছেন সেই রবীন্দ্রনাথই।

স্বাধীনোত্তর যুগে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে মূলত শিক্ষিত জনমানসে একটি বিশেষ ধারার সঙ্গীত হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এই দুই প্রতিভাবান ছাত্রী, রবিগানের সাধিকা, শিক্ষিকা ও সর্বোপরি শিল্পী – সুচিত্রা মিত্র ও কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ তাঁদের জন্মশতবর্ষে এসে বাঙালি যদি রবীন্দ্রনাথের গানের প্রকাশ ভঙ্গিমা বা গায়কির দিকে ‘ফিরে না চায়’ তাহলে আমরা এই সঙ্গীতধারাটিকে ক্রমেই বিস্মৃত হব এবং অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে যেমন বলা হয়, এক্ষেত্রেও আমরা সেই আত্মঘাতী বাঙালি হিসাবেই চিহ্নিত হব। এদিক থেকে বিচার করলে সুচিত্রা আর কণিকা সমস্ত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অবশ্যপাঠ্য হওয়া উচিত। গান পাঠ শুধু টেক্সটটুকুতেই শেষ হয় না, স্বরলিপির স্বরগুলোতে শিল্পী কীভাবে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং কীভাবে রবীন্দ্রনাথের কথা অনুযায়ী, গান রচয়িতা এবং গায়ক বা গায়িকা দুজনে মিলে (কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিনজনে মিলেও) একটি গানকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছেন – তার পাঠও প্রয়োজন।

সুচিত্রা এবং কণিকা যে আজীবন শুধুই রবি ঠাকুরের গান গেয়ে গেলেন কিন্তু সে কি শুধুই রবীন্দ্রনাথের গানের প্রতি মুগ্ধতা? বোধহয় তা নয়। এই দুই সঙ্গীতশিল্পীরই মনোজগৎ তৈরি হয় শান্তিনিকেতনে, তৈরি হয় তাঁদের নান্দনিকতার বোধও। কণিকার ক্ষেত্রে আবার খোদ রবীন্দ্রনাথের স্নেহচ্ছায়ায়। সুচিত্রার বাবা সৌরীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় পেশায় পুলিস কোর্টের উকিল হলেও নেশায় ছিলেন সাহিত্যিক। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে তাঁর যাতায়াত ছিল। অবনীন্দ্রনাথের জামাই মণিলাল নাগ ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাঁরা একত্রে ভারতী পত্রিকার সম্পাদনা করেন (১৩২২-১৩৩০)। সাহিত্যের সব শাখাতেই ছিল সৌরীন্দ্রনাথের অবাধ গতি। ফলে সাহিত্যরস, রবীন্দ্রনাথের জীবনবোধ, প্রকৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা, নিজের সঙ্গে নিজের বোঝাপড়া, প্রেম এবং আধ্যাত্মিকতা যেভাবে কণিকা ও সুচিত্রার মনের গভীরে প্রভাব বিস্তার করেছিল তার ছাপ আমরা এঁদের গায়নে পাই। সুচিত্রা মিত্রের গায়কিতে রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন পর্যায়ের গানের বিচিত্র ভাবের অনবদ্য প্রকাশ ঘটে কী অনায়াসেই! আমরা শুনতে থাকি: ‘তবু মনে রেখো’, ‘কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি’ বা ‘যতখন তুমি আমায়’। আশ্চর্য লাগে গানবিশেষে গায়কির নিখুঁত বদলে।

সুচিত্রার শহুরে স্মার্টনেসকে কোনওদিনই ছুঁতে পারেননি কণিকা। আবার কণিকার কণ্ঠের স্নিগ্ধ অতলতা বারবার বিস্মিত করেছে সুচিত্রাকে। কণিকার গড়ে ওঠায় যে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের অমৃত-স্পর্শ আছে, তাকেও নাকচ করা সম্ভব হয়নি সুচিত্রার পক্ষে। দুজনে দুই ধাতুতে গড়া। দুই ঘরানা, দু’রকমের ব্যক্তিত্ব। টানাপোড়েন, দ্বন্দ্ব আর তারমধ্যেও ভালোবাসার অবিরল স্রোত। এ সম্পর্ককে কীভাবেই বা ব্যাখ্যা করা যায়! তাই হয়ত কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় চিরতরে চলে যাওয়ার পর সুচিত্রা বলেছিলেন, “মোহর চলে গেছে, আর শান্তিনিকেতনে যাব না।”

তিনি বাংলার ‘মোহর’। তাঁকে সুচিত্রার মতো চিনতে হয়ত আর কেউই পারেননি।  দুজনেরই জন্ম শতবর্ষ এই বছরেই। সুচিত্রার জন্মদিন উনিশে সেপ্টেম্বর এবং কণিকার বারোই অক্টোবর।