• facebook
  • twitter
Wednesday, 30 October, 2024

পটে কালীপূজা

জ্যেষ্ঠপুত্র কালীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ছিলেন বিখ্যাত কালীসাধক। তিনি হয়েছিলেন বীরভূম ম্যাজিস্ট্রেটের দেওয়ান। ময়নাপুরে তিনি কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি অনেকগুলো শ্যামাসংগীত রচনা করেছিলেন। এছাড়া তিনি 'কালীসুধাসিন্ধু' নামে একটি তন্ত্রগ্রন্থ লিখেছিলেন। কালিপ্রসাদ তাই পরবর্তীকালে বীরভূম জেলার সদর সিউড়িতে বসতি স্থাপন করেন।

পটে বিভিন্ন কালীপূজা। ফাইল চিত্র

শৈলী দারুময়ী লৌহী লেপ্যা লেখ্য চ সৈকতা। মনোময়ী মণিময়ী প্রতিমাষ্টবিধা স্মৃতা।।১২।।
[শ্রীমদ্ভাগবতম্]

শ্রীমদ্ভাগবতম্-এ আছে শিলাময়ী, কাষ্ঠময়ী, ধাতুময়ী, লেপ্যা (মৃত্তিকা চন্দনাদি নির্মিত), লেখ্যা (চিত্রপটাদি লিখিত), বালুকাময়ী, মনোময়ী, মণিময়ী, এই আট প্রকার আমার প্রতিমা হইয়া থাকে।
আবার মহাকাল সংহিতায় আছে –
তৈজসে প্রতিমাযন্ত্রেঽথবা মাহেয়দারবে।
শৈলেয়ে অথবা দেবি ধাতবে গিরিসম্ভবে।।
বিল্ববৃক্ষঃ পত্রিকা চ ঘটঃ পূর্ববদীরিতঃ।
গোময়েনোপলিপ্তং বা স্থণ্ডিলং জগদীশ্বরি।।
সিন্দুরাঙ্কং মণ্ডলং বা শূলখড়্গশরাস্তথা।
পুস্তকং বা চিত্রপটং সর্বতোভদ্র এব বা।।

এর মানে হল, দেবীপূজা তৈজসে অর্থাৎ আসবাবপত্রে, যন্ত্রে, মাটিতে, দারুতে, পাথরে, ধাতুতে, গিরিসম্ভবে (পর্বত থেকে উৎপন্ন হয়, এমন কিছু), বিল্ববৃক্ষে, পত্রিকায়, ঘটে, গোময়লিপ্ত যজ্ঞস্থণ্ডিলে, সিন্দুরাঙ্কিত মণ্ডলে, শূল-খড়্গ-বাণ ইত্যাদিতে, পুস্তকে, চিত্রপটে এবং সর্বতোভদ্রমণ্ডলে করা যেতে পারে।

শাস্ত্রে পটচিত্রে দেবীপূজা করার কথা বলা থাকলেও ব্যাপকভাবে পটে দেবীপূজা অর্থাৎ দুর্গাপূজা বা কালীপূজা হয় না। বঙ্গদেশে দেবীপূজা ব্যাপকভাবে হয়ে থাকে মাটির প্রতিমাতে। কারণ বাংলায় মসৃণ মৃত্তিকার আধিক্য। মাটি যেমন সুলভ, তেমনই মাটি দিয়ে সহজেই বিগ্রহ নির্মাণ করা যায়। রাঢ়দেশে সূত্রধর, কলকাতাও পূর্ববঙ্গে কুম্ভকার এবং মৈমনসিং ও ত্রিপুরাতে গ্রহাচার্যগণ প্রতিমা নির্মাণ করে আসছেন।

পটের ইতিহাস অতি প্রাচীন। বাংলায় ‘পট’ শিল্প একটি লোকায়ত চিত্রকলা শিল্প। সাহিত্য সৃষ্টির আগে মানুষ তাঁর মনের ভাব ছবি এঁকে প্রকাশ করত। শুধু তাই নয়, তাঁর অভিজ্ঞতা ও স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য ছবি এঁকে রাখত। তারপরে যখন চিত্রকলার উন্নতি হল, তখন কোনও বস্তু, ব্যক্তি, প্রকৃতি প্রভৃতির প্রতিকৃতি আঁকতে শুরু করল। শুধু তাই নয়, মানুষ তাঁর কল্পনাকেও চিত্ররূপ দিল। তখন সে তাঁর আরাধ্য দেবতাদের প্রতিরূপ আঁকতে শুরু করল। এই চিত্রকলার একটি ধারায় কাপড়ের ফালির উপর ছবি আঁকা হত। সেই চিত্রকলাকে সাধারণভাবে পট বলা হত। পট কথাটি সংস্কৃত পট্ট শব্দ থেকে এসেছে। ‘পট্ট’ কথাটির অর্থ কাপড়। এখন অবশ্য পট শুধু কাপড়ে নয় কাগজেও পট আঁকা হয়।

যারা এই পটচিত্র আঁকেন তাদের পটুয়া, পোটো, পটিদার (উড়িষ্যা), পাইটকাদার (পুরুলিয়া), যাদুপেটা (পুরুলিয়া), চিত্রকর বলা হয়। সাধারণ ভাবে পটুয়া বা চিত্রকর বলা হয়। আমাদের রাজ্যে বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে আছে এই পটুয়ারা। তবে সবাই এঁরা কালীপূজা বা দুর্গাপূজার জন্য পটে ছবি আঁকেন না। রাঢ়দেশে সাধারণত কর্মকার ও সূত্রধরগণ এবং দক্ষিণবঙ্গে কুম্ভকারগণ পূজার জন্য পটচিত্র অঙ্কন করেন। আবার বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরের মল্লরাজ সহ অন্যান্যদের পট এঁকে দেওয়া ফৌজদার পরিবারের পটশিল্পীরা দাবি করেন, অতীতে তাঁরা মল্লরাজাদের সেনাবাহিনীতে ছিলেন।

পূজা করার জন্য বা দেবতাদের ছবি ঘরে রাখার জন্য পট আঁকার ব্যপক প্রচলন ছিল কালীঘাটে। এই চিত্র আঁকতেন চিত্রকর পদবীর পটুয়ারা। কালীঘাটে যারা তীর্থ করতে আসতেন তাঁরা ফেরার সময় ঠাকুর-দেবতার পট কিনে নিয়ে যেতেন। কালীঘাটের সামাজিক বা সাম্প্রতিক বিষয়ের উপর অঙ্কিত পটও খুব জনপ্রিয় ছিল। বর্তমানে অবশ্য কালীঘাটে আর পট আঁকা হয় না।

পটে পূজা করার পদ্ধতি অতি প্রাচীন। বাংলাতেও ঘটে-পটে পূজা করার প্রথা বহুদিনের। বর্তমানে কিছু সংখ্যায় পটে কালীপূজা ও দুর্গাপূজা হতে দেখা যায়। তবে পটে দুর্গাপূজা হতে বেশি দেখা যায়। এই দুর্গাপূজাগুলো সবই প্রায় পারিবারিক। কালীপূজাও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পারিবারিক। তবে নদীয়া জেলার শান্তিপুরে পটে বারোয়ারি কালীপূজা হতে দেখা যায়। বাঁকুড়া জেলায় পটে দুটি পারিবারিক কালীপূজার খোঁজ পাওয়া গেছে।

শান্তিপুর পটেশ্বরী তলায় পটে কালীপূজা:
নদীয়া জেলার শান্তিপুরে রামনগর পটেশ্বরী তলায় একটি কালীপট আছে। রাসের সময় সেখানে পূজা হয় এবং ভাঙারাসের দিন সমারোহে সেই পট বের হয়। কালীপূজার সময় সেখানে পূজা হয়না। প্রতি পূর্ণিমায় এখানে কালীপূজা হয়। প্রতিবছর রাসের আগে পট আঁকা হয়। এখানে এই কালী মাকে পটেশ্বরী বলা হয়। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন, শান্তিপুরে রাস খুব বিখ্যাত। রাস পূর্ণিমার পরের পরের দিন ভাঙারাস আরও জনপ্রিয়। এদিন রাসপূজার সমস্ত ঠাকুর শোভাযাত্রা করে শান্তিপুর শহর ঘোরে।

এই পূজার ইতিহাস যেটুকু জানা যায় তা হল:– আগে এই পটেশ্বরী তলার সামনে দিয়ে গঙ্গা নদী বইতো। সে প্রায় পাঁচ-সাতশো বছর আগেকর কথা। তখন এই স্থানে গঙ্গার ধারে কিছু সাধু থাকতেন। তাঁরা ঠিক করেন কালীপূজা করবেন। তাঁরা প্রতিমা তৈরি করতে পারেন না; আবার প্রতিমা গড়িয়ে নেবেন তাঁদের সেই সামর্থ্য নেই। তখন নিজেরা কালীর পট এঁকে পূজা শুরু করেন। পরবর্তীকালে পট এঁকে দিতেন কুমোর পাড়ার পালেরা। কালীপট আঁকায় সুনাম অর্জন করেছিলেন মহানন্দ পাল। তাঁর পূর্বপুরুষগন এই পট আঁকতেন। তিনি মারা গেছেন প্রায় ৩০/৩৫ বছর আগে। বর্তমানে তাঁর পুত্রগণ পট এঁকে দেন। কাঠামো আর চার মিটার মার্কিন‌ কাপড় দিয়ে আসতে হয়। আগে শান্তিপুরের এক ব্যবসায়ী কাপড় দিতেন। বর্তমানে বারোয়ারি কমিটি থেকেই দেওয়া হয়।

সময়ের স্রোতে সাধুদের পূজা আজ বারোয়ারি। রাসপূর্ণিমার দিন পূর্ণিমা থাকতে থাকতে পূজা হয়। মোট তিন দিনের উৎসব। দ্বিতীয় দিন হোম, ভোগ, নৈবেদ্য। এই দিন হয় জোড়া পাঠা বলি। নদীয়া জেলার মদনপুরের সিংহ পরিবার থেকে সদস্যরা এসে বলি দিয়ে যান। অতীতে মোষ বলি হত। তারপরের দিন ভাঙারাস। এদিন দধিকর্মা। ভাঙারাসের সমারোহে অংশগ্রহণ করেন পটেশ্বরী। সমারোহের পর নিকটবর্তী খালে পট বিসর্জন হয়। কাঠামো থেকে পটটা খুলে খালের জলে নিরঞ্জন করে কাঠামোটা মন্দিরে ফেরত নিয়ে যাওয়া হয়। সেই কাঠামোতেই সারা বছর পূজা হয়। পটেশ্বরীর মন্দির আছে; মন্দিরটা প্রায় ১৫০ বছরের পুরনো।
[তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন পটেশ্বরীমাতা সেবায়েত সমিতির উপদেষ্টা ও আহ্বায়ক শ্যামল বোস]

শান্তিপুর আতাবুনিয়া গোস্বামী পাড়া লেনের ভট্টাচার্য বাড়ির পটের কালী পূজা:
অঞ্জন ভট্টাচার্য ছোটবেলা থেকেই রাসের সময় পটেশ্বরী কালীপূজা দেখে মোহিত হয়ে যেতেন। পটেশ্বরীর মতো পূজা করার ভীষণ ইচ্ছা হয়। সে এতটাই ছোটো পালদের কাছে গিয়ে পটেশ্বরী আঁকানোর সাহস হচ্ছে না। পাড়ার রঞ্জিত চট্টোপাধ্যায়কে বললেন পটেশ্বরী এঁকে দিতে। আর বিভিন্ন কাগজ কেটে সাজালেন পটের কাঠামো। খেলাচ্ছলে শুরু হল পটেশ্বরীর অনুকরণে কালীপূজা। তখন অঞ্জনবাবুর বয়স মাত্র ৬/৭ বছর। তারপর কৃষ্ণনগর থেকে ডাকের সাজ এনে সাজাতেন। ১৫ বছর হল ডাকের কাজ করছে বাগআঁচড়ার শিল্পীরা। তারপর নানা শিল্পীকে দিয়ে পট আঁকিয়েছেন। মাঝে পট এঁকেছিলেন সৌমেন খান। এ বছর (২০২৩) এঁকেছে সৌরভ প্রামানিক। ৫৫ বছর ধরে পূজা করছেন অঞ্জনবাবু একার উদ্যোগে।

পূজা রাসের তিন দিন। পূর্ণিমার উদয় পেলে পূজা অর্থাৎ পূর্ণিমা যদি দ্বিপ্রহরের পর লাগে তাহলে ওই দিন পূজা হবে না। প্রথম দুইদিন প্রসাদ বিতরণ; খিচুড়ি, পোলাও, পায়েস ইত্যাদি। ভাঙারাস অর্থাৎ তৃতীয় দিন দধিকর্মা, নৈবেদ্য। ভাঙারাসের সমারোহে অংশগ্রহণ। সমারোহের পর ১০ জন ঢাকি নিয়ে খালের ধারে পট বিসর্জন। পট জলে বিসর্জন দিয়ে কাঠামো মন্দিরে ফেরত। পট মার্কিন কাপড়ের উপর মাটি লেপে আঁকা হয়। পটেশ্বরীর মতো প্রতি পূর্ণিমায় পূজা হয় না। বাড়িতে নারায়ণ আছেন, নারায়ণের নিত্য পূজার সময় কাঠামোতে ফুল-পাতা দেওয়া হয়।
[তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন অঞ্জন ভট্টাচার্য (৬২)]

শান্তিপুর বেজপাড়া সেনগুপ্ত বাড়িতে পটে কালীপূজা:
ছোটবেলায় আমরা অনেকে দেশলাই বাক্সের ছবি বা মার্কা জমাতাম। অতীতে কালীমার্কা দেশলাই বিখ্যাত ছিল। নদীয়ার শান্তিপুরের বেজপাড়ার কয়েকটি কিশোর ছেলে সেই দেশলাইয়ের কালীর ছবি দিয়ে কালী পূজার শুরু করে। শান্তিপুরে রাস পূর্ণিমার সময় রাস যেমন বিখ্যাত তেমন কালীপূজাও বিখ্যাত। তাই উৎসাহী ছেলের দল অল্প সাধ্যের মধ্যে এইভাবে সাধ পূরণ করল। প্রথমে কালীপূজা শুরু হয়েছিল মুখার্জি বাড়ির গলিতে। এক বছর বৃষ্টির জন্য পূজা পণ্ড হতে বসলে সেনগুপ্ত বাড়ির বারান্দায় পূজা শুরু হয়। সেনগুপ্তরা জাতিতে বৈদ্য। বৈদ্যদের কথ্য ভাষায় বেজ বলে এখানে।

কালীমার্কা দেশলাইয়ের ছবি কীভাবে পটে আঁকা ছবিতে পরিণত হলো, তা কেউ বলতে পারেন না। কত বছর আগে এই পরিবর্তন তাও জানেন না। পূর্বে ছবি আঁকতেন মহানন্দ পাল। তিনি মারা যাওয়ার পর ছবি আঁকেন হাবুল পাল। কাঠের ফ্রেমে মার্কিন কাপড়ের উপর মাটি লেপে পট আঁকা হয়। কালীপূজার দিন সকালে পূজা হয় তাতে অমাবস্যার লাগুক বা না লাগুক। পূজাতে বলি হয় না। আগে আখ চাল কুমড়ো বলি দেওয়া হতো। বলি দেওয়ার লোকের অভাবে এখন কেবলমাত্র উৎসর্গ করা হয়। বিকালে হয় বৈকিলি; তাতে থাকে চিনির সন্দেশ, গজা, মুড়কি। পরদিন বিসর্জন মোতিগঞ্জের ঘাটে। দুটো ঢাক নিয়ে যাওয়া হয় বিসর্জনে। আগে শোভাযাত্রা হত। পট বিসর্জন দিয়ে কাঠামো মন্দিরে ফেরত আনা হয়। সারা বছর কোনও পূজা হয়না।

সেনগুপ্ত বাড়ির বারান্দাই আজ মন্দির। সেনগুপ্ত পরিবার পূজার মূল দায়িত্ব নেয়। সর্বত্র পারিবারিক পূজা বারোয়ারি পূজায় পর্যবসিত হয়। এক্ষেত্রে বারোয়ারি পূজা পারিবারিক রূপ নিয়েছে। অবশ্য প্রতিবেশীরা চাঁদা দিয়ে এই পটের পূজার সাহায্য করেন। পটে আছে তিন সন্ন্যাসী; শোয়া সন্ন্যাসী, আর দু’পাশে দুই সন্ন্যাসী।
[তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত (৫০)]

নামো মাজডিহা মহাপাত্র বাড়ির কালীপূজা ও দূর্গাপূজা: মাজডিহা গ্রাম পঞ্চায়েত, ওন্দা থানা, জেলা বাঁকুড়া:
নামো মাজডিহার মহাপাত্ররা পূর্বে বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাদের পূজারী ছিলেন। এখানে আসার আগে তাদের বসতি ছিল বিষ্ণুপুরের খুলডাঙ্গা। আমি ব্যক্তিগত স্তরে খোঁজ খবর করে খুলডাঙ্গা গ্রাম খুঁজে পাইনি। বর্তমান বংশধরদের দাবি বিষ্ণুপুর রাজারাই পট ও পূজা দিয়েছিলেন। অবাক কাণ্ড রাজারা সর্বত্র দুর্গাপট দিয়েছিলেন। এখানে দুর্গাপট ও শ্যামাপট দিয়েছিলেন। দুটি পটই খুব জীর্ণ। সেটি কত দিনের প্রাচীন, কিভাবে এল এবিষয়ে কেউ বিশেষ কিছু বলতে পারলেন না।

কালী পূজার দিন সকাল থেকে নির্জলা উপবাস। অমাবস্যা লাগলে পট মেলা হয়। তারপর পূজা, অর্চনা, ছাগ বলি। পরদিন আরতি, খাওয়া দাওয়া। পালিকর্তার সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যবস্থা থাকে মাংস, ভাত অথবা খিচুড়ি। অমাবস্যা ছাড়লে পট গোটানো। তারপর ঘট বিসর্জন। বিসর্জন হয় কানা নদীতে।

মহাপাত্র বাড়িতে নারায়ণ শিলার নিত্য পূজা হয়, তখন মা শ্যামার নিত্য পূজা হয়। আগে মা শ্যামার পূজা করার জন্য বাৎসরিক ১৯ টাকা সরকারি সাহায্য পেতেন। সে প্রায় ষাট বছর আগের কথা। দুর্গাপূজা হত খুলডাঙ্গায়, আর কালীপূজা হত নামো মাজডিহাতে।

মহাপাত্র পরিবারে মায়ের মন্দির আছে। মন্দির প্রায় ১০০ বছরের পুরনো। সম্প্রতি সংস্কার করা হয়েছে। কালীপূজাতে বাইরে থেকে ভট্টাচার্যরা পূজা করেন। দুর্গাপূজা নিজেরাই পূজা করেন কোনও পুরোহিত নেই। দুর্গাপূজা সবাই মিলে করেন, কালীপূজায় পালি পড়ে‌। বর্তমানে ছয়ঘর মহাপাত্র ও তিন ঘর মুখোপাধ্যায় পরিবার মিলে পূজা করেন। এজন্য আট বছর অন্তর পালি পড়ে।

এখানেও একটি কিংবদন্তি শোনা যায়, মায়ের মেয়ে খাওয়ার গল্প। মহাপাত্র বাড়ির এক কন্যা পায়ে তোড়া পড়ে ছম ছম শব্দ তুলে মায়ের মন্দিরে প্রবেশ করেছিল। তোড়ার আওয়াজে মা বিরক্ত হয়ে মেয়েটিকে মা গলধঃকরন করে নেয়। শুধু তোড়াটি মায়ের মুখে আটকে ছিল। কিন্তু তখন মায়ের মাটির বা অন্য কিছুর বিগ্রহ ছিল কিনা জানা যায় না। এনাদের বিশ্বাস বরাবর পটের ঠাকুরই ছিল। সেই থেকে মহাপাত্র বাড়ির মেয়েরা পায়ে নুপুর পরে না। এমনকী মন্দিরে পূজার সময় ঢাকঢোল বাজানো নিষেধ।

ময়নাপুর মুখোপাধ্যায় পরিবারের পটের কালী পূজা: ময়নাপুর গ্রাম পঞ্চায়েত, জয়পুর থানা, জেলা বাঁকুড়া। বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাদের দেওয়ান ছিলেন ময়নাপুরের মুখোপাধ্যায় পরিবারের চণ্ডীচরণ মুখোপাধ্যায় (১৭৪০ – ১৮০১ খ্রিস্টাব্দ)। তিনি ছিলেন শক্তিসাধক। চণ্ডীচরণ ময়নাপুরে দুর্গাপূজা ও কালীপূজার প্রচলন করেছিলেন। কিংবদন্তি আছে, তিনি ইংরাজ কর্তৃক বন্দী হন এবং মায়ের কৃপায় মুক্তি পান। চণ্ডীচরণের দুই পুত্র; কালীপ্রসাদ (১৭৯১ – ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দ) ও তারিণীপ্রসাদ (১৭৯৩ – ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দ)। কালীপ্রসাদের বংশধরদের বড়বাড়ি ও তারিণীপ্রসাদের বংশধরদের ছোটোবাড়ি বলা হয়।

জ্যেষ্ঠপুত্র কালীপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ছিলেন বিখ্যাত কালীসাধক। তিনি হয়েছিলেন বীরভূম ম্যাজিস্ট্রেটের দেওয়ান। ময়নাপুরে তিনি কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি অনেকগুলো শ্যামাসংগীত রচনা করেছিলেন। এছাড়া তিনি ‘কালীসুধাসিন্ধু’ নামে একটি তন্ত্রগ্রন্থ লিখেছিলেন। কালিপ্রসাদ তাই পরবর্তীকালে বীরভূম জেলার সদর সিউড়িতে বসতি স্থাপন করেন। কিন্তু তাঁর প্রতিষ্ঠিত কালীমন্দিরে এখনও পূজা হয়, যা বড়বাড়ির কালীপূজা নামে খ্যাত।

তারিণীপ্রসাদও দেওয়ান ছিলেন। তিনি এই পেশাগত জীবনে দীর্ঘদিন পশ্চিম বর্ধমান অর্থাৎ বর্তমান বাঁকুড়া জেলার জেলা জজের সেরেস্তাদার ছিলেন। তিনি পিতৃ প্রতিষ্ঠিত দুর্গোৎসবের শ্রীবৃদ্ধি করেছিলেন। তারিণীপ্রসাদের সাত পুত্র ও তিন কন্যা। ষষ্ঠপুত্রের নাম বিমলানন্দ।

বিমলানন্দ মুখোপাধ্যায় (১৮৩৪ – ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দ) ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। এই পদ ত্যাগ করে পরবর্তীকালে মুর্শিদাবাদের নশীপুর, পূর্ণিয়ার শ্রীনগরের রাজ ম্যানেজার হয়েছিলেন। তিনি ময়নাপুরে পৃথক একটি কালীপূজা প্রবর্তন করেন। যা ছোটবাড়ির কালীপূজা নামে খ্যাত। এই কালীপূজা হয় পটে।

এই কালীপটটি ১৮৬৫ খ্রিষ্টাব্দে বিমলানন্দ বর্ধমানের মহেন্দ্রলাল মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে আঁকিয়ে ছিলেন। বিমলানন্দ নিজেই নিত্য পূজা করতেন। বিমলানন্দের পর তাঁর পালিত পুত্র চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায় (১৮৭৬ – ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দ) প্রত্যেক অমাবস্যায় এই পটে কালীপূজা করতেন। প্রকৃতপক্ষে চন্দ্রশেখর ছিলেন বিমলানন্দের ভ্রাতুষ্পুত্র অর্থাৎ বিমলানন্দের ভাই বগলানন্দের ষষ্ঠপুত্র। বিমলানন্দের কোনও সন্তান ছিল না বলে ভায়ের ছেলেকে পুত্রস্নেহে মানুষ করেন। চন্দ্রশেখরও ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। চন্দ্রশেখরের পর তার পুত্র ও পৌত্ররা এই কালীপূজা দেখভাল করছেন।

পট থাকলেও কালী পূজার সময় একটি মাটির মূর্তি তৈরি করা হয়। কালীপূজাতে অন্নভোগ, আরতি হয়। আগে বলি হত, এখন হয় না। ২০০৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে বলি বন্ধ হয়ে গেছে। একাসনে বসে পূজা এবং পূজার মাধ্যমে ঘট বিসর্জন। পরদিন বিকালে প্রতিমা বিসর্জন।

বড়বাড়ির পূজাতেও একই নিয়ম। বলা উচিত বড়বাড়ির অনুকরণে ছোটবাড়ির পূজা। প্রতিমা তৈরি করেন বাজে ময়নাপুর গ্রামের দিলীপ বরেশ। দিলীপ বাবুরা তিন পুরুষ (শিবরাম – নন্দ- দিলীপ) ধরে প্রতিমা তৈরি করছেন। দূর্গাপূজার বিসর্জনের পর কালী প্রতিমা তৈরি শুরু হয়। মুখোপাধ্যায় পরিবারে কুলদেবতা হিসেবে লক্ষ্মীজনার্দন আছেন।

তথ্য ঋণ:
১) শ্রীশ্রী দূর্গা: যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি (সংকলক – প্রদীপ কর, টেরাকোটা)
২) বাংলার চিত্রকলা: অশোক ভট্টাচার্য (পশ্চিমবঙ্গে বাংলা আকাদেমি)
৩) নন্দবংশ: শ্রী চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায় (এস.সি. আড্ডি এন্ড কোং বুকসেলার্স এন্ড পাবলিশার্স)
৪) বাঁকুড়ার পটশিল্পী: সুখেন্দু হীরা (রাঢ় কথা – পট সংখ্যা ১৪২৯)
৫) ক্ষেত্র সমীক্ষা।