‘করে শুধু মিছে কোলাহল’

আমরা এখন এমন একটা সময়ের মধ্যে চলেছি, যখন কেউ কারও কথা শোনে না। কেউ কাউকে মানে না। এক শ্রেণির লোকের শুভবুদ্ধি, বিবেচনা বোধ লোপ পেয়েছে। চারদিকে হিংসার ছড়াছড়ি। আইনের শাসন কেমন যেন নড়বড়ে। শুধু বাকবিতণ্ডা আর কোলাহল নিয়ে আমরা চলেছি। এ কথা বলতে মনে পড়ে গেল কবিগুরুর একটা গানের লাইন— ‘তোমার কথা হেথা কেউ তো বলে না, করে শুধু মিছে কোলাহল’। সত্যি একটা কঠিন আমাদের ঘিরে রেখেছে। এর থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় কী, আমরা কেউ তা জানি না। রাজ্য প্রশাসনের নেতৃত্বে আছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি মাঝেমাঝেই সভাসমিতিতে গিয়ে মানু,কে হিংসা ও বিভেদ ভুলে শান্তি ও সম্প্রীতির নিয়ে চলার বার্তা দেন। কিন্তু তাঁর বাণী অনুসরণ করে ক’জন লোক চলে? চললে এই হানাহানি থেকে মুক্ত থাকা যেত। তাঁর দল তৃণমূলের নেতা ও জনপ্রতিনিধিদেরও শৃঙ্খলা মেনে চলার কথা শোনান— মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কথা শুনে তাঁদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে বলেন। বলেন, গাড়ি নিয়ে যাওয়ার বদলে পায়ে হেঁটে তিনি মানুষের কাছে যেতে বলেন, তাহলে বেশি মানুষ তাদের মনের কথা, অভাবের কথা বলার সুযোগ পাবেন।

দুর্গোৎসব বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে— সেকথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে মানুষকে পুজোয় এবং উৎসবে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এমনকি এবার শহরের অনেকগুলি পুজোর উদ্বোধন করে সকলকে শান্তিতে রাখার জন্য তিনি দেবী দুর্গার কাছে প্রার্থনা জানিয়েছেন। কিন্তু সেই আকাঙিক্ষত শান্তি কি এবার এল? চারদিক থেকে কেমন যেন একটা অশান্তি ও হানাহানির খবর আমরা প্রায় প্রতিদিনই পাচ্ছি। কেন এত হিংসা, কেন এত হানাহানি, কেন এত রক্তপাত, কেন এত দলাদলি, যা আমাদের নিত্য যন্ত্রণার মধ্যে রেখেছে। মানুষের সদিচ্ছা থাকলে, একের প্রতি অপরের সহানুভূতি থাকলে এই অবস্থার থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। কিন্তু কেউ কথা শোনে না, কেউ অপরকে মানে না। তাই একটি অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে আমরা চলেছি। আর রাজ্যের রাজনৈতিক দলগুলি ভোটের আশায় দলের স্বার্থে, সমাজে এই অস্বস্তিকর পরিবেশকে আরও উত্তপ্ত করে তুলছে। তাদের সবকিছুর মধ্যেই রাজনীতির দেখা একটি অভ্যেসে পরিণত হয়ে গেছে। এই অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় কী?
এবার দেবী দুর্গার পিতৃগৃহে আগমনের অনেক আগেই মুখ্যমন্ত্রী জনসাধারণের কাছে আবেদন রেখেছিলেন এখন সবকিছু ভুলে পুজো ও উৎসবে যোগ দিতে। শারদোৎসবে মেতে উঠেছিল সারা বাংলা। যত অভাব, অভিযোগ, দুঃখ দারিদ্রই থাকুক না কেন, এই পুজোয় একটি নতুন জামা, নতুন প্যান্ট, নতুন জুতো পরে ঠাকুর দেখতে রাস্তায় বের হওয়ার আনন্দই আলাদা। রাস্তায় মানুষের ঢল। যাঁরা রাজনৈতিক দলের কর্মী, তাঁরাও পুজোর এই কয়েকদিন আনন্দে মেতে থাকবেন। নেতাদেরও পুজো উপলক্ষে সামান বিশ্রাম। কিন্তু রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা তাঁদের মনে—আসল কথা হল রাজনীতি কি ভুলে থাকা যায়? পুজো শেষে বিভিন্ন দলের নেতাদের মধ্যে শুভেচ্ছা বিনিময়ও চলল, তখন কিছু সময়ের জন্য শত্রুতা ভুলে থাকা, মিত্র সাজা।

কিন্তু শহর কলকাতায় এবার পুজোর আনন্দে ছেদ এনে দিয়েছে আরজি কর মেডিকেল কলেজের একটি মর্মস্পর্শী ঘটনা। যা প্রতিটি শহরবাসীর, রাজ্যের মানুষের মনে চরম অস্বস্তি, অশান্তির ছাপ ফেলেছিল। একজন কর্তৃব্যরত মহিলা চিকিৎসক, যিনি স্নাতকোত্তর স্তরের পড়ুয়া ছিলেন, তাঁর মৃতদেহ মেলে কলেজেরই সেমিনার রুমের কক্ষে। সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল সারা হাসপাতালে। দুনিয়ার চিকিৎসকরা অবিলম্বে অভিযুক্ত বা অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করার দাবি জানিয়ে কর্মবিরতি ঘোষণা করলেন। তারপর এই ঘটনা গড়াল অনেকদূর। মুখ্যমন্ত্রী এই চিকিৎসকদের সঙ্গে দেখা করে তাঁদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে কাজে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন— তার জন্য তাঁকে চিকিৎসকদের ধরনামঞ্চে এসেছিলেন। কালীঘাটে তাঁর নিজের আবাসে আন্দোলনরত চিকিৎসকদের প্রতিনিধিদের ডেকে একটা মীমাংসায় আসার চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর চেষ্টা এবং তাঁদের দাবি মেটানোর আশ্বাস সত্ত্বেও, চিকিৎসকরা তাঁদের দাবি নিয়ে জেদ ধরে থাকলেন।


তারপর ঘটনা আরও বড় আকার ধারণ করল। চিকিৎসকরা ১০ দফা দাবি ঘোষণা করে, শহরে মিছিলের পর মিছিল বের করল। মুখ্যসচিব তাঁদের সঙ্গে স্বাস্থ্য ভবনে দেখা করে তাঁদের দাবি নিয়ে আলোচনা করলেন। বললেন, তাঁদের দাবির প্রায় সবটাই মেটানো হয়েছে— বাকি যা আছে, তা করতে সময়ের প্রয়োজন। তিনি জুনিয়র চিকিৎসকদের আমরণ অনশন কর্মসূচি, যা তাঁদের কয়েকজন সহকর্মী শুরু করেছিলেন, তা তুলে নিয়ে অবিলম্বে কাজে যোগদানের অনুরোধ জানালেন। কিন্তু তবুও তাদের মন গলল না— তাঁরা অনশন আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল রইলেন। আন্দোলনকারীদের সমর্থনে এগিয়ে এলেন অন্যান্য মেডিকেল কলেজের জুনিয়র চিকিৎসকরা। তাঁদের ১০ দফা দাবি ন্যায়সঙ্গত বলে, তাঁদের সঙ্গে যোগ দিলেন বিভিন্ন মেডিকেল কলেজের সিনিয়র চিকিৎসকরাও। সুতরাং অবস্থা এমন পর্যায়ে এসে পৌঁছল যে, সরকারি হাসপাতালগুলিতে চিকিৎসা পরিষেবা প্রায় ভেঙে পড়ার মুখে এসে দাঁড়াল। পুজোর মুখে চিকিৎসকদের এই ধরনের আন্দোলন শহরবাসীর ওপর বিরাট প্রভাব পড়ল। বলতে গেলে বাঙালির শ্রেষ্ঠ পুজোৎসব অনেকটাই ম্লান হয়ে গেল। আন্দোলনে যোগ দিল উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজের জুনিয়র/সিনিয়র চিকিৎসকরা এবং জেলার সরকারি হাসপাতালের ডাক্তাররাও। সুতরাং পুজোর মধ্যে চিকিৎসকদের এই ধরনের ব্যাপক আন্দোলন সবার মনেই অস্বস্তি সৃষ্টি করল।

এদিকে আমরণ অনশনে বসা সাতজন জুনিয়র চিকিৎসকের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটায় আন্দোলনের সামগ্রিক অবস্থা আরও জটিল রূপ নিল। অনশনকারীদের একজনকে আরজি করে ভর্তি করাতে হল, তাঁর অবস্থা সঙ্কটজনক।

আসলে চিকিৎসকদের ১০ দফা দাবি তেমন অসঙ্গত ছিল না। মুখ্যসচিব বলেছিলেন, দাবির বেশির ভাগ মেটানো হয়েছে। কিন্তু এই মৌখিক আশ্বাসে চিকিৎসকরা সন্তুষ্ট না হয়ে তাঁরা সরকারের কাছে লিখিত দাবি জানিয়েছিলেন। যা সরকার সে কারণেই হয়তো দেয়নি। চিকিৎসকদের আন্দোলন পুজোর আনন্দ, পুজোর জৌলুস অনেকটাই কেড়ে নিয়েছে। এমনকি বড় বড় পুজোর উদ্যোক্তারা এবার শান্ত মনে পুজো শেষ করতে পারেননি। বাইরে আন্দোলন— চিকিৎসকদের মিছিল, তাঁদের উচ্চকিত কণ্ঠে স্লোগান, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’। ফলে মনস্থির রেখে পুজোর আয়োজন করতে পারেননি। এবার শহরে শহরতলিতে পুজোর বাজারও অন্যবারের তুলনায় জমেনি। একদিকে প্রবল বৃষ্টি, অপরদিকে চিকিৎসকদের আন্দোলন, মিছিলের পর মিছিল— ফলে শহরতলি থেকে অনেকেই শহরে বাজার করতে আসেনি। মনে হয় ভীতি, শহরে বাজার করতে গেলে যদি কোনও সমস্যায় পড়তে হয়।
নিয়মিত মোমবাতি মিছিল, মোবাইলের আলো জ্বালানো, কাঁসর ঘণ্টা বাজানো— বড় বড় রাস্তা দখল এবং পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তি। আন্দোলনকারীদের মনোবল বাড়াতে সিনিয়র চিকিৎসকরা এসে আন্দোলেনের নেতাদের পিঠে হাত রেখে বলেছেন, ‘তোমাদের দাবি সঙ্গত, আমরা তোমাদের সঙ্গে আছি বলে দাবিপত্রে সই করেছেন।

উৎসবের মাঝে চিকিৎসকদের এই ধরনের আন্দোলনের জন্য সাধারণ মানুষও বিব্রত বোধ করেছেন। তাঁদের অধিকাংশ বলেছেন, জুনিয়র চিকিৎসকরা পুজোর সময় আন্দোলন করার তেমন যৌক্তিকতা মেনে নেওয়া যায় না। যদিও যে সব দাবি নিয়ে তাঁরা আন্দোলনে নেমেছেন, তার প্রতি তাঁদের সমর্থন রয়েছে। সারা বছর পুজোর জন্য বাঙালি যে যেখানেই থাকুক, সাগ্রহে অপেক্ষা করে থাকেন। সেই পুজোর সময় এমন অঘটন ঘটলে তা সত্যিই বড় দুঃখের।

যদিও অন্যায়, অবিচারের অবসান, মানুষ সুখে শান্তিতে পুজোর আনন্দ উপভোগ করুক, তা সবাই চায়।
আন্দোলনরত চিকিৎসকরা তাঁদের দাবি পূরণের জন্য সরকারের দেওয়া আশ্বাস মেনে নিয়ে দেখতে পারতেন সরকারের কথার দাম আছে কিনা। প্রশাসনের তরফ থেকে মুখ্যসচিব, ডিজি এবং কলকাতা পুলিশের বড় কর্তারা অনশন তুলে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন। কিন্তু চিকিৎসকরা তাঁদের অনুরোধ মানতে নারাজ। মুখ্যমন্ত্রী এর আগে বলেছিলেন, আলোচনায় বসলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়, অনেক জটিল সমস্যার সমাধান করা যায়। জুনিয়র চিকিৎসকদের আন্দোলন নিয়ে কম আলোচনা হয়নি। কিন্তু আন্দোলনকারীরা তা না শুনলে কার কী করার আছে?