• facebook
  • twitter
Wednesday, 23 October, 2024

প্রশ্নের মুখে বিচার ব্যবস্থা

বিচারে বিলম্বে সেইসব অভিযুক্তর জীবনে বড় ক্ষতি করে দেয় যারা পরে নির্দোষ প্রমাণিত হয়। বিচারবিভাগের স্বায়ত্ত শাসনের উপর যে কোনও সীমাবদ্ধতা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ নিরপেক্ষ ও ন্যায় বিচারের ধারণাকে দুর্বল করে।

নৈতিকতা এবং সততাই হল বিচার ব্যবস্থার মৌলিক স্তম্ভ, যা আইন ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় রাখে। আদালতের বিচারক বা বিচারপতির পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে কোনও রাজনৈতিক দলের প্রার্থী হয়ে ভোটে দাঁড়ানোর একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে ইদানিং। এই ধরনের প্রবণতা বিচার ব্যবস্থার নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়। উল্লেখ্য, ২০২৪-এর লোকসভা ভোটে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গাঙ্গুলি বিচারপতির পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে বিজেপির হয়ে ভোটে দাঁড়ান। এইভাবে বিচারপতির পদ ছেড়ে দিয়ে তাঁর ভোটে দাঁড়ানো নিয়ে তুমুল সমালোচনা হয়। তৃণমূল কংগ্রেস সমালোচনা করে বলেছিল, স্পষ্ট হয়ে গেল অভিজিৎ গাঙ্গুলি গেরুয়া মতাদর্শে বিশ্বাসী। তাই কি বিচারপতি থাকাকালীন বিভিন্ন মামলায় বিজেপিকে খুশি করতেই তিনি রাজ্য সরকারের বিভিন্ন কাজের তীব্র সমালোচনা করতেন। আর এবার খোদ সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির মুখে উঠে এল একই প্রসঙ্গ।

মোদির রাজ্য গুজরাতে বিচারবিভাগীয় অফিসারদের এক বার্ষিক সম্মেলনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বিচারপতি গাভাই বলেছেন, ‘ভোটে লড়ার জন্য অবিলম্বে আদালত থেকে ইস্তফা দিয়ে ভোটের প্রার্থী হয়ে যাওয়া এমন একজন বিচারকের নিরপেক্ষতা জনসাধারণের ধারণাকে প্রভাবিত করতে পারে।’ কোনও বিচারক বা বিচারপতি যখন তাঁর আসন (বিচারক বা বিচারপতির আসন) থেকে ইস্তফা দিয়ে কোনও রাজনৈতিক দলের টিকিটে ভোটে দাঁড়ান, সেক্ষেত্রে তিনি বিচারক বা বিচারপতি থাকাকালীন বিচার ব্যবস্থার প্রতি কতটা নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পেরেছিলেন, তা নিয়ে জনমানসে প্রশ্ন উঠে যায়। অর্থাৎ আদালতে বিচারক বা বিচারপতি থাকাকালীন তিনি আদৌ নিরপেক্ষ ছিলেন কিনা, তা নিয়েও কথা ওঠে। বেঞ্চে থাকাকালীন এবং বেঞ্চের বাইরে থাকাকালীন বিচারককে নৈতিকতার সর্বোচ্চ মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। একজন বিচারক যখন অফিস ও সৌজন্যতার বাইরে বেরিয়ে রাজনীতিবিদ বা আমলাদের প্রশংসা করেন, তখন তা সামগ্রিকভাবে বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের আস্থাকে প্রভাবিত করতে পারে।

উদাহরণ হিসাবে বিচারপতি গাভাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারপতিকে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল সেখানকার প্রেসিডেন্ট পদের এক প্রার্থীর সমালোচনা করার জন্য। বিচারপতি গাভাইয়ের মতে, বিচারকদের নির্দিষ্ট মামলার বাইরে গিয়ে বিবৃতি দেওয়া, বিশেষ করে লিঙ্গ-ধর্ম-বর্ণ এবং রাজনীতি ইত্যাদির মতো স্পর্শকাতর বিষয়গুলি নিয়ে বিবৃতি দেওয়া রীতিমতো উদ্বেগের বিষয়। জনগণের যাতে বিচার ব্যবস্থার প্রতি সবসময় অটুট আস্থা থাকে, তা সুনিশ্চিত করতেই হবে। আর তা না হলে বা বিচার ব্যবস্থার উপর আস্থার ঘাটতি তৈরি হলে মানুষ বিচার ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে, আদালতের বাইরে গিয়ে বিচার খোঁজার চেষ্টা করবেন। সেক্ষেত্রে সমাজে আইন-শৃঙ্খলার অবক্ষয় ঘটতে পরে। যার ফলে মানুষ আদালতে এসে ন্যায়বিচারের দাবি জানাতে দ্বিধাবোধ করতেই পারে। পাশাপাশি দীর্ঘসময় ধরে মামলা চললে, খুব ধীরগতিতে মামলা চললে আইনি প্রক্রিয়ার প্রতি মানুষের বিতৃষ্ণা তৈরি হয়। বিচারে বিলম্বে সেইসব অভিযুক্তর জীবনে বড় ক্ষতি করে দেয় যারা পরে নির্দোষ প্রমাণিত হয়। বিচারবিভাগের স্বায়ত্ত শাসনের উপর যে কোনও সীমাবদ্ধতা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ নিরপেক্ষ ও ন্যায় বিচারের ধারণাকে দুর্বল করে।

‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ শুধু বললেই চলবে না। বিচার ও আইনের উপর আস্থা রাখতে হবে। বিচারক বা বিচারপতিদের রায় বা আদেশের পাশাপাশি তাঁদের আচরণও যেন সম্পূর্ণ বিচার ব্যবস্থাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে না দেয়, সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে।