• facebook
  • twitter
Wednesday, 23 October, 2024

১২৫ জন্মবর্ষেও কুরুচিকর বিতর্কের ফেরে জীবনানন্দ

বনলতা নামটির বাস্তবতার যুক্তিও সেখানে অসাড় হয়ে পড়ে। ১৯৩৪-এ ‘বনলতা সেন’ লেখার আগেই ১৯৩৩-এর আগস্টে লেখা জীবনানন্দ দাশের ‘কারুবাসনা’ উপন্যাসের (১৯৮৬-তে প্রকাশিত) নায়কের প্রতিবেশিনী ও কৈশোরকালের প্রথম প্রেম তথা গ্রামবাংলার মেয়ে বনলতার আবির্ভাব ঘটে।

জীবনানন্দ দাশ তাঁর দিনলিপির খাতায় ব্যক্তিগত জীবনের ঘনিষ্ঠজনের কথা Y নামে উল্লেখ করেছেন। ব্যক্তিগত গোপনীয়তাই এই সাংকেতিক নামের ব্যবহার, তা সহজেই অনুমেয়। Y-এর প্রতি তাঁর দুর্বলতা নানাভাবে প্রকাশ করেছেন । প্রথমে ১৯৩০-এর আগে BABY-র BY থেকে পরে ১৯৩১ থেকে শুধু Y লিখেছেন। সে যে তাঁর কাকা অতুলানন্দ দাশের মেঝমেয়ে শোভনা তাও গবেষণায় বেরিয়ে আসে। জীবনানন্দ তাঁর ব্যক্তিগত নিঃসঙ্গ ও বিধ্বস্ত জীবনে শোভনার অভাববোধকে খাতার পাতায় নানাভাবে তুলে ধরেছেন। সেই Y-কে নিয়ে গল্পেরও পরিকল্পনা করেছিলেন জীবনানন্দ। সেখান ‘Y= শচী’কে নিয়ে একটি গল্পও লিখেছেন তিনি। সেই ‘গ্রাম ও শহরের গল্প’-এর নায়িকা গ্রামবাংলাকে আপন করে বেড়ে ওঠা শচী কলকাতায় এসে পার্থিব সুখস্বাচ্ছন্দ্যে সফল হলেও নিঃসন্তান একাকী সেই হারানো দিনের মতো। অন্যদিকে গল্পের নায়ক সোমেন শচীর পাশাপাশি গ্রামবাংলায় বেড়ে উঠেছে, কবিতা লেখে, বেকার ও বিয়ে করেনি। বিয়ে হওয়ার সম্ভাবনাও নেই মনে করে সে। এখন সেও কলকাতায় থাকে।

জীবনানন্দ দুজনকেই নিঃসঙ্গ করে রেখেছেন। শচী সেখানে গ্রামবাংলায় ফিরে যেতে চাইলেও সময় অনেকটাই গড়িয়ে যাওয়ায় ইচ্ছে থাকলেও সোমেন তাতে রাজি হয়নি। সেক্ষেত্রে কলকাতার বিচ্ছিন্ন নির্বাসনই শচী-সোমেনের নিয়তি হয়ে ওঠে। অন্যদিকে ভূমেন্দ্র গুহ জীবনানন্দ দাশের ‘শচী’ নামে একটি অপ্রকাশিত উপন্যাসের কথা বলেছেন। আসলে প্রাণের টান বড় টান, তাকে এড়িয়ে চলা যায় না। জীবনানন্দের দাশের ভাষায়, ‘আমি তারে পারি না এড়াতে’। সেই সম্পর্ককে গোপন করা যায়, অস্বীকার করা যায় না। তার আত্মিক যোগ নানাভাবে নানা রূপে প্রকাশের আলো খুঁজে নেয়। সেদিক থেকে জীবনানন্দ দাশের সৃজনবিশ্বে স্বাভাবিকভাবেই শোভনার অস্তিত্ব একাত্ম হয়ে পড়ে। অবশ্য শিল্পের মিথস্ক্রিয়ায় বা শিল্পীমনের অদৃশ্য সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় সংযোজন, বিয়োজন ও পরিবর্ধন এবং পরিশেষে সংশোধনের মাধ্যমে গড়ে তোলা রূপের মধ্যে ছায়ার কায়া মেলানো দুরূহ। বিশেষ করে স্রষ্টা যদি সে বিষয়ে নীরব থাকেন, তাহলে জোর দিয়ে বলাটাও অসমীচীন। জীবনানন্দ দাশ তাঁর খাতা তথা দিনলিপিতে সংকেতে বা ঈঙ্গিতে-ভঙ্গিতে, অথবা মনের খেদ-দুঃখ-হতাশা-অভিমানের রেশ ধরে সময়ের অনুবাদকে তুলে ধরেছেন, তা দিয়ে তাঁর মনকে বোঝা যায় বা পড়া যায় ঠিকই। কিন্তু তাতে তাঁর সৃষ্টির নেপথ্যকে সুনির্দিষ্ট করে বলা যায় না। তা শুধু অদৃশ্যই নয়, অভিনব রূপান্তর। অন্যদিকে অশোক মিত্র ‘বনলতা সেন’ কবিতাটির পঁচাত্তর পছর অতিক্রান্ত উপলক্ষ্যে আনন্দবাজার পত্রিকায় (২০১০-এর ২১ ডিসেম্বর) তাঁর নিবন্ধের শিরোনামে সরাসরি জানিয়েছেন, ‘রাজশাহি জেলে বন্দি ছিলেন বনলতা সেন’। স্বাভাবিক ভাবেই তা ‘বনলতা সেন’ কবিতার সঙ্গে জেলে বন্দি বনলতার চেয়ে শোভনার সংযোগ আরও নিবিড়, আরও গভীর।

শুধু তাই নয়, বনলতা নামটির বাস্তবতার যুক্তিও সেখানে অসাড় হয়ে পড়ে। ১৯৩৪-এ ‘বনলতা সেন’ লেখার আগেই ১৯৩৩-এর আগস্টে লেখা জীবনানন্দ দাশের ‘কারুবাসনা’ উপন্যাসের (১৯৮৬-তে প্রকাশিত) নায়কের প্রতিবেশিনী ও কৈশোরকালের প্রথম প্রেম তথা গ্রামবাংলার মেয়ে বনলতার আবির্ভাব ঘটে। সেক্ষেত্রে অপরাজেয় ব্যক্তিত্বময়ী বলেই রাজবন্দিনী বনলতার প্রতি কবির অন্তর্দৃষ্টিতে ‘বনলতা সেন’ সৃষ্টি হয়েছে, তা মেনে নেওয়া যায় না। কবিতার ভাববিগ্রহের মধ্যে যেভাবে নাটোরের বনলতা সেনের মূর্তি গড়ে ওঠে, তার মধ্যে শুধু ব্যক্তিত্বের আলোই উঠে আসেনি, চারিত্রিক কলঙ্কও প্রকট হয়ে উঠেছে। আর তা হয়েছে অশোক মিত্রের নিবন্ধটি প্রকাশের অনেক আগে। ওপার বাংলার অর্থনীতিবিদ তথা লেখক আকবর আলি খান তাঁর ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’ (২০০০) বইয়ের ‘লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের অর্থনীতি’ প্রবন্ধে ‘নাটোরের বনলতা সেন’কে রূপজীবী বারাঙ্গনা বলে চিহ্নিত করেছেন। সেখানে অমর্ত্য সেনের বিশ্বে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের শিকার ‘নিরুদ্দিষ্ট নারী’(missing woman)দের পরিচয়সূত্রে লেখকের সমাজে প্রান্তিক নারীদের উন্নয়নের আলোচনার সূচনায় জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেনের কথা প্রকট হয়ে ওঠে । ১৯৬৮/৬৯ নাগাদ সরকারি কাজে নাটোরে গিয়ে দিন পনেরো থাকার অভিজ্ঞতায় তাঁর ধারণা যে পোক্ত হয়েছে, সেকথাও জানিয়েছেন। সেক্ষেত্রে উত্তর বঙ্গের নাটোরের রূপজীবীদের নামডাক থেকে ‘দু-দণ্ড শান্তি’, ‘নিশীথের অন্ধকারে’, ‘দূর অন্ধকারে’, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন’ প্রভৃতির মাধ্যমে আকবর আলি খান বনলতাকে বারবণিতা বলে সুনিশ্চিত হন। সেখানে বনলতা সেন-রা ‘নিরুদ্দিষ্ট নারী’দের চেয়ে উঁচু স্তরের বলে অভিহিত করেন তিনি। ‘সেন’ পদবিতে ‘ভদ্রবংশ’-এর ইঙ্গিতেও বনলতার নামের মধ্যে আত্মগোপনের প্রয়াস মনে হয়েছে তাঁর। সেক্ষেত্রে কবিতাটি সম্পর্কে আকবর আলি খানের প্রশংসাতেও বনলতার চরিত্রের কলঙ্ক আরও দগদগে হয়ে ওঠে, ‘আমার জানা মতে নিষিদ্ধ প্রেমের আনন্দ ও বেদনা এত সুন্দরভাবে আর কোনো কবি ফুটিয়ে তুলতে পারেনি।’ স্বাভাবিক ভাবেই ‘বনলতা সেন’-এর এরূপ মূল্যায়নে বিতর্ককে আমন্ত্রণ জানায়।

জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি তাঁর অসামান্য সৃষ্টিই শুধু নয়, বহুমাত্রিক পরিচয়ের অনন্য স্মারক। এজন্য কবিতাটির একক বিষয় হিসাবেই স্বতন্ত্র বই হয়ে ওঠাটা ছিল সময়ের অপেক্ষা। ওপার বাংলার বিশিষ্ট জীবনানন্দ গবেষক তথা লেখক আব্দুল মান্নান সৈয়দ সম্পাদিত জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’ বইটিই ছিল আকবর আলি খানের আকরগ্রন্থ। সেটি কবির সমাসন্ন জন্মশতবর্ষের (১৯৯৯) আগেই ১৯৯৬-এ প্রকাশিত হয়েছিল। অন্যদিকে আকবর আলি খানের বনলতা সেনের কলঙ্কিত মূর্তিটিকে অচিরেই অস্বীকার করে তীব্র সমালোচনা করেন সেদেশের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক মোঃ আবু তাহের মজুমদার তাঁর ‘জীবনানন্দ’ (২০০২) বইটিতে। আকবর আলি খানের গবেষণাকে বিরক্তিকর, স্থূল রুচির, দূরাঅন্বয়ী এবং নান্দনিক ধারণারহিত বলে অভিমত প্রকাশ করে আবু তাহের মজুমদার বারোটি পয়েন্টে নিজের বক্তব্য তুলে ধরেন তাঁর ‘বনলতা সেন’ নিবন্ধে। তাঁর মতে, বনলতা বরিশালের ভদ্রঘরের মেয়ে, জীবনানন্দের প্রতিবেশেনী। ‘কারুবাসনা’র বনলতাকে স্মরণ করিয়ে দেন তিনি। এদিকে তার পরের বছর (২০০৩) অশোক মিত্রের আত্মজীবনী ‘আপিলা চাপিলা’ প্রকাশিত হয় এবং তাতে বনলতার পরিচয় নিয়ে ভিন্নতর ইঙ্গিত প্রদান করেন। সেদিক থেকে তখনও বনলতা সেনকে নিয়ে সেভাবে শোরগোল পড়েনি। ২০০৯-এ জীবনানন্দ দাশের ডায়েরি প্রকাশের পরেও বনলতা সেনকে নিয়ে নতুন করে আলোড়ন সৃষ্টি হয়নি।

জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতাটির ইংরেজি অনুবাদে ‘Banalata Sen of Natore’ করেছেন। এজন্য আকবর আলি খান বনলতা সেনের পরিচয়ে নাটোরকে প্রাধান্য দিয়েছেন। স্বাভাবিক ভাবেই তাতে গণিকাবৃত্তির প্রসিদ্ধ অঞ্চলে বনলতা সেনের বারাঙ্গনার পরিচয় প্রকট হয়ে ওঠে। তাঁর এই অনুমান স্বীকৃতি তো পায়নি, উল্টে তীব্র সমালোচিত হয়ে চলেছে। অন্যদিকে সমালোচক ‘বনলতা সেন’ কবিতাটির সঙ্গে প্রাচীন ইতিহাসের সংযোগের আধারে যেভাবে অন্ত্যজ অন্ধকারের পরিচয়কে নিবিড় করে কবির সঙ্গে বনলতার সম্পর্ককে স্বরচিত কল্পনায় গড়ে তুলেছেন, তা শুধু বিস্ময়কর নয়, অপব্যাখ্যার সামিল। বিশেষ করে পৃথিবীর পথে হাজার বছর ধরে পথ হেঁটে যেভাবে সিংহল সমুদ্র, মালয় সাগর, বিম্বিসার ও অশোকের ধূসর জগৎ, বিদর্ভ নগর প্রভৃতির মধ্যে বাস্তব ও কল্পনার বিস্তারে (কেননা মালয় সাগরের পরিচয় মেলে না। মালাবার উপকূল বা মালদ্বীপ সংলগ্ন সমুদ্রাংশও হতে পারে।) যে অন্ধকারাচ্ছন্ন ইতিহাস উঠে আসে, তার মধ্যে প্রাচীন বৌদ্ধধর্মের যোগসূত্র বিশেষভাবে লক্ষণীয় । বনলতার রূপায়বেও এসেছে বিদিশা ও শ্রাবস্তীর প্রাচীন নগরীর কথা। সেদিক থেকে আকবর আলি খান যেভাবে ইতিহাসের অন্ধকারের আলোতে বহু পথ হেঁটে পরিশ্রান্ত হতাশাগ্রস্ত কবিকে নাটোরের বনলতার সেনের নিষিদ্ধ প্রেমের আশ্রয়ে খুঁজে পেয়েছেন, তা যেমন উদ্দেশ্যমূলক ব্যাখ্যার অবতারণা হয়ে ওঠে, তেমনই তাতে যুক্তির চেয়ে অনুমানই প্রাধান্য লাভ করে। আসলে কবিতার চাবিও, কাঠিও নেই। কবিতা নিজেই চাবি, নিজেই কাঠি। কবিতা তো মানুষের মনের তালা খোলে। পাঠকমনের তালা খোলাতেই তার সৌরভ আর গৌরব।

কবিতার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভূতি ও সংবেদনশীল চেতনার চাবিই মনের দরজা খুলে দেয়। অন্যদিকে কবিতার জিয়নকাঠির মাধ্যমেই পাঠকমনে প্রাণের পরশ ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে সেই কবিতাকেই তালা করে আকবর আলি খান নতুন আলোকে জীবনানন্দ দাশের ‘বনলতা সেন’কে চেনাতে গিয়ে কবিতাটির শবব্যবচ্ছেদ করে তার প্রাণের হদিশে ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়েছেন। মানসিক অন্ধকারের অভাবমোচনে যেভাবে বনলতা সেনের কাছে ক্ষণিকের শান্তি লাভের কথা বলা হয়েছে, তাতে নিষিদ্ধ প্রেমকে রিক্ত দাম্পত্যপ্রেমের বিপ্রতীপে স্পষ্ট করা গেলেও তার স্বরূপ উন্মোচিত হয় না। রহস্যময়ী বনলতার সান্নিধ্যে কবির শান্তির আশ্রয়কে গণিকার সঙ্গে কবির সম্পর্কের মতো কুৎসিত ও ঘৃণ্য চিত্রকল্পের অবতারণার মধ্যেই মনের বিকৃত রূপচিত্রই ভেসে ওঠে। মানসিক অন্ধকারের মতো সে তো মানসিক আশ্রয়ও হতে পারে। আর সেটাই বাস্তব। সেখানে কবির নাটোরে যাওয়ার প্রমাণ নেই বা বনলতা সেন নামেই বাস্তবের নারী কবিকল্পনায় ‘বনলতা সেন’ হয়ে উঠেছে, এরকম ভাবনাটাই অমূলক। এটি কবিতা। তাতে উত্তম পুরুষে ব্যক্ত ‘আমি’ই যে কবি, সেকথাও সুনিশ্চিত করে বলা যায় না।

শিল্পরূপের ক্ষেত্রে যেখানে আত্মগোপনই শ্রেষ্ঠ পন্থা, সেখানে নিজেকে মেলে ধরার স্পষ্টতার মধ্যেও থাকে নিজেকে আড়ালের সক্রিয় উদ্যোগ। জীবনানন্দ দাশের কৃতিত্ব তো প্রকাশের স্পষ্টতার মধ্যেও নিজেকে আচ্ছন্ন রাখায়। সেক্ষেত্রে সভ্যতাগর্বী মানুষের অভ্যাসের জীবনে নিজের শান্তির আশ্রয় খুঁজে চলা জীবনে অন্ধকারাচ্ছন্নতার মধ্যে আশার আলো জেগে থাকে। সেই চলমান ‘হাজার বছর ধ’রে’ অনন্ত পথচলা জীবনের কথা জীবনানন্দ আশ্চর্য দ্যোতনায় এর আগের কবিতাতেও ব্যক্ত করেছেন। ‘বনলতা সেন’-এর আগে ‘পথ হাঁটা’ কবিতাতেও বর্তমান। কবিতাটির শেষ দুলাইন : ‘উড়ে গেছে ; বেবিলনে একা-একা এমনি হেঁটেছি আমি রাতের ভিতর / কেন যেন; আজো আমি জানিনাকো হাজার-হাজার ব্যস্ত বছরের পর।’ স্বাভাবিকভাবেই সেই চলার কথাই ‘বনলতা সেন’ কবিতাটিতে অভিনব গরিমা লাভ করেছে। ব্যক্তিগত জীবনযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত কবির অসুখী দাম্পত্যের জীবনের ছায়া তাঁর উপন্যাস (১৯৩২-এ ‘প্রেতিনীর রূপকথা’ ও ১৯৩৩-এ ‘কারুবাসনা’ এবং পরে ১৯৪৮-এ লেখা ‘মাল্যবান’, ‘জলপাইহাটি’, ‘সুতীর্থ’ তিনটি উপন্যাসে) ও গল্পেও নানাভাবে উঠে এসেছে। শুধু তাই নয়, কবি তাঁর ডায়েরিতেও সংকেতে-ইঙ্গিতে, ভাবে-ইশারায় লিখে রেখেছেন। সেক্ষেত্রে কবির জীবনের ছায়া তাঁর শিল্পরূপের কায়ায় উঠে আসাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাকে সুনিশ্চিত হয়ে বলাটা একেবারেই অসমীচীন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৩৪-এর আগে জীবনানন্দ দাশের আরও তিনজন নারীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কের কথা জানা যায়। কার কতটুকুর প্রভাব বা ছায়া কীভাবে জীবনানন্দের সৃষ্টিতে মিশে আছে, তা সুনিশ্চিত ভাবে বলাটাই কবিতার বিরুদ্ধাচরণ। অন্যদিকে মোহ আর মায়াময় জীবনে সময়ান্তরে মোহ কেটে গেলেও মায়া থেকে যায় আজীবন। সেই মায়ার ছায়াই জারিত হতে থাকে অবিরত। সেখানে অবচেতন মনের সচেতন শিল্পরূপে স্বাভাবিক ভাবেই বাস্তবের ঘরের চেয়ে মনের ঘরটি প্রাধান্য লাভ করে।

এজন্য দিনের শেষে অভ্যাসের জীবনে সন্ধ্যা আসে, চিল রোদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে, অন্ধকার যাপনের আয়োজন চলে, সব পাখি ঘরে ফেরে, সব নদীও; জীবনের লেনদেনও ফুরিয়ে যায়। অভ্যাসের জীবন থেকে বেরিয়ে অন্ধকারে সেই মনের ঘরে মায়াবী বনলতা সেনের আলোয় নিজেকে খোঁজার আবসর আন্তরিক হয়ে ওঠে। সেক্ষেত্রে কবির ব্যক্তিগত জীবনের ছায়ায় তাঁর কবিতাটির কায়া মেলানো সহজতার মধ্যেও কবির জিয়নকাঠিটির অপরাজেয় প্রাণশক্তির পরিচয়ই নিবিড় হয়ে ওঠে। একেক জন একেক ভাবে তাঁর বনলতার সঙ্গে কবির সম্পর্ক খুঁজে পায়, বনলতার বিচিত্র প্রকৃতির ছায়া খুঁজে নেয়। নামের সাদৃশ্যে কেউ নাটোরের ম্যানেজার ভুবন সেনের বোন বনলতা সেনের কথা বলেন, কেউ আবার সেই বোনকে বিধবা বোন বানিয়ে নেন। ‘দেশ’-এর ‘জীবনানন্দ ২’ সংখ্যায় (২৬ ডিসেম্বর ১৯৯৮) সুমিতা চক্রবর্তী তাঁর প্রবন্ধে (‘পুরুষের জন্য, পুরুষেরই সৃষ্টি’) ‘বাংলার এক অধ্যাপিকা’র মধ্যেও বনলতা সেনের পরিচয়ের কথা জানা যায়। তাঁর ‘মালদা-র কোনো কলেজে’ কাজ করার কথাও উঠে আসে । প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মালদার প্রথম কলেজ মালদা কলেজ ১৯৪৪-এ প্রতিষ্ঠিত। তাহলে ‘বনলতা সেন’ তার অনেক আগেই প্রকাশিত।

অন্যদিকে বনলতা সেন রসিকমনে রহস্যময়ী অপরূপা। দীপ্তি ত্রিপাঠী তাঁর ‘আধুনিক বাংলা কাব্য পরিচয়’-এ (ষষ্ঠ সংস্করণ ১৯৯৭) বনলতা সেনের রূপায়বে এডগার এলান পো’র ‘হেলেনের প্রতি’ কবিতাটির মিল খুঁজে পেয়েছেন। হেলেনের ‘The hyacinth heir, thy classic face’-এ বনলতার চুল ও মুখের ছবি ভেসে ওঠে। শুধু তাই নয়, বিদিশা ও শ্রাবস্তীর মধ্যেও ক্লাসিক চেতনা জাগরণের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন সমালোচক। পোও তাঁর কবিতাটিতে গ্রীস ও রোমের স্মৃতি জাগিয়েছেন : ‘To the glory that was Greece ! And the grandeur that was Rome’। সেক্ষেত্রে বিদিশা বা শ্রাবস্তীর মধ্যে রূপজীবীদের কথাই প্রাধান্য দেওয়া অসমীচীন। তার অধরা রূপমাধুরীর সৌরভই বনলতার আভিজাত্য ও গৌরব। তাঁর স্বরূপ স্বাভাবিকভাবেই কৌতূলোদ্দীক।

এজন্য বনলতার পরিচয় নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি শিল্পীদের তুলিতেও তাঁর অসাধারণ রূপশ্রীকে তুলের ধরার প্রয়াস বিদ্যমান। ‘দেশ’-এর সংখ্যাটিতেও গণেশ পাইন, যোগেন চৌধুরী, বিকাশ ভট্টাচার্য ও অর্পিতা সিংহ চারজন প্রথম সারির শিল্পীর মনের মাধুরীর রঙে রঙিন ছবিও প্রকাশিত হয়েছে । আসলে বনলতা সেনের মানসীপ্রতিমা কবির মতো পাঠককের মনেও রোমাঞ্চকর রহস্যমুখর মায়াবী হাতছানি বয়ে আনে । সেখানে তাঁর অধরা মাধুরীকে নিজের মতো করে দেখার সদিচ্ছা গড়ে ওঠাটাই দস্তুর । বনলতা সেন-এর মানসীপ্রতিমাকে বারবণিতার মূর্তিতে কলুষিত করার প্রয়াস স্বাভাবিক ভাবেই কাব্যমোদী পাঠকের কাছে যেমন অপ্রত্যাশিত, তেমনই তার যোগসূত্রে নতুন করে চর্চার পরিসর বিস্তৃতি পাওয়াটায় কবিতাটির বনেদি আভিজাত্যকেই অনস্বীকার্য করে তোলে । অন্যদিকে কবিতাটির বহুত্বব্যঞ্জকতা ও বহুমাত্রিকতা এখনও সমান সচল। আবহমান কালের ধারায় ‘বনলতা সেন’-এর অস্তিত্ব এখনও চর্চিত হয়ে চলেছে । সম্প্রতি ‘সাপ্তাহিক বর্তমান’-এ(৬ জানুয়ারি ২০২৪) নৃসিংপ্রসাদ ভাদুড়ীর প্রচ্ছদ নিবন্ধেও (‘গীতা কি বাস্তব জীবনের পথ নির্দেশক?’) শ্রীকৃষ্ণের ‘অনন্ত প্রসারিত’ ‘বিশ্বাত্মা’র পরিচয়ে উঠে এসেছে, ‘আমিও ছিলাম সেখানে, ছিলাম অনাদি সংসারের পিতা-মাতার হৃদয়ের মধ্যে, প্রাণের মধ্যে—‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে’-র নীচে আরও অব্যবহিত পরের তিন লাইন উদ্ধৃতি। আর সেখানেই কবিতাটির অসাধারণ অপরিসীম ব্যাপ্তি, অর্থের বহুধাবিস্তৃত অসীমতা। জীবনানন্দ দাসের মধ্যে টি এস এলিয়টের ‘The Sacred Wood’(১৯১৯) গ্রন্থের ‘Tradition and the individual Talent’ প্রবন্ধের-ছায়া সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। নিরন্তর প্রবহমানতার সঙ্গে অস্থায়ী সময়ের সমন্বয়ের ঐতিহ্য পরম্পরায় ‘বনলতা সেন’-এর অবাধ বিস্তার। সেখানে জীবনানন্দ তাঁর ‘কবিতার কথা’য় পরিষ্কার করে বলেছেন, ‘কবির পক্ষে সমাজকে বোঝা দরকার, কবিতার অস্থির ভিতরে থাকবে ইতিহাসচেতনা ও মর্মে থাকবে পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান।’ সেই সমকালের ভাবকে ভাষায় মূর্ত করে মূর্তি থেকে প্রতিমা গড়ে তোলা কবিপ্রতিভাই চিরকালের সম্পদ হয়ে ওঠে। সেখানে অর্থের বহুধাবিস্তৃতিতে বিতর্ক স্বাভাবিকই শুধু নয়, স্বাস্থ্যকরও। আর তাতেই কবিতার গৌরব ও সৌরভ। কিন্তু মনের কালিতে কালিমালিপ্ত করে সেই বিতর্ককে ছড়িয়ে দেওয়া কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়। বনলতা সেনের কলঙ্কিত মূর্তিটি তাঁর মানসীপ্রতিমাকে স্পর্শ করতে না পারলেও তা অস্বাস্থ্যকর অস্বস্তির পাশাপাশি ভ্রান্তি-বিভ্রান্তিকে মুখরোচক করে তোলে। কবির কবিতার চেয়ে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনই তার লক্ষ্য হয়ে ওঠায় তা ছিন্নমূল বিচ্ছিন্নতার শিকারে পরিণত হয়। অবশ্য ‘বনলতা সেন’ যে অচিরেই স্বমহিমায় বিপদমুক্ত হবে, তা তার সূর্যের মতোর চির ভাস্বর প্রকৃতিই বলে দেয় ।