স্বপনকুমার মণ্ডল
৪৮তম আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা আজ ৯ ফেব্রুয়ারি শেষ হচ্ছে। সেখানে বাংলাদেশের অনুপস্থিতি চোখে পড়েছে স্বাভাবিকভাবেই। অন্যদিকে বিপুল জনসমাগমের আয়োজনে স্বাভাবিকভাবেই গণমাধ্যমে বইমেলাকে বাঙালির মহাকুম্ভের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। এতে যে বাঙালির উৎকর্ষমুখর বনেদিয়ানারই পরিচয় মেলে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। অন্যদিকে বইয়ের তীর্থযাত্রীদের মধ্যে পাঠকের সঙ্গে বইয়ের পরিচয় নিয়ে গোল বেঁধে যায়। বিশেষ করে সেখানে বইয়ের উৎসবের আলো পাঠককের শ্রীবৃদ্ধিতে কতটা সহায়ক হয়ে উঠছে, বিষয়টি আপনাতেই ভাবিয়ে তোলে। আসলে আধুনিক বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ,কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ’—যাযাবরের ‘দৃষ্টিপাত’-এর এই বহুচর্চিত মন্তব্যটি বাঙালির আবেগপ্রবণতায় কতটা সত্য হয়ে উঠেছে, সে-বিষয়ে বিতর্ক রয়ে গেছে। কেননা বিজ্ঞানের ক্রান্তিকালেও বাঙালির আবেগে যেমন টান পড়েনি, তেমনই সুযোগের খবর পেলে ছুটে যায়, হুজুগের গন্ধ পেয়ে নড়েচড়ে বসে। শুধু কি তাই! আজ রবীন্দ্রনাথের কথায় ‘বাজে কথা’র সাহিত্যচর্চা কিংবা প্রচলিত কথায় ‘বাজে কথা’-র শিল্পসাধনায় আধুনিক বিশ্বে বাঙালির জুড়ি মেলা ভার।
অন্যদিকে সাধারণে অসাধারণ ব্যক্তিকে মহাপুরুষ বানিয়ে তোলা বা দেবত্বে উন্নীত করাও তার ভাঁড়ারে টান পড়ে না, বরং তা সোৎসাহে বেগবান মনে হয়। এজন্য বারো মাসে তেরো পার্বণে তার যেমন মন ভরে না, তেমনই তার বছরভর মেলাতেও আশ মেটে না। তার ফলে উৎসবকে মেলায় কিংবা মেলাকে উৎসবে পরিণত করা আবেগপ্রবণ বাঙালির ক্ষেত্রে সময়ের অপেক্ষা মাত্র। বর্তমান বিশ্বের বিশ্বায়নের নামে ব্যবসায়ানের পণ্য বিপণনের মেলাও বাঙালিকে বিপন্ন করেনি। সেদিক থেকে বাংলার বইমেলা অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই বাঙালির বই-উৎসব বা বই-পার্বণ হয়ে উঠেছে। কিন্তু কথাটা যেভাবে বলা হল, সেভাবে অবশ্য কার্যকরি হয়নি। কেননা তাতে মানে ফাঁক না থাকলেও মানায় ফাঁকি থেকে যায়। উৎসবের আমেজ আপামর বাঙালির আপনার প্রাণে। সেক্ষেত্রে বইমেলা আজও কতিপয় পরিশীলিত বাঙালির মনে ঠাঁই নিয়েছে। সেজন্য মাঝে মাঝে মনে হয়, মেলার আধিক্যেও বইমেলা আজও বই মেলাতে কিংবা বই মেলানোতে মিলনমেলায় পরিণত হয়নি।
পাকিস্তানের শিক্ষাসচেতনতায় বিপ্লবী কিশোরী থেকে বর্তমানে তরুণী মালালা ইউসুফজাই তাঁর ভাষণে যুদ্ধপীড়িত দেশে খাদ্যের রসদ কিংবা সমরাস্ত্রের পরিবর্তে বই তুলে দেওয়ার কথা বারেবারে দাবি তুলেছেন। সেদিক থেকে সহজেই অনুমেয়, বইয়ের বিস্তার কত জরুরি। অথচ যে-বই মনকে সচল করে তোলে, সে-বইই অচলতার শিকার হয়ে থাকে। বইমেলা নানা জায়গায় নানাভাবে অনুষ্ঠিত হলেও তা যে কতটা বইকে সচল করতে পেরেছে সেবিষয়ে সন্দেহ রয়ে যায়। কেননা ব্যবসায়িক কারণেই হোক বা অন্যকোনো কারণেই হোক অধিকাংশ মেলাই শহরকেন্দ্রিক। শুধু তাই নয়, বইমেলার লক্ষ্যও সেক্ষেত্রে শিক্ষিত পাঠকশ্রেণির উপর। সেদিক থেকে বইমেলার বুনিয়াদে কৃত্রিম আমেজ তৈরির প্রয়াস থাকলেও তার রসদে সাধারণের টানের অভাব অনিবার্য হয়ে ওঠে। স্বাভাবিকভাবেই বইমেলায় মেলার কৃত্রিম আমেজ তৈরির প্রয়াস থাকলেও তাতে মিলনমেলার বড়ই অভাব। বইমেলায় মাঠ ভরে না বলে খেদোক্তির অভাব নেই। আবার সেখানেও ‘কী কিনব’-র চেয়ে অন্য মেলার মতো কিছু একটা কেনাই মুখ্য হয়ে ওঠে। সেদিক থেকেও বইমেলাও সেই শিক্ষাশোভন আভিজাত্যও শিথিল হয়ে পড়ে।
এপ্রসঙ্গে মার্ক টোয়েনের একটি গল্প মনে পড়ে। প্রখ্যাত লেখক বলেই শুধু নয়, বইচোর হিসাবেও তিনি চর্চিত। একদিন এক বক্তৃতাসভায় জনৈক বাগ্মী তাঁর ভাষণের সময় মার্ক টোয়েনকে অমনোযোগী দেখে উষ্মা প্রকাশ করেন। এতে সেই অমনোযোগী শ্রোতা বক্তাকে বিস্মিত করে জানান সেই বক্তব্যের সব কথাই তাঁর একটি বইয়ে লেখা রয়েছে। সত্যি সত্যিই মার্ক টোয়েন সেই বক্তাকে তাঁর সেই বইটি দেখিয়ে তা প্রমাণ করেন। আসলে সেটি ছিল একটি বড় অভিধান। বইমেলাও তদ্রূপ জীবনের একটি অভিধানবিশেষ। কিন্তু সমস্যা হল প্রয়োজন ব্যতীত কেউ অভিধানের পাতা খোলে না। ফলে জীবনের অভিধানটির অপ্রয়োজনের দ্বারটি আপনাতেই রুদ্ধ হয়ে পড়ে।
মেলায় থাকে মিলনের অবসর। বইমেলাও লেখক ও পাঠকের মিলনস্থল বটে। উভয়জনের যোগসূত্র রচনা করেন প্রকাশক। কিন্তু সেভাবে ভাবলে হতাশ হতে হয়। বইমেলার বাড়বাড়ন্তে সেই পাঠকের সংখ্যা সেভাবে কি বেড়েছে? নাকি লেখক-পাঠকের ভঙ্গুর সংযোগ সেতুস্বরূপ প্রকাশকের পাঠক তৈরির কোনো দায় নেই? শুধু সেলসম্যানের মতো বইকে পণ্য করেই সে দায় থেকে মুক্ত হওয়ার প্রয়াস ক্রমশ দীর্ঘতর হবে? তাহলে সংবেদনশীল মনে কিন্তু প্রকাশকের ব্যবসায়িক সেলসম্যানের ভাবমূর্তি আরও নিবিড় হয়ে উঠবে এবং এতে বইমেলার আসল উদ্দেশ্যই তাতে ব্যাহত হবে। ‘শিক্ষক দিবস’-এর তাৎপর্য যেমন মাস্টারমশাইকে উপহার দেওয়ার অনুষ্ঠানে হারিয়ে যায়, তেমনই অভ্যাসবশে বইমেলার মহৎ উদ্যোগও আর পাঁচটা বাণিজ্যিক মেলার সঙ্গে একাসনে সামিল হয়ে পড়বে। আর তাতে বাঙালির আবেগপ্রণোদিত বই সংস্কৃতিতে বই-উৎসবের ঘনঘটার নেপথ্যে তার রসিক মনের সরসতা আপনাতেই বিরস হয়ে উঠবে। অবশ্য সেক্ষেত্রে বইমেলার আয়োজকদের ভূমিকাও কম যায় না। কেননা বইয়ের সঙ্গে পাঠকের সংযোগ রক্ষায় আয়োজকদের প্রয়াসের উপরেও বর্তায় বইকি! আসলে আধুনিক বিশ্বে বইয়ের বিচিত্র বহুবিধ বিষয়ের সুবিপুল সম্ভারের রকমারি রঙিন প্রচ্ছদপটে নবীন পাঠকের বিস্ময়ে হারিয়ে যাওয়াই স্বাভাবি।
কিন্তু তাকে বিস্ময়ের অরণ্য থেকে মুক্তি প্রদানের দায়ও বইমেলার। অন্যদিকে ‘কোন্ বই কেন পড়ব’ এই বিষয়টিই যদি সেই পাঠকের মধ্যে দানা না বাঁধে, তাহলে তো তার পক্ষে বইয়ের অরণ্যে হারিয়ে যাওয়ার মানসিকতাও হারিয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, সব ফুলের যেমন সমান আকর্ষণ থাকে না, তেমনই সে-সবে পুজোও মেলে না। সেক্ষেত্রে পাঠকভেদে পাঠযোগ্য বইয়ের চাহিদায় রকমফের বৈচিত্র বর্তমান। তৃষ্ণার্ত পথিকের যেমন সমুদ্রের লবণাক্ত জলের অতলান্ত পরিসর দেখে হতাশ হয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক, তেমনই আনকোরা পাঠকের পক্ষে বইমেলায় বইয়ের অরণ্যে দিগভ্রান্ত নবকুমার সাজাটাও অস্বাভাবিক নয়। সেদিক থেকে এই লবণাক্ত সমুদ্রের নিস্তরঙ্গ তলদেশের মণিমুক্তোর হদিশের মতো (এজন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লাইব্রেরিকে সমুদ্রের সঙ্গে তুলনা করেছেন।) বইয়ের অরণ্যে বনৌষধির সন্ধানের মাধ্যমে পাঠকের স্বাস্থ্য রক্ষা করাও জরুরি। এজন্য পথহারা পাঠকের সম্বিত ফিরিয়ে আনার জন্য বইমেলা হয়ে উঠুক অরণ্যের কপালকুণ্ডলা। তার তাতে পথহারা পাঠককুমারের মনে যেমন ‘পাঠক, তুমি পথ হারিয়েছ’র চেতাবনি সহজসাধ্য হয়ে উঠবে, তেমনই সেইসঙ্গে ‘এসো’র আমন্ত্রণে নতুন পথের দিশা রোমাঞ্চ বয়ে আনবে। সেই রোমাঞ্চের টানেই বোধ হয় বইমেলার পথ প্রশস্ত হয়ে ওঠে।