ড. বিমলকুমার শীট
স্বামী লোকশ্বরানন্দ (১৯০৯-১৯৯৮) স্বামী বিবেকানন্দ প্রবর্তিত রামকৃষ্ণ ভাবধারায় অনুপ্রাণিত সন্ন্যাসী। তিনি কলকাতা তথা ভারতবর্ষের শিক্ষা ও সংস্কৃতি জগতে বহু পরিচিত এক ব্যক্তিত্ব । ভারতের অন্যতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘নরেন্দ্রপুর’ এর রূপকার তিনি। স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শে পশ্চিমবঙ্গে গ্রামগঠন, বস্তি উন্নয়ন এবং যুবশক্তির বিকাশে তাঁর অবদান বিশেষ উল্লেখ্য। সংসার ত্যাগের আগে স্বামী লোকেশ্বরানন্দের নাম ছিল শিবপদ বন্দ্যোপাধ্যায়, ডাক নাম কানাই থেকে স্বামী লোকেশ্বরানন্দ হয়ে ওঠা অতি সহজ ব্যাপার ছিল না। তাঁর জন্য দীর্ঘ সংগ্রামের পথ বেয়ে তাকে উঠে আসতে হয়েছে। তখন দেশ ছিল পরাধীন, সমাজ ছিল কুসংস্কারাচ্ছন্ন, আর্থিক দৈন্য ছিল প্রকট। এ হেন পরিস্থিতি মোকাবিলা করে পথ করে নিতে হয়েছে তাঁকে।
স্বামী লোকেশ্বরানন্দ ১৯০৯ সালে ১১ এপ্রিল, পূর্ববঙ্গের (অধুনা বাংলাদেশ) খুলনা জেলার সাতক্ষীরা মহকুমার কেঁড়াগাছি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। এই গ্রামের মাহাত্ম্যও রয়েছে। এখানে জন্মেছিলেন শ্রীচৈতন্যের পার্ষদ যবন হরিদাস। কেঁড়াগাছি লোকেশ্বরানন্দের মামাবাড়ি। পিতৃপুরুষের বাসস্থান ছিল বারুইপাড়ায়। নিকটবর্তী সোনা বেঁড়েতে ছিল রানী রাসমণির জামাতা মথুরামোহন বিশ্বাসের পৈতৃক ভিটে। আর কাছাকাছি সব গ্রামেই ছিল তাঁর জমিদারির অন্তর্ভূক্ত। মথুরাবাবুর গুরুগৃহ ছিল তালাগ্রামে। এক সময় বিষয় সম্পত্তির ভাগবাটোয়ারা নিয়ে মথুরাবাবুর গুরুবংশীয়দের মধ্যে বিবাদ চললে সেই বিবাদ মেটাতে তালাগ্রামে মথুরবাবু আসেন। সঙ্গে ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ ও হৃদে। মাগুরা, বারুইপাড়া, চড় গ্রাম থেকে কপোতাক্ষ নদী পার হলেই তালাগ্রাম। শ্রীরামকৃষ্ণ এই পথে এসেছিলেন তালাগ্রামে । একটি অন্তরঙ্গ সভায় স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লোকেশ্বরানন্দ একবার বলেছিলেন, ‘এ হয়তো আমার স্পর্ধা হয়ে যাচ্ছে। তবু বলছি আমি ভাবি, তিনি বোধ হয় আমাকেই খুঁজছিলেন। যেন আমাকে ডেকে বলছেন আয়, আয়, আমার কাছে চলে আয়। নিজের বাড়ি ছেড়ে কেন পরের বাড়িতে আছিস? নিজের বাড়িতে চলে আয়’।
ছোটবেলা থেকেই কানাই প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর। গ্রামের সকলেরই সে প্রিয় ছিল। ক্লাসে শিক্ষক অন্য কোনও ছাত্রকে প্রহার করলে তার চোখ দিয়ে জল পড়ত। কানাই বেশি ঘনিষ্ঠ ছিল তার মায়ের সঙ্গে। মায়ের প্রভাবই তার জীবনে বেশি করে পড়েছিল। জাতপাতের বিধিনিষেধ ছোটবেলা থেকেই কানাইয়ের ভালো লাগত না। ফুটবল খেলে জল খেতে যেতেন তথাকথিত নীচু জাতিদের বাড়ি। বয়স্করা দেখে ফেললে ভয় দেখাত বাড়িতে বলে দেবে বলে। কানাই কিন্তু সে সব গ্রাহ্য করত না । লালমণিরহাট স্কুলে ভর্তি হলে স্কুলের প্রধান শিক্ষক শ্রীশচন্দ্র সান্যাল এর দ্বারা কানাই প্রভাবিত হন। প্রধান শিক্ষক, তার মা ও স্ত্রী তিন জনেই শ্রীশ্রীমা সারদাদেবীর দীক্ষিত। প্রতিদিন তিনি কানাইকে বাড়িতে ডেকে নিয়ে যেতেন। ঠাকুর-মা-স্বামীজীর কথা বলতেন। আর সাধু হতে প্রেরণা দিতেন। ধ্যানজপ করতে বলতেন- অন্যান্য শিক্ষকরা কানাইকে জজ-ম্যাজিস্ট্রেট হবার কথা বললেও প্রধান শিক্ষক বলতেন “তুমি ভাল সাধু হও এই আমি চাই”। তিনি রাজা মহারাজ (স্বামী ব্রহ্মানন্দ), বাবুরাম মহারাজ (স্বামী প্রেমানন্দ) ও মহাপুরুষ মহারাজ (স্বামী শিবানন্দ) কথাও বলতেন। বলতেন – ‘মহাপুরুষ মঠে বিরাজ করছেন। এই বেলা গিয়ে তাঁকে ধর’। এরপর লোকেশ্বরানন্দ মনে মনে শ্রীমহাপুরুষ মহারাজকে গুরুপদে বরণ করেনিলেন ।
তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষার পর ভর্তি হয়েছিল কলকাতা বঙ্গবাসী কলেজে। এই সময় কানাই বেলুড় মঠ থেকে জ্ঞান মহারাজের দেওয়া বই কলেজে নিয়ে যেতেন। আবার তাঁর নির্দেশে লোকেশ্বরানন্দ শ্রদ্ধানন্দ পার্কে ও শিয়ালদা স্টেশনে বই বিক্রি করেছেন। জ্ঞান মহারাজকে গভীর শ্রদ্ধা করতেন লোকেশ্বরানন্দ। তিনি লিখেছেন – কোনও কোনও ব্যক্তির সম্বন্ধে বলা হয় তাঁরা যেন এক একটা প্রতিষ্ঠান। জ্ঞান মহারাজ সেই শ্রেণীর একজন ব্যক্তি। কত লোককে না তিনি অনুপ্রাণিত করেছেন। ব্যক্তিগত কথা গৌণ, মুখ্য হচ্ছে দেশ ও সমাজ। কথার মধ্যে হতাশা নেই, প্রধান সুর হচ্ছে এগিয়ে যাও, বাধা বিঘ্ন দেখে ভয় পেও না। সত্যের জয় শেষ পর্যন্ত হবেই’।
বঙ্গবাসী কলেজে পড়ার সময় লোকেশ্বরানন্দ থাকতেন শ্রীমানী মার্কেটের উপর ঘর ভাড়া করে। সেই সময় বঙ্গবাসী কলেজের প্রিন্সিপাল, ভাইস প্রিন্সিপালরাও স্বদেশী করতেন। সেই অবহে লোকেশ্বরানন্দ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। পড়াশুনায় অবহেলা করতে শুরু করেন। ঠিক করে ফেলেন ভারত স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত সে আর কলেজে আসবে না। লোকেশ্বরানন্দ তখন বিভিন্ন জায়গায় বক্তৃতা দিয়ে নতুন নতুন যুবকদের স্বাধীনতা আন্দোলনে টেনে নিয়ে আসতে লাগলেন । ইংরেজ সরকারের পুলিশের সমালোচনা করায় পুলিশ তার উপর বিরুপ হয়ে উঠল। পুলিশের চর তাঁর উপর নজর রাখতে লাগল। একদিন যখন লোকেশ্বরানন্দ ও তাঁর দাদা নৌকা করে কপোতাক্ষ নদী পার হচ্ছেন, তখন সাদা পোশাকের এক পুলিশ তাঁর ইংরেজ অফিসারের প্ররোচনায় কানাই এর দাদাকে মারতে শুরু করে। ইংরেজ অফিসার তখন সেই পুলিশকে বলে যে, সে ভুল লোককে মারছে। আসল অপরাধী কানাই (লোকেশ্বরানন্দ) পুলিশ তখন নির্দয়ভাবে কানাইকে মারতে থাকে। মেরে তার সারা শরীর রক্তাক্ত করে দেয়।
গ্রামে তার নিকটবর্তী অঞ্চলে স্বাধীনতা আন্দোলন করে কানাই এক বছর পর কলকাতায় ফিরে আসেন।
আন্দোলনের বিশৃঙ্খল অবস্থা দেখে কানাই আশাহত হয়ে পড়েন। পুনরায় কলেজে ভর্তি হন। এই সময় কয়েকজন সহিংস স্বাধীনতা সংগ্রামী কানাইকে একটা অন্ধকার পার্কে ডেকে নিয়ে গিয়ে তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানতে চায়। কানাই যখন বলল সে সাধু হতে চায়, তখন তাঁরা বলল তুমি তো তাহলে আমাদের ধরিয়ে দেবে। আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে। অতএব তোমাকে আমরা এক্ষুণি গুলি করব’। কানাই নির্ভয়ে বলল ‘মারতে হয় মারুন। কিন্তু আমি বিশ্বাসঘাতক নই। তাছাড়া, আপনারা তো কেউ সঠিক নাম বলেননি’। সম্ভবত এ কথায় কাজ হল। লোকগুলি ক্ষান্ত হয়ে চলে গেল। এর আগে কানাই তখন কলকাতায় আইএ পড়ে। তখন স্বদেশিকতার জোয়ার। গ্রামে এসে কানাই ঘোষণা করল আজ থেকে কেউ বিলিতি চিনি খাবে না। এ দিকে সে দিনই গ্রামের দু বাড়িতে পৈতে। ইতিমধ্যে সেখানে বিলিতি চিনি দিয়ে খাবার তৈরি হয়েছে। তাঁদের সব আয়োজন পণ্ড হবার উপক্রম। শেষে বয়স্কদের অনুনয়ে কানাই সম্মতি দিলেও সে নিজে সেই খাবারে মুখ দিল না।
১৯৩১ সালে কনাই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি এ পাশ করলেন। যোগদিলেন রামকৃষ্ণ মিশনের দেওঘর স্কুলের কিছুদিন শিক্ষক হিসাবে। ১৯৩৩ সালে তিনি যখন সঙ্ঘে যোগ দেন, তখন তাঁকে সবাই ডাকতে লাগল ব্রহ্মচারী কানাই বা কানি মহারাজ নামে। এই সময় তাঁকে আরামবাগের কাছে ভাঙামোড়ায় রিলিফ করতে পাঠানো হয়। রিলিফ করতে গিয়ে দেখলেন মানুষজন সব গাছে। সাপ আর মানুষ এক সাথে রয়েছে। গর্ভবতী মহিলা গাছের উপরেই সন্তান প্রসব করছে। কানাই নৌকাতে করে গিয়ে সবার খাবার পৌঁছে দিতেন। একবেলা খেয়ে রিলিফ করতেন। শেষে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মঠে ফিরে আসেন।
এরপর কানাইকে ব্রহ্মদেশে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত এক দ্বীপে ত্রাণ কাজে পাঠানো হয়। আরাকানে পৌঁছলে পুলিশ তার জিনিসপত্র তন্নতন্ন করে দেখে এবং তাঁকে বার বার জিজ্ঞাসাবাদ করে। কিন্তু কানাই মহারাজের কাজ থামল না। বর্মা সংবাদপত্র রিলিফ কাজে ভূয়সী প্রশংসা করে এবং রিলিফের বিস্তৃর বিবরণ বের করতে লাগল। সেখান থেকে ফিরে আসার পর কানাই মহাজারকে বিভিন্ন স্থানে বক্তব্য রাখার জন্য পাঠানো হয়। তারপর কানাই মহারাজ যখন চেরাপুঞ্জীতে, তখন ১৯৩৮ সালে তার আনুষ্ঠানিক ব্রহ্মচর্য দীক্ষা হয় বেলুড় মঠে শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী পার্ষদ স্বামী বিজ্ঞানানন্দজীর কাছে। তখন তাঁর নাম স্বামী সুব্রতচৈতন্য। এরপর কানাই মহারাজকে বেলুড় মঠ কর্তৃপক্ষ আবার দেওঘরে পাঠান হেডমাস্টার হিসাব। ১৯৪৪ সালে ব্রহ্মচারী সুব্রতচৈতন্য বেলুড় মঠে এলেন সন্ন্যাসের জন্য । স্বামী বিরজানন্দজী মহারাজের কাছে সন্ন্যাস পেলেন, নাম হল স্বামী লোকেশ্বরানন্দ। সমাপ্তি ঘটল এক দীর্ঘ যাত্রা পথের।