উনিশ শতকের বাংলা তথা ভারতের এক অনন্য ও বিস্ময়কর মনীষী পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। এমন স্বয়ংসম্পূর্ণ মনীষী সমগ্র ভারতবর্ষে বিরল। বাংলা তথা ভারতবর্ষের যে নবজাগরণ তার মূল কেন্দ্রীয় শক্তি ছিল যুক্তিবাদ ও মানবিকতাবাদ এবং বিদ্যাসাগর ছিলেন তার একজন প্রধান ঋত্বিক —এ কথা বললে খুব একটা অত্যুক্তি হবে না। মধ্যযুগের আঁধার থেকে বাংলা সাহিত্য সমাজ ও সংস্কৃতিকে মুক্ত করে আলোর পথের সন্ধান দিয়েছিলেন তিনি। এই প্রসঙ্গে ডঃ সুকুমার সেনকে উদ্ধৃত করে বলি, “ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে আমাদের মধ্যে ইতিহাস সচেতনতা দেখা দিয়েছে, তখন থেকে আজ পর্যন্ত ‘আপ-টু-ডেট’ বলতে আড়াই জন মানুষের নাম করতে পারি—একজন বিদ্যাসাগর , অন্যজন রবীন্দ্রনাথ আর অর্ধেক রামমোহন রায়।” আবার এই রবীন্দ্রনাথই ঈশ্বরচন্দ্র সম্পর্কে এটি চরম সত্য কথা উচ্চারণ করেন। তিনি বলেন, “বিধাতা সাত কোটি বাঙালী গড়িতে গড়িতে একটি মানুষ সৃষ্টি করিয়াছিলেন।” এই দুটি উদ্ধৃতি থেকেই আমরা ঈশ্বরচন্দ্রের সম্বন্ধে একটা আভাস পেয়ে যাই। গভীর মানবিক, উদার এবং প্রগতিশীল বা আধুনিক মানুষের সন্ধান এই ছোট নিবন্ধে আমরা করব।
তখন ব্রিটিশ শাসনকাল । অর্থাৎ পরাধীন ভারতবর্ষ। দোর্দন্ড প্রতাপে ইংরেজরা ভারত শাসন করছে । ঔপনিবেশিক যুগের যাবতীয় চিহ্ন বর্তমান । অন্যদিকে বাঙালির বুদ্ধি- বিভাসার স্ফুরণ— যাকে নবজাগরণ বলে আখ্যায়িত করা হয়। এই যুগ চিত্রনে আমরা গোপাল হালদারের একটি দীর্ঘ উক্তিকে সম্বল করছি । তিনি লেখেন,” রামমোহন থেকে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত যুগটার মধ্যভাগে বিদ্যাসাগরের স্থান । কবে থেকে যুগের আরম্ভ , কবে তার শেষ , এ তর্কে না গিয়েও বলা যায় হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠা (১৮১৭,২০শএ জানুয়ারি) থেকে প্রথম মহাযুদ্ধের অবসান (১৯১৮, ১১ই নভেম্বর) ,১৯১৯ সালে পাঞ্জাবের উপর জঙ্গী অত্যাচার এবং গান্ধীজীর ভারতীয় রাজনীতিতে আবির্ভাব —মোটামুটি
এই এক শতক বৎসরকে সমগ্রভাবে একটা যুগ বলে গণনা করা চলে। যুগটা প্রধানত বাঙালি জীবন নিয়ে , ‘বাংলার নবযুগ’, ‘বাঙালির নবজাগরণের যুগ’— তার ইংরেজি নাম কেউ ‘রিনেসেন্স’ দেন, কেউ দেন না। পরাধীন দেশে, একটা আধা সামন্ত ব্যবস্থার মধ্যে বাঙালি ভদ্রলোক শ্রেণী এই যুগের স্রষ্টা বাহক ও ধারক। তা সত্ত্বেও , এই একশত বৎসরের মধ্যে বাঙালি সমাজে যে ব্যাপক আলোড়ন ও জীবনস্ফূর্তি দেখা গেল— নানাদিক থেকে দেখা গেল এত অদ্ভুত কীর্তির স্রষ্টার, মনীষী ও কর্মী পুরুষের আবির্ভাব—- যে তিন হাজার বৎসরের ভারতের ইতিহাসে তার তুলনা নেই। জীবনের এমন জোয়ার এ দেশের ঘটেনি—গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময়ও নয়, মোগল রাজত্বে আকবরের দিনেও নয়। মধ্যবিত্ত বাংলার সেই জাগরণের ত্রুটি তাই বলে কম নয়— এখনো তার জের আছে, কিন্তু সে যুগের চরিত্র বিচার না করেও— সে যুগের বাঙালি জাগরণের সকল অসম্পূর্ণতা স্বীকার করেও, তার জন্য গৌরববোধ করা চলে।।”
আমরা বলব এই গৌরবের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। বিদ্যাসাগরের প্রবল ও প্রভূত কীর্তিকে বুঝতে হলে সেই সময়কালের চরিত্রটা একটু বুঝে নেওয়ার দরকার আছে। কি পরিস্থিতিতে ও কোন কোন প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে তাঁকে যেতে হয়েছিল এবং তিনি তাঁর কর্মযজ্ঞকে অটুট রাখতে পেরেছিলেন তা একটু উল্লেখের দাবি রাখে।
মনে রাখতে হবে, যুগটা ছিল ঔপনিবেশিক যুগ এবং আধা সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার রমরমা । এর ফলে বাংলা তথা ভারতবর্ষ দু’দিক থেকে শোষণ ও বঞ্চনার শিকার হয়েছিল। পরাধীনতার গ্লানি ও ঔপনিবেশিক পরিকাঠামোয় বিদেশী শাসকদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, অবদমিত ভারতীয় তথা বাঙালি জাতির প্রতিনিধি ছিলেন ঈশ্বর চন্দ্র। প্রতিটি ক্ষেত্রেই সহ্য করতে হয়েছে পরাধীনতার গ্লানি। বিদেশী শাসকের রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করা খুবই কঠিন। এই শোষণ ও শাসনকে আমরা বলছি বাহ্যিক শাসন ও শোষণ। এই শোষণের কবলে পড়ে নানা কারণে ভারতীয় সমাজের অধিকাংশ মানুষ ছিল দারিদ্র্য পীড়িত এবং শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। অন্যদিকে ভারতীয় আধা সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় সমাজ ছিল ভীষণভাবে কুসংস্কার ও অন্ধকারের ঘেরাটোপে বন্দী। মহিলাদের অবস্থা ছিল আরো শোচনীয় । মধ্যযুগীয় পুরুতান্ত্রিক সমাজে মহিলাদের জন্য না ছিল কোন সুযোগ সুবিধা বা অধিকার, না ছিল পারিবারিক ও সামাজিক অধিকার। শোষণ অত্যাচারের বিরুদ্ধে কথা বলার অধিকার তাদের ছিল না । শিক্ষার অধিকার তো ছিলই না । যেটুকু যৎসামান্য ছিল, তা ছিল উচ্চবিত্ত পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। সাধারণ জনগণের অবস্থা সহজেই অনুমেয় । তারাও এই শোষণ শাসনের ( ব্রাহ্মণ্যবাদের শোষণ ও শাসন) শিকার হয়েছিল। একেই আমরা বলছি অভ্যন্তরীণ শাসন শোষণ । একদিকে বিদেশী শক্তির দ্বারা শাসন শোষণ, অন্যদিকে দেশীয় অভ্যন্তরীণ সমাজ ব্যবস্থার দ্বারা শোষণ ও শাসন । এই প্রেক্ষাপটেই বাংলার নবজাগরণের সূচনা ও অগ্রগতি। নবজাগরণের মূল কেন্দ্র কেন্দ্রে ছিল মানব হিতৈষণার ভাবনা । এবং সেখান থেকেই মানবতাবাদী চিন্তাভাবনার বিকাশ ও বিস্তৃতি। এর ভিত্তি ছিল যুক্তিবাদ। বিদ্যাসাগর এই প্রেক্ষাপটেই তাঁর কর্মযজ্ঞকে এগিয়ে নিয়ে যান।
ইতালির নবজাগরণের মতো বাংলার নবজাগরণেরও মূল কেন্দ্রে ছিল যুক্তিবাদ ও মানবতাবাদ। বিদ্যাসাগর পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান যুক্তিবাদ ও শিক্ষাকে গ্রহণ করে, ভারতের শিক্ষার সাথে তার মেলবন্ধন করতে চেয়েছিলেন । আমরা এখানে বিদ্যাসাগরের শিক্ষা চিন্তায় যে উদার মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সে সম্বন্ধেই দু চার কথা বলার চেষ্টা করছি।
বিদ্যাসাগর জানতেন যে সমাজকে ধরে রাখে শিক্ষা, তাই শিক্ষার আধুনিকীকরণ তিনি জরুরী মনে করেন ।১৮৫২ সালের এপ্রিল মাসে তিনি হ্যালিডে সাহেবের কাছে সংস্কৃত কলেজে সম্পাদক হিসেবে একটি ‘নোট’ পাঠান। সেই নোটের বিভিন্ন পর্যায়ে বিদ্যাসাগরের প্রখর যুক্তিবাদী, বৈজ্ঞানিক এবং মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিটি ধরা পড়ে। তিনি তার নোটের এক জায়গায় লেখেন “একথা ঠিক যে হিন্দু দর্শনের অনেক মতামত আধুনিক যুগের প্রগতিশীল ভাবধারার সঙ্গে খাপ খায় না, কিন্তু তা হলেও প্রত্যেক সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতদের এই দর্শন সম্বন্ধে জ্ঞান থাকা উচিত। শিক্ষার্থীরা যখন দর্শন শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হবে তার আগে ইংরাজি ভাষায় তারা যে জ্ঞান অর্জন করবে তাতে ইউরোপের আধুনিক দর্শন
বিদ্যা পাঠ করা অসুবিধা হবে তাদের। ভারতীয় ও পাশ্চাত্য এই দুই দর্শনেই সম্যক জ্ঞান থাকলে, এদেশের পন্ডিতদের পক্ষে আমাদের দর্শনের ভ্রান্তি ও অসারতা কোথায় তা বোঝা সহজ হবে… এই শিক্ষার আরেকটি সুবিধা হল এই যে , পাশ্চাত্য দর্শনের ভাবধারা আমাদের বাংলা ভাষায় প্রকাশ করতে হলে যে বৈজ্ঞানিক পরিভাষা দরকার তা পন্ডিতদের আয়ত্তে থাকবে”। এ থেকেই শিক্ষার সম্পর্কে বিদ্যাসাগরের মূল দৃষ্টিভঙ্গিতে ধরা যায়।
তিনি পাশ্চাত্য দার্শনিক ধারার সাথে পরিচিত ছিলেন। বেন্থাম, মিল বা আগস্ট কোঁতের দার্শনিক চিন্তাধারার সাথে তাঁর নিবিড় পরিচয় ছিল। এর ফলে পাশ্চাত্য দর্শনের যে উদারবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ছিল —তাকে তিনি সাদরে গ্রহণ করেছিলেন । তবে মনে রাখতে হবে যে পাশ্চাত্য দর্শনের প্রভাবেই তিনি সম্পূর্ণরূপে প্রভাবিত হয়ে উদারপন্থী হয়েছিলেন তা কিন্তু নয় । উদার ও মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিটি গড়ে উঠেছিল দেশীয় সমাজ, ধর্ম ও নীতি নৈতিকতার মধ্যে যে অনুদার ও অবৈজ্ঞানিক ও যুক্তিহীনতা ছিল— তার প্রতিবাদ স্বরূপ। তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন যে সমাজকে ধরে রাখে শিক্ষা। আর এই শিক্ষাকে বৈজ্ঞানিক, উদারীকরণ, যুক্তিবাদ ও মানবিকতার ভিত্তি উপর প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেই দেশ ও দশের, সমাজ ও মানুষের উপকার হবে । তাই তিনি সংস্কৃত কলেজের শিক্ষাকে টোল- চতুস্পাঠীর শিক্ষা থেকে মুক্ত করে আধুনিক করে গড়ে তুলতে অগ্রণী ভূমিকা নেন। তাঁর শিক্ষা চিন্তায় আমরা দুটি মৌলিক চিন্তার সন্ধান পাই । এক জনশিক্ষা এবং দুই স্ত্রী শিক্ষা। তাঁর এই প্রচেষ্টা “বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থাতে এক নতুন মূল্যবোধের সূচনা ঘটায়। প্রচলিত ধর্মীয় বিশ্বাস ও নীতি শিক্ষার উদ্দেশ্যকে গুরুত্ব না দিয়ে বিদ্যাসাগর মার্জিত বুদ্ধি ও সমাজ কল্যাণবোধ সমন্বিত এক নতুন শিক্ষা দর্শন প্রচলন করতে চেয়েছিলেন এবং এই কারণেই তিনি তার পূর্ববর্তী ও সমকালীন সমাজ সংস্কারকদের কৃতিত্বকে অতিক্রম করতে পেরেছিলেন”।
জনশিক্ষার বিষয়টি নিয়ে একটি বিতর্ক আছে। অনেকেই বিদ্যাসাগরের একটি মন্তব্য নিয়ে এই বিতর্কের সূত্রপাত করেন এবং বলেন যে বিদ্যাসাগর জনশিক্ষার নাকি পক্ষে ছিলেন না । তারা তাদের বক্তব্যের সমর্থনে বিদ্যাসাগরের একটি মন্তব্যকে হাতিয়ার করেন। জনশিক্ষা নিয়ে বিদ্যাসাগরের মন্তব্যটি ছিল, ” To educate whole people is certainly desirable, but this is a task which , it is doubtful whether only government can undertake or full fill…. It seems almost impracticable in the present circumstances of the country, to introduce any system of education with such limited expenditure, viz is Rupees 5 to 7 a month for each school.” এখানে একটি বিষয় বোঝার আছে নামমাত্র অর্থ বরাদ্দ করে (স্কুল পিছু মাসে পাঁচ থেকে সাত টাকা) তৎকালীন সরকার যে গণশিক্ষার জন্য উদ্বাহু হয়েছিল তা শুধু অবান্তর ও অবাস্তবই নয়, চরম হাস্যকর একটি ব্যাপার। তাছাড়া বিদ্যাসাগর এই জনশিক্ষাকে “Desirable” বলে আখ্যা দিয়েছেন। তবে বিরোধিতা কোথায় ? আসলে সরকার যেটা করতে চেয়েছিল সেটা এক চরম অবাস্তবতা। জনশিক্ষার নামে এক ধরনের প্রতারণা। এই অবাস্তবতার বিরুদ্ধেই ছিল তাঁর প্রতিবাদ ।এই প্রতিবাদকে বিদ্যাসাগরের গণশিক্ষা বা জনশিক্ষার বিরোধিতা বলে যারা প্রচার করতে চান তাদের মন মানসিকতার প্রতি একটু সন্দেহ থেকেই যায়।
জনশিক্ষা বা গণশিক্ষা যাতে প্রকৃত অর্থেই সাফল্য লাভ করে তার জন্য সংস্কৃত কলেজে থাকাকালীন বিদ্যাসাগর মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের কথা চিন্তা করেন। শুধু তাই নয়, সেই সময়তে সংস্কৃত কলেজে ব্রাহ্মণ ও বৈদ্যদের ছেলেরাই পড়ার সুযোগ পেত। কিন্তু বিদ্যাসাগর হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদীদের কুযুক্তি ও কুসংস্কারকে নস্যাৎ করে দিয়ে সংস্কৃত কলেজের দ্বার সমগ্র হিন্দু জাতির অর্থাৎ অশূদ্র ও শূদ্র প্রত্যেকের কাছেই খুলে দিয়েছিলেন। একে কি জনশিক্ষার প্রচেষ্টা বলব না? একজন গবেষক লেখেন, “আসলে বিদ্যাসাগরের শিক্ষা চিন্তা কলেজের মুষ্টিমেয় ছাত্রদের জন্য সীমাবদ্ধ ছিল না, তিনি ছিলেন বাংলার গণশিক্ষার প্রথম প্রবর্তক যিনি সাফল্যের সঙ্গে জনসাধারণের মধ্যে বাংলা শিক্ষার প্রচলন করতে সমর্থ্য হয়েছিলেন এবং সেজন্য অনেক পাঠ্যগ্রন্থ রচনা করেছিলেন বোধয় (১৮৫১, বর্ণ পরিচয় (প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ ১৮৫৫), কথামালা (১৮৫৬) ইত্যাদি তাঁর সুনিপুণ পরিকল্পনা ও সুগভীর চিন্তার ফসল।” এরপর নিশ্চয়ই বিদ্যাসাগরকে এই বাংলার জনশিক্ষা বা গণশিক্ষার পথপ্রদর্শক বা প্রবর্তক বলতে আপত্তি থাকার কথা নয়!
স্ত্রীশিক্ষা বা নারীশিক্ষা ক্ষেত্রে বাংলা তথা ভারতবর্ষে বিদ্যাসাগরের অবদান অপরিসীম ও প্রবাদপ্রতিম । এ বিষয়ে বহু গবেষণা পুস্তক ও প্রবন্ধ রাজি প্রকাশিত হয়েছে ।এখানে সেই বিষয়ে বিশদ, বিস্তৃত আলোচনা না করে, দুটি বিষয়ের উপর বিদ্যাসাগরের নারীশিক্ষার যে ভিত রচিত হয়েছিল তাকে উল্লেখ করার প্রয়াস নিচ্ছি । কেন নারীশিক্ষা ? কেন নারীশিক্ষা নিয়ে ভাবতে হল নবজাগরণের এক শ্রেষ্ঠ মনীষীকে ? কয়েকটি উদ্ধৃতি দিয়ে বিষয়টি বুঝে নিচ্ছি। আমাদের সমাজ ও সভ্যতার সম্পর্কে মানুষের অগ্রগতি ও প্রগতিকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য যা দরকার সে সম্বন্ধে জেমস্ স্টুয়ার্ট মিল বলেন, “The the moral regeneration of mankind will only really commence when the most fundamental of the social relations is placed under the rule of equal justice , and their strongest sympathy with an equality in rights and civilisation” এছাড়াও প্রখ্যাত ঐতিহাসিক A.S.Altekar বলেন, ” One of the best ways to understand the spirit of a civilization and to appreciate its’ excellences and realise its’ limitations is to study the history of position and status of women in it.” ‘রুল অফ ইকুয়াল জাস্টিস’ এবং ‘পজিশন অফ স্টাটাস অফ ওম্যান’ এই শব্দগুলির অর্থ তদানীন্তন বাংলা তথা ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় কি ছিল তা আমরা জানি। উনবিংশ শতকে ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় নারীর অবস্থান নতুন করে এখানে আলোচনার দাবি রাখে না। বিদ্যাসাগর খুবই পরিষ্কারভাবে বুঝতে পেরেছিলেন যে একমাত্র শিক্ষাই নারী জাতির মুক্তির ও মর্যাদার পথ।
পারিবারিক, সামাজিক সব ক্ষেত্রেই তার মুক্তি নির্ভর করছে শিক্ষার উপর। তিনি প্রকৃতই নারী জাতির শিক্ষার জন্য তাঁর সর্বস্ব পণ করেছিলেন। এবং প্রকৃত পথপ্রদর্শক এর ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বাস্তববাদী ও যুক্তিনিষ্ঠ। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে নারী জাতির উন্নতির জন্য যে শিক্ষার প্রয়োজন সে শিক্ষা দিতে গেলে হিন্দু ধর্মের গোঁড়াপন্থীরা শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে বাঁধার সৃষ্টি করবে। তাই শাস্ত্রকেই তিনি তাঁর আয়ুধ হিসাবে গ্রহণ করে ‘মহা নির্বাণতন্ত্রে’র একটি শ্লোক—” কন্যাপ্যেবং পালনীয়া শিক্ষানিয়তি যত্নতঃ” অর্থাৎ পুত্রের মতোই কন্যাকেও যত্ন করে পালন করতে শিক্ষা দিতে হবে। এর ফলে নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে বাঁধা এলেও তা খুব বেশি অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারেনি, বাঁধা দিয়েও সফল হতে পারেনি। তাঁর কাছে শিক্ষা ও নারীর সামাজিক ও পারিবারিক সম্মান একই সূত্রে গাঁথা ছিল—-দুটিকে তিনি আলাদা করতে পারেননি। আসলে সমাজের মূলেই তিনি আঘাত করতে চেয়েছিলেন। তাঁর উদার মানসিকতা ও মানবিকতার উজ্জ্বল আলোর ছটায়। এই কারণেই একজন গবেষক বলেন, ” Vidyasagar… became a champion of social reformer throughout the nation,” একজন উদার, মানবিক ও আধুনিক মানুষ হিসাবে জাতির কাছে পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করে তিনিই বাংলা তথা ভারতের নবজাগরণের একজন শ্রেষ্ঠ মনীষী হিসাবেই বিবেচিত হন।