সমগ্র রাজ্য এক গভীর উদ্বেগ নিয়ে প্রতিটি মুহূর্ত কাটাচ্ছে। উদ্বেগ অনশনরত জুনিয়র ডাক্তারদের নিয়ে। কার্যত দু’সপ্তাহের বেশি সময় অতিক্রান্ত, অনশন চলছে। রাজনীতির এই অস্ত্র সুকঠিন— যিনি প্রয়োগ করেন, তাঁকেই ক্ষতবিক্ষত করে অস্ত্রটি। কোন পরিস্থিতিতে, কোন রাজনীতিবোধে চালিত হয়ে জুনিয়র ডাক্তাররা অনশনের পথ বেছে নিয়েছিলেন, তাঁদের সামনে ভিন্নতর বিকল্প ছিল কি না, এই প্রশ্নগুলির চেয়ে এখন অনেক গুরুতর হয়ে উঠেছে রাজ্যবাসীর সম্মিলিত প্রার্থনা, এই বার তাঁরা অনশন প্রত্যাহার করুন। এই অনশন তাঁদের যে রাজনৈতিক ও সামাজিক দৃশ্যমানতা দিয়েছে, তাকে অস্বীকার করার প্রশ্নই নেই। যে ভঙ্গিতে নাগরিক সমাজ তাঁদের সমর্থনে পথে নেমেছে, আন্দোলনের পক্ষে মতামত গড়ে তুলেছে, ভারতের ইতিহাসে তেমন উদাহরণের সংখ্যা খুব বেশি নয়।
জুনিয়র ডাক্তাররা এই মুহূর্তে একটি রাজনৈতিক সম্ভাবনার সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছেন। দলীয় রাজনীতি নয়, প্রকৃতার্থে রাজনৈতিক মুহূর্ত। এই পরিস্থিতিটিকে সরকারের সঙ্গে আলোচনার, দর কষাকষির কাজে ব্যবহার করাই হবে বিচক্ষণতার পরিচায়ক।গত দু’মাসে মুখ্যমন্ত্রী কত বার আন্দোলনরত ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছেন, সে কথা ভুলে তাঁকে আরও এক বার সম্পূর্ণ সদিচ্ছার সঙ্গে এই ডাক্তারদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। তাঁর প্রশাসনের প্রতি যে গভীর অনাস্থা তৈরি হয়েছে, তাকে অতিক্রম করার দায়ও মুখ্যমন্ত্রীরই। স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রতিটি রন্ধ্রে বাসা বাঁধা দুর্নীতির মূলোচ্ছেদ করার সদিচ্ছা যে তাঁর আছে, সে কথা তাঁকেই প্রমাণ করতে হবে। মনে রাখতেই হবে যে, জুনিয়র ডাক্তাররা এই সরকারের শত্রুপক্ষ নন, বরং সরকারের কাছে প্রকৃত শাসনের দাবি পেশ করা নাগরিকদের প্রতিনিধি। তাঁদের সঙ্গে শীর্ষনেত্রীর সম্পর্কটি সহযোগিতার হতেই হবে।
দু’পক্ষকেই জেদ ছেড়ে সমাধানের পথে এগিয়ে আসতে হবে,এছাড়া গতি নেই। রাজ্যের বেহাল জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার মোড় ঘোরানোর যে সম্ভাবনা গত দু’মাসে তৈরি হয়েছে, রাজনৈতিক জেদের বেনোজলে তা যাতে ভেসে না যায়, তা নিশ্চিত করা উভয় পক্ষেরই কর্তব্য। সরকার ও প্রশাসনকে স্বাস্থ্যব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ সংস্কার সাধনে বাধ্য করতে চান তাঁরা। অনশন তুলে নেওয়া মানে সেই দাবি থেকে সরে আসা নয়। বরং, সেই চাপের রাজনীতি থেকে সরে এসে তাঁরা একটি উচ্চতর নৈতিক অবস্থান থেকে দাবি করতে পারেন যে, অতঃপর বল সরকারের কোর্টে— বৃহত্তর নাগরিক সমাজের সামনে সরকারকে জবাবদিহি করতে হবে যে, ডাক্তারদের দাবি পূরণের ক্ষেত্রে সরকার কত দূর অগ্রসর হল। প্রয়োজনে প্রতি দশ বা পনেরো দিন অন্তর সাংবাদিক সম্মেলন করে সেই খতিয়ান পেশ করতে হবে। বস্তুত, স্বাস্থ্যব্যবস্থার সংস্কারের কাজটি একা সরকারের পক্ষে করা অসম্ভব— যাঁরা সেই ব্যবস্থার ভিতরে থেকে কাজ করেন, সেই ডাক্তারদের এই প্রক্রিয়ার শরিক হতেই হবে। সংস্কারের প্রতিটি ধাপেই যাতে চিকিৎসকদের প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব থাকে, তা নিশ্চিত করতেও সরকারকে বাধ্য করা যায়। সত্যিই যদি সেই সংস্কার সাধিত হয়, তবে তাতে বিপুল মানবসম্পদের প্রয়োজন।
ডাক্তাররা যদি মানুষের কথা ভেবেই আন্দোলন করেন, তবে সেই মানুষের স্বার্থেই সুস্থ শরীর-মনে সংস্কারের প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করা কর্তব্য।মরণপণ জেদ ছেড়ে তাঁরা আলোচনায় ফিরুন। তাঁদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে, এখন তাঁরা অনশন প্রত্যাহার করলে তা কোনও অর্থেই তাঁদের পরাজয় নয়, চাপের মুখে নতিস্বীকার করা নয়। বরং, তা পরিণতমনস্কতার প্রমাণ। এই জোরের জায়গা থেকে তাঁরা আলোচনায় ফিরলে এই কথাটিই প্রমাণ হবে যে, রাজ্যের স্বাস্থ্যব্যবস্থার অসুখ সারাতে তাঁদের সঙ্কল্পটি সত্য— তা কোনও ক্ষুদ্র রাজনৈতিক বা অন্যবিধ স্বার্থ দ্বারা চালিত নয়।জুনিয়র চিকিৎসকদের দাবিপত্রকে কেন্দ্র করে যে আন্দোলন চলছে, তার মোকাবিলায় রাজ্য প্রশাসন কখনও নির্মম ঔদাসীন্য দেখিয়েছে, কখনও অতিসক্রিয় হয়ে উঠেছে, কখনও নির্বোধ হঠকারিতায় আন্দোলনের পথ রোধ করতে গিয়ে আদালতের তিরস্কার শুনেছে, কখনও প্রতিবাদীদের একাংশকে অহেতুক গ্রেফতার করে নাগরিক ক্রোধের আগুনে ইন্ধন দিয়েছে। এই গোটা প্রক্রিয়াটিতে দুই তরফের পারস্পরিক আস্থা উত্তরোত্তর কমছে, যে আস্থা সুষ্ঠু প্রশাসনের অপরিহার্য শর্ত।
এই আস্থা ফেরানোর প্রধান দায়িত্ব শাসকদের, কারণ তাঁরা শাসক।এক দিকে, সিবিআইয়ের তদন্ত প্রক্রিয়ার উপর সর্বোচ্চ আদালতের নজরদারি তার নিজস্ব নিয়মেই চলবে, সেই প্রক্রিয়ায় রাজ্য প্রশাসনের যথাযথ সহযোগিতা মিলছে কি না, সেটাও ওই নজরদারির আওতায় পড়বে। পাশাপাশি, সরকারি হাসপাতালে নিরাপত্তাব্যবস্থার অগ্রগতির উপরেও সুপ্রিম কোর্ট নজর রাখছে, সিভিক ‘পুলিশ’ সংক্রান্ত নির্দেশ কার্যত তারই অঙ্গ। নজরদারি চলছে কেন্দ্রীয় রেফারাল ব্যবস্থার প্রস্তুতির উপরেও। অন্য দিকে, ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে আদালত নিজেকে জড়াতে নারাজ। সুপ্রিম কোর্টের এই অবস্থান একটি কথা স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দেয়: সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার সামগ্রিক আয়োজনটির বিশদ সংস্কারের দায়িত্ব রাজ্য সরকারেরই। লক্ষণীয়, সেই দায়িত্ব ঠিক ভাবে পালন করা হলে জুনিয়র চিকিৎসকদের দাবিপত্রেরও জবাব মিলবে।এখানেই প্রশাসনের প্রকৃত কাজ। প্রথমত, কোনও কায়েমি স্বার্থের সঙ্গে আপস না করে সততার সঙ্গে প্রকৃত সংস্কারের আয়োজন করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সেই বিষয়ে কেবল প্রতিবাদী চিকিৎসকদের নয়, বৃহত্তর সমাজকেও অবহিত রাখতে হবে। টাস্ক ফোর্স গঠন করে দেওয়া হয়েছে, হাসপাতালে নিরাপত্তাব্যবস্থার ৯০ থেকে ৯৮ শতাংশ প্রস্তুত হয়ে গিয়েছে, কেন্দ্রীয় রেফারাল ব্যবস্থার (অর্ধপক্ব) পরীক্ষামূলক আয়োজন চালু করা হচ্ছে— ইত্যাকার অনির্দিষ্ট এবং অস্পষ্ট কথা বলে পরিস্থিতি ‘ম্যানেজ’ করা যাবে না।
প্রশাসনের চালকদের কথায় বিশ্বাস না রাখতে পারার প্রভূত কারণ আছে। তাঁদের প্রথম কাজ নিজেদের সংশোধন করা, অস্বচ্ছ কৌশলের রাস্তা ছেড়ে স্বচ্ছ আলোচনার পথে আসা। অন্যদিকে, আন্দোলনকারী জুনিয়র চিকিৎসক এবং তাঁদের প্রবীণতর উপদেষ্টা বা নেপথ্য-চালকদেরও আন্দোলন-সর্বস্ব নেতিবাচক প্রতিস্পর্ধার বৃত্ত থেকে এখনই নিষ্ক্রান্ত হওয়া দরকার। কেবল বিপজ্জনক এবং হঠকারী আমরণ অনশন প্রত্যাহার করা জরুরি নয়, প্রশাসনের সঙ্গে সত্যকারের গঠনমূলক আলোচনার পথে পূর্ণশক্তিতে যোগ দেওয়ার দায়িত্বও সত্বর তাঁদের নিতে হবে। সমালোচনা এবং চাপসৃষ্টি তার গুরুত্বপূর্ণ প্রকরণ, কিন্তু সেটাই এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য হতে পারে না। বাস্তবিক, উচ্ছ্বসিত জন-আবেগে ভর করে রাস্তার জনজোয়ারের গৌরবে শাসকদের ‘হারিয়ে দেওয়া’র আত্মপ্রসাদ একটি সম্ভাবনাময় সামাজিক আন্দোলনের প্রকৃত লক্ষ্যকে ভুলিয়ে দিতে পারে। আপনবেগে পাগলপারা হয়ে পড়ার সেই দুর্লক্ষণগুলি ক্রমশ প্রকট হচ্ছে। উত্তরণের পথ যেন কানাগলিতে পর্যবসিত না হয়।