শোভনলাল চক্রবর্তী
আর জি কর কাণ্ডে আবার প্রশ্নের মুখে সমাজ মাধ্যম।এবার আঙুল উঠেছে ভুল তথ্য ও মিথ্যা প্রচার ঘিরে। সম্প্রতি আমার এক বন্ধুর সঙ্গে আড্ডায় কলকাতার সাম্প্রতিক অবস্থা আলোচনার পর সে একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে যোগ করেছিল, “অধঃপতন বোধ হয় একেই বলে…”।তখন,সেই পড়ন্ত বিকেলে, খুব একটা গুরুত্ব দিয়ে ভেবে দেখিনি কথাগুলি। কিন্তু, অসচেতন ভাবেই হয়তো সেগুলি রেখে দিয়েছিলাম মনের মধ্যে। তাই, দিন কয়েক ধরে, প্রায়ই মনে হচ্ছে, “কী অবস্থা হল…।”সত্যিই তো, আজকাল নিম্নরুচিরই জয়জয়কার সর্বত্র; রুচিসম্মত রসোত্তীর্ণ শিল্প-সাহিত্যের-সঙ্গীতের কদর কোথায়? এক দশক আগেও যে গানকে গান বলে ধরাই হত না, সেই গানই আজ ‘ভাইরাল’ হচ্ছে; অপাঠ্য, নিম্ন মানের, সাহিত্যপদবাচ্য নয় এমন লেখা নিয়ে মাতামাতি হচ্ছে; পাতে দেওয়ার অযোগ্য চলচ্চিত্র, ধারাবাহিক, ওয়েব-সিরিজ় ‘হিট’ হচ্ছে।কী ভাবে এই অধোগতি হল আমাদের? কেন আমাদের রুচি পৌঁছে গেল এত নিম্ন স্তরে? ভাল এবং খারাপ, বাজারে যখন দুইই পাওয়া যায়, তখন ভালটাকে বর্জন আর খারাপটা গ্রহণ করতে কবে থেকে শিখলাম আমরা?
পণ্ডিতেরা কী বলবেন জানি না, তবে একজন নাগরিক হিসাবে মনে হয়, আমাদের এই আলোর পথ ছেড়ে অন্ধকার পথের যাত্রী হয়ে ওঠার অন্যতম কারণ গত এক দশকে সমাজমাধ্যমের অবিরাম উত্থান। কেন সমাজমাধ্যমের ঘাড়ে দায় চাপাচ্ছি, সেটা একটু ব্যাখ্যা করে বলা প্রয়োজন। কিছু ক্ষণের জন্য ধরে নিন, কালযন্ত্রে চেপে এই শতকের গোড়ার দিকে আমরা ফিরে গিয়েছি। স্বাভাবিক ভাবেই, সমাজমাধ্যম ব্যাপারটা কী, সে সম্পর্কে আমাদের কোনও ধারণা নেই। বস্তুত, মোবাইল-কম্পিউটার এই মহার্ঘ বস্তুগুলিও তখনও সর্বজনীন নয়। এই রকম পৃথিবীতে তিন জন মানুষ, ধরা যাক, তিন রকমের শিল্পচর্চা করেন। প্রথম জন লেখালিখি করেন, দ্বিতীয় জন ভালবাসেনগান গাইতে, তৃতীয় জন অভিনয় করেন পাড়ার নাটকে। কিন্তু নিজ নিজ শিল্পচর্চায় তিন জনই বেশ অদক্ষ।সে কারণেই বৃহত্তর পাঠক, শ্রোতা বা দর্শক সমাজে প্রচলিত যে সমস্ত আত্মপ্রকাশের মাধ্যম— অর্থাৎ লেখালিখির ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক পত্রিকা, গান-বাজনার ক্ষেত্রে ক্যাসেট বা সিডি, এবং অভিনয়ের ক্ষেত্রে চলচ্চিত্র বা ধারাবাহিক— সেগুলির মধ্যে দিয়ে কেউই আত্মপ্রকাশের সুযোগ পাননি। পত্রিকা, ক্যাসেট, চলচ্চিত্র এবং ধারাবাহিক, প্রত্যেকটি পণ্যই মানুষ মূল্য দিয়ে ক্রয় করেন এবং উপায় থাকলে গ্যাঁটের কড়ি খরচ করে সাধারণত কেউই নিম্ন মানের জিনিস ক্রয় করতে চান না। অতএব পত্রিকায় যেমন নিম্ন মানের লেখা ছাপানো সম্পাদকের চলে না, তেমনই চলে না ক্যাসেট কোম্পানির খারাপ গায়কের ক্যাসেট প্রকাশ করা, এবং পরিচালকের খারাপ অভিনেতাকে চলচ্চিত্র বা ধারাবাহিকে সুযোগ দেওয়া।
সমাজবিজ্ঞানীর দৃষ্টিকোণ থেকে পুরো ব্যাপারটা দেখলে কী উপসংহার টানা যায়? যে উৎপাদনকারীর পণ্যের মান খারাপ (বা যথেষ্ট ভাল নয়), তিনি পণ্যটি নিয়ে প্রচলিত মাধ্যমে বাজারে প্রবেশ করতে পারলেন না বিক্রয়ের জন্য, বাজারে প্রবেশের বাধা থাকার ফলে। এখানে বলে রাখা ভাল, অপ্রচলিত মাধ্যমে যদিও বা তিনি বাজারে প্রবেশ করেন (নিজের পয়সা খরচ করে অমনোনীত উপন্যাস বই হিসাবে প্রকাশ নেওয়া যেতে পারে), তাঁর পণ্যটি তিনি কেবল বাজারের একটি অতি ক্ষুদ্র অংশের কাছেই পৌঁছে দিতে পারবেন বাজারে প্রবেশের মাধ্যমটি অপ্রচলিত বলেই। সুতরাং খারাপ পণ্যটি ভোক্তাদের (পাঠক, শ্রোতা বা দর্শক)— সমস্ত না হলেও অন্তত বেশির ভাগের— সম্ভাব্য বিকল্পের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারল না এবং তাঁদের রুচি ও পছন্দকে প্রভাবিত করতে পারল না।ধরুন, সেই তিন ব্যক্তি আজও ঠিক একই মানের (অর্থাৎ খারাপ) শিল্পচর্চা করেন। কিন্তু তা বলে, আগেকার মতো এখন বৃহত্তর পাঠক, শ্রোতা, দর্শক সমাজে তাঁদের আত্মপ্রকাশ আটকে থাকবে কি? মোটেই না। কারণ, সমাজমাধ্যম।
দেড় দশকের একটু আগে জন্মগ্রহণ করা সমাজমাধ্যম বাজারে প্রবেশের সমস্ত বাধাকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না। আমি খারাপ উপন্যাস লিখলাম, প্রথম শ্রেণির পত্রিকায় ছাপল না? কুছ পরোয়া নেহি, উপন্যাসটি সমাজমাধ্যমে ধারাবাহিক হিসাবে প্রকাশ করে ঔপন্যাসিক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করব। অডিশনে অতীব খারাপ অভিনয় করলাম বলে আমাকে সিনেমায় মুখ দেখাতে দিলেন না পরিচালক? বয়েই গেল! অখ্যাত কোনও পাইস হোটেলে “কষা মাংসটা বেশ কষা মাংসের মতোই খেতে হয়েছে” বলতে বলতে আমার মাংস-ভাত খাওয়াটা মোবাইল-ক্যামেরায় রেকর্ড করব আর তার পর সেই ভিডিয়ো ‘ভ্লগ’ হিসাবে সমাজমাধ্যমে আপলোড করে সমাজমাধ্যম কাঁপিয়ে দেব!ফলত, আগে যে বাজার, বাজার-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিম্ন মানের পণ্য প্রত্যাখ্যান করত, এখন সেই বাজারই ছেয়ে যেতে শুরু করল অত্যন্ত নিম্ন মানের পণ্যে। শুধু তা-ই নয়, ক্রেতারা, যাঁরা সাধারণত নিম্ন মানের পণ্য ক্রয় করেন না, তাঁরাও আশ্চর্যজনক ভাবে সেই পণ্যের দিকে আস্তে আস্তে ঝুঁকতে লাগলেন।কেন ক্রেতারা ঝুঁকতে লাগলেন নিম্ন মানের পণ্যের দিকে?
প্রথমত, বাজারে ভালর তুলনায় অনেক বেশি খারাপ পণ্যের জোগান হওয়ায় অনেক সাধারণ ক্রেতা বিভ্রান্ত হয়ে প্রায় নিজের অজানতেই খারাপ পণ্যের খপ্পরে পড়ে গেলেন। দ্বিতীয়ত, খারাপ পণ্যের প্রকাশ মাধ্যম সমাজমাধ্যম হওয়াতে সেগুলির বিনিময় মূল্য হয়ে দাঁড়াল প্রায় শূন্য! বিনামূল্যের জিনিসের প্রতি মানুষের টান মজ্জাগত। তৃতীয়ত, খারাপ পণ্য, ভাল পণ্যের তুলনায়, সর্ব স্তরের ক্রেতার কাছে অনেক সহজলভ্য (এটিও খারাপ পণ্যের প্রকাশ মাধ্যম সমাজমাধ্যম হওয়ার ফল)। ভাল বই এখনও টাকা খরচ করে কিনতে হয়, কিন্তু সমাজমাধ্যমে প্রকাশিত উপন্যাস হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়।সমাজমাধ্যমের মধ্যে দিয়ে খারাপ পণ্য গ্রহণ করতে শুরু করার ফলে সেই পণ্য আমাদের সামগ্রিক রুচি এবং পছন্দের উপর প্রভাব বিস্তার করতে লাগল। প্রথমে ধীরে ধীরে, তার পর বেশ দ্রুত এবং ব্যাপক ভাবে। ঘুমোনোর সময়টুকু ছাড়া দিনের বাকি সময়টার বারো আনাই আমরা সমাজমাধ্যমে কাটাতে লাগলাম যে! ফলত, আমাদের রেফারেন্স পয়েন্ট বা মানবিন্দুটাই বদলে গেল। কোনটা ভাল, আর কোনটা খারাপ, সেই বোধটাও লুপ্ত হল।খারাপ পণ্যের প্রতি চাহিদা যে হেতু সৃষ্টি হল, বাজারে অতএব খারাপ পণ্যের জোগানও বৃদ্ধি পেল স্বাভাবিক নিয়মেই।
কেবল আর সমাজমাধ্যমের মধ্যে দিয়ে নয়, আমরা দেখলাম, প্রচলিত কিছু মাধ্যমের মধ্যে দিয়েও বাজারে খারাপ পণ্য প্রবেশ করতে শুরু করল (টিভি সিরিয়ালের কথাই ভাবুন)। অধিকাংশ ভোক্তা যখন উচ্চ মানের পণ্য ছেড়ে নিম্ন মানের পণ্যের দিকে ঝুঁকছে, তখন সেই পণ্য সরবরাহ না করলে বাজারে টিকে থাকা প্রচলিত মাধ্যমগুলির পক্ষে প্রায় অসম্ভব। এ সবের যোগফল— সমাজের মন্দ-ভারসাম্যে আটকে পড়া।এই নিম্নরুচির সাম্যাবস্থা থেকে উত্তরণের পথ আছে নিশ্চয়ই, কিন্তু তা অন্য সাধনার ফল। সেই সাধনার সাধ বা সাধ্য এখনও সমাজে সহজলভ্য নয়। তবুও, একটু সতর্ক কি হতে পারি না আমরা? বিনা আয়াসে, বিনা ব্যয়ে কোনও বিনোদন হস্তগত হচ্ছে বলেই তাতে তনুমন ঢেলে দিতে হবে, এই মানসিক আলস্যটুকু তো বর্জন করাই যায়। সবচেয়ে ধনী দেশগুলোর গোষ্ঠী ওইসিডি বলছে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে সংবাদপত্র পড়ছে মাত্র ২০ শতাংশ তরুণ। জনপ্রিয় হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া। ফলে বিপদে পড়ছে বিবিসি, সিএনএনের মতো প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো।
ভারতের গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান টাইমস গ্রুপকে একটি বাংলা কাগজ বিক্রি করে দিয়ে ডিজিটাল উইংকে আঁকড়ে ধরতে হয়েছে। এ কথা প্রায় সবাই বুঝে গেছেন যে সামনের দিনগুলোয় গণমাধ্যমকে টিকে থাকতে হলে সমাজ মাধ্যম ওরফে স্যোশাল মিডিয়ার ‘স্বাদ’কে বুঝতে হবে। ব্রিটেনের গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রক সংস্থাও তা-ই বলছে। তাদের শঙ্কা, চলতি বছর এ হার আরো কমতে পারে। আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা পিউ রিসার্চ সেন্টার জানাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের মোট কিশোর-কিশোরীর ৯৫ শতাংশ স্মার্টফোন ব্যবহারের সুযোগ পায় এবং এদের ৪৫ শতাংশ প্রায় সব সময় ‘অনলাইনে’ থাকে। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের তরুণদের অভ্যাস বিশ্লেষণ করেছে রয়টার্স ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব জার্নালিজম। বলা হচ্ছে, সংবাদের ক্ষেত্রে তরুণেরা পুরো সমাজের কথা ভাবে খুব কম। সংবাদের ক্ষেত্রে তরুণদের ব্যক্তিসত্তা বেশি কার্যকর থাকে। সৌদি আরবে ১৮-২৪ বছর বয়সী তরুণদের ৮০ শতাংশ সংবাদ সংগ্রহ করেন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম থেকে। সেখানে সর্বগ্রাসী ভূমিকা রাখছে স্ন্যাপচ্যাট। অন্যদিকে এশিয়ার দেশ দক্ষিণ কোরিয়ায় ৯৭ শতাংশ কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণী ‘নেইভর’ নামের একটি সার্চ ইঞ্জিন ও পোর্টালে সংবাদ খোঁজেন। দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, ডোনাল্ড ট্রাম্প বা নরেন্দ্র মোদির অনলাইন সক্রিয়তাতেই স্পষ্ট যে গণমাধ্যমের অবস্থা ভাল নয়।আমাদের দেশের বিভিন্ন রিসার্চ গ্রুপের সাম্প্রতিক রিপোর্ট বলছে, ফেসবুক ও ইউটিউবেই বেশি সময় দিচ্ছে পাঠক। তবে এ কথা ঠিক যে সোশ্যাল মিডিয়া গণমাধ্যম হয়ে ওঠার সময় এখনো আসেনি।
ভবিষ্যতে কী হবে সেটা বলা যায় না। তবে এখন পর্যন্ত সোশ্যাল মিডিয়া সামাজিক গণমাধ্যম হিসেবেই কাজ করছে। সামাজিক গণমাধ্যম এবং গণমাধ্যমের মধ্যে একটি মূল পার্থক্য হচ্ছে গণমাধ্যমে যে তথ্যটা দেওয়া হয় সেটা সম্পাদনার মাধ্যমে উপস্থাপিত হয়। অর্থাৎ একটি তথ্যকে সম্পাদনা, যাচাই-বাছাই, মূল্যায়ন করে নির্দিষ্ট ট্রিটমেন্ট দিয়ে পত্রপত্রিকায় বা টেলিভিশনে প্রচারিত এবং প্রকাশিত হয়। এই পার্থক্যের কারণে যারা গণমাধ্যমের ভোক্তা, পাঠক এবং দর্শক তারা গণামাধ্যমকে বিশ্বাস করে যে, নিউজটি সম্পাদিত হয়ে এসেছে। অতএব এটার ওপর বিশ্বাস রাখা যায়। সামাজিক গণমাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে যে কোনো বিষয় চলে আসে। মানুষ জানতে পারে। এক্ষেত্রে তাৎক্ষণিকতার একটি মূল্যায়ন আছে। কিন্তু পাঠকের মনে গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমের যে একটি পার্থক্য সেটা কিন্তু থেকেই যায়। সম্পাদনা হচ্ছে সাংবাদিকতার প্রাণ। যেখানে সম্পাদনা নেই সেখানে আসলে সাংবাদিকতা হয় না। সম্পাদনা ছাড়া যে সামাজিক মাধ্যম চলে সেগুলো কোনো গণমাধ্যম হতে পারে না।তবে সামাজিক যোগাযোগের শক্তিশালী এই প্ল্যাটফর্মে কোনো ঘটনা প্রকাশের পর সেই জল অনেক দূর গড়ানোর বহু ঘটনা অহরহই ঘটছে৷ নানা সীমাবদ্ধতার কারণে মূলধারার গণমাধ্যমে কোনো ঘটনা যদি না আসে বা তারা কৌশলে এড়িয়ে যেতে চাইলেও অনেক সময় পারেনি৷ কারণ ফেসবুকে রাখঢাকহীন আলোচনার সঙ্গে তথ্য-প্রমাণ হাজির হওয়ায় পর অনেক ঘটনাই শিরোনাম হয়েছে পত্রিকার পাতায়, আর তাতে নড়েচড়ে বসতে হয়েছে অনেকেকই। তবে শেষ বিচারে সমাজ মাধ্যম রয়ে গেছে এমবার্ত একো বর্ণিত সেই শুঁড়িখানাতেই।