মূল্যবোধের রাজনীতিতে সত্যিই কি ‘কলঙ্কিত’ কেজরিওয়াল?

ফাইল চিত্র

পুলক মিত্র

অবশেষে রাজধানী দিল্লির দখল নিল দিল্লি। ১৯৯৩-এর পর এই দিল্লিতেই একের পর নির্বাচনে হারতে হয়েছে বিজেপি-কে। আম আদমি পার্টির পরাজয়ে কংগ্রেস শিবির যেমন খুশি, তেমনই দীর্ঘকাল পর দিল্লির দখল নিতে পেরে অত্যন্ত উল্লসিত বিজেপিও। তবে বিজেপির এই জয় খুব একটা মসৃণ পথে আসেনি। শুধু সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপানো নয়, দলকে জেতানোর জন্য ময়দানে নামতে হয়েছে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকেও।

২০০৮-এর নির্বাচনে দিল্লিতে কংগ্রেস পেয়েছিল ৪০ শতাংশ ভোট। এবার তা দুই অঙ্কের গণ্ডি পেরোতে পারেনি। অন্যদিকে, ২০১৩-তে বিজেপির ভোটের হার ছিল ৩৩ শতাংশের বেশি। তারপর থেকে বিজেপির ভিত্তি মজবুত থাকলেও, মাত্র কয়েকটি আসনে জয় পেয়েছিল এই দল।


২০১৫ থেকে বিজেপির ভোটের হার বাড়তে থাকে। আপের এই হারের জন্য দায়ী কি সরকারের কাজের প্রতি অসন্তোষ? নাকি আদর্শগত প্রশ্নে মানুষের বিশ্বাসের ভিত্তি টলে গিয়েছিল? ২৭ বছর পর দিল্লিতে ক্ষমতায় ফেরা রাজনৈতিক দিক থেকে বিজেপির কাছে এক উল্লেখযোগ্য মুহূর্ত। ২০১৫তে দেশজুড়ে প্রবল মোদী হাওয়া থাকা সত্ত্বেও দিল্লির ভোটাররা কিন্তু বিজেপিকে পছন্দ করেননি। যদিও ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে তাদের খুব ভালো ফল হয়েছিল। কিন্তু ২০২০-র বিধানসভার ভোটে বিপুল গরিষ্ঠতা পায় আপ।

২০১৫তে বিজেপি জিতেছিল মাত্র ৩টি আসনে। আর ২০২০তে পেয়েছিল ৮টি আসন। কিন্তু বিজেপির ভোট বেড়েছিল ৭ শতাংশ। অন্যদিকে, আপের ভোট প্রায় ১০ শতাংশ কমে যায়। বিজেপির জয়ের সুবাদে ২০১৩-র পর এই প্রথম কেন্দ্র ও দিল্লিতে একই দলের সরকার হতে চলেছে। ২০২০তে বিজেপির ভোটের হার ৩৮ শতাংশ ছাড়িয়ে গিয়েছিল, যা ২০১৩তে ছিল ৩৩ শতাংশ। নতুন দিল্লি আসনে হারতে হয়েছে অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে। হেরেছেন মণীশ সিসোদিয়া, সত্যেন্দ্র জৈনের মতো নেতারা। কারাগার থেকে বেরনোর পর আর মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে ফেরেননি কেজরিওয়াল। বলেছিলেন, একেবারে জেতার পরই ফিরবেন। কিন্তু সেই ফেরা আর হল না। দলকেও জেতাতে পারলেন না তিনি।

কেজরিওয়াল কি দিল্লিবাসীর অসন্তোষ আঁচ করতে পেরেছিলেন? তা না হলে, ২০ জন বিধায়ককে কেন আবার টিকিট দেওয়া হল না? বিজেপি-ও তাদের প্রার্থী বদল করেছিল। বিজেপি তাতে লাভবান হলেও, আপ পারল না। দিল্লির নির্বাচনে বিজেপির জয় এবং আপের পরাজয় নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি আপকে কীভাবে হারানো হল, সেই প্রশ্নও উঠে আসছে। প্রশ্ন উঠেছে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়েও।

ভোটার তালিকা নিয়ে বেশ কিছু গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে আপ। তথ্য বলছে, ২০২০-র বিধানসভা নির্বাচন ও ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের মধ্যে দিল্লিতে ভোটার বেড়েছে ৪ লক্ষ। গত বিধানসভা নির্বাচনের মাত্র ৭ মাস আগে ৪ লক্ষ নতুন ভোটার যুক্ত হয়েছে। অরবিন্দ কেজরিওয়ালের কেন্দ্র নতুন দিল্লিতে গত ৫ বছরে ভোটার কমেছে ২৭ শতাংশ।

এর আগে, মহারাষ্ট্রে ভোটে লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচনের মধ্যবর্তী সময়ে ৪০ লক্ষ নতুন ভোটার যুক্ত হওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন রাহুল গান্ধী। বিভিন্ন মহল থেকে এই প্রশ্নগুলো উঠে আসছে। এখন নির্বাচন কমিশন কি এই সব প্রশ্নের জবাব দেবে?

নির্বাচনী হিসেব-নিকেশের চেয়ে আপের পরাজয়ে বড় হয়ে উঠে এসেছে মূল্যবোধ ও আদর্শগত প্রশ্ন। গত ১২ বছরে আপের একের পর এক নেতা জেলে গিয়েছেন, জেলে যেতে হয়েছে মুখ্যমন্ত্রী, উপ মুখ্যমন্ত্রীকেও। তাই সরকার চালানো আপের পক্ষে খুব একটা সহজ ছিল না। একের পর এক নেতা, মন্ত্রী, বিধায়কের বাড়িতে তল্লাশি চালানো হয়েছে। অনেকে আপ ছেড়ে যোগ দিয়েছেন বিজেপি-তে।

পাশাপাশি বিভিন্ন মহলে সন্দেহের মেঘও তৈরি হয়। রাজনৈতিক মহলের একাংশ আপকে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের বি-টিম বলে মনে করেন। তার ওপর আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের কাছে কেজরিওয়ালের চিঠি লেখার ঘটনায় সন্দেহের মেঘ আরও ঘনীভূত হয়েছে। আপের উত্থানের পিছনে আরএসএসের ভূমিকা বরাবরই অনুচ্চারিত থেকে গিয়েছে। তবে দিল্লির বিজেপির জয়ের পর এই বিষয়টি আবার সামনে চলে এসেছে।

শুধু তাই নয়, দিল্লির দাঙ্গার সময়ও আপের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আপের নেতারা কখনই গ্রেফতারির প্রতিবাদ জানাননি। আপ লোকপালের নাম ঘোষণা নিয়ে কখনও উৎসাহ দেখায়নি। গত ১০ বছরে বিজেপির সঙ্গে আপের বারবার সংঘাত হয়েছে। আরএসএস ঘনিষ্ঠতা নিয়ে আপ কখনও এই সব অভিযোগ নিয়ে অবস্থান স্পষ্ট করেনি। তবে নির্বাচনে হারলেও, প্রধান বিরোধী দল হিসেবে নিজের অস্তিত্ব বজায় রেখেছে আপ।

এখন প্রশ্ন হল, আপ কি দিল্লিতে নিজের আদর্শগত ভিত্তি মজবুত করতে ব্যর্থ হয়েছে? অন্য যে প্রশ্নটি উঠছে, তা হল দিল্লির হিন্দু ভোটারদের বিজেপির ভোটার হিসেবে গণ্য করার ক্ষেত্রে আপের কোনও ভুল হয়েছিল কি?

হিন্দু ভোট কব্জা করার জন্য আপকে কেন বিজেপির হিন্দুত্বের পথ ধরতে হল? গত নির্বাচনে কেজরিওয়াল বলেছিলেন, প্রতি মাসের প্রথম মঙ্গলবার হনুমান চালিশা পাঠের আয়োজন করা হবে। রাজনীতির ময়দানে দিল্লির ভোটাররা বিজেপি ও আপের মধ্যে তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য ফারাক খুঁজে পাননি।

তবে কেজরিওয়ালকে সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হয়েছে কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। যে রামলীলা ময়দান থেকে আন্না হাজারের নেতৃত্বে আন্দোলনে গতি এসেছিল এবং দিল্লির ক্ষমতা থেকে কংগ্রেসকে উৎখাত করা হয়েছিল, সেই একই ময়দানে লোকসভার নির্বাচন উপলক্ষে কেজরিওয়ালের গ্রেফতারির বিরুদ্ধে সভা করেছিল কংগ্রেস। সেই সভায় মঞ্চে দুটি চেয়ার ফাঁকা রাখা হয়েছিল। একটি কেজরিওয়ালের, অন্যটি ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনের। সেই সময় দুই নেতাই জেলে ছিলেন। কেজরিওয়ালের গ্রেফতারি নিয়ে রাহুল বরাবরই মোদি সরকারকে নিশানা করেছেন। ইন্ডিয়া জোটের এই দুই শরিক দিল্লির নির্বাচনে যেভাবে কাদা ছোড়াছুড়ি করেছে, তা ভোটারদের নজর এড়ায়নি। সেক্ষেত্রে এই জোটের আর গুরুত্ব রইল না। এমনকি ২০১৩তে আপ যখন কংগ্রেসকে হারিয়ে প্রথমবার ক্ষমতায় আসে, তখনও কেজরিওয়ালের দলকে সমর্থন দিয়েছিল কংগ্রেস। তারপর দুই দল দেশের বিভিন্ন রাজ্যের নির্বাচনে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। একমাত্র ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে আপ ও কংগ্রেসের মধ্যে রফা হয় এবং একসঙ্গে লড়াই করে। কিন্তু দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে আপ একতরফাভাবে ৭০টি আসনেই প্রার্থী ঘোষণা করে দেয়।

দিল্লিতে বিজেপির ভিত বরাবর শক্তিশালী থেকে গেলেও, তিনবার তারা কংগ্রেসের শীলা দীক্ষিতের কাছে হেরেছে। ২০১৫ এবং ২০২০তেও আপকে হারাতে পারেনি বিজেপি।

কেজরিওয়াল বেশ কিছু ভুল করেছেন, যার ফায়দা তুলেছে বিজেপি। যেমন, যমুনা নদীর দূষণ নিয়ে তাঁর তির্যক মন্তব্য এবং বিজেপি-কে কদর্য ভাষায় আক্রমণ। অন্যদিকে, মহিলাদের অ্যাকাউন্টে ২৫০০ টাকা করে দেওয়ার ঘোষণা বিজেপিকে বাড়তি ফায়দা দিয়েছে। বিজেপি এবারের নির্বাচনে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে কাউকে তুলে ধরেনি। তথাপি জয় ছিনিয়ে নিতে সমর্থ হয়েছে।

সততাকে বরাবরই বড় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন কেজরিওয়াল। কিন্তু তাঁর বাসগৃহের আড়ম্বরপূর্ণ সজ্জা নিয়ে ভোটারদের মধ্যে সন্দেহের বাতাবরণ তৈরিতে সফল হয়েছে বিজেপি। যে রাজনৈতিক মূল্যবোধ ও ভাবমূর্তির ওপর ভর করে দিল্লিতে কেজরিওয়ালের উত্থান ঘটেছিল, তা নিয়ে আজ বড় প্রশ্নচিহ্ন তৈরি হয়েছে। দেশের মানুষ আজ বলছেন, কেজরি, তুমিও…।