আদপে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান রূপায়ণ কি সম্ভব?

রতন পাখিরা।‌ সাদামাটা নিপাট এক ভদ্রলোক। পাঁচ ফুট ছ’য়ের মানুষটির পরনে ময়লা না কাঁচা ঢলঢলে পায়জামা, খদ্দেরের পাঞ্জাবি। কাঁধে শান্তিনিকেতনি ব্যাগ। আর তারই ভেতর “ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান”। জানি, রতন পাখিরাকে আপনারা কেউ চেনেন না।‌ যারা চিনতেন, তাঁরাও ভুলে গেছেন।‌ তাঁকে আমি প্রথম দেখি ১৯৮৭ সালে বিধানসভায়।‌ ১৯৭ ঘাটাল বিধানসভা সিটে প্রথম তিনি জিতে আসেন। ১৯৮৭ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত ছিলেন ঘাটালের সিপিএম বিধায়ক। বিধানসভায় ঘাটালের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে বিরোধীদের মত গলা ফাটাতেন তিনি। আর ছিলেন সবঙের কংগ্রেস বিধায়ক ডাঃ মানস ভুঁইয়া। তাঁর কপালেশ্বরী আর কেলেঘাইয়ের ভয়ে আমরা মানসদাকে দেখলেই ছুটে পালাতাম। খপ করে হাতটা চেপে ধরতেন। বলতেন, সব ভেসে গেল; কেলেঘাইটা নিয়ে লেখ না একটা। বর্ষা এলেই রতন পাখিরা আর মানস ভুঁইয়া সরগরম করে তুলতেন বিধানসভা। ঘাটাল নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর সামনে সোচ্চার হতেন রতন পাখিরা।

এহেন রতন পাখিরা একদিন সন্ধ্যারাতে আমাকে ধরে নিয়ে গেলেন কিড স্ট্রিটে এমএলএ হোস্টেলে তাঁর ঘরে। খাটের ওপর ছড়িয়ে বসলেন ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান নিয়ে। বোঝালেন, ঘাটাল হচ্ছে গামলার মত নিচু জায়গা। ফলে, বর্ষার সময় হুঁ হুঁ করে জল ঢোকে সেখানে। তারওপর শিলাবতী-কংসাবতী ভাসিয়ে নিয়ে যায় ঘাটাল শহরকে। অন্যসময় আপাতত নিরীহ কুলকুলে নদী শিলাবতী। তখন নদীর ওপর ব্রিজ হয় নি। নদীর তীরে থাকত নানা আকারের, নানান রঙের নৌকা। তখন শিলাবতী দেখার মত। আমার অনেকটা বেনারসের মত লাগত।

পশ্চিমবঙ্গের ঘাটাল মহাকুমা কলকাতা থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার পশ্চিমে। এমন একটি বাড়ি খুঁজে পাওয়া কঠিন যেখানে কখনও বন্যার সমস্যা হয়নি৷ ঘাটাল শহরের উপকণ্ঠে বসবাসকারী ৫৫ বছর বয়সী চম্পা সিং বলেন, “এখানে বসবাস করা কতটা কঠিন, আপনাকে বলে বোঝাতে পারবো না। বর্ষায় ভেসে যায় পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটালের বিস্তীর্ণ এলাকা। শিলাবতী, ঝুমি ও কংসাবতী নদীর জল বাড়লে ঘাটাল মহকুমার বিস্তীর্ণ এলাকা জলমগ্ন হয়ে থাকে। রূপনারায়ণ দিয়ে সেই জল বেরিয়ে গেলে সমস্যা কাটে। কিন্তু, তা না হওয়ায় এলাকাবাসী দুর্ভোগের মধ্যে পড়েন। জলের তলায় চলে যায় রাস্তাঘাট। যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ত্রাণ শিবির, প্রতিবেশীর পাকা বাড়ির ছাদে আশ্রয় নেন মানুষ। নৌকায় করে চলে যাতায়াত।


তার মধ্যে রাত-বিরেতে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে বা গুরুত্বপূর্ণ কাজে অন্যত্র যাওয়ার প্রয়োজন পড়লে তো আরেক সমস্যা। সেইসময় কার্যত অসহায় হয়ে পড়েন এলাকাবাসী। শুধু কি তাই ! জল নামলেও শুরু হয় অন্য আতঙ্কে। বিষধর সাপের আনাগোনা বাড়ে। এর পাশাপাশি এলাকায় পানীয় জলের সমস্যা দেখা দেয়। সেই বন্যার প্রভাব কেবল পশ্চিম মেদিনীপুরেই সীমাবদ্ধ থাকে না। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার পাঁশকুড়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলেও তার প্রভাব পড়ে। সেখান থেকেই ৪০ বছর আগে তৈরি হয়েছিল ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের পরিকল্পনা। যার বাস্তবায়ন এখনও প্রত্যক্ষ করতে পারম ঘাটালবাসী।

ফি বছর বর্ষা এলেই সংবাদ শিরোনামে ভেসে ওঠে ‘ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান’। ধসে যাওয়া একের পর এক বাড়ি, জলে তলিয়ে যাওয়া আপনজন, গবাদী পশুকে নিয়ে পাকা বাড়ির ছাদে আশ্রয় নেওয়া ঘাটালবাসী শোনেন আবারও ভরসার বাণী। তার পর বর্ষা শেষ, আলোচনাও কোথাও যেন হারিয়ে যায়! গত চল্লিশ বছর এভাবেই বর্ষায় ঘুরে ফিরে আসে ‘ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান’। কিন্তু কী এই ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান? এই পরিকল্পনার শুরু কোথায়? কোথায় দাঁড়িয়ে প্রকল্প ?

সে বছরও ব্যাপক বৃষ্টি হয়েছিল। পশ্চিম মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ এলাকা এমনই বিপর্যয়ের মুখে পড়ে, যে সংসদেও ওঠে ঘাটালের কথা। তার পর থেকে সংসদে বার বার আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ায় ঘাটাল। পাঁচের দশকে প্রথবার সংসদে ঘাটালের বন্যার সমস্যার কথা তোলেন বাম সাংসদ নিকুঞ্জবিহারী চৌধুরী। এর পরই ঘাটালের বন্যা সমস্যা খতিয়ে দেখতে একটি বিশেষ কমিটি গঠিত হয়। সেই কমিটিই ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাব গৃহিতও হয়। ঘাটালবাসী মন্ত্রীর মুখে শুনলেন তাঁদের জন্য ‘মাস্টার প্ল্যানের কথা’। ১৯৫৯ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের মানসিংহ কমিটি বন্যা কবলিত এলাকা পরিদর্শন করে। তারপর নানা কারণে থমকে যায় প্রকল্প।

তারপর ১৯৮৩ সাল। প্রায় কুড়ি বছর পর ‘ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান’ প্রকল্পের শিলন্যাস করেন রাজ্যের তৎকালীন সেচ মন্ত্রী প্রভাস রায়। তবে প্ল্যানের অগ্রগতি বলতে ওই শিলন্যাস। আচমকা থমকে গেল তার কাজ। এরপর বছর বছর বন্যায় ভেসে ১৯৯৩ সালে ‘ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান রূপায়ণ সংগ্রাম কমিটি’ গঠন করেন ঘাটালের বাসিন্দারা। তাতেও অবশ্য কাজের কাজ কিচ্ছু হয়নি। সেই রাজ্য ও কেন্দ্রের টানাপোড়েন এখনও জারি।

২০০৯ সালে অবশ্য প্রকল্প পুনর্মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত নেয় রাজ্য। ডিটেলস প্রোজেক্ট রিপোর্ট তৈরি শুরু হয়। ২০১০ সালে গঙ্গা ফ্লাড কন্ট্রোল কমিশনে প্রকল্পের ডিপিআর-ও জমা পড়ে। তার পরের বছরই মাস্টার প্ল্যান সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য চেয়ে ডিপিআর ফেরত পাঠায় কেন্দ্র। ২০১৫ সালে প্রকল্প রিপোর্টে সবুজ সংকেত দেয় কেন্দ্র। কিন্তু তাতেও কাজের কাজ কিছু হয়নি।

ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান মূলত ঘাটালকে ঘিরে থাকা মূল নদী এবং শাখা নদীগুলোর নিয়মিত ড্রেজিং করা। যাতে সেগুলোর জলধারণ ক্ষমতা বাড়ে । এবং বন্যার হাত থেকে ঘাটাল রক্ষা পায়। বলা হয়, পাম্প হাউস তৈরির অনুমোদন, চন্দ্রকোনা-ঘাটাল-দাসপুর-সহ পাশ্ববর্তী এলাকায় নদীপথ সংস্কার করা হবে কংসাবতী ও শিলাবতীতে।স্থানীয় খালগুলোতে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ, খাল সংস্কার। সেই সঙ্গে ঘাটালের নদী ও খাল গুলোতে লক গেট বাসানো প্রকল্পের লক্ষ্য।

অজানা কারণে এক চুলও এগোয়নি বামফ্রন্ট সরকার। ২০০৭ সালে একটা বড়সড় বন্যা ঘটে যাওয়ার পর ফের চাগাড় দেয় ‘ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান’। ২০০৮ সালে রাজ্য সরকার পূর্বতন ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের অংশ বিশেষ ঝাড়পোঁছ করে একটি সার্বিক পরিকল্পনায় হাত দেয়। কেন্দ্রীয় সরকারি পরামর্শদাতা সংস্থা ‘ওয়াটার অ্যান্ড পাওয়ার কনসালটেন্সি সার্ভিসেস লিমিটেড’ তথা ‘ওয়াপকস’কে। একটি প্রকল্প তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই সংস্থা ও রাজ্যের সেচ ও জলপথ বিভাগ যৌথভাবে ২০০৯ সালের ২৪ আগস্ট একটি রিপোর্ট জমা দেয়। প্রকল্প ব্যয় দাঁড়ায় ১৪৯২ কোটি টাকা। কিন্তু তারও কিছু ভুল ত্রুটির কারণে খড়্গপুর আই আই টি দ্বারা সংশোধিত হয়ে ২০১১ সালের জুলাই মাসে তা চূড়ান্ত হয়। এই রিপোর্টই গঙ্গা ফ্লাড কন্ট্রোল কমিশন (জি এফ সি সি) দ্বারা অনুমোদিত হয়ে কেন্দ্র সরকারের ঘরে আজও পড়ে রয়েছে অর্থ দফতরের অনুমোদনের অপেক্ষায়। প্রযুক্তিগত ও প্রশাসনিক অনুমোদন মিলেছে অবশ্যই। প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭৪০ কোটি টাকা। জি এফ সি সি -র ছাড়পত্র পেয়েছে ২০১৫ সালের মে মাসে। মোট প্রকল্প ব্যয়ের অংশ নিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের বিরোধ বাধে। শেষমেষ ৫০:৫০ শেয়ারে কেন্দ্র সরকার রাজি হলেও রাজ্য সরকার আজও সম্মত হয়নি। রাজ্যের দাবি, জনস্বার্থে কেন্দ্রকে প্রকল্প ব্যয়ের ৭৫ ভাগ দিতেই হবে। যা কেন্দ্র সরকার মানতে নারাজ। এই নিয়ে দড়ি টানাটানি আজও চলছে। কোনও ফয়সালা হয়নি। যা হচ্ছে শুধুই রাজনীতি আর রাজনীতি। ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান রূপায়ণ না হওয়ার এটি একটি বড় কারণ। এর মধ্যে প্রকল্প ব্যয় কিন্তু থেমে নেই। রাজ্য সেচ দপ্তরের একটি সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে এই প্রকল্প ব্যয় দাঁড়িয়েছে প্রায় দু’ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় জল সম্পদ দফতরের উপদেষ্টা কমিটি ২০১৮ সালে ৮ জুন এই সংক্রান্ত রিপোর্ট জমা দিয়েছেন। যত দেরি হবে প্রকল্প ব্যয়ও বাড়তে থাকবে।

ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের আওতায় রয়েছে দুই মেদিনীপুর জেলার ১৩টি ব্লক ও পাঁচটি পুরসভা এলাকা। ‘ওয়াপকস’-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ঘাটালে বন্যার জন্য দায়ী মূলত কংসাবতী ও শিলাবতী নদী। প্ল্যান রূপায়ণের জন্য কংসাবতী অববাহিকা অঞ্চলে ১২টি ও শিলাবতী অববাহিকা অঞ্চলে ৯টি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। ঘাটালের বন্যা রুখতে যেগুলি রূপায়ণ জরুরি। যেমন, দুই নদী সংস্কার, দুই পারে বাঁধ নির্মাণ, সেতু নির্মাণ, আলাদা করে রাস্তা নির্মাণ প্রভৃতি রয়েছে। এর সঙ্গে চেতুয়া, মোহনখালি, দুঃশ্বাসপুর ও শোলাটোপা সার্কিট থেকে জবর দখল করে থাকা কয়েক হাজার ঘরবাড়ি সরিয়ে নিতে হবে। ‘ওয়াপকস’ই বলেছে, এই সার্কিট বাঁধগুলোর অবস্থা অত্যন্ত সঙ্গীন। রক্ষণা-বেক্ষণ ও মজবুতিকরণের কাজ প্রায় দুঃসাধ্য। মূলত ঘাটাল শহরের অনেকটাই কিন্তু শিলাবতী নদীর বাঁধেই অবস্থিত।

প্রস্তাবে বলা আছে, এই জবরদখল কারীদের সরে যেতেই হবে। শিলাবতী, কংসাবতী, দুই কাঁসাই, দুর্বাচটি, প্রভৃতি নদীগুলোকে একশো থেকে দেড়শো মিটার পর্যন্ত চওড়া করতে হবে। ছোটো একটা উদাহরণ দিই, শিলাবতী নদী দেড়শো মিটার চওড়া করলে ঘাটাল শহরের মহকুমা শাসকের কার্যালয়টি থাকবে তো? এবার দুই পাড়ের দৃশ্য ভাবুন! নদীগুলোর সংস্কার হলে বিপুল পরিমাণ মাটি কোথায় থাকবে? প্রস্তাবে বলা আছে উচ্ছেদ হওয়া কয়েক হাজার পরিবারকে পুনর্বাসন দিতেই হবে।

দেখতে দেখতে রাজ্যে ৩৪ বছরের বাম শাসন শেষ হয়েছে। ১২ বছরের তৃণমূল সরকার কাজ করছে রাজ্যে। কিন্তু ‘ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান’ বাস্তবায়িত হয়নি। ২০১১ সালে অবশ্য সেচমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে এই বিষয়টি নিয়ে উদ্যোগী হন মানস ভুইঞা। কেন্দ্রীয় সরকারের ‘গঙ্গা ফ্লাড কন্ট্রোল কমিটি’ও ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানকে ছাড়পত্র-ও দেয়। প্রাথমিক ভাবে প্রকল্পের বাজেট ঠিক হয়েছিল ২,২০০ কোটি টাকা। কিন্তু গঙ্গা ফ্লাড কন্ট্রোল কমিটির হস্তক্ষেপের পর সেই বাজেট কমে দাঁড়ায় ১,২৪০ কোটি টাকা। সেই সময়ের নিয়ম অনুযায়ী এই প্রকল্পের ৭৫ শতাংশ ব্যয়ভার কেন্দ্রীয় সরকারের বহন করার কথা ছিল। বাকি অর্থ দিতে হত রাজ্যকে। কিন্তু পরবর্তী সময় সেই নিয়ম বদলে কেন্দ্র-রাজ্য দুই সরকারের উপরই প্রকল্পের পঞ্চাশ শতাংশ করে খরচের দায়ভার চাপে।

বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান দীর্ঘ দিনের প্রস্তাবিত প্রকল্প।বয়স ষাট পেরিয়েছে তার। তবে এখনও এই প্রকল্প দিনের আলো দেখেনি। ২০২২ সালে কেন্দ্রীয় সরকার প্রকল্পটিকে ‘ফ্ল্যাড ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড বর্ডার এরিয়া’ প্রোগ্রামে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব দেয় রাজ্য সরকারকে। রাজ্য সম্মতি জানায়। ওই বছরই ‘ইনভেস্টমেন্ট ক্লিয়ারেন্স’ও দেয় কেন্দ্র।তারপর নতুন করে আর কোনও অগ্রগতি বা টাকা বরাদ্দ কিছুই হয়নি।

তবে মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পরে ঘাটালের প্রস্তাবিত মাস্টার প্ল্যান কার্যকর করতে রাজ্য সরকার পদক্ষেপ করছে বলে খবর। লোকসভা ভোটের ফল প্রকাশের পর ঘাটালের সাংসদ দেবের সঙ্গে প্রাক্তন সেচমন্ত্রীর বৈঠকও হয়েছিল। তারপরই শিলাবতীর সঙ্গে চন্দ্রেশ্বর খালের সংযুক্তির জন্য জমি চিহ্নিতকরণের কাজ শুরু হয়েছে। ওই খালের সংযোগ মাস্টার প্ল্যানেরই অন্তর্ভুক্ত।
২৪-এর লোকসভা ভোটে ঘাটালে দেব নির্বাচনী প্রচারে প্রধান ইস্যুই করেছিলেন ঘাটাল মাস্টারপ্ল্যানকে। বস্তুত, অর্ধ শতক ধরে ঘাটাল মাস্টারপ্ল্যান ঘিরে আবর্তিত হয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুরের রাজনীতি। কিন্তু ওই প্রকল্প আর বাস্তবায়িত হয়নি। প্রথম বার সাংসদ হয়ে অভিনেতা দেব ঘাটাল মাস্টারপ্ল্যানের কথা তুলেছিলেন সংসদে।

‘ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান’ রূপায়ণ করতে হলে স্থায়ীভাবে জমি অধিগ্রহণ করতে হবে ৩৮৩৯ হেক্টর ও অস্থায়ীভাবে গ্রহণ করতে হবে ৯০৮৩ হেক্টর জমি। মোট ১২ হাজার ৯২২ হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করতে হবে রাজ্য সরকারকে। কত বিঘা জমি ভেবে দেখুন। এই পরিমাণ জমি অধিগ্রহণ করা হলে ঘাটাল ব্লক ও ঘাটাল শহরের অস্তিত্বই তো বিপন্ন হয়ে পড়বে। জমি আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে উঠে আসা এই সরকার এই বিপুল পরিমাণ জমি কৃষকদের কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারবে ?

‘ওয়াপকস’ই বলেছে, সার্কিট বাঁধগুলির অবস্থা অত্যন্ত সঙ্গীন। রক্ষণা-বেক্ষণ ও মজবুতিকরণের কাজ প্রায় দুঃসাধ্য। ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান দীর্ঘায়িত করার এটিও একটি বড় কারণ। শুধুমাত্র এই একটি কারণেই ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান আটকে যেতে পারে। প্রস্তাবে আরও অনেক শর্ত রয়েছে যা এই স্বল্প পরিসরে আলোচনা সম্ভব নয়। রাজ্য সেচ দফতরের এক আধিকারিক বলছিলেন, ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান রূপায়ণ ও সোনার পাথরবাটি একই। তাহলে কী ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান কোনোদিন রূপায়ণ হবে না? বর্ষায় ঘাটাল কী চিরকাল ডুববে? এই সমস্যা উপলদ্ধি করেই হয়তো দাসপুর পঞ্চায়েত সমিতি, ঘাটাল পঞ্চায়েত সমিতি, ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান রূপায়ণ সংগ্রাম কমিটি এমনকি বামেদের পক্ষ থেকে যে প্রস্তাবগুলো জমা পড়েছে তার সারাংশ হল দাসপুরে শিলাবতী নদীর সুরতপুর থেকে বা কাঁসাইয়ের গোকুলনগর থেকে বৈকুণ্ঠপুরে চন্দ্রেশ্বর খালের সঙ্গে একটি নতুন করে খাল কেটে যুক্ত করে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে জল প্রবাহিত হয়ে রূপনারায়ণ নদে গিয়ে পড়বে।

তাহলে ঘাটালের বন্যা প্রবণতা কমবে বলে দাবি করা হয়েছে। এই প্রায় চার কিলোমিটার খাল কাটতেও সেই বাধা জমি অধিগ্রহণ। তার উপর চন্দ্রেশ্বর খাল কাটাই নিয়ে ১৯৭২ সাল থেকে একটি মামলা জিইয়ে রয়েছে এখনও। তার সমাধান কিন্তু জরুরি। এর সঙ্গে আরও একটি বিষয়, চন্দ্রেশ্বর খাল কাটাই শুরু হলেই পাঁচশোর বেশি কৃষক পরিবার ক্ষতিপূরণের দাবিতে সরব হবেন। তাঁরা আজও ক্ষতিপূরণ পায়নি। তাঁরা ছেড়ে কথা বলবেন? এই সমস্যাগুলো কোনও রাজনৈতিক দলই খুলে বলছে না। কবে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান রূপায়ণ হবে? বা আদৌ রূপায়ণ হবে কী না। রতন‌ পাখিরা নেই, ঘাটালের সাংসদ দীপক অধিকারী অর্থাৎ দেব আপ্রান চেষ্টা করছেন। কিন্তু ঘাটালবাসী যে তিমিরে ছিলেন, সেই তিমিরেই থাকবেন কি? দেব কেন, আদপে কেউই জানেন না।