ডাক্তারকন্যার কি ‘জাস্টিস’ পাওয়া সম্ভব?

হীরক কর

‘জাস্টিস’, ‘জাস্টিস’ বলে তারস্বরে চিৎকার করতে করতে টলোমলো পায়ে এগিয়ে চলেছে শিশু কন্যাটি। কতই বা বয়স হবে, বছর তিন। ১৪ আগস্টের মধ্য রাত। রবীন্দ্রসদনের সামনের রাস্তা। মেয়েদের রাত দখলের লড়াইতে সামিল সেও। এখনো মুখে ঠিক মত বোল ফোটে নি । আধো উচ্চারণে তার ‘জাস্টিস’, ‘জাস্টিস’ সোস্যাল মিডিয়ায় রীতিমতো ভাইরাল।

কিন্তু, ডাক্তারকন্যার কি ‘জাস্টিস’ পাওয়া সম্ভব । উত্তরটা সহজ, সম্ভবত “না” । কেননা, ‘প্লেস অব অকারেন্স’ বা ‘পিও’ অনেক আগেই নষ্ট হয়ে গেছে। আর এই কারণেই কামদুনি বা তাপসী মালিকরা সঠিক বিচার পাননি। পুলিশ যাওয়ার আগেই ক্রাইম সিন আগুনে পুড়‍িয়ে ফেলা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের নোবেল চুরির ক্ষেত্রেও একই ঘটনা। সিবিআই পৌঁছেছিল নোবেল চুরির প্রায় একমাস পরে। ততদিনে ‘পিও’ তছনছ হয়ে গেছে। ডাক্তারকন্যার মৃত্যুর পর যখন পুলিশ প্রথম ‘প্লেস অব অকারেন্স’ অর্থাৎ সেমিনার হলে যায় তখনই বুঝতে পারা গিয়ে ছিল যা হবার হয়ে গিয়েছে। সেখানে অন্যান্য পড়ুয়া ও হাসপাতাল কর্মচারীদের ঢোকা-বেরনো চলেছে অবাধে। এমনকি তরুণীর কুর্তি, জিন্সের প্যান্ট সহ অন্যান্য জিনিস টেনে সরানো হয়েছে। ঘটনার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অকুস্থল ঘিরে না দিয়ে গাফিলতি প্রমাণ করেছেন। এবং সেটা ইচ্ছেকৃত। তরুণী চিকিৎসকের মৃত্যুর খবর এক ইর্ন্টানের মাধ্যমে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রথম জানতে পারে। তারা বিষয়টি তৎকালীন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে জানান। সন্দীপ ঘোষ সেমিনার হলে এসে দেহ দেখেন। সেখান থেকে ফিরে এসে হাসপাতালের অন্য এক আধিকারিককে নির্দেশ দেন চিকিৎসকের পরিবারকে জানিয়ে দিতে তরুণী আত্মঘাতী হয়েছেন। এর প্রতিবাদ করে এক চিকিৎসক বলেছিলেন তরুণী অর্ধনগ্ন  এবং পোশাক অবিন্যস্ত অবস্থায় রয়েছে। এরপরে এটাকে কী করে আত্মহত্যা বলা যায়। সন্দীপ ঘোষ ওই চিকিৎসকের কথায় পাত্তা দেন নি। সন্দীপের নির্দেশ মতোই তরুণীর পরিবারকে ফোন করেন  এক আধিকারিক। তরুণীর পরিবারকে দীর্ঘক্ষণ বসিয়ে রাখার পিছনেও সন্দীপ ঘোষের বিশেষ ভূমিকা ছিল। তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন তিলোত্তমার বাবা-মাকে বসিয়ে রেখে সেমিনার হলে তথ্য প্রমাণ লোপাট করার কাজ চলছিল। ওই হাসপাতাল কর্তা ঘটনার পর কাদের কাদের ফোন করেছিলেন তার তথ্য এখন তদন্তকারীদের হাতে।


সিবিআইয়ের জোরায় মুখ খুলতে শুরু করেছে সিভিক ভলেন্টিয়ার সঞ্জয় রায়। জেরার মুখে জানিয়েছে, মদ ও গাঁজা দুটো একসঙ্গে খাওয়ায়, তার নেশা চরমে উঠে গিয়েছিল। সেমিনার হলে যাওয়ার আগে সে তিন তলার করিডোরে অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে। সেখানে কোনো মহিলা আছে কিনা তার খোঁজ খবর নেয়। টলতে টলতে সে চারতলায় পৌঁছয়। রোস্টার দেখে জানতে পারে বৃহস্পতিবারের ডিউটিতে আছেন এক মহিলা চিকিৎসক। এরপর সেমিনার রুমে ঢুকে দেখে  মহিলা চিকিৎসক গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সে চিকিৎসককে জাপটে ধরে। এতে ঘুম ভেঙে যায় মহিলার। তিনি সঙ্গে সঙ্গে এর প্রতিবাদ করেন। তাকে লক্ষ্য করে ঘুষি মারে। সঞ্জয় পাল্টা ঘুষি চালায়, চিকিৎসকের থুতনিতে গিয়ে লাগে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে দুজনের মধ্যে ধস্তাধস্তি চলে। সঞ্জয় এবার মহিলাকে বেধরক মারতে শুরু করে। তাতেও দামেন নি ডাক্তার তরুণী। উল্টে তার হাত ছাড়িয়ে বাইরে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেন। দরজার কাছে পৌঁছলে সঞ্জয় তাকে টেনে ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে নেয়। দেওয়ালে মাথা ঠুকে দেয়। তরুণী আহত হন। ল্যাঙ মেরে চিকিৎসককে মাটিতে ফেলে দেয়। তারপর তার জিন্স ও অন্তর্বাস খুলে ফেলে। চিকিৎসক বাধা দিলে তাকে মারতে থাকে। তরুণী চিৎকার করে বলতে থাকেন তিনি ওপরমহলে অভিযোগ জানাবেন। সঞ্জয় তাঁর মুখে কাপড় গুঁজে দেয়। তদন্তকারীদের সে বলেছে। তরুণীর আচরণে তার মাথা গরম হয়ে যায়। শ্বাসরোধ করে খুন করে ডাক্তারকন্যাকে। এরপর সে তার এক চিকিৎসক বন্ধুকে ফোন করে গোটা ঘটনাটা জানায়। সঞ্জয়ের এই স্টেটমেন্ট তখনই কাজে লাগবে যখন এর সপ‍ক্ষে ‘এভিডেন্স’ অর্থাৎ প্রমাণাদি পাওয়া যাবে। কিন্তু, এতদিন ধরে জেরা করেও সঞ্জয়ের কাছ থেকে ‘এভিডেন্স’ জোগাড় করতে পারে নি সিবিআই। সিবিআইয়ের এখন ভরসা ডিজিটাল এভিডেন্স আর ফরেন্সিক রিপোর্ট।

এটা থেকে স্পষ্ট চিকিৎসকদের একাংশের সঙ্গে এই সিভিক ভলেন্টিয়া‍রের ভাল রকম ঘনিষ্ঠতা ছিল। অভিযুক্ত সঞ্জয় তাদের কাছে অনেক কিছু পৌঁছে দিতেন। মাদক, মহিলাও হতে পারে। এর বিনিময় ওইসব চিকিৎসকদের দিয়ে  নিজের বহু কাজ করে নিত সঞ্জয়। তার মোবাইল ঘেঁটে একাধিক ডাক্তারের নাম ও হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ এর চার্ট পাওয়া গেছে। যেখানে চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয় ছাড়াও বিভিন্ন বিষয় রয়েছে। কিন্তু সঞ্জয়ের সঙ্গে আর কে কে ছিল এ ব্যাপারে এখনো মুখ খোলেনি সে। এখনো তার দাবি এ কাজ সে একাই করেছে।

সোস্যাল মিডিয়ায় একটি অডিও ক্লিপ ঘোরাঘুরি করছে, তাতে বলা হয়েছে, এই মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ মোটা টাকা নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের পাশ করাবার চক্র চালাত। সেই টাকার মোটা অংশ যেত পার্টি ফান্ডে যেত। আমাদের ডাক্তারকন্যাকে হুমকি দেওয়া হয়েছিল, টাকা না দিলে তাঁর থিসিস পাশ করানো হবে না। এই নিয়ে ঝামেলা চলছিল মাস ছয়েক ধরে। ঘটনার দিন যে চারজনের সঙ্গে অনলাইনে আনা খাবার তিলোত্তমা খেয়েছিল তাদের মধ্যে ছিল এক মহিলা ইর্ন্টান, তার বয়ফ্রেন্ড, এবং তাদের দুই বন্ধু। তাদের সঙ্গে এই নিয়ে তিলোত্তমার মধ্য রাত পর্যন্ত ঝগড়া হয়। তারপর  তারা ডাক্তারকন্যাকে বলে, এবার তুই ঘুমিয়ে পর। এরপর ওরা মদ খেতে যায়। মদ্যপ অবস্থায় ডাক্তারকন্যাকে ওই মেয়েটি ও আরেক জন চেপে ধরে। বেধরক মারধর করা হয় । দেওয়ালে মাথা ঠুকে দেওয়া হয়। শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। মৃতদেহের পিঠের ওপর বুট পড়ে যাতায়াত করা হয়। দুই পায়ের মাঝখান থেকে চিঁড়ে দেওয়া হয়। অভয়া মারা গেলে তারা সেমিনার রুম থেকে বেরিয়ে পাশের বাথরুমে হাত পা ধুতে যায়। পরে প্রমাণ লোপাটের জন্য সন্দীপ ঘোষের নির্দেশে ওই বাথরুম ভেঙে ফেলা হয় বলে অভিযোগ।

অপরাধীরা সেমিনার রুম থেকে বেরিয়ে ‘তারকাটা’ সঞ্জয়কে ফোন করে। সঞ্জয় ওই সময় গ্রুপ ডি স্টাফদের সঙ্গে জরুরি বিভাগের নিচে বসে মদ খাচ্ছিল। তাকে বলা হয়, যা সেমিনার রুমে তোর খাবার রাখা আছে। মাতাল সঞ্জয় এসে মৃতদেহকেই ধর্ষণ করে। কানের হেডফোন ফেলে চলে যায়। ইর্ন্টানরা সকলকে বলে সেমিনার রুমে কেউ যাবে না। ওখানে কাজ হচ্ছে ।

পরদিন সকালে পুলিশ গিয়ে দেখে সেমিনার রুমে একটি গদিওয়ালা সোফা রয়েছে। পাশে একটি গদি রাখা রয়েছে। সেখানে পরিপাটি করে সাদা চাদরে বিছানা করা। সেখানে শুয়ে নেই তিলোত্তমা। মৃতদেহ পরে রয়েছে মাটিতে। তাই দেখে তদন্তকারীরা আশ্চর্য হয়ে যান। তবে কি অন্য জায়গায় খুন করে সেমিনার রুমে বডি ফেলে দেওয়া হয়েছে ! ইনকোয়েস্ট করার পর প্রাথমিক তদন্তে কলকাতা পুলিশ সূত্রেই জানা যায়, তিলোত্তমার ঘাড়ের এবং পেলভিকের হাড় ভেঙেছে। কিন্তু এই কলকাতা পুলিশই পরে জানায় ময়নাতন্ত্রের রিপোর্টে কোন হাড়ভাঙ্গা পাওয়া যায়নি। তবে কি ময়নাতদন্ত রিপোর্ট ‘ম্যানুফাকচারিং’ করা হয়েছে। সেই জন্যই তো কলকাতা পুলিশ তড়িঘড়ি ময়নাতদন্ত করিয়ে মৃতদেহ দাহ করার ব্যবস্থা করে। যাতে আদালতের নির্দেশে দ্বিতীয়বার ময়নাতদন্ত না করানো যায়। সিবিআই জানতে পেরেছে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে তিলোত্তমার পরিবার দেহ সংরক্ষণের অনুরোধ করেছিলেন। যাতে দ্বিতীয়বার ময়নাতদন্ত করা যায়। কিন্তু এক শীর্ষ কর্তা তাতে বাধা দেন। কে সেই কর্তা ? স্বাস্থ্য দফতরের কেউ ?

সেমিনার রুমে চাবি থাকে ওই ওয়ার্ডের সিস্টার ইনচার্জ এর কাছে। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অধ্যাপকরা বলছেন ক্লাস হয়ে যাওয়ার পর বিকেল চারটে নাগাদ সেমিনার রুমে তালাচাবি পড়ে যায়। ওই সেমিনার রুমে রয়েছে সিস্টার ইনচার্জের কনফিডেন্সিয়াল কাগজপত্রের আলমারি। সেই আলমারির চাবিও থাকে সিস্টার ইনচার্জের কাছে। অধ্যাপকদের প্রশ্ন, ওই চাবি এই ইন্টার্ন‍দের  কাছে গেল কী করে। ফলে ধোঁয়াশা রয়েছে সর্বত্র।

ঘটনা হলো,  প্রিন্সিপাল সন্দীপ ঘোষ এই চক্রে ভীষণভাবে জড়িত। যে দুজন ইন্টার্ন এতে জড়িত, তারা হোস্টেলে সেক্স র‍্যাকেট চালায়। ডাক্তারকন্যা সেটা জানতে পেরে প্রতিবাদ করেছিলো। প্রিন্সিপালকে জানিয়ে ছিলো। কিন্তু ওনারা এটায় গা করেন নি। তিলোত্তমা হতাশ হয়ে বলেছিল যে সে এবার সোশ্যাল মিডিয়া, ফেসবুক,ইত্যাদিতে জানিয়ে দেবে। সেখান থেকেই গণ্ডগোলের শুরু, প্রথমে ওকে ভয় দেখানো হয়, ওর নতুন গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। দিনের পর দিন নাইট ডিউটি দেওয়া হয়। তারপরে রাতে টর্চার করার ফন্দি আঁটে ছেলেগুলো।

প্রিন্সিপাল জানতেন, কিন্তু টর্চারটা যে এতটা খারাপ হবে, সেটা বুঝতে পারেননি। তাই মৃত্যুর পরেই ধামাচাপা দেবার চেষ্টা চলছিলো। এমনকি আর জি কর হাসপাতালের ডাক্তাররা বাইরের কলেজের ডাক্তারদেরও ঢুকতে দিতে চাইছিলেন না। পরের ব্যাপারগুলো আমরা মিডিয়া থেকে সবাই জানি।

কথা হচ্ছিল এক চিকিৎসক বন্ধুর সঙ্গে। তাঁর মতে ,চোখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসার মতো ঘটনা অর্থাৎ পেটেকিয়াল হিমরেজ হবার জন্য গলায় তিরিশ সেকেন্ডের বেশি সময় ধরে পেশার দিয়ে রাখতে হয়। সাধারণভাবে হ্যাঙ্গিং-এ এরকম ঘটে না। একটি সুস্থ, যুবতী মেয়েকে অতক্ষণ গলা টিপে স্ট্র্যাঙ্গল করা হয়েছে। তার হাড় ভেঙে যাওয়া টর্চারের দাগ সারা গায়ে। ১৯ আগস্ট সোমবার ময়নাতদন্ত রিপোর্টটি প্রথমবার সোস্যাল মিডিয়ায় দেখা যায়। ওই দিন সন্ধ্যায় কলকাতা পুলিশ নিশ্চিত করে ভাইরাল রিপোর্টটি আসল। পুলিশের দাবি, রিপোর্টটি পরিবারকে দেওয়া হয়। তাই প্রকাশ্যে এল কি করে।‌পরিবারের দাবি তারা কাউকে দেননি। এই রিপোর্টে একাধিক আঘাতের কথা বলা হয়েছে। তবে ‘পিলভিক’ বা অন্য হাড় ভাঙ্গার উল্লেখ নেই। দেহের বাইরের অংশে ষোলটি আঘাত। যা খালি চোখে দেখা গেছে। গাল, ঠোঁট, নাক, চোয়াল, থুতনি, ঘাড়,হাত, সহ বিভিন্ন অঙ্গ পতঙ্গের ছরে যাওয়া ও কাল সিটের দাগ। ডান ঘাড়ে কামরের দাগ রয়েছে। দেহ ব্যবচ্ছেদের পরে দেখা গেছে ভেতরের অংশে মূলত মস্তিষ্ক, গলা, থাইরয়েড কার্টিলেজে আঘাত রয়েছে। সেখানেও রক্তক্ষরণ হয়েছে। শরীরের বাইরের অংশে যে আঘাতের চিহ্ন মিলেছে তা মৃত্যুর কারণের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
কলকাতা পুলিশ প্রথম থেকেই দাবি করছিল চিকিৎসা খুন ও ধর্ষণের ঘটনায় একজনই জড়িত। সে সিভিক ভলেন্টিয়ার সঞ্জয় রায়। কিন্তু কলকাতা শহরের ময়নতন্ত্রকারী চিকিৎসকদের বড় অংশই এই তথ্য মানতে নারাজ। তাদের পাল্টা প্রশ্ন একজনের পক্ষে কি করে একই সময় নাক মুখ চেপে ধরে শ্বাসরোধ এবং গলা টিপে খুন করা সম্ভব। কি করেই বা সমস্ত কিছুর পরে ধর্ষণ করে সে ৩০ মিনিটের মধ্যেই বেরিয়ে যায়। তর্কের খাতিরে যদি ধরে না হয় এমনটা সম্ভব । তাহলে মৃতদেহে এত আঘাতের চিহ্ন কেন  ? ঘুমের মধ্যেও যদি কেউ খুন হন তাহলে কি তিনি প্রতিরোধের চেষ্টা করবেন কখনও। ময়নাতদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী তিলোত্তমার শরীরে মোট ২৫টি আঘাতের চিহ্ন মিলেছে। এর মধ্যে ১৬ টি শরীরের বাইরের অংশে। বাকি ন’টা ভেতরে। যা শব ব্যবচ্ছেদের পরে পাওয়া গেছে। ময়নাতদন্ত রিপোর্টে লেখা হয়েছে, তরুণীর মৃত্যু হয়েছে গলা টিপে এবং নাক মুখ চেপে ধরে। এক চিকিৎসকের মতে, স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হচ্ছে, হয় গলা টিপে ধরা, নয়তো নাক মুখ চেপে ধরে শ্বাসরোধ  করে খুন করা। এক্ষেত্রে দুটোই করা হয়েছে বলে ময়নাতদন্তে উঠে এসেছে। এটা কী করে সম্ভব ! একজন গলা টিপে ধরলে তরুনীর তো হাত পা খোলা অবস্থায় থাকছে। এই পরিস্থিতিতে তিনি প্রতিরোধের চেষ্টা করবেন। ধাক্কা দিয়ে সরাতে চাইবেন নয়তো লাথি মারবেন। এক্ষেত্রে কি এসবের কিছুই হয়নি। একজন গলা টিপে ধরলে, অন্যজন নাক মুখ চেপে ধরলে। বাকিরা হাত-পা ধরে থাকলে এমন ঘটনা বেশি বিশ্বাসযোগ্য।  ময়নাতদন্ত রিপোর্ট যেভাবে লেখা হয়েছে সে নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে বিশেষজ্ঞদের। ময়নাতদন্ত রিপোর্টে লেখা হয়েছে, ‘এন্ডোসার্ভাইক্যাল ক্যানেল’ (যা জরায়ুর অনেকটাই ভেতরের অংশ) থেকে সাদা ঘন চটচটে তরল সংগ্রহ করা হয়েছে। তবে সেই তরল কি ? উত্তর নেই রিপোর্টে। সেমিনাল ফ্লুইডে কতটা বীর্য এবং কতজনের বীর্য মিলেছে সেটা ফরেনসিক পরীক্ষার আগে বলা সম্ভব নয়। ময়নাতদন্ত রিপোর্ট উল্লেখ করা হয়েছে তরুণীর ‘হাইমেন’ ছিঁড়ে গিয়েছিল। রক্ত এবং তরল মিশে যোনিপথে বেরিয়ে এসেছিল। যোনিপথে একাধিক আঘাতের  চিহ্ন পাওয়া গেছে। ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের মতে, ধর্ষণের প্রতিরোধ করার চিহ্ন এগুলো। এত আঘাত এবং ধর্ষণ করে একজনের পক্ষে এভাবে চলে যাওয়া খুবই কঠিন।

মেয়েটি শুধু গণধর্ষিতাই নয়, বহুক্ষণ ধরে চলেছিল এই নারকীয় তান্ডব। দুই তিন জনও নয়, এই রেপ মহোৎসবে যোগদান করেছিল আরো অনেকে। তাদেরই অনেকে সম্ভবত এখন আরজিকরে মেকি প্রতিবাদে বসদের বাঁচাচ্ছে। আরো বুঝে নিন, এই কয়েক ঘন্টা সময় ওখানে কেউ যায়নি। কেন ? বাকিদের চোখ রাঙানি ছিল,   সেই জন্যেই কি সঞ্জয়কে করিডোরে ঘোরাফেরা করতে দেখা গিয়েছিল ওই সময় ?

গোটা পোস্টমর্টেম রিপোর্ট, যেটা সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরছিল, এটা ফরেন্সিক টিমের প্রাথমিক রিপোর্ট, পোস্ট মর্টেম রিপোর্টই নয়। মৃতার দেহ তো পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে পুলিশ এসকর্ট দিয়ে, তাহলে পরে হাইকোর্ট নির্দেশ দিলেও পুনরায় পোস্টমর্টেম হবার আর চান্স রইল না।  রিপোর্টে একটা চশমার কথা বলা হয়েছে যেটা মেয়েটির দেহের কাছে পড়েছিল। ডাক্তারকন্যা তো চশমা পরতেন না, তাহলে চশমাটা কার ? সেটা কোথায়? তার ডিএনএ অ্যানালিসিস হয়েছে ? ওই ভাঙা চশমাই নাকি তিলোত্তমার চোখে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। আরজিকর হাসপাতালের প্রাক্তন অধ্যক্ষ বলেন ,”চেস্ট ডিপার্টমেন্টে যে ঘটনা ঘটেছে সেই মেয়েটিকে আমি বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলাম বাট শি ডায়েড, ইট ওয়াজ আনঅ্যাভয়ডেবল।” অর্থাৎ সন্দীপ ঘোষ স্বচক্ষে তিলোত্তমাকে জীবিত অবস্থায় দেখেছেন। এবং চিকিৎসা করার ব্যবস্থা না করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছেন। তাই, প্রশ্ন উঠেছে, ওকে কেন এখনও গ্রেফতার করা হচ্ছে না ? সমস্ত প্রতিষ্ঠানে কিছু অদৃশ্য মানুষ কাজ করেন, যেমন ঠিকা শ্রমিক, বাসন ধোয়ার মাসি, বাথরুম পরিষ্কার করার লোক ইত্যাদি। এঁরা সাধারণত সবটা জানেন কিন্তু এঁদের কাছে কেউ জানতে চায় না। এদের নিশ্চয়ই জিজ্ঞাসাবাদ করবে সিবিআই।

আরজি কর হাসপাতালের নানান জুনিয়র ডাক্তার, আশেপাশের দোকানদার, রোগীদের কথা বলে বোঝা গেছে, নির্যাতিতা মৃত মেয়েটির প্রাথমিক রিপোর্ট বলছে ওই তরুণী ডাক্তারের চোখ যৌনাঙ্গ এবং শরীরে রয়েছে একাধিক আঘাতের চিহ্ন। আততায়ী এ ক্ষেত্রে একজন হতে পারে না, কারণ যে কোনও মহিলার ওপর আক্রমণ হলে তিনি সবার আগে আত্মরক্ষা করবেন। চিৎকার করবেন। কিন্তু কেউ ওই নির্যাতিতার চিৎকার শুনতে পাননি। রাতের নিস্তব্ধতায় সামান্য চিৎকার যেখানে অনেক বেশি করে শোনা যাওয়ার কথা। এ ক্ষেত্রেও প্রশ্ন ওঠে, আততায়ী কোনওভাবেই একা হতে পারে না।
আরজি কর হাসপাতালে চরম অরাজকতা চলছে। আর তার নেপথ্যে রয়েছে এক এবং একমেদ্বিতীয়ম আরজি কর হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ। যিনি কিনা শাসক দলের নয়নের মণি। তিনি নাকি এক প্রভাবশালী মহিলার দেওরপো। এহেন সন্দীপ ঘোষের কোনও কাজ নিয়ে প্রশ্ন তুললে মেলে হোস্টেল খালি করে দেওয়ার হুমকি। শুধু কী তাই, মহামান্য অধ্যক্ষের কাজের বিরোধিতা করলে মিলত সাপলি অর্থাৎ ফেল করানোর হুমকিও। এর সঙ্গে রয়েছে আর্থিক দুর্নীতি, নিয়োগ দুর্নীতি, হাসপাতালের হিসেবের গরমিলের মতো একাধিক অভিযোগ। অথচ যদি কেউ শাসক দলের ছাত্র সংগঠন টিএমসিপির সদস্য হন তাহলে মেলে নানা ছাড়পত্র।
মহামান্য অধ্যক্ষের সঙ্গে দেখা করতে চাইলেও সাধারণ ছাত্র থেকে প্রফেসাররা দেখা করতে পারতেন না। তাঁদের অপেক্ষা করে ফিরে যেতে হতো। তাঁর প্রশ্রয়ে কলেজ ক্যাম্পাসে টিএমসিপি আশ্রিত দুষ্কৃতীদের অবাধ যাতায়াত চলে। অভিযোগ, জুনিয়র ডাক্তারদের জোর করে গায়ে অ্যাপ্রন চাপিয়ে তৃণমূলের মিছিলে যেতে বাধ্য করাও হতো। আর বাধা দিলে বা না যেতে চাইলে কপালে জুটত মার। অভিযোগ রয়েছে হাউজ স্টাফ নিয়োগের ক্ষেত্রে অনার্স পাওয়া ছাত্রদের ইন্টারভিউতে কম নম্বর দিয়ে তৃণমূল করা ছাত্রদের অনৈতিকভাবে নিয়োগেরও।

২০২৩ সালে আরজি করের একটি ভিডিয়ো সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল। ওই ভিডিয়োতে দেখা যাচ্ছে মর্গে মৃতদের পরিবারের কাছ থেকে টাকা চাইছে সেখানকার ডোমেরা, না দিলে বডি প্রপার সেলাই হবে না। রেট ? ১৫০০ টাকা থেকে ২০০০ টাকা। ভিডিয়ো ভাইরাল হওয়ার পর একটি তদন্ত কমিটিও গড়া হয়েছিল সন্দীপবাবুর তত্ত্বাবধানে, কিন্তু কী হয়েছে তারপর ? তদন্ত রিপোর্ট কোথায় কেউ আর জানে না।
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে স্বাস্থ্যভবন নির্দেশিকা জারি করে সন্দীপ ঘোষের বদলির। ২০২৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মহামান্য অধ্যক্ষকে বদলি করার নির্দেশ এসেছিল মুর্শিদাবাদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। স্বাস্থ্যভবন থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল সন্দীপবাবুকে আরজি করের অধ্যক্ষ পদ থেকে অবিলম্বে অব্যাহতি দেওয়ার, কারণ তাঁর বিরুদ্ধে ছিল বিস্তর অভিযোগ। তা বদলি হলেন কি সন্দীপবাবু? না হননি, কারণ তাঁর ঘনিষ্ঠ টিএমসিপির কিছু ছাত্রদের নিয়ে বদলির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করান সন্দীপবাবু। অভিযোগ, ওই বিক্ষোভে শামিল ছিলেন বেশকিছু প্রাক্তনী সহ বহিরাগতরাও। ফলস্বরূপ অজ্ঞাত কারণ সন্দীপবাবুর বদলি আটকে যায়। সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে অভিযোগ আরজি কর মেডিকেল কলেজে ময়নাতদন্তে আসা দেহকে বেআইনিভাবে পড়াশোনার কাজে ব্যবহার করার। শুধু তাই নয়, হাসপাতালের জৈব আবর্জনা সিন্ডিকেটে বিক্রি করা, আমজনতার টাকার অপব্যবহার ও বেশি দামে হাসপাতালের জিনিস কেনারও অভিযোগ রয়েছে আরজি করের মহামান্য অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে। প্রাক্তন অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ হাসপাতালের ভেতরে বেআইনি খাবারের দোকান বসানো, পড়াশোনায় অনিয়ম, বেআইনি পার্কিংয়েরও। যা নিয়ে একবার ইডির কাছে নালিশও জানানো হয়েছিল বিরোধী পক্ষের তরফে। শুধু তাই নয় এই মহামান্য অধ্যক্ষটি আবার র‍্যাগিংয়েরও সমর্থক বটে।

আরজি করের মেডিকেল কলেজের রোগীকল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান তথা বর্তমান তৃণমূল বিধায়ক সুদীপ্ত রায়ের বিরুদ্ধে ২০২৩ সালে গুরুতর অভিযোগ উঠেছিল । অভিযোগ করেছিলেন আরজি করের প্রাক্তন ডেপুটি সুপার আখতার আলি। অভিযোগ রোগীকল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান সুদীপ্ত রায় এবং তাঁর সহযোগী তথা অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ অবৈধভাবে আরজি কর হাসপাতালের নানা সরঞ্জাম সুদীপ্ত রায়ের সিঁথিতে অবস্থিত নার্সিংহোমে পাচার করতেন। এই দুজন ছাড়াও অভিযোগে নাম ছিল এই দুইজনের ঘনিষ্ঠ আরজি করের আরও বেশ কয়েকজনেরও। আখতার আলির অভিযোগ, সুদীপ্ত রায় এবং তাঁর সাগরেদ সন্দীপ ঘোষ হাসপাতালের কোটি কোটি টাকা নয়ছয় করছেন।এমনকি শিশুর জীবনদায়ী ওষুধও জাল। তারই প্রতিবাদ করেছিলেন আমাদের ডাক্তারকন্যা। সন্দীপ ঘোষ কানে তোলেননি। এসবের জন্যই কি নৃশংস ভাবে প্রান দিতে হল তিলোত্তমাকে।

তিলোত্তমার খুনের ঘটনার প্রতিবাদ করায় হুমকি শুনতে হচ্ছে ডাঃ শ্রেয়া রায়কে। তিনি একটি হোয়াসআপ গ্রুপে লিখেছেন, ডাঃ অন্তরপ্রিয়া রানা, ডাঃ শিরিন গুলনাজ, ডাঃ অনিকেত, ডাঃ দর্শনা, তাঁকে হুমকি দিচ্ছে। এরা তৃণমূলের ইউনিয়নের সঙ্গে জড়িত। তিনি আরো অভিযোগ করেছেন, ঘটনার পর ৩৬ ঘন্টা ধরে এরা প্রমাণ লোপাটের চেষ্টা করেছে। অভিযোগ, আর জি কর হাসপাতালের দু’জন হাউস স্টাফ, একজন ইর্ন্টান চেস্ট বিভাগে সেক্স ও ড্রাগ রকেটের সঙ্গে যুক্ত ছিল। তাঁদের চিহ্নিত করে ফেলে ছিলেন নিহত পড়ুয়া তরুণী চিকিৎসক। তাদের সঙ্গে এই রাকেট চালানো নিয়ে তীব্র তর্ক -বিতর্ক হয় তিলোত্তমার। দুঁদে গোয়েন্দাদের মতে, হাসপাতালের চেস্ট ডিপার্টমেন্টের সিনিয়রদের ব্যবহারে খুন হয়ে যাওয়া চিকিৎসক খুবই হতাশায় ভুগছিলেন। সেই হতাশার কথা বাড়িতে বাবা মায়ের কাছে বলেও ছিলেন। ওই হাসপাতালে ডিউটিতে যেতে ভালো লাগছে না বলে অনীহা প্রকাশ করেছিলেন। তাই, সেক্স -ড্রাগ-জাল ওষুধ চক্রই তিলোত্তমার মৃত্যুর কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। সেই জন্যই প্রমাণ লোপাটের এত চেষ্টা।
ঘটনার দিন বিকেল চারটে বেজে কুড়ি মিনিটে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে সুরাতহাল সম্পন্ন হয়। সেই রিপোর্টে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট লিখেছেন টালা থানার দায়ের করা ইউডি কেস নম্বর ৮৬১/২৪-এর ভিত্তিতে সুরাতহাল সম্পন্ন হল। ৯ আগস্ট ১০টা ১০ মিনিটে হাসপাতালে তরফে আউট পোস্টে মৃতদেহ উদ্ধারের খবর এসে পৌঁছায়। সাড়ে দশটায় টালা থানার পুলিশ হাসপাতালে পৌঁছে যায় । তখনই ঘটনার স্থান  ঘিরে দেওয়া হয় ‘ক্রাইমসিন টেপ’ দিয়ে। সেমিনার রুমের বাইরে ও পাহারা বসিয়ে দেওয়া হয়। দুপুর বারোটা বেজে ৪৪ মিনিটে চিকিৎসক তরুণীকে মৃত বলে ঘোষণা  করেন ডাক্তাররা। ১টা বেজে ৪৭ মিনিটে টালা থানার তদন্তকারী অফিসার মৃত্যুর ঘটনায় অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা রুজু করেন। রাত এগারোটা বেজে ৪৫ মিনিটে মৃতার বাবার অভিযোগের ভিত্তিতে সেই জিডি বদলে যায় ফাস্ট ইনফরমেশন রিপোর্ট বা এফআইআরে। সকাল ১০ টা১০ মিনিটে টালা থানায় লিখে বেরোনো পুলিশের জেনারেল ডাইরিতে ভিত্তিতেই দিনভর চলেছে আর জি কর কান্ডের সমস্ত তদন্ত। নাকি এর পিছনে রয়েছে অন্য কোন রহস্য। আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের অভিযোগ, ঘটনা ধামাচাপা দিতে গিয়ে পুলিশ সময়টা গুলিয়ে ফেলেছে। কোন তথ্য প্রমাণ রাখা হবে আর কোনটা নয় সে হিসাব করতে গিয়ে এই সবটা গুলিয়ে গেছে। এখন ‘সময় সরণি’ মিলছে না। হাইকোর্ট প্রশ্ন তোলার পরে এই নিয়ে এখন পুলিশকে    তিরস্কারের মুখে ফেলেছে সুপ্রিম কোর্টও।

ঘটনার পর ১৮ দিন পেরিয়ে গেছে। কলকাতা পুলিশের তরফে দাবি করা হয় চিকিৎসকের দেহ প্রথম দেখা গিয়েছিল ৯ আগস্ট বেলা সাড়ে নটা নাগাদ। পুলিশের কাছে খবর পৌঁছায় বেলা ১০টা ১০ মিনিটে। পুলিশ তদন্ত শুরু করেই প্রথম জানতে চায় মৃতদেহ প্রথম কে দেখেছিল। কিন্তু তার কোন উত্তর মেলেনি। একবার অধ্যক্ষ ঘনিষ্ঠ পড়ুয়াদের মধ্যে থেকে বলা হয় একজন নার্স দেখেছেন ।কিন্তু তিনি কোথায়? পুলিশ জানতে চাইলে কাউকেই হাজির করানো হয়নি। এরপর বলা হয়, একজন আয়া দেখেছেন।  তিনি কে ? উত্তর মেলেনি। কিছুটা বিরক্ত হয়েই পুলিশ বলে দেয় ময়নাতদন্তের ব্যবস্থা আগে হোক তারপর দেখা যাবে কে প্রথম দেখেছিল। কিন্তু কে প্রথম দেখেছিল তাকে খুঁজে বার করা হয়েছে কি। উত্তর নেই। যে অবস্থায় তরুণীর মৃতদেহ উদ্ধার হয় সেটা যে স্বাভাবিক মৃত্যু নয় সেটা বুঝতে একদল অভিজ্ঞ চিকিৎসক, হাসপাতালের অধ্যক্ষ, পুলিশের বড়কর্তাদের এতটা সময় লাগলো কেন। আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের মতে এইসব প্রশ্নের উত্তর,ইঙ্গিত করছে গাফিলতি এবং এক বৃহৎ ষড়যন্ত্রের দিকে। সিবিআই এখন মনে করছে সুরতহাল তো বটেই, তিলোত্তমার ময়নাতদন্ত করা হয়েছে অতি দ্রুত। কিন্তু কিসের এত তাড়াহুড়ো। এই ঘটনার সুরতহাল এবং ময়নাতদন্ত রিপোর্ট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেই রিপোর্টের সঙ্গে পারিপার্শ্বিক তথ্যপ্রমাণ মিলে যাচ্ছে বলেও খবর। ঘটনাস্থল থেকে সংগ্রহ করা নমুনার বায়োলজিক্যাল ফরেন্সিক পরীক্ষা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেই পরীক্ষার রিপোর্ট এখনো পর্যন্ত এসে পৌঁছায়নি। ফলে মূল প্রশ্নটা রয়েই গেছে, এটা ধর্ষণ না গণধর্ষণ।
সিবিআই অফিসাররা মনে করছেন অত্যন্ত দ্রুত সুরতহাল এবং ময়নাতদন্ত করে ফেলা হয়েছে। মৃতদেহও দাহ করা হয়েছে অতি দ্রুত।  সুরতহাল ও ময়নাতদন্তের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু ধাপ, যা খুন-ধর্ষণের তদন্তে খুবই জরুরী। সেগুলো এখানে সম্ভবত মানা হয়নি। সুরতহাল এবং ময়নাতদন্ত করার সময় যে ভিডিওগ্রাফির ফুটেজ সিবিআই পেয়েছে তার বহু অংশই নাকি অস্পষ্ট। ইচ্ছা করেই এমনটি করা হয়েছে কিনা সেটা খতিয়ে দেখছেন তদন্তকারীরা। মৃতদেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিস্তারিত বিবরণও উল্লেখ করা হয়নি ময়না তদন্ত রিপোর্টে। সে রাতে হাসপাতালে থাকা সকলের বক্তব্যও পাওয়া যাচ্ছে না। আলাদা করে কথা বলে বেরিয়ে আসছে বেশ কিছু অসঙ্গতি। মৃতদেহ কে প্রথম দেখলেন তা নিয়েও ধোঁয়াশা কাটেনি। মৃতদেহ প্রথম দেখা গিয়েছিল বেলা সাড়ে নটায়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পুলিশকে খবর দেন বেলা দশটা দশ মিনিটে। মাঝে প্রায় ৪০ মিনিট সময় কি কারনে নষ্ট হল সেটাও ভাবাচ্ছে সিবিআই অফিসারদের। এর মধ্যেই কি তথ্য-প্রমাণ নষ্ট করা হয়েছে। ওই সময় এক শীর্ষ কর্তাকে ফোন করেন সন্দীপ ঘোষ। মৃতদেহের ছবি তুলে সেই ব্যক্তিকে পাঠানো হয়। তারপরেই সকালের শিফটের চিকিৎসকদের দেরিতে হাসপাতালে আসতে বলা হয়েছিল। ঘটনার দিন সন্দীপ উত্তরবঙ্গের এক চিকিৎসকের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ রাখছিলেন। তাঁর সঙ্গে ফোন এবং ম্যাসেজ চালাচালির প্রমাণ পেয়েছে সিবিআই। ওই চিকিৎসক সহ সবটাই এখন সিবিআই তদন্তের আতশ কাঁচের নিচে।

প্রমাণের অভাবে আমাদের ডাক্তারকন্যা হয়ত ‘জাস্টিস’ পাবেন না। কিন্তু, সিবিআই তদন্তের ফলে সেক্স -ড্রাগ-জাল ওষুধ চক্র দিনের আলোর মত পরিষ্কার হয়ে যাবে। খোলসা হবে অনেক অসাধু চক্রেরই। শুধু আর জি কর হাসপাতালই নয়; বাস্তু ঘুঘুর বাসা ভেঙে যাবে সমস্ত সরকারি হাসপাতালেই। স্বস্তি পাবেন সৎ চিকিৎসকরা। যারা প্রাণ ভয়ে এতদিন প্রতিবাদও করতে পারছিলেন না যাঁরা। নিজের প্রাণ দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের এই উপকারটুকু করে দিয়ে গেলেন ডাক্তারকন্যা। তাঁকে সেলাম।
১৮ আগস্ট রবিবার রাতে শিলিগুড়ির বাঘা যতীন পার্কে রাতদখলের লড়াইতে নেমেছিলেন মেয়েরা। সেখানে নিজের সংগঠনের মেয়েদের নিয়ে অংশ নিয়েছিলেন ‘আনন্দম ট্রান্সফরমেশন সোসাইটি ফর সোস্যাল ওয়েলফেয়ার’ এর কর্ণধার বেগমজান। বেগম বলেছিলেন, পুলিশ-প্রশাসনে যাঁরা আছেন, তাঁদের এমন ভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে পরবর্তীতে নিজেদের বিবেকের কাছে জবাবদিহি না করতে হয়। মনে রাখতে হবে অর্থ আর ক্ষমতার শেষে থাকে অবসর। রিটায়ারমেন্টের পর ক্ষমতার পাহাড় থেকে নামলেই বিবেক দংশাতে থাকে। তখন সত্যিই তো মরমে মরে মানুষ। নিজের বিবেকের কাছে জবাবদিহি করতে করতেই প্রাণ যায়। নিজের সঙ্গে নিজের লড়াই। এক্কেবারে হক কথা কইছেন বেগমজান ।