লজ্জা দিবসের পরিবর্তে

অনিন্দ্য ভুক্ত

ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠলে একটা অদ্ভুত ভালোলাগা সর্বাঙ্গে জড়িয়ে থাকে। জীবন যতই গ্লানিময় হোক, সেই মুহূর্তে মন থাকে একেবারে গ্লানিমুক্ত। শিক্ষক দিবসের সেই ভোরবেলায় একটা মেসেজ মনটাকে  ক্লেদাক্ত করে দিয়ে চলে গেল। একেবারে সরকারি মেসেজ। শিক্ষক দিবসের শুভেচ্ছা।

আরও একটা শিক্ষক দিবস এসে গেল। অতঃপর দিনভর আবার সেই ভক্তি ভক্তি খেলা। তিন দশক পেরিয়ে গেল শিক্ষকতার পেশায়। যেদিন থেকে এই রাজ্যে খেলা-মেলা দিয়ে মানুষের মনকে সমস্যার দিক থেকে ঘুরিয়ে রাখার প্রচেষ্টা শুরু, সেদিন থেকে এটিও একটি নতুন খেলা হিসেবেই সংযুক্ত হয়েছে। আজকে আরজিকর কান্ডকে কেন্দ্র করে হয়তো শিক্ষাক্ষেত্রের দুর্নীতিগুলো পরিস্ফুট হতে শুরু করেছে, কিন্তু যা দেখা যাচ্ছে তা তো হিমশৈলের চূড়া মাত্র। আর যেদিন থেকে এইসব দুর্নীতির, গোড়াপত্তন বলব না, বরং বিস্তার বলি, শুরু, সেদিন থেকেই শিক্ষক দিবস পালনের নামে একটা হৈ হৈ কান্ডের বিস্তারও শুরু।


যে মেসেজের কথা দিয়ে এই লেখার প্রারম্ভ, সেই মেসেজ প্রেরণ‌ও এই হৈ হৈ কাণ্ডের একটি অঙ্গ মাত্র। শিক্ষা প্রাঙ্গণগুলিতে এই হইহই কাণ্ডের উপর এই মেসেজ একটি সরকারি সিলমোহর মাত্র। কিন্তু এই নির্লজ্জতা যে এই বছরেও চলবে তা ভাবাও যায়নি। কাজটা যেই করে থাকুক, যে সন্দীপ ঘোষই হোক না কেন, সেও তো খাতায়-কলমে একজন শিক্ষক। তাহলে আজ তো পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষক সমাজের কাছে এটি একটি লজ্জা দিবস হওয়া উচিত ছিল। অথচ সর্বত্রই শিক্ষকরা এই ভক্তি ভক্তি খেলায় আজ ব্যস্ত।

ভক্তি ভক্তি খেলা বলছি কেন? খেলাই তো। একজন শিক্ষককে সত্যিকারের ভক্তি জানানোর উপায় কি? উপায় কি এই নয় যে, সেই শিক্ষকের ক্লাসে নিয়মিত উপস্থিত থাকা, তাকে একটি ভালো রেজাল্ট উপহার দেওয়া। আজ কিন্তু সে সব সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত। দৈনন্দিন শ্রদ্ধা ভক্তি অনুপস্থিত বলেই আজ একদিনের এই আনুষ্ঠানিক ভক্তি ভক্তি খেলা।

যাই হোক, সে কথা নয়। সে অন্য প্রসঙ্গ। এই পচন তো অনেক দিনই ধরেছে। আজ পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষক সমাজের গায়ে প্রচুর ক্লেদ। তবে সেই ক্লেদের দায় কি কেবল এই শিক্ষক সমাজেরই, নাকি যারা শিক্ষা প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত তাদের? এই ক্লেদ কি তাদের অবদান নয়?

এ কথা অনস্বীকার্য শিক্ষক সমাজ‌ও এই পচনের ভাগীদার। শিক্ষকতার বিনিময়ে তেঁতুল পাতা দিয়ে সংসার যাপনের সময় অনেক কাল চলে গেছে। এখন শিক্ষকতা একটি লোভনীয় পেশা। আর লোভকে সঙ্গে করে যে পেশায় পদার্পণ, সে পেশা তো একদিন কলুষিত হতে বাধ্য। কিন্তু এখানেই শিক্ষা প্রশাসনের একটি বড় দায়ভার থেকেই যাচ্ছে।

প্রশাসন যখন শিক্ষকতার পেশাকে পণ্য হিসেবে বিক্রি করতে শুরু করে, শিক্ষা জগৎ তখন থেকেই কলুষিত হতে শুরু করে। নাচতে নেমে ঘোমটা টানার প্রবাদপ্রতিম বাক্যটির কথা সবাই জানে। যিনি বা যারা অর্থের বিনিময়ে শিক্ষকতা পেশাটিকে কেনেন, তিনি বা তাঁরা যে পরবর্তীকালে নির্দ্বিধায় পয়সার বিনিময়ে পাশ করানোর দায়িত্ব নেবেন, পয়সার বিনিময়ে লাশ পাচার করবেন বা সমাজের চূড়ান্ত ক্ষতি করছে জেনেও ব্যবহৃত চিকিৎসা সরঞ্জাম অবলীলাক্রমে বিক্রি করে দেবেন তা তো কোনও অবাক হওয়ার বিষয়ই নয়।

কিন্তু অবাক হওয়ার বিষয়, আজকে যখন খ্যামটা নাচতে গিয়ে ঘোমটা সরে গেছে, তখনও দু’হাত পেতে শিক্ষক দিবসের এই সম্মান গ্রহণের লালসা। একজন শিক্ষক হিসেবে মনে হয়, আজ তো আমাদের মাথা নিচু করে সমাজের সামনে দাঁড়ানো উচিত ছিল, প্রয়োজন ছিল ক্ষমা প্রার্থনার। দোষ আমি না করেই থাকতে পারি, বৃহত্তর শিক্ষক সমাজ না করেই থাকতে পারে, কিন্তু এই সমাজেরই একজন বা দুজন তো করেছেন, করে চলেছেন আর আমি সেই সমাজেরই একজন সদস্য।

অনস্বীকার্য, এই দোষ আসলে প্রকৃত শিক্ষকদের নয়। দোষ, যারা শিক্ষকতার পোশাকটি পরে প্রশাসনের মাথায় চড়ে বসেছেন। আজ যে কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দিকে তাকিয়ে দেখুন, সেখানে সরকারি বেসরকারি আনুকূল্যের অভাব নেই, অভাব নেই বিভিন্ন ধরনের অনুদানের। একদল মানুষ সেই অনুদানগুলিকে লুটেপুটে নিয়ে চেটেপুটে খেতে ব্যস্ত হয়ে জলাঞ্জলি দিচ্ছেন শিক্ষাকে, সঙ্গে নিচ্ছেন কিছু অর্থলোলুপ শিক্ষককে, আর তার দায়ভার পেতে হচ্ছে বৃহত্তর শিক্ষক সমাজকে। কিন্তু তবু যে আজ ক্ষমাপ্রার্থনার কথা বলছি, সেটা একমাত্র এই কারণেই যে, এই সমাজটি শিক্ষক সমাজ। এই মহানুভবতাই বৃহত্তর সমাজ তাদের কাছ থেকে প্রত্যাশা করে। কে দোষ করেছে, কীভাবে দোষ করেছে, কেন দোষ করেছে, এসব প্রশ্ন আজ অপ্রাসঙ্গিক।

আজ তাই শিক্ষকদের লজ্জানত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনার দিন ছিল। পরিবর্তে আমরা আভূমি আনত হয়ে সরকারি মেসেজ পেয়ে আপ্লুত হয়ে পড়ছি, ভুলে যাচ্ছি এর পেছনের রাজনৈতিক মেসেজটির কথা। প্রশ্ন হচ্ছে, ভবিষ্যৎ এর জন্য আজকের পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষক সমাজকে ক্ষমা করবে কি?

ভেবে দেখা দরকার। ভেবে দেখার জন্য ব্যতিক্রমী মন দরকার। সেই ব্যতিক্রমী মননই আগামী দিনে এই ক্ষতবিক্ষত শিক্ষা ব্যবস্থাটিকে নতুন করে গড়ে তুলবে, আপাতত সেই আশা নিয়েই বেঁচে থাকা যাক। আশা আছে বলেই তো জীবন আছে, জীবন আছে বলেই তো ভবিষ্যৎ আছে, ভবিষ্যৎ আছে বলেই তো সামনে একটা সুন্দর পৃথিবী থাকলেও থাকতে পারে।