বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে নারীদের প্রতি বৈষম্য তথা ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ দিন দিন বেড়েই চলেছে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২১ সালে এই দেশে প্রায় ৩২ হাজার নারী ধর্ষিতা হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ৮৬ জন এবং প্রতি ১৬ মিনিটে একজন ধর্ষিতা হচ্ছে। সামাজিক ভয়ে প্রতিদিন অসংখ্য ধর্ষণের ঘটনা চাপা পড়ে যায়। সম্মানহানির ভয়ে অধিকাংশ ঘটনাকেই সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয় নিপীড়িতার মানসিক আতঙ্কে। আবার রিপোর্টে দেখা গেছে, প্রায় ৮১ শতাংশ ধর্ষণের ক্ষেত্রে অপরাধী ধর্ষিতার পরিচিতা কেউ। ফলে পারিবারিক চাপে অনেক ঘটনা চার দেওয়ালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে, থানা পর্যন্ত যেতে পারে না। শুধু ধর্ষণই নয়, আমাদের সমাজে নারীরা ইভ-টিজিং, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য, অ্যাসিড হামলা এবং পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়ে চলেছে নিত্যদিন। বেশির ভাগই চাপা থেকে যায় সমাজে সম্মানহানির ভয়ে।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীদের জন্য ন্যায় ও অধিকার নিয়ে আওয়াজও ওঠে। ২০১২ সালে নির্ভয়া-কাণ্ডে গোটা দেশজুড়ে আন্দোলন হয়েছিল। তৎকালীন মনমোহন সিং সরকার নতুন ও কড়া আইন আনতে বাধ্য হয়েছিল। সেই আন্দোলন ২০১৪ সালে ইউপিএ সরকার পতনের অন্যতম কারণ ছিল। যদিও ধর্ষণের মতো জঘন্য ঘটনা এখনও কমেনি এদেশে। সম্প্রতি কলকাতার আরজি কর হাসপাতালের ঘটনা ফের দেশব্যাপী এক আন্দোলনের সূচনা করেছে। পশ্চিমবঙ্গ তথা বিভিন্ন রাজ্যে মানুষ এর বিচার চেয়ে পথে নেমেছে।
আরজি করের ঘটনার সময়ই উত্তরাখণ্ডের দেরাদুনে এক বাস স্ট্যান্ডে এক নাবালিকাকে গণধর্ষণ করা হয় ১২ আগস্ট। উত্তরপ্রদেশের মোরাদাবাদে এক হাসপাতালের নার্সকে ১৭ আগস্ট রাতে আরজি করের মতোই ধর্ষণ করা হয়। ২৩ আগস্ট মহারাষ্ট্রের বদরাপুলে ১১ বছর বয়সী এক বালিকাকে ধর্ষণ করা হয়। একটি সর্বভারতীয় সাময়িক পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী, আরজি কর ঘটনার দশ দিনের মধ্যে ১৬টি ধর্ষণের ঘটনা মিডিয়াতে আসে। যদিও জনসাধারণের ক্ষোভ আছড়ে পড়ে আরজি কর ঘটনার প্রতিবাদে ও বিচার চেয়ে। ক্রমশ তা রাজনৈতিক রূপ নেয়। বিরোধী দলগুলি প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের মতো সরকার বদলানোর সুপ্ত বাসনা প্রকাশ্যে এনেছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার অবশেষে ‘অপরাজিতা—ধর্ষণ বিরোধী আইন’ পাস করেছে বিধানসভায়।
বিলকিস বানুকে ২০০২ সালে গুজরাত দাঙ্গায় গণধর্ষণ করা হয়, থেঁতলে মেরে ফেলা হয় তিন বছরের শিশুকে এবং খুন করা হয় গর্ভের অজাতকেও। দীর্ঘদিন লড়াই করার পর অপরাধীদের আজীবন কারাবাসের সাজা হলেও, ২০২৪ সালে সবাইকে মুক্তি দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা তাদের মালা দিয়ে সংবর্ধনা দেয়। ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে কাশ্মীরের কাঠুয়াতে আসিফা নামের এক আট বছর বয়সী শিশুকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়। দু-একটি ছোটখাটো আন্দোলন ছাড়া এই নিয়ে কোনও আলোচনাই হয়নি। অপরাধীরা পরে ছাড়াও পেয়েছে।
অন্যদিকে, অপরাধী বলে চিহ্নিত করে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর বুলডোজার দিয়ে ভেঙে ফেলা হচ্ছে। সরকারের বিরূপ সমালোচনা করলে দেশদ্রোহীর তকমা লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। নিগ্রহকারী, ধর্ষক ও হত্যাকারীরা অনায়াসেই জামিন পেয়ে যাচ্ছে। এই যেমন মহারাষ্ট্রের ঘটনায় অপরাধীদের পুলিশ ধরার পরের দিনই জামিন দিয়ে দেয়। যদিও পরে আবার তাদের গ্রেপ্তার করে পুলিশ। রাজস্থানে বাংলার পরিযায়ী শ্রমিক আফরাজুলকে পুড়িয়ে মারার কথা অনেকেই ভোলেননি। সেই অপরাধীও অনায়াসে জামিন পায়। শুধু তাই নয়, হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের সদস্যরা তাকে মালা পরিয়ে সংবর্ধনা দেয়। ভোটে বিজেপি তাকে প্রার্থীও করে।
এইসব ঘটনাবলী প্রমাণ করছে, দেশের মানুষ এক চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। শুধু সংখ্যালঘুরাই নয়, সংখ্যাগুরু প্রগতিশীল মানুষও লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠছেন কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির। একটি সর্বভারতীয় ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত ২০২২ সালের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৭ থেকে ২০২২-এর মধ্যে দেশজুড়ে ২৯০০টি জাতিগত দাঙ্গা হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৮ এবং ২০১৯-এ আসানসোলে ধর্মীয় দাঙ্গা এবং ২০২০-তে দিল্লির ধর্মীয় দাঙ্গা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই সময় অধিকাংশ মানুষই নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাতে বাধ্য।