অসাম্যই যেখানে ‘গ্যারান্টি’’

প্রথম দফা ভোটের পর থেকেই বিজেপির প্রচারে বারবারই উঠে আসছে হিন্দুত্ব প্রসঙ্গ, মুসলিম ভীতি ও জাতীয়তাবাদ৷ সম্প্রতি আরজেডি প্রধান লালুপ্রসাদ যাদব এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘রিজার্ভেশন তো মিলনা চাহিয়ে মুসলমান কো পুরা৷ ’ কথাটি লুফে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি৷ লালুর নাম না করে তাঁকে উদ্দেশ করে মধ্যপ্রদেশে এক নির্বাচনী সভায় বলেন, ‘‘গবাদি পশুর খাবার খেয়ে নেওয়ায় পশুখাদ্য কেলেঙ্কারিতে জেল খাটা এক তফসিলি জাতি-উপজাতি ও অনগ্রসর শ্রেণিকে বঞ্চিত করে মুসলিমদের সম্পূর্ণ দিতে চাইছেন৷ কংগ্রেস চুপ করে আছে৷ কিন্ত্ত ওই নেতা ‘ইন্ডিয়া’ জোটের আসল মানসিকতা প্রকাশ করে দিয়েছেন৷ ’’ থেমে থাকেননি লালুও৷ তিনি পাল্টা বলেছেন, ‘সংরক্ষণ সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়ার ভিত্তিতেই তো হওয়া উচিত৷ প্রধানমন্ত্রী এটা বুঝবেন না৷ কারণ উনি আমার মতো অনগ্রসর শ্রেণির মানুষ নন৷ ’

রামমন্দির ইসু্য নিয়ে ফের সরব হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মোদি৷ এই ইসু্যতে কংগ্রেসকে তীব্র ভাষায় বিদ্ধ করেছেন মোদি৷ বলেন, ‘কংগ্রেস যাতে বাবরি মসজিদের তালা এনে রামমন্দিরে ঝোলাতে না পারে তা নিশ্চিত করতেই বিজেপিকে ৪০০ আসনে জেতাতে হবে৷ রাজীব গান্ধি যেভাবে শাহ বানো মামলার রায় পাল্টে দিয়েছিলেন, শাহজাদাও সেভাবে রামমন্দির নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায় বদলে দিতে চান৷ ’

এই তরজা চলাকালীন কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধি এক ভিডিও বার্তায় বলেন, ‘দেশে এই দুর্বিষহ পরিস্থিতির জন্য মোদি ও তাঁর দল বিজেপিই দায়ী৷ … আজ দেশের কোণায় কোণায় তরুণরা বেকারত্বের জ্বালা অতিষ্ঠ, মহিলাদের উপর নির্যাতন চলছে৷ দলিত, আদিবাসী, পিছড়েবর্গ এবং সংখ্যালঘুরা প্রবল বৈষম্যের শিকার৷ ’
এদিকে আবার লালু-মোদির তরজা নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত, মোদি যে ধর্মীয় মেরুকরণ ও সংরক্ষণ নিয়ে প্রচারে নেমেছেন, তা আটকাতে মোদির অস্ত্রই তাঁকে পাল্টা ছুড়েছেন লালু৷ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের অন্যতম নেতা ছিলেন লালুপ্রসাদ৷ তাই তিনি মোদির আক্রমণের পাল্টা উত্তর দিয়ে বলেন, ‘সংরক্ষণ সামাজিক অনগ্রসরতার উপর ভিত্তি করে হয়, ধর্মের ভিত্তিতে নয়৷ অটলবিহারী বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় সংবিধান পর্যালোচনা কমিশন গঠন করেছিলেন৷ মণ্ডল কমিশন ৩৫০০ অনগ্রসর শ্রেণির জন্য সংরক্ষণ সুপারিশ করেছিল৷ এর মধ্যে শুধু ইসলাম নয়, অন্য বহু ধর্মের মানুষও রয়েছেন৷ ’


সম্প্রতি রাহুল গান্ধি বলেছেন, ‘আপনারা বিজেপির মিথ্যা প্রতিশ্রুতিতে ভুলবেন না৷ ওরা বার বার ঐক্যবদ্ধ দেশের মানুষের মধ্যে বিভাজন আনতে চাইছে৷ ’ আবার মোদির উস্কানিমূলক ভাষণের প্রতিবাদ জানিয়ে তাঁর ভিডিও বার্তায় সোনিয়া গান্ধি বলেছেন, ‘বিরোধী ইন্ডিয়া জোট সংবিধান এবং গণতন্ত্র রক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ৷ রাজনৈতিক স্বার্থেই ঘৃণা-বিদ্বেষ ছ.ড়ানো হচ্ছে৷ ’

রায়বেরিলিতে এক নির্বাচনী জনসভায় কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধি মন্তব্য করেন, এদেশের কোনও নির্বাচিত সরকার তাঁদের দেশদ্রোহী বলতে পারে সেকথা কল্পনাও করতে পারতেন না মহাত্মা গান্ধি ও জওহরলাল নেহরু৷ রাহুল গান্ধির সমর্থনে সভায় প্রিয়াঙ্কা বলেন, ‘মহাত্মা গান্ধি ও পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েছিলেন সাধারণ মানুষের অধিকার অর্জনের দাবিতে৷ তাঁরা ভাবতেও পারতেন না ভবিষ্যতে কেউ তাঁদের দেশদ্রোহী বলতে পারে৷ ’

ব্যক্তি আক্রমণ থেকে শুরু করে ধর্মীয় মেরুকরণ ও সাম্প্রদায়িক শক্তিকে উসকে দিয়ে দেশে জাতিদাঙ্গার পরিস্থিতি সৃষ্টি করে আতঙ্ক ছড়ানো, সবই আরএসএসের নির্দেশিত পথে করে চলেছেন নরেন্দ্র মোদি৷ এবারের ভোটে তিনি আরও বেশি আসন চান, যাতে ‘মহাশক্তিধর’ হয়ে উঠতে পারেন৷

আমাদের গণতন্ত্র নেতা নির্বাচনের প্রক্রিয়াকে যত গুরুত্ব দিয়েছে, জনগণের সক্ষমতা নির্মাণে সেই গুরুত্ব দেয়নি৷ যে সক্ষমতা অর্জন গণতন্ত্রের মূলকথা, সেই অর্জনে সমস্ত ব্যক্তির সমান সুযোগ হচ্ছে প্রাথমিক শর্ত৷ সেই শর্ত লঙ্খিত হয়েছে৷ সক্ষমতার প্রথম ধাপ শিক্ষা৷ কোটি কোটি মানুষ তা থেকে বঞ্চিত৷ একই কথা বলা চলে স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, নারী-পুরুষের সমানাধিকারের বিষয়ে৷ মোদির গ্যারান্টিতে সেই বঞ্চনা ক্রমবর্ধমান৷ সেসব সক্ষমতা অর্জনের মধ্য দিয়ে মানুষ গণতন্ত্রের সজাগ প্রহরী হয়ে দাঁড়ায়, সেই সক্ষমতার অভাবকেই হাতিয়ার করেই তৈরি হয়েছে মোদি-জমানার ভিত্তিস্তম্ভ৷

লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে চলেছে বেকারত্বের হার৷ দেশে যুবশক্তির এই অপচয়, দেশের মানুষের মধ্যে এই অসাম্যই এখন মোদির সরকারের ‘গ্যারান্টি’৷