নারায়ণ দাস
বাংলাদেশ নিয়ে ভারত এখন চরম অস্বস্তিতে। দিল্লি না পারছে ঢাকাকে দূরে ঠেলতে— না পারছে কাছে টানতে। ভারতের বিরুদ্ধে লাগাতার দূরভিসন্ধি প্রচার চলছে। স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের অবদান বেমালুম ভুলে গিয়ে বর্তমান ইউনূস সরকার নানা অপপ্রচার চালাচ্ছে। কোথায় তদারকি সরকার বাংলাদেশের উন্নয়ন ও সংস্কারের কাজে হাত লাগাবে, তা না করে নানা মত ও পথের ছাত্র আন্দোলন দমন করতেই তদারকি সরকার ব্যতিব্যস্ত। উগ্র মৌলবাদী ছাত্র বাংলাদেশের বর্তমান তদারকি সরকারকে উচ্ছেদ করে সামরিক শাসনের দাবি তুলেছে। তাই তদারকি সরকার এখন দিশেহারা। ওই ছাত্র আন্দোলনের মধ্যেই বাংলাদেশের বর্তমান প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি দেশে আশু সাধারণ নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে। তারা সংস্কারের কাজের দোহাই দিয়ে বর্তমান সরকারের নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টার বিরোধী। কিন্তু ইউনূস খান সংস্কারের কাজ সম্পূর্ণ না করে নির্বাচনের ডাক দিতে রাজি নন।
ভারতের বিরুদ্ধে বিরামহীন অপপ্রচার চললেও দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ঠিক আগের মতোই চলছে। ভারতের বিভিন্ন ধরনের পণ্য বাংলাদেশে যাচ্ছে, তেমনই বাংলাদেশেরও কিছু কিছু দ্রব্য ভারতে আসছে। দুই দেশের মধ্যে আগের সেই মধুর সম্পর্ক না থাকলেও, বাংলাদেশে যখন যে সরকারই আসুক অথবা সেনাশাসনই হোক, ভারতের সাহায্য ও সহযোগিতা ব্যতীত সেই সরকারের চলা অসম্ভব। যদিও সে দেশে ভারত বিরোধিতার খামতি নেই। এই অবস্থায় আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থাগুলির প্রধান তুলসী গাবার্ড সম্প্রতি ভারতে এসে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ এবং সেখানে বর্তমানে যে অবস্থা চলছে, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে বর্তমানে যে অশান্তি চলছে, তার দমন না হলে বাংলাদেশ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। সুতরাং শান্তিশৃঙ্খলা না ফিরলে, উন্নয়নের কাজও ব্যাহত হবে— কারণ আগস্টের গণ অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের বিস্তর ক্ষতি হয়েছে।
নয়াদিল্লির সাউথ ব্লকে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা নিয়ে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল থেকেও ওই বাংলা যাতে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে, তার জন্য ভারতের চেষ্টা অব্যাহত। কিন্তু ভারতের উদ্বেগ বাড়িয়ে বাংলাদেশের তদারকি সরকারের প্রধান ইউনূস খান চিন সফরে যাচ্ছেন বেজিংয়ের আমন্ত্রণে। আবার পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছে। পাক সেনাবাহিনী প্রায় ৩০ লক্ষ স্বাধীনতাকামী বাংলাদেশিদের হত্যা করলেও, সেই মর্মান্তিক ঘটনা ভুলে গিয়ে, বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর শীর্ষকর্তারা পাকিস্তানে গিয়ে পাক সেনাকর্তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে দেশে ফিরবেন— তেমনই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কয়েকজন শীর্ষকর্তা বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন। তাঁরা বাংলাদেশ সেনাররা যাতে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র তৈরি করতে পারে, তার জন্য সবরকম সাহায্যের আশ্বাস দিয়ে গেছেন। চিনও বাংলাদেশের ব্যাপরে পিছিয়ে নেই। বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থায় চিনও সবরকম সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সেই প্রতিশ্রুতি কী কী, তা বিশদে জানতে ইউনূস খান চিন সফরে যাচ্ছেন। তিনি সেখানে বেজিং সরকারের শীর্ষনেতাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন এবং জানতে চাইবেন চিন কোন কোন খাতে বাংলাদেশকে সাহায্য করতে উৎসাহী। চিন শেখ হাসিনার জমানার সময়েই তার আধিপত্য বিস্তার করেছে। এবং নানা অস্ত্রসম্ভার দিয়ে বাংলাদেশকে সাহায্য করা ছাড়াও, উন্নয়ন খাতে বিপুল অর্থ ঢেলেছে। সুতরাং ইউনূস খানের বেজিং সফর যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই তা মাথাব্যথার কারণ ভারতেরও। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর, দীর্ঘ পাঁচ দশকের ওপর পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনও সম্পর্কই ছিল না। ইদানিং পাকিস্তানও বাংলাদেশের বড় বন্ধু। কূটনৈতিক সূত্র মনে করে বেজিং সফর শেষ করে দেশে ফিরে ইউনূস খান পাকিস্তানেও যেতে পারেন পাক সরকারের আমন্ত্রণে। ভারতের পাশ্ববর্তী হিন্দুরাজ্য নেপালের সঙ্গে ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক মধুর হলেও, নেপাল আবার বন্ধুত্ব পাতিয়েছে চিনের সঙ্গে। চিন নেপালের উন্নয়নে নানাভাবে সাহায্য করছে। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে নেপালও চিনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলেছে, বাংলাদেশকে সাহায্য করতে তারাও প্রস্তুত। মোদীর তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ অগ্রাহ্য করে নেপালের প্রধানমন্ত্রী অলি চিনে চলে যান। যা ভারত ভালো চোখে দেখেনি।
পাকিস্তান ও চিন যদি বাংলাদেশে এসে ঘাঁটি গেড়ে বসে এবং ভারতের বিরুদ্ধাচারণের সহায়ক হয়, তাহলে তা ভারতের পক্ষে চরম অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠবে। বাংলাদেশ ভারতের সবচাইতে নিকটতম প্রতিবেশী এবং অত্যন্ত নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে এই দুই দেশের মধ্যে। কিন্তু চিন ও পাকিস্তান বাংলাদেশে এসে নানাভাবে তাদের আধিপত্য বিস্তার করে তাহলে ভারত কীভাবে এই তিন শক্তির মোকাবিলা করবে, তা নিয়ে সাউথ ব্লক চিন্তিত। শুধু চিন্তিত নয়, ভারত কীভবে বাংলাদেশের সঙ্গে তার সম্পর্ক বজায় রাখবে, তা এখন থেকেই প্রচণ্ড মাথা ব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে। এই মাথাব্যথা প্রশমনের ওষুধ খুঁজে চলেছে ভারত। আবার বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন ভারতে আশ্রয় নিয়ে আছেন। তাঁকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর জন্য বাংলাদেশ নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের তদারকি সরকার হাসিনাকে দেশে নিয়ে আসার জন্য ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বন্দি প্রত্যার্পন চুক্তির কথা উল্লেখ করেছে। ভারত এ ব্যাপারে বলেছে হাসিনা ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন এবং তা তাঁকে দেওয়া হয়েছে। হাসিনা যতদিন প্রয়োজন ভারতে থাকতে পারেন। সুতরাং তাঁর ক্ষেত্রে এই বন্দি বিনিময় চুক্তি প্রযোজ্য নয়। এটা অবশ্য বলার অপেক্ষা রাখে না, হাসিনা বাংলাদেশে ফিরে গেলে বিচারের নামে প্রহসন সৃষ্টি করে তাঁর প্রাণনাশের চেষ্টা করা হবে।
এদিকে ইউনূস খানের চিন সফরে রওনা হওয়ার আগেই বাংলাদেশে আবার নতুন করে অশান্তি ছড়িয়ে পড়েছে। যেসব ছাত্র সংগঠনগুলির সহযোগিতায় এবং মতের ভিত্তিতে বাংলাদেশের সেনাপ্রধান ইউনূস খানকে প্যারিস থেকে আনিয়ে তদারকি সরকার গঠন করেছিলেন— তাঁর শাসনের একমাস যেতে না যেতেই সেই ছাত্রদের একাংশ সেনাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। অন্য একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেচে, বাংলাদেশ জাতীয় নাগরিক পার্টি। এই দলের সমর্থনে এসে দাঁড়িয়েছে জামায়েত ইসলামী, হেফাজতে ইসলামী এবং আরও কয়েকটা ছোট ছাত্র সংগঠন। এই জাতীয় পার্টির নেতারা (ছাত্র) বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বলেছে, তারা আর সেনাবাহিনীর খবরদারি সহ্য করবে না। সেনারা তাদের ক্যাপ্টেন সেনটের বাইরে এসে বাংলাদেশের শাসকের কাজ নিয়ে মাথা ঘামানো বন্ধ করুক। তারা বলেছে, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে রাজনৈতিক দলগুলি— সেনারা দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করার কাজে নিয়োজিত থাকুক। মৌলবাদীরাও জাতীয় পার্টিকে সমর্থন করেছে।
অপরদিকে জাতীয় পার্টির দাবি, পূর্বতন আওয়ামি লিগ বাংলাদেশে আর কোনও রাজনৈতিক দল নয়। আওয়ামি লিগের প্রধান শেখ হাসিনা সহ অন্যান্য নেতাদের বিচার সেষে এই দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। আওয়ামি লিগ অতীতে দেশের শাসন কাজ পরিচালনা করলেও, এখন আর লিগ কোনও রাজনৈতিক দল নয়। এই দল ক্ষমতাসীন থাকাকালীন ভারতের দাসত্ব করেছে। এই অবস্থায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকারউজ্জমান নতুন জাতীয় পার্টির নেতাদের হুঁশিয়ারি দিয়ে ঘোষণা করেছে তারা আর বাংলাদেশে কোনওরূপ ধ্বংসাত্মক আন্দোলন বরদাস্ত করবে না। তার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ঢাকা শহরের নিরাপত্তা কঠোর করেছে সেনাপ্রধান সেনাবাহিনীর শীর্ষ কর্তাদের সঙ্গে সম্প্রতি একটি বৈঠকে বসে দেশের সার্বিক অবস্থা পর্যালোচনা করেন। কোনও কোনও মহলের মতে, বাংলাদেশের ছাত্ররা আবার নতুন করে যে অশান্তির চেষ্টা করছে, তা থামাতে সেনা কর্তৃপক্, শাসনভার হাতে নিতে পারে— অর্থাৎ বাংলাদেশ সামরিক শাসনের কবলে পড়তে পারে। এমন একটি বার্তা দিয়েছিলেন সেনাপ্রধান কিছুদিন আগে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের অন্য কিছু ভাবতে বাধ্য করবেন না। বাধ্য করবেন না অন্য কোনও ব্যবস্থা অবলম্বন করতে।’ একই সঙ্গে সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি নষ্ট না করার পরামর্শ দিয়েছিলেন সকলকে।’
ছাত্র নেতারা বিশেষ করে, যাঁরা নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টির সদস্য, তাঁরা বাংলাদেশের সেনাপ্রধানকে ‘ভারতের দালাল’ বলতেও দ্বিধা করেনি। যার ফলে সেনাবাহিনীর অনেকেই ক্ষুব্ধ। সেনাবাহিনীর একাংশ আবার বলেছে, আওয়ামি লিগকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশে সাধারণ নির্বাচন সম্ভব নয়। এই যখন অবস্থা, তখন একদল বিক্ষোভকারী প্রকাশ্যে রাস্তায় মিছিল করে তদারকি সরকারের প্রধান ইউনূস খানের অবিলম্বে পদত্যাগের দাবি জানিয়েছে। তারপর বাংলাদেশে কী হবে, তা তারা বুঝে নেবে। রাজনৈতিক মহল মনে করে, জাতীয় পার্টির নেতারা যেভাবে সেনাপ্রধানকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে, তার পিছনে বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠনগুলিরও মদত রয়েছে।
এই অবস্থায় দেশকে অগ্নিগর্ভ রেখে ইউনূস খানের চিন সফর হয় কিনা, তা বোঝা যাচ্ছে না। তদারকি সরকার প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর, ওই সরকারের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ তোলা হয়নি। কিন্তু সম্প্রতি ঢাকা শহরে একদল লোক মিছিল করে এই সরকারের উচ্ছেদের দাবি জানাল। তাহলে কি বাংলাদেশে ‘সামরিক আইন জারি হতে চলেছে? কোনও কোনও মহল এই আশঙ্কাও করছে। অর্থাৎ বর্তমানে বাংলাদেশ যে অশান্তির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তাতে সাধারণ মানুষের যন্ত্রণা দিন দিন বাড়ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য আকাশছোঁয়া। সাধারণ মানুষের তা নাগালের বাইরে। তদারকি সরকারের প্রধান এখন কোন দিক সামলাবেন? ছাত্রদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর কর্তাদের মতবিরোধ বাংলাদেশকে একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রকের এক মুখপাত্র সম্প্রতি বলেছেন, তাঁরা বাংলাদেশের ঘটনাবলীর দিকে নজর রাখছে। তবে পশ্চিমবঙ্গ-বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটা তারের বেড়া দেওয়া নিয়ে যে অশান্তির সৃষ্টি হয়েছিল, আপাতত তার সুরাহা হয়েছে। তবে অনুপ্রবেশ থেমে নেই। ভারত এই নিকটতম প্রতিবেশী বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে যে উদ্বিগ্ন, তা প্রকাশ্যে বলেছেন দিল্লির সাউথ ব্লকের এক কর্তা। তবে বাংলাদেশে শান্তি ফিরিয়ে আনতে এবং এই দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কে অটুট রাখতে, ভারত তৎপর। ভারতের মাথাব্যথার সবচাইতে বড় কারণ হবে পাকিস্তান ও চিন যদি বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে নাক গলাতে শুরু করে। তখন ভারতকে বাংলাদেশ নিয়ে একটি অবস্থান নিতেই হবে। কারণ চিন ও পাকিস্তান যদি বাংলাদেশে তাদের আধিপত্য বিস্তার করে, তাহলে ভারতকে একটি অস্বস্তির মধ্যে থাকতে হবে। বেজিং সম্প্রতি বাংলাদেশকে আরও অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করবে এমন কথাও বলেছে। আর এই জন্যই ইউনূস খানকে চিন সফরে যাওয়ার জন্য বেজিংয়ের আমন্ত্রণ।