নারায়ণ দাস
কোনও নির্বাচন এলে— তা লোকসভা, বিধানসভা অথবা পঞ্চায়েত ও পুরসভারই হোক, প্রচারে কুকথা, কুমন্তব্য বা ব্যক্তিগত আক্রমণের ফোয়ারা ওঠে। প্রার্থীরা তাঁদের নিজ নিজ কেন্দ্রে মানুষের ভোট চাওয়ার সময় কুকথায় ঝড় তোলেন, যা নিয়ে বিতর্ক বাঁধে— এমনকি নির্বাচন কমিশনের কাছে এ ব্যাপারে নালিশও যায়। কিন্তু এ ব্যাপার নিয়ে কারওর কোনও মাথাব্যথা নেই। নির্বাচন কমিশন অথবা রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী অফিসারের কাছে নালিশ গেলেও খোঁজ করে এ ব্যাপারে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। সুতরাং কুকথা বা কুমন্তব্য এবং ব্যক্তিগত আক্রমণ করা ভোট এলেই তা অব্যাহত গতিতে চলে। ভোটাররা প্রার্থীদের এইসব কুকথা কতটা বিশ্বাস করে তা বলা যাবে না— তবে নির্বাচনী সভায় এসে তাঁরা প্রার্থীদের সব কথা শোনেন। তাঁদের কাছ থেকে কোনও প্রতিবাদ আসে না। শেষ পর্যন্ত ভোটের দিন ভোটটা ভোট কেন্দ্রে এসে দেন।
নির্বাচনে শাসক দলের প্রার্থীরা বিরোধী প্রার্থীদের সম্বন্ধে কুকথার ঝড় তুললে ঝুলিতে ভোট আসার কতটা সুবিধা হয়, তা বলা যাবে না। কিন্তু যে প্রার্থী তাঁর বিরোধী প্রার্থী সম্বন্ধে অশালীন মন্তব্য করেন, মানুষ তার ব্যক্তিগত রুচির পরিচয় পায়। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে ছয়টি উপনির্বাচনেও প্রার্থীরা প্রচারে নেমে বিরোধী প্রার্থী বা তাংর দল নিয়ে নানা আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন। তাঁদের মধ্যে শাসক দলের একজন মন্ত্রীও আছেন— যিনি জনপ্রিয়। তাঁর বিরুদ্ধে একজন মহিলাকে নিয়ে কুকথার অভিযোগ উঠেছিল। এই মহিলা আবার বিরোধী দলের একজন প্রার্থী। আবার মহারাষ্ট্রের বিধানসভা নির্বাচনে অরবিন্দ সাওয়ন্তকে নিয়ে অভিযোগ উঠেছে যে তিনি প্রচারে অশালীন কথা বলেছেন, কোনও মহিলা প্রার্থীর বিরুদ্ধে।
এই দু’জনই নয়, সারা দেশে নির্বাচন বা উপনির্বাচন এলেই প্রচারে নেমে প্রার্থীরা তাঁদের বিরোধী প্রার্থীদের নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেন, তাঁদের মধ্যে একাধিক মহিলা আছেন। যাঁদের নিয়ে কুকথার ঝড়, তাঁরা প্রতিবারের মতো এবারও জাতীয় নির্বাচন কমিশনের কাছে এর প্রতিকার চেয়ে অনুরোধ জানিয়েছেন। নির্বাচন কমিশন মহিলাদের বিরুদ্ধে অশালীন মন্তব্যের জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশ পাঠাল সংশ্লিষ্ট রাজ্য নির্বাচনী অফিসারদের কাছে। মুখ্য নির্বাচনী কমিশন রাজীব কুমার একটি পর্যালোচনা সভায় বলেছেন, মহারাষ্ট্রের যে নেতা মহিলার সম্বন্ধে কুকথা বলেছেন, তা যথেষ্ট আপত্তিকর। তিনি এই সভায় জানিয়ে দেন মহিলা প্রার্থীদের নিয়ে মর্যাদা হানিকর কোনও মন্তব্য মেনে নেওয়া হবে না। তবে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তা নিয়ে কোনও কথা বলেননি মুখ্য নির্বাচনী অফিসার। ব্যবস্থা নেওয়ার আগেই তিনি ছেড়ে দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট রাজ্যের মুখ্য নির্বাচনী অফিসারদের উপর। কিন্তু মুখ্য নির্বাচনী অফিসারদের এ ব্যাপারে নড়েচড়ে বসতে দেখা যায় না। সুতরাং কুকথা মন্তব্য নির্বাচন এলে প্রার্থীদের মধ্যে চলতেই থাকে। তবে পশ্চিমবাংলায় যে মন্ত্রী মহিলা প্রার্থীর বিরুদ্ধে অশালীন কথা বলেছিলেন বলে অভিযোগ— তাঁকে সমালোচনায় বিদ্ধ করেছেন বিরোধী দলের নেতৃবর্গ। এমনকি মন্ত্রীর নিজের দলের কোনও কোনও নেতা তাঁর অশালীন মন্তব্যকে ভালোভাবে নেননি।
তবে মন্ত্রী সমালোচনার ঝড় সামলিয়ে বলেছেন, মহিলারা তাঁর কাছে মাতৃস্বরূপা। সেই চোখেই তিনি তাঁদের দেখেন। সুতরাং তাঁর মন্তব্য নিয়ে কেউ যদি আঘাত পেয়ে থাকেন, তার জন্য তিনি দুঃখিত। কিন্তু রাজনৈতিক মহল মনে করে, মন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করলেই হল না— যাঁর সম্বন্ধে তিনি কুকথা বলেছিলেন, তিনি তো আগুন হলেন— মন্ত্রীর দুঃখ প্রকাশ তাঁর গ্রহণ করার জন্য মানসিকতা নেই। তবে মানুষ তো জানলেন মন্ত্রীর রুচিবহির্ভূত কথা।
সংসদীয় গণতন্ত্রে শাসক দল যেমন থাকবে শাসন কার্য পরিচালনা করার, তেমনই একাধিক বিরোধী দলও থাকবে। নির্বাচন এলে, তা যে কোনও নির্বাচন, তাতে লড়ার জন্য শাসক দলের যেমন প্রার্থী থাকবে, তেমনই থাকবে বিরোধী দলেরও প্রার্থী। প্রচারে বিরোধীরা যেমন শাসক দলের শাসনের বিভিন্ন দিক নিয়ে সমালোচনা করবে, ত্রুটি বিচ্যুতি ধরবে, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের কথা মানুষের সামনে তুলে ধরবে, তেমনই শাসক দলের প্রার্থীরাও বিরোধী দলের প্রার্থীদের সমালোচনা করবেন। করবেন দলের সমালোচনাও। উভয় পক্ষের সে সমালোচনা রুটিবহির্ভূত হবে না, কুকথা, কুমন্তব্যের ঝড় বইবে না। সেটাই গণতন্ত্রের নিয়মনীতি ও বিধি।
কিন্তু আমরা নির্বাচন এলে শাসক এবং বিরোধী দলের প্রার্থীদের মধ্যে সেই রুচিবোধ দেখি না। দেখি অশালীন মন্তব্যের ঝড়— যা গণতান্ত্রিক বিধিতে কলুষিত করে। নির্বাচনে জয়পরাজয় থাকবে। যাঁরা জয়ী হবেন, তাঁরা খুশি হবেন। বেশি সংখ্যায় যে দলের প্রার্থীরা জয়ী হবেন, সেই দলই মন্ত্রিসভা গঠন করবে। এই পথেই সংসদীয় গণতন্ত্র চলে। কিন্তু দুঃখের বিষয় সেই গণতান্ত্রিক পথে অনেক রুচিবহির্ভূত বিষয় থাকে, যা গণতন্ত্রের সুন্দর পথকে রুদ্ধ করে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অনেকগুলি নির্বাচন হল। লোকসভা এবং বিধানসভাগুলির পরিচালনার দায়িত্ব বর্তায় জাতীয় নির্বাচন কমিশনের ওপর। কমিশন নির্বাচনী প্রচারে প্রার্থীদের কী কী মানতে হবে, তার একটি নির্দেশমানা জারি করে। তার মধ্যে অবশ্যই আছে প্রার্থীদের নির্বাচনের আচরণ বিধি মেনে চলতে হবে— যেমন কোনও প্রার্থীর সম্বন্ধে অশালীন কথা বলা চলবে না, চলবে না ব্যক্তিগত আক্রমণ। কিন্তু প্রার্থীরা কি তা মেনে প্রচার করেন? বিরোধী দলগুলি যেমন তাদের প্রার্থীদের নির্বাচনের নিয়ম মেনে প্রচার করতে বলেন, কিন্তু সেই নির্দেশ ভেঙে শালিনতার গণ্ডি পেরোতে শাসক দলের প্রার্থীদের সম্বন্ধে নানা আপত্তিকর মন্তব্য করেন, যা গণতন্ত্র বহির্ভূত। আবার শাসক দলের প্রার্থীরা তাদের সরকারের জনহিতকর কাজের ফিরিস্তি মানুষের সামনে তুলে ধরেন, আবার তাঁদের মধ্যে কেউ সেই বিরোধী কোনও প্রার্থীর বা প্রার্থীদের সম্বন্ধে নানা কুকথা ও কুমন্তব্য করেন। নির্বাচন কমিশনে নালিশ জানিয়েও কোনও লাভ হয় না। এইভাবেই লোকসভা ও বিধানসভার প্রার্থীদের প্রচার চলে আসছে।
শাসক দলের প্রার্থী এবং বিরোধী দলের প্রার্থীদের প্রচারে যে কুকথার ঝড় ওঠে, তা নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। মানুষ অর্থাৎ যাঁরা ভোটদাতা, তাঁরাও বিভ্রান্ত হন। শাসক দলের প্রার্থীরা সরকারের গুনগান গাইলেও, ভোটাররা তা সবটা মেনে নেয় না। তাঁরা ভোটের দিন আগেই ঠিক করে নেন, যাঁরা যোগ্য প্রার্থী, তাঁরা তাঁদের সমর্থন পেতে পারেন। তাঁদের কেউ আবার সবটাই যে শাসক দলের ভোটবাক্সে পড়ে, তা বলা যাবে না। আবার বিরোধী প্রার্থীরা সরকারের নানা কাজের সমালোচনা করলেও মানুষ তাঁদের সবাইকে যে ভোট দেবে তাও বলা যায় না। শাসক দলের প্রার্থীরা প্রচার কালে প্রশাসনের নানা সুবিধা পেয়ে থাকেন, যা বিরোধী প্রার্থীরা পায় না। শাসক দলের প্রার্থীদের প্রধান হাতিয়ার হল, সরকারের প্রশস্তি পাওয়া, আর বিরোধী প্রার্থীদের সরকারের অপশাসনের নানা বিষয় মানুষের কাছে তুলে ধরা।
ভোটের প্রচার যদি এইভাবে বিধি মেনে চলে, তাহলে কারওর কিছু বলার থাকে না। ভোটাররা তাদের ইচ্ছেনুযায়ী প্রার্থীদের ভোট দেন, তারা শাসক দলের প্রার্থীরাও হতে পারে অথবা বিরোধী প্রার্থীরা। এক্ষেত্রে প্রচারে কোনও পক্ষের প্রার্থীদেরই অশালীন মন্তব্য করার সুযোগ নেই।
উপনির্বাচন সে লোকসভারই হোক অথবা বিধানসভার হোক, সাধারণ মানুষ তেমন গুরুত্ব দিয়ে নেয় না। শাসক দলের প্রার্থীরাই সাধারণত উপনির্বাচনে জয়ী হন। আবার তার ব্যতিক্রম যে হয় না, তা বলা যায় না। রাজ্যের মানুষ এবার এই ছয়টি উপনির্বাচনের ফলাফলের দিকে তাকিয়ে আছে। কারণ প্রতিটি ক্ষেত্রেই লড়াই হবে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস এবং ভারতীয় জনতা পার্টির মধ্যে। কংগ্রেস এবং সিপিএণও এই লড়াইয়ে আছে। সম্প্রতি আরজি কর মেডিকেল কলেজে একজন মহিলা চিকিৎসকের মর্মান্তিক মৃত্যু নিয়ে চিকিৎসকের মধ্যে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এই নারকীয় ঘটনায় অপরাধী বা অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে চিকিৎসকরা লাগাতার আন্দোলনে মেতে ওঠে। মুখ্যন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জুনিয়র চিকিৎসকদের প্রতিনিদিদের সঙ্গে আলোচনা করে তাঁদের দশটি দাবির মধ্যে অধিকাংশ দাবি মেনে নেন। চিকিৎসকরা আমরণ অনশন তুলে নেন। মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের আন্দোলন প্রত্যাহার করে কাজে যোগ দেওয়ার অনুরোধ জানান। শেষ পর্যন্ত চিকিৎসকরা কাজে যোগ দেন এবং অনশন প্রত্যাহার করে নেন। আরজি করের ঘটনায় নাগরিক সমাজও অপরাধী বা অপরাধীদের কঠোর শাস্তি চেয়ে সরব হন।
এই ঘটনার প্রভাব এই ছয়টি উপনির্বাচনে পড়ে কিনা, তা বোঝা যাবে ভোটের ফলাফলে। নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে যাতে হয়, তার জন্য কেন্দ্রীয় ফোর্স মোতায়েন করা হয়েছে প্রতিটি ভোট কেন্দ্রে। ভোটের প্রচারে প্রার্থীদের মধ্যে কুকথা ও অশালীন মন্তব্যের ঝড় উঠেছিল। তা ভোট কেন্দ্রগুলির জনমানুষের ওপর কতটা প্রভাব ফেলে, তা বোঝা যাবে ফলাফলে।