• facebook
  • twitter
Wednesday, 8 January, 2025

ঘটনা-অঘটন ঘটেছে বারবার সেই আগস্টেই

হাসিনার দেশত্যাগের পরে আমুল বদলে যাওয়া বাংলাদেশে সকলের নজর ছিল সেই গ্রেনেড হামলার আপিল মামলা ও ‘ডেথ রেফারেন্স’এর রায় কি হয় সেদিকে। তবে আগস্টে নয়, আকস্মিক পরিবর্তিত দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ডামাডোলের আবহে অনুমান ও আশঙ্কা সত্য করে গত ডিসেম্বরের ১ তারিখে আপিল আদালতের রায়ে দেশ থেকে পলাতক তারেক রহমান এবং লুৎফুজ্জমান বাবর সহ সকল আসামী খালাসপ্রাপ্ত হয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে একইভাবে গত ৫ ডিসেম্বরে এক রায়ে বাংলাদেশ উচ্চন্যায়ালয় তারেক রহমান ও তাঁর ব্যবসায়িক বন্ধু গিয়াসুদ্দিন আল মামুনকে দুর্নীতি নিরোধক আইনের মামলায়ও অভিযোগ থেকে নিষ্কৃতি দেয়।

ফাইল চিত্র

শান্তনু রায়

পড়শি বাংলাদেশে সম্প্রতি এক ধুয়ো তোলা হচ্ছে সেদেশ নাকি নতুন করে স্বাধীনতা পেয়েছে ৫ই আগস্টে গণঅভ্যুত্থান বা ‘বিপ্লব’ এর মাধ্যমে যদিও প্রকৃতপক্ষে এক চরম প্রতিক্রিয়াশীল জঙ্গী ইসলামী মৌলবাদী শক্তি সেদেশে ক্ষমতাদখল করেছে ষড়যন্ত্র ও দীর্ঘ পরিকল্পনায় হাসিনা বিদায়ের মাধ্যমে ভারতবিদ্বেষকে মূলধন করে ।নিজেদের অপকর্ম থেকে নজর ঘোরাতে সেই অপশক্তি ‘আগস্ট বিপ্লব’ বলে (অপ) প্রচার করতে চাইলেও আগস্ট মাসটা বোধহয় বাংলাদেশের পক্ষে শুভ তো নয়ই বরং যথেষ্ট শোকের- হয়তো আওয়ামী লীগের পক্ষেও তো বটেই। কারণ দল এবং দলীয় সরকারের পক্ষে অনেক বিয়োগান্তক ঘটনা ঘটেছে এই আগস্ট মাসেই -একবার নয় এপর্যন্ত তিন তিনবার।
সত্য এ যে বিরাশি বছর আগে আগস্টেরই ৯ তারিখে বিয়াল্লিশের আন্দোলন হিসেবেও পরিচিত ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন শুরু হয়েছিল ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যে ভূখণ্ডে তার অংশ ছিল এই আজকের বাংলাদেশ । আবার সাতচল্লিশের ১৪ই আগস্ট ব্রিটিশের অধীনতা থেকে মুক্তি মিলেছিল ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগ কর গঠিত ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের পূর্ব অংশ হিসেবে পূর্বপাকিস্থান হিসেবে পরিচিত অধুনা বাংলাদেশের।

তবে মর্মান্তিক সত্য এও যে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবর রহমান সপরিবারে নৃ্শংসভাবে খুন হন তাঁর নিজের দেশেরই সেনাবাহিনীর একাংশের দ্বারা ঊনপঞ্চাশ বছর আগের আগস্টের ১৫ তারিখের মধ্যরাতে -সালটা ছিল ১৯৭৫ ।আবার সেদিন দেশের বাইরে থাকায় রেহাই পাওয়া শেখ মুজিবের দুই কন্যার জেষ্ঠ্যা হাসিনা সে ঘটনার ২১বছর পর ১৯৯৬ এ বাংলাদেশের প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হলেও এই আগস্টে কুর্সি ছাড়তে বাধ্য হয়ে দেশ্ছাড়া-আবার ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয়ে।

এর আগে মুজিব হত্যার ২৯ বছর পর আগস্ট মাসটা আবার এক ভয়াবহ মাস হিসেবে উপস্থিত হলো আওয়ামী লীগ ও মুজিব–কন্যার পক্ষে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্র বঙ্গবন্ধু এভিন্যুতে দলের কেন্দ্রীয় অফিসের সামনে থেকে শুরু হওয়া পদযাত্রায় এক ভয়ানক গ্রেনেড আক্রমনে ২২ জন দলীয় সমর্থক ও নেতার প্রাণহানি ঘটায়। আহত হন ২০০ জন।

আসলে ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্র বঙ্গবন্ধু এভিন্যুতে দলের কেন্দ্রীয় অফিসের সামনে থেকে শুরু হওয়া পদযাত্রাই ছিল সেই গ্রেনেড হামলার লক্ষ্য। সেই পদযাত্রার উদ্দেশ্য ছিল— দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সিলেটে বোমা নিয়ে আক্রমন, গোপালগঞ্জে দলের ছাত্র সংগঠন বাংলা দেশ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি সহ সারা দেশেই দলীয় কর্মী ও সমর্থকদের উপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জ্ঞাপন করা। সেদিন বিকেল থেকেই কালো পতাকা হাতে কর্মী ও সমর্থকরা মিছিল স্থলে আসতে আরম্ভ করে জমায়েতে। বিকেল পাঁচটা নাগাদ দলের সভাপতি ও সংসদে বিরোধী দলনেত্রী শেখ হাসিনা এলেন এবং একটি খোলা ট্রাকের উপর ভ্রাম্যমান মঞ্চে দাঁড়িয়ে উপস্থিত বিশাল জমায়েতকে ভাষণ দিয়েছিলেন। রাস্তার উপর বসেছিলেন দলের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এবং কর্মীরা। শেখ হাসিনা ঐ সমাবেশে ভাষণে তীব্র আক্রমন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন সরকারকে। ওই সরকারকে সন্ত্রাসবাদী এবং ‘বোমা নিক্ষেপক’ সরকার আখ্যা দিয়ে হাসিনা দেশকে বাঁচাতে দেশবাসীকে সংঘবদ্ধ সংগ্রাম করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “এই সরকারের দিন শেষ”। কিন্তু কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই যে ভয়াবহ ঘটনা ঘটল বা ঘটানো হয়েছিল তাতে শেখ হাসিনারই জীবন শেষ হতে যাচ্ছিল। যখন হাসিনা ভাষণ শেষ করে চলে যেতে উদ্যত তখন প্রথমে একটা গ্রেনেড উড়ে এসে পড়ল ঐ ট্রাকের ডায়াস থেকে দু’গজ দূরে। তারপর এক নাগাড়ে একটার পর একটা কমপক্ষে গোটা দশেক গ্রেনেড বিস্ফোরন ঘটে। পরিণামে ঢাকার সেই রাস্তা রক্তে লাল নিহত ও আহতদের রক্তে।

সেদেশের প্রথম সারির সংবাদপত্র প্রথম আলো লিখেছিল- আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সংসদে বিরোধী নেত্রীকে হত্যা করার জন্য যেভাবে গ্রেনেড আক্রমন করা হয়েছিল তা দেখে আমরা অত্যন্ত বিস্মিত বিভ্রান্ত এবং ভীত। অন্যদিকে ডেলী স্টার ২২ তারিখের সম্পাদকীয় স্তম্ভে লিখেছিল- যেভাবে ওই আক্রমন করা হয়েছিল যে তা থেকে পরিস্কার যে ওই আক্রমণ ছিল এক সুপরিকল্পিত সুসংহত প্রচেষ্টা।
প্রথম দিকে ঐ হামলার তদন্ত ভিন্ন পথে চালিত করতে চেষতা করেছিল তৎকালীন খালেদা জিয়ার সরকার। পরে অবশ্য রাজনৈতিক পট বিভিন্নভাবে পরিবর্তন হলে এবং ২০০৯-এ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরে এলে পুনরায় তদন্ত হয় এবং অতিরিক্ত চার্জশিট দাখিল করে পুলিশ তারেক রহমান সহ বিএনপি ও জামায়েতের প্রভাবশালী নেতা ও সাবেক মন্ত্রী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ।ইতিমধ্যে তারেক চিকিৎসা করানোর কারণ দেখিয়ে বাংলাদেশ ত্যাগ করে লণ্ডন উড়ে যান এবং পরে নিজের নিরাপত্তার কারণে সেখানে স্বেচ্ছা নির্বাসন গ্রহন করে। পরবর্তীতে দূর্নীতি নিরোধক কমিশনও তারেক রহমান এবং তাঁর ব্যবসায়িক অংশীদার গিয়াসুদ্দিন আল মামুনের বিরুদ্ধে ১২ টি মামলা করে। ২০১৬-র জুলাইয়ে বাংলাদেশ হাইকোর্ট এক রায়ে তারেক রহমানের ৭ বছরের জেল ও ২০ কোটি টাকা জরিমানা আদেশ দেন। অন্যদিকে ২০০৪ এর গ্রেনেড আক্রমনের মামলায় ২০১৮ সালের ১০ই অক্টোবর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইবুন্যালের রায়ে হামলার ঘটনায় লুৎফুজ্জমান বাবর, আব্দুস সালাম পিন্টু সহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড হয়। খালেদাপুত্র তারেক রহমান সহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং আরও ১১ জনের বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড হয়। রায়দানকালে বিচারক তাঁর রায়ে ঐ গ্রেনেড হামলা “একটি সুনিপুণ পরিকল্পনা, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে সম্পাদিত”বলে মন্তব্য করেন। সেই রায়ের প্রেক্ষিতে যথারীতি ‘ডেথ রেফারেন্স ও আপীল মামলা আসে হাইকোর্টে । পরের বছর ১৭ আগস্ট বেলা ১১টা থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যে সারাদেশের ৬৩টি জেলার গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও ঢাকার ৩৪টি সহ মোট সাড়ে চারশো স্থানে একযোগে সিরিজ বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ(জে এম বি)-ঘটনার পর পুলিশের পক্ষ থেকে দেড়শতাধিক মামলাও দায়ের করা হয়।

এরপর অবশ্য পদ্মা-যমুনা দিয়ে বয়ে গেছে বহু জল। ২০০৯ এ ক্ষমতায় ফিরে টানা ১৫ বছর প্রধানমন্ত্রীর আসনে এবং গত জানুয়ারীতে আবার চতুর্থবারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হওয়া শেখ হাসিনা এক দীর্ঘ পরিকল্পিত চক্রান্তের চূড়ান্ত পরিণতিতে এই আগস্টের পঞ্চম দিনে গদিচ্যূত–সেনাবাহিনীর সক্রিয়তায় প্রাণ রক্ষার্থে শেখ হাসিনার দেশত্যাগ করে আবার ভারতে-তাঁর রাজনৈতিক জীবনও অনিশ্চিত- দলের অস্তিত্বও সঙ্কটাপন্ন। অনেকেই লক্ষ্য করছেন, হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধী দলকে কোনঠাসা করে পনের বছর ধরে ‘স্বৈরাচার’ চালানোর অভিযোগে সোচ্চার দলগুলির মদতে গড়া প্রতিহিংসা পরায়ন বর্তমান ইউনুস সরকারও চরম অসহিষ্ণুতা ও হিংস্রতায় আরও নির্মমভাবে পথের কাঁটা বিরোধী পরিসর ও প্রতিবাদী স্বরকে স্তব্ধ করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন নিজেদের অপকর্ম অপ্রতিহত কিন্তু গোপন রাখার অভিপ্রায়ে।

শুধু আওয়ামী লীগের সদস্যরাই নন, বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও হাসিনা মন্ত্রীসভার প্রাক্তন মন্ত্রী রাশেদ খান মেননকে জামিন অযোগ্য ধারায় কেস দিয়ে গ্রেফতার করা হয়েছে। শুধু ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমন করে তাদের গৃহে অগ্নিসংযোগ ও দেবালয় বিনষ্ট করা হচ্ছে এমনটি নয় প্রগতিশীল মুক্তমনা মুসলমান বুদ্ধিজীবীরাও আজ নিগ্রহের শিকার। সাংবাদিকেরা এবং সংবাদ মাধ্যমও রেহাই পায়নি।দেশত্যাগে উদ্যত দৈনিক ভোরের কাগজের সম্পাদক ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের প্রাক্তন সাধারন সম্পাদক শ্যামল দত্ত ও একাত্তর টিভির পরিচালক মোজাম্মেল বাবুকে সীমান্তের কাছে আটক করে গ্রেফতার করা হয়- গ্রেফতার করা হয়েছে লেখক সাংবাদিক তথ্যচিত্র নির্মাতা এবং ঘাতক নির্মূল কমিটির সভাপতি ৭৩ বছরের শাহরিয়ার কবীরকেও -ইসলাম বিদ্বেষ ও খুনের অভিযোগে। তাঁকে শারীরিকভাবেও নিগ্রহ করা হয়।

হাসিনার দেশত্যাগের পরে আমুল বদলে যাওয়া বাংলাদেশে সকলের নজর ছিল সেই গ্রেনেড হামলার আপিল মামলা ও ‘ডেথ রেফারেন্স’এর রায় কি হয় সেদিকে । তবে আগস্টে নয়, আকস্মিক পরিবর্তিত দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ডামাডোলের আবহে অনুমান ও আশঙ্কা সত্য করে গত ডিসেম্বরের ১ তারিখে আপিল আদালতের রায়ে দেশ থেকে পলাতক তারেক রহমান এবং লুৎফুজ্জমান বাবর সহ সকল আসামী খালাসপ্রাপ্ত হয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে একইভাবে গত ৫ ডিসেম্বরে এক রায়ে বাংলাদেশ উচ্চন্যায়ালয় তারেক রহমান ও তাঁর ব্যবসায়িক বন্ধু গিয়াসুদ্দিন আল মামুনকে দুর্নীতি নিরোধক আইনের মামলায়ও অভিযোগ থেকে নিষ্কৃতি দেয়।

অন্যদিকে বিনাবিচারে আটক সন্ন্যাসী চিন্ময়স্বামীর ক্ষেত্রে বারবার লঙ্ঘিত হচ্ছে মানবাধিকার ও আইনের অধিকার-তাঁর হয়ে জামিনের আবেদন করতে যাওয়া আইনজীবীদের আদালত চত্বরেই এমন নির্মমভাবে মারা হয়েছে যে তাঁদের একজন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন হাসপাতালে। বিষয়টি সেদেশের বিশিষ্ট কবি ও দার্শনিক ফর হাদ মজহারও সম্প্রতি মহম্মদ ইউনুসকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। তবুও প্রথম দু’বার জামিনের আবেদন শুনানী করতেই দেওয়া হলো না- বরং চিন্ময়স্বামীরপক্ষে নতুন করে জামিনের আবেদন করতে গিয়ে সুপ্রীম কোর্টের প্রবীন আইনজীবী রবীন্দ্র ঘোষ আদালত কক্ষের মধ্যেই গালিগালাজ ও নিগ্রহের সম্মুখীন হন। অবশেষে গত ২ জানুয়ারি জামিনের আবেদনের শুনানী হলেও আবেদন খারিজ করে দেন আদালত।

বস্তুত সেদেশে আজ মানবাধিকার গণতান্ত্রিক অধিকার সবই চরমভাবে ধর্ষিত –বিচারব্যবস্থাও যে বিধ্বস্ত ত্রস্ত নিরপেক্ষতাহারা তারই লজ্জাজনক নজির একমাসেরও অধিককাল ‘দেশদ্রোহিতা’র হাস্যকর অভিযোগে বিনাবিচারে আটক থাকা চিন্ময়স্বামীর জামিনের আবেদন খারিজ হওয়া।এরকম অনেক মর্মান্তিক ও লজ্জাজনক নজির আজ সেদেশে হামেশা তৈরি হচ্ছে যা শঙ্কিত করছে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন আবিশ্বকে।