স্বপনকুমার মণ্ডল
মাইকেল মধুসূদন দত্তের (১৮২৪-১৮৭৩) মৃত্যুর পর ‘বঙ্গদর্শন’ (ভাদ্র ১২৮০) পত্রিকায় কবির প্রশংসায় পঞ্চমুখ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সুপবন বইতে দেখে জাতীয় পতাকা উড়িয়ে দিয়ে তাতে লিখতে বলেছেন ‘শ্রীমধুসূদন’। উনিশ শতকের বাংলা নবজাগরণের প্রভাবে প্রস্ফুটিত বাংলা সাহিত্যের পরিচয়ে সাহিত্য সম্রাট সেদিন যথার্থই উপলব্ধি করেছিলেন। বাংলা সাহিত্য যে ইতিপূর্বে উৎকর্ষমুখর বনেদিয়ানা লাভ করেছে, বঙ্কিমচন্দ্রের মনে তা নিয়ে কোনওরকম সন্দেহ ছিল না বলেই তাঁর এরূপ মনোভাব স্বত:স্ফূর্তভাবে বেরিয়ে এসেছে। সেখানে বাংলায় কবি জয়দেবের পরেই মাইকেল মধুসূদন দত্তের নাম করেছেন সাহিত্য সম্রাট। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক যোগসূত্র রক্ষা করে মধুকবির অসাধারণ বিস্তার আরও বেশি মহিমান্বিত করেছে বাঙালিকে। আসলে বাংলার ঐতিহ্য সুপ্রাচীন হলেও বাঙালির মননের নির্বিরোধ চলন খুব বেশি দিনের কথা নয়। সাহিত্যকে সেই মননের চলনে প্রতীয়মান করলেই বিষয়টি সহজবোধ্য হয়ে ওঠে। চর্যার সূচনায় ‘চঞ্চল চীএ’-এর কথা ব্যক্ত করা হয়েছে। অথচ সেই চঞ্চল চিত্তটি ধর্মীয় বিত্তে বৃত্তাকারেই আবর্তিত থেকেছে সুদীর্ঘকাল। সেখানে শুধু বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনযুগেরই নয়, তার মধ্যযুগের বহুমুখী সাহিত্যশাখাতেও সেই চঞ্চলা প্রকৃতির সবুজ বাতায়নে সুদূরের পিয়াসীর হাতছানি উপেক্ষিত হয়েছে । আসলে যেখানে চিত্তরঞ্জন ও চিত্তপ্রসাদের আকাঙ্ক্ষা তীব্রতর হয়ে ওঠে না, যেখানে চিত্তকে জয় করার মধ্যে জীবনধারণের বার্তাই প্রকট হয়ে ওঠে, সেখানে চিত্তের ব্যক্তিকেন্দ্রিক সঙ্কীর্ণতাবোধ কাটিয়ে ওঠা দুরূহ । এজন্য দেবনির্ভর প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে সমাজ বা গোষ্ঠীগত চেতনার মধ্যে ক্রমশ ব্যক্তিজীবনের অস্তিত্ব নানাভাবে পরিব্যাপ্ত হলেও তাতে জীবনতৃষ্ণা মূর্ত হয়ে ওঠার অবকাশ পায়নি । সেখানে নিয়তিতাড়িত জীবনকে কেন্দ্র করেই তা আবর্তিত । শুধু তাই নয়, যেখানে মানবিক আবেদন (‘সবার উপর মানুষ সত্য’) বিঘোষিত হওয়ার অপেক্ষায় তৃষ্ণাতুর, সেখানে ‘আমি সত্য’র ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ আপনাতেই ব্রাত্য হয়ে পড়ে । জীবন বাঁচানোই যেখানে উপজীব্য হয়ে ওঠে, সেখানে তার চিত্তের সম্প্রসারণ অপ্রত্যাশিত মনে হয় । জীবনরসিক কবি মুকুন্দ চক্রবর্তীও সেখানে প্রতিকূল জীবনচিত্রের পাশে চিত্তজয়ী প্রকৃতিকে সবুজ করে তুলতে পারেননি । অন্যদিকে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার সোপানবাহী তথা মধ্যযুগের আধুনিক মননশীল কবি ভারতচন্দ্র ‘যাবনী মিশাল’ দিয়েও চিত্তের প্রসার ঘটাতে পারেননি । সেখানে জীবনের পরিচয় মূর্ত হয়ে উঠলেও তার চিত্তশীলতা যাপনপ্রকৃতির মধ্যেই আবর্তিত । আসলে জীবন মানে তো শুধু প্রাণে বাঁচা নয়, তার সমৃদ্ধি লাভ করে মনে আর মানের উৎকর্ষে । সেই মানের উচ্চতা ও মনের প্রসারতা বাঙালিজীবনে তখনও অধরামাধুরী । শুধু তাই নয়, বাংলা সাহিত্যের আধুনিকতার সূচনাতেও তার আবেদন মূর্ত হতে পারেনি । এজন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্য । মধুকরের ন্যায় তিনি দেশে-বিদেশের মধু সঞ্চয় করে বাংলা সাহিত্যে প্রথম আন্তর্জাতিক আস্বাদ বয়ে আনেন । শুধু তাই নয়, তাঁর সচেতন প্রয়াসেই তা সম্ভব হয়েছে । সেদিক থেকে তাঁর ‘মাইকেল’ হওয়াটা তাঁকে বাঙালিসমাজে ব্রাত্য করে তুললেও বাংলা সাহিত্যের বুনিয়াদকে যে বনেদি করে তুলেছে, তা তাঁর এক ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’ই(১৮৬১, ১৮৬২) প্রতীয়মান । অন্যদিকে উনিশ শতকে কলকাতাকেন্দ্রিক নবজাগরণের মাধ্যমে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সোপানে সেই চিত্তের প্রসারণ সম্ভব হয়ে ওঠেনি । এজন্য অবশ্য বাঙালি মননের সক্রিয়তার অভাবকে সম্পূর্ণ দায়ী করা চলে না । কেননা উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকেই যে বাংলা সাহিত্যের অভিমুখ সম্পূর্ণত আন্তর্জাতিক হয়ে উঠল, তাও না । বিষয়টি সেদিক থেকে বিশ্লেষণের দাবি জানায় ।
বাঙালির বিত্তের অভাব থাকলেও চিত্তে সে শুধু বনেদি নয়, অভিজাতও বটে । চিত্তশালী বাঙালি তার স্বভাবে বিত্তের দাস হওয়ার বাতিককে অত্যন্ত সহজেই পরিহার করতে পেরেছে । শুধু তাই নয়, তার ঘরকুণো প্রকৃতির মধ্যেও ভাববিলাসী চিত্তটির আশুতোষ প্রকৃতিটি অত্যন্ত সতেজ ও সজীব ছিল । আধুনিক পরিসরেও অণুকরণপ্রিয় বাঙালির মধ্যে পাশ্চাত্য বণিকদের ব্যবসাবৃত্তিকে আত্মস্থ করার সদিচ্ছা সক্রিয় হয়ে ওঠেনি । অন্যদিকে চাঁদবেনে কিংবা ধনপতির বাণিজ্যযাত্রাও নিস্তরঙ্গ বাঙালিজীবনে সেভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি । সেক্ষেত্রে ধনের প্রাচুর্য বৃদ্ধিতে আধিপত্য বিস্তারের প্রতি বাঙালিমানস চিরকালই উদাসীন থেকেছে । অথচ মননচর্চায় ও মননের মধু আহরণে স্বভাবজয়ী বাঙালির চিত্তের গতিশীল অভিমুখ অনায়াসেই আধুনিকতার পরশকে আত্মস্থ করায় উন্মুখ হয়ে উঠেছিল । শুধু তাই নয়, সেখানে বণিক হওয়ার বাসনা তীব্র না হলেও সাহেব হওয়ার কল্পনা নিবিড়তা লাভ করেছে । সেক্ষেত্রে পাশ্চাত্য শিক্ষা-সংস্কৃতির আলোয় বাঙালিচিত্তের প্রসারণ ঘটেছিল অতিদ্রুততায় । সাহিত্যে তার প্রতিফলন ঘটতে সময় লেগেছে ঠিকই, কিন্তু তাতেও তার চিত্তের স্বকীয়তা প্রতীয়মান । আসলে বাঙালির স্বকীয়তায় তার মননের আভিজাত্যবোধ অত্যন্ত প্রকট ও স্বভাবজ । এজন্য তার স্বজাত্যবোধ ও স্বদেশপ্রীতিজাত ভাষিক অস্তিত্ব কখনই তাকে হীনমন্যতাবোধে ব্রাত্য করে তোলেনি, কিংবা, ভাষান্তরে বিপথে চালিত করেনি । শুধু তাই নয়, বাঙালি তার স্বভাবসিদ্ধ মননের প্রতি বরাবরই শ্রদ্ধাশীল থেকেছে । এজন্য চিত্তের প্রসারণে যেমন ডানা মেলে দিতেও তার দ্বিধাবোধ হয়নি, তেমনই তার সংকোচনেও জড়তা জেগে ওঠেনি । সেখানে বাঙালিত্বের গরিমা আপনাতেই ভাস্বর । ঈশব্রচন্দ্র গুপ্তের মধ্যেই তা প্রতিভাত ও প্রতিপন্ন । স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর গুরু ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের মধ্যেই খাঁটি বাঙালি কবির পরিচয়ের কথা সপ্রশংস ব্যক্ত করেছেন । আবার তাঁর প্রয়োজনও ফুরিয়েছে বলে তাঁর অভিমত । অন্যদিকে আধুনিক শিক্ষার সোপানে গড়ে তোলা আধুনিক মননের সক্রিয়তার অবকাশে যেখানে রক্ষণশীলতা বনাম প্রগতিশীলতার দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে ওঠে, সেখানে চিত্তের পক্ষবিস্তার সীমাবদ্ধ মনে হয় । আসলে স্বদেশের ভাবনাই যখন দানা বাঁধে না, সেখানে দেশান্তরের চেতনা আপনাতেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে । অথচ তারপরেও বাঙালিচিত্ত দেশান্তরের অভিমুখে অভিযান করেছে । রাজা রামমোহন রায় সেই অভিযাত্রী । ফরাসি বিপ্লবের সাম্য-মৈত্রী- স্বাধীনতার পতাকা তাঁকে শ্রদ্ধান্বিত করেছিল । অথচ বহু ভাষাবিদ হয়েও তাঁর পক্ষে সাহিত্যে আন্তর্জাতিকতার আবহ বয়ে আনার অবকাশ ছিল না । সেই অবকাশে মাইকেল মধুসূদন দত্তই বাংলা সাহিত্যে আন্তর্জাতিকতার আবহই শুধু বয়ে আনেননি, তার ভিতেই তাঁর সৃষ্টিকৌশল নবদিগন্তের সূচনা করেছে । সেখানে তাঁর সনেট, অমিত্রাক্ষর ছন্দ থেকে গীতিকবিতার সোপানই শুধু প্রস্তুত হয়নি, আন্তর্জাতিক আকুতি থেকে তার চেতনার আলোও বিস্তার লাভ করেছে ।
উনিশ শতকীয় নবজাগরণের আলোয় বাংলা সাহিত্যের আকাশে আধুনিকতার বর্ণরঙিন পরিসরটি অত্যন্ত সচেতনভাবেই গড়ে তোলায় ব্রতী হয়েছিলেন মধুসূদন । সেখানে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মেলবন্ধনে তাঁর ভূমিকাটি শুধু পথিকৃতের আভিজাত্যে নিঃস্ব হয়ে পড়ে না, বরং উৎকর্ষবিধায়ক আলোকিত পরিসরে নবচেতনার দ্বার উন্মুক্ত করে তোলে । সেক্ষেত্রে মধুসূদন শুধু পাশ্চাত্য ভাবনায় ভাবিত হয়ে শুধুমাত্র তাঁর বিষয়গৌরবেই গৌরবান্বিত হতে চাননি, তার আঙ্গিকসৌষ্ঠবেও বনেদি হতে চেয়েছিলেন । সেখানে পাশ্চাত্য ভাষা শিক্ষাতেও তাঁর অদম্য প্রয়াস বিস্ময়কর । প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মধুসূদনই প্রথম বাংলায় গ্রীক ভাষাচর্চা করেছিলেন । তাঁর ‘পদ্মাবতী’(১৮৬০) নাটকে যেমন প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করেছেন, তেমনই তাতে গ্রীকপুরাণের কাহিনি অবলম্বিত হয়েছে । আর তাঁর প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের অপূর্ব সমন্বয়ে প্রস্তুত ‘মেঘনাদবধ কাব্য’টিতে সেই গ্রীকপুরাণের হাতছানির নিবিড়তার কথা তিনি রাজনারায়ণ বসুকে অকপটে জানিয়েছেন : ‘It is my ambition to engraft the exquisite graces of the Greek mythology on our own ; in the present poem, I mean to give free scope to my inventing power (such as they) and to borrow as little as I can from Valmiki.’ শুধু তাই নয়, সেক্ষেত্রে মধুসূদন গ্রীকের কাহিনির চেয়ে গ্রীকের মতো লিখতে চেয়েছিলেন, ‘I shall not borrow Greek stories but write, rather try to write, as a Greek would have done.’ মধুসূদনের সদম্ভ প্রকৃতির মধ্যে যেমন তাঁর সহজাত প্রতিভার চারিত্রিক বিশেষত্ব বর্তমান, তেমনই তাতে আন্তর্জাতিক মননের উৎকর্ষও বিদ্যমান । অন্যদিকে মননের স্বকীয় আভিজাত্যে মধুসূদনের স্বাধীন প্রকৃতির সবুজ বাতায়নই তাঁকে প্রগতিশীল পাশ্চাত্য মানসপ্রকৃতির আধুনিকতাবোধে সক্রিয় করেছিল । সেখানে তাঁর আদর্শ কবি মিল্টনের ‘Paradise Lost’-এর শয়তানের স্বাধীনতাবোধও তাঁর মাধ্যমে উচ্চকিত হয়েছে । ‘Better to reign in hell than to serve in heaven’এর প্রতিধ্বনি মধুসূদন তাঁর সেই মহাকাব্যে কত ভাবেই না ব্যক্ত করেছেন । স্বধর্মে নিধনও শ্রেয়, পর ধর্ম ভয়াবহ’র বার্তা তাঁর প্রিয় নায়ক মেঘনাদের মাধ্যমে নানাভাবে উচ্চারিত হয়েছে । রাবণের সংসর্গ ছেড়ে ‘রাবণের পদাশ্রয়ে রক্ষার্থে আশ্রয়ী’ তথা ‘ধর্মপথগামী’ রাবণ-অনুজ বিভীষণের প্রতি মেঘনাদের তীব্র ভৎর্সনা ধ্বনিত হয়েছে, ‘শাস্ত্রে বলে, গুণবান যদি / পরজন, গুণহীন স্বজন, তথাপি/ নির্গুণ স্বজন শ্রেয়, পরঃ পরঃ সদা !’ সেখানে বাল্মীকি-রামায়ণের উক্তি মেঘনাদের কণ্ঠ থেকে নিসৃত হলেও তার মধ্যে মিল্টনীয় উচ্চারণ প্রতিধবনিত হয়ে ওঠে । আন্তর্জাতিকতা যেমন উদারতার হাতছানি বয়ে আনে, তেমনই আত্মসম্মানবোধে সক্রিয় করে । কেননা পারস্পরিক সম্মানবোধের মাধ্যমেই আন্তর্জাতিক পরিসরটি সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে । এজন্য নিজেদের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধাবোধ শুধুমাত্র শ্রেষ্ঠত্বের সোপান প্রস্তুতেই সহায়ক হয়ে ওঠে না, সেইসঙ্গে মানবিক দায়বদ্ধতায় উদার আকাশের হাতছানিও বয়ে আনে । সেদিক থেকে ‘বিধর্মী’ মধুসূদন বাংলা সাহিত্যে স্বাজাত্যবোধের মাধ্যমে স্বধর্মের আদর্শে প্রাণিত করতে চেয়েছিলেন, তা শুধু তাঁর স্বকীয় প্রকৃতিকেই আভিজাত্য প্রদান করে না, সেইসঙ্গে অন্তর্জাতবোধকেও সক্রিয় করে তোলে । সেখানে দেব-দৈত্য থেকে প্রভু-দাসের আপাতিক সমীকরণটিই রূপান্তরিত হয়ে মানবিক অস্তিত্বে উৎকর্ষমুখর মনে হয় । তাতে অস্তিত্বের সোপান বেয়ে মননবিশ্বে আত্মসচেতনতার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আবেদনটিও মূর্ত হয়ে ওঠে । শ্রেষ্ঠত্ববোধে মানবিক মূল্যবোধ সেখানে গতি লাভ করে । আর সেই গতি বাংলা সাহিত্যের প্রগতিকে ত্বরান্বিত করেছে ।
অন্যদিকে বাঙালি ধনে ধনী না হলেও মনে বনেদি । সেক্ষেত্রে সাহিত্যে তার স্ববাক্মূর্তিটিকে প্রতিমায় রূপান্তর করে শ্রদ্ধা নিবেদন করাটা ছিল সময়ের অপেক্ষামাত্র । অথচ তার জন্য প্রয়োজন তা আত্মস্থ করা । মধুসূদন তা পেরেছিলেন বলেই তাঁর পক্ষে আন্তর্জাতিক মননের সংযোগটি রক্ষা করা সহজসাধ্য হয়েছিল । শুধু তাই নয়, তিনি অত্যন্ত সচেতনভাবেই আন্তর্জাতিক পরিসরটিকে বাংলায় আপন করে যাপন করেছেন । অন্যদিকে সে সময় বাঙালিমানসে শিক্ষা-সংস্কৃতির আলো প্রতিফলিত হলেও তার মননের অভিমুখটি ছিল তখনও স্বদেশি । স্বাভাবিকভাবেই আন্তর্জাতিক মননকে আত্মস্থ করার শক্তি ও প্রতিভা এবং সদিচ্ছার অভাবে অনেকেই মধুসূদনের মতো সফলকাম হতে পারেননি । অন্যদিকে বাঙালির স্বকীয়তায় চিত্তের প্রসারণ ঘটলেও তার আভিজাত্যবোধে তা আপনার স্বরচিত বৃত্তে আবর্তিত হয়েছে । মধুসূদন পোশাকে সাহেব হলেও মনে আজীবন বাঙালিই ছিলেন । মনের এই স্বকীয়তা বাঙালির সহজাত । বঙ্কিমচন্দ্রও মননে আন্তর্জাতিক হয়েছিলেন । অথচ তিনি আবার তাঁর স্বরচিত বৃত্তেই ফিরে এসেছেন । শিল্পী বঙ্কিমের চেয়ে সেখানে নীতিবাগীশ বঙ্কিমের পরিচয় প্রকট হয়ে উঠেছে । আসলে এঁরা আনর্জাতিক ছাঁচটিকে ব্যবহার করেছেন মাত্র, অনুকরণ বা অনুসরণের নকলনবিশি করেননি । তার অন্তস্থিত সত্তাটিকে সাজিয়েছেন নিজের মতো । অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ তো দেশীয় সত্তার মধ্যে আন্তর্জাতিক পরিসরকে মিলিয়ে দিয়েছেন । ‘হে মোর চিত্ত’-এর ‘দিবে আর নিবে মিলিবে মেলাবে’র আহ্বানে কবিগুরু বাঙালিচিত্তের অসীম বিস্তারকে অমোঘ করে তোলেন । তাঁর ‘নব মহাভারত’( প্রমথনাথ বিশী রবীন্দ্রসাহিত্যকে এভাবে অভিহিত করেছেন ।) সাহিত্যে আবিশ্ব প্রতিধ্বনিত হয়েছে । অন্যদিকে এজন্য তাঁকে আন্তর্জাতিক মুখাপেক্ষী হতে হয়নি । অথচ তাঁকে বিরোধিতার নামান্তরে বিশ শতকের তৃতীয় দশকে বিদেশি সাহিত্যের অভিমুখে কল্লোলীয় অভিজাত্রায় বাংলা সাহিত্যে আন্তর্জাতিক পরিসর উন্মুক্ত হয়ে পড়ে । অর্থাৎ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে রবীন্দ্রনাথই বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় আন্তর্জাতিক পরিসরকে সমৃদ্ধ করে তোলেন । কল্লোলীয় সাহিত্যের অভিমুখ আন্তর্জাতিক হলেও তার আবেদন কতখানি আন্তর্জাতিকতা সম্পন্ন হয়ে উঠেছে, তা নিয়ে বিতর্ক বর্তমান । তবে বাংলা সাহিত্যের অভিমুখটি যে কল্লোলীয়দের মাধ্যমে আন্তর্জাতিকতায় সামিল হয়েছে, তা অনস্বীকার্য । অন্যদিকে যা মধুসূদনে প্রতিফলিত হয়েছে, তাই রবীন্দ্রনাথে অভ্যন্তরীণ পূর্ণপ্রতিফলন ঘটেছে । সেদিক থেকে কল্লোলীয় সাহিত্যে সেই আন্তর্জাতিক মননটি তার অভিমুখের সামনে অবিকল্প হয়ে ওঠে । কেননা সেখানে ‘পথ রুধি’ রবীন্দ্র ঠাকুর’ । স্বাভাবিক ভাবেই আন্তর্জাতিক আবহে বাংলা সাহিত্য তাতে নতুন মাত্রা লাভ করে । দেশ থেকে দেশান্তরে তার অভিজাত্রা, সীমাথেকে অসীমে তার হাতছানি । সেখানে মধুসূদনের কবিকণ্ঠই যে সেই যাত্রার আগমনিকে সূচিত করেছিল, তাও সহজে অনুমেয় । এবছর তাঁর জন্মের দুশো বছর পূর্তিতে সেই আন্তর্জাতিক কবিকণ্ঠই আমাদের হাতছানি দিয়ে চলেছে। মাইকেল মধুসূদন দত্তকে নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের সুগভীর প্রত্যয় আজও সমান প্রাসঙ্গিক, ভাবা যায়!