ধর্মীয় হিংসায় অস্থির বাংলাদেশে সাদাত হাসান মান্টোর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পাঠ অত্যন্ত জরুরি

সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী সাদাত হাসান মান্টো। ফাইল চিত্র

স্বপনকুমার মণ্ডল

ধর্মীয় সংকটে শুধু ধর্মের সংকটই মূর্ত হয়ে ওঠে না, মানবিক অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়ে। মানুষের ধর্মীয় বোধের অভাবই যেমন মৌলবাদী চেতনাকেই উগ্র করে তোলে,তেমনই তার মূল্যবোধে তীব্র সংকট দেখা দেয়। সেদিক থেকে উগ্র সাম্প্রদায়িক ভাগ বাঁটোয়ারার রেশ যে সাতচল্লিশের দেশভাগের পরেও জারি ছিল এবং এখনও বহাল তবিয়তে আছে, তা সাম্প্রতিক ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বাংলাদেশের দিকে তাকালেই সহজবোধ্য হয়ে ওঠে । এ বছর ৫ আগস্ট সে দেশের অভ্যুত্থানের মধ্যেই সেই ধর্মীয় বিদ্বেষের প্রলয়ঙ্করী রূপ অচিরেই উগ্র মূর্তি লাভ করে। ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সে দেশের সংবিধান থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটিই তুলে দিয়ে মৌলবাদীদের স্বদেশ গড়ে তোলার যুদ্ধংদেহি মনোভাব অচিরেই প্রকট হয়ে ওঠে। সেখানে সে দেশের মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট শব্দটি দেশের সংবিধান থেকে বাতিল করার বিপক্ষে রায় দিলেও তা নিয়ে কোনও রকম হেলদোল নেই, উল্টে ইসকোনের মতো সংখ্যালঘু মানুষের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে দেশদ্রোহী বলে চিহ্নিত করে নিষিদ্ধ করায় মরীয়া হয়ে উঠেছে।

সেক্ষেত্রে সে দেশের সংখ্যালঘুদের অস্তিত্ব সংকট আরও ভয়ঙ্কর রূপ লাভ করেছে। অন্যদিকে ধর্মীয় বিদ্বেষ যখন মানুষের মনকে নিরন্তর বিষিয়ে তুলছে,তখন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথাও আমাদের প্রাণিত করে না,বরং তার অভাববোধে দেশভাগের ক্ষতবিক্ষত ভয়ঙ্কর রূপটি জেগে ওঠে। আর সেখানেই সেই সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত আবহে দেশভাগের পরিসরেও যিনি ধর্মীয় পরিচয়ের বাইরে গিয়ে মানবধর্মের কথা সোচ্চারে তাঁর সাহিত্যে তুলে ধরেছেন, তিনি সাদাত হাসান মান্টো (১৯১২-১৯৫৫)। সেক্ষেত্রে তাঁর সাহিত্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিরল নজির অনির্বাণ দীপশিখা হয়ে ওঠে। নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারার মধ্যে যে ঘৃণ্য রাজনীতি বর্তমান,তার পরিচয় সাদাত হাসান মান্টোর সাহিত্যে কত আগেই প্রকাশিত হয়েছে,তা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। সেখানে মানবতার ধর্মই ব্যাহত হয় না, মনুষ্যত্ববোধেরও অবলুপ্তি ঘটে। শুধু তাই নয়, সম্প্রতির অভাববোধেই পারস্পরিক বিদ্বেষ কীভাবে মানবতাকে তিলে তিলে হত্যা করে চলে,তার নিবিড় পরিচয়েই সাদাত হাসান মান্টোর গল্প শেষ হয়ে যায় না । সেখানে জাগিয়ে তোলে মানবিক সত্তাকে, মানুষের মূল্যবোধকে, আত্মজাগরণ ঘটায় পারস্পরিক একাত্মতাবোধের। তাঁর দেশভাগের সাহিত্য মানুষ ভাগের কথাতেই শেষ হয় না,মানুষে মানুষে অভেদ্য সত্তাকেই বড় করে তোলে।


আসলে সাহিত্যে দেশভাগ ও দেশভাগের সাহিত্য বিষয়দুটি শুধু শব্দের স্থানপরিবর্তনের আধারেই ব্যবধান রচনা করে না, বিষয়ান্তরেও পার্থক্যমুখর । প্রথমটির দেশান্তরে অসীম ব্যাপ্তির পাশে দ্বিতীয়টির সসীম আবেদন আপনাতেই বিতর্ককে আমন্ত্রণ জানায় । সেখানে ভাগে কারো পৌষমাস, ভাগ্যে কারো সর্বনাশ। দেশভাগের শিকারে সামিল না হলে তো দেশভাগের সাহিত্য উঠে আসবে না । সেক্ষেত্রে দেশভাগের ফলে যে- বিভাজিত দেশের বিপুল সংখ্যক জনসংখ্যা কমে যাওয়ার আধারে উন্নতির সোপান প্রস্তুত হয়েছে, তার দেশভাগের সাহিত্য না থাকাই দস্তুর। আমাদের বাংলা সাহিত্যের দিকে লক্ষ করলেই তার পরিচয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পূর্ববাংলা তথা বাংলাদেশের সাহিত্যে তার অপরিচয় অত্যন্ত স্পষ্ট। অথচ পশ্চিমবঙ্গের বাংলা সাহিত্যে তার রেশ এখনও অত্যন্ত সজীব এবং প্রকাশমুখর। সেদিক থেকে দেশভাগের সাহিত্যের বিস্তারেও বিভাজিত দুই দেশের মধ্যে সমান প্রাসঙ্গিকতা লাভ করে না যদি না সমান ভাবেই তার শরিক হয়ে ওঠে। বাংলার মতো পাঞ্জাবেও তার পরিচয় সমুজ্জ্বল। অন্যদিকে সাহিত্যে দেশভাগের প্রকৃতি প্রায় একই রকম বিষাদমুখর বিপন্নতাবোধে সবুজ হয়ে ওঠে। ছিন্নমূল মানুষের স্বদেশে পরবাসী হওয়া থেকে অস্তিত্বের সংকটে পড়া অনিকেত শরণার্থীর উদ্বাস্তুর অনিশ্চিত অস্থির জীবনের মাসুল গোনার দায় মানবিক সত্তাকেই প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়।

সেখানে দেশভাগ মানে মানুষভাগের সোপানে মনের বিচ্ছেদবোধে একদিকে বেদনাবিদুর অকালসন্ধ্যা, অন্যদিকে বিদ্বেষজাত অন্ধত্বের তীব্র হাতছানি সবই জীবনকে বিপন্ন করে তোলে । স্মৃতি আর সত্তার বল্গাহীন চলনে জীবনের স্বাভাবিক গতি শুধু বেগতিক হয়ে পড়ে না, তার স্বচ্ছন্দ প্রকৃতিই বিষাক্ত আবহের শিকার হয়ে ওঠে। সেক্ষেত্রে সাহিত্যে দেশভাগের পরিচয় বিষাদবৃক্ষের ছায়ায় কায়া বিস্তার করে । স্বাভাবিক ভাবেই তার ফলে সূর্যালোকে এসে আত্মঅবলোকন করার মানসিকতা নিঃস্ব হয়ে পড়ে । সেদিক থেকে দেশভাগ যে সমাধান নয়, সমস্যা এবং সেই সমস্যার নানা পরত বর্তমান, তার পরিচয় সেই বিষাদবৃক্ষের ছায়ায় শুধু নিবিড় হয়ে ওঠে না, তা একটু তলিয়ে দেখলেই তা বোধগম্য হয়ে ওঠে। শুধু তাই নয়, নানাবিধ স্বার্থসিদ্ধির জন্য দেশের মানুষের ওপরে দেশভাগের দায় চাপিয়ে দেওয়ার অমানবিক কৌশল যে মানুষকে স্বদেশ থেকেই নির্বাসিত করেনি, মানবিক মূল্যবোধের কাছেও ব্রাত্য করে তুলেছে, তার পরিচয় সময়ান্তরে আপনাতেই প্রকট হয়ে উঠেছে। বর্তমানে দেশের অনুপ্রবেশকারী বনাম শরণার্থীর অস্তিত্বসংকট সেকথা আরও প্রত্যয়সিদ্ধ করে তুলেছে। অথচ দেশভাগের করুণ পরিণতি নিয়ে সংবেদী চিত্তের নিরাসক্ত ও নির্মোহ আত্মসমীক্ষার অবকাশ সাহিত্যের ক্ষেত্রে বিস্তার লাভ করেনি। বিশেষ করে বাংলা সাহিত্যে তার অভাববোধ বর্তমান।

সেদিক থেকে উর্দু সাহিত্যে সাদাত হাসান মান্টোর (১৯১২-১৯৫৫) লেখনী রেট ক্লিফের ব্যবচ্ছেদে ক্ষতবিক্ষত মানুষের মনের ছবি আঁকায় নিপুণ তুলিকা হয়ে উঠেছে। তাঁর শৈল্পিক আঁচড়ে দেশভাগের বিষাদবৃক্ষটিই শুধু মূর্ত হয়ে ওঠেনি, তার মূলের বিস্তারে অমানবিক চেতনাও আমাদের সামনে সবাকমূর্তি লাভ করে। সেদিক থেকে মান্টোর সাহিত্যে দেশভাগের পরিচয় শুধু বিষাদঘন স্মৃতির ভাবাবেগ নেই, রয়েছে আত্মসমীক্ষার বিবেকী সংবেদ। তাঁর সাহিত্যের বৃহৎ অংশ জুড়েই দেশভাগের মর্মান্তিক প্রকাশ নানাভাবে তীব্র প্রশ্নবাণে আমাদের মূল্যবোধের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়।

সাদাত হাসান মান্টো নিজে দেশভাগের শিকার হয়েছেন। ১৯৩৬ থেকে মুম্বই- এ তাঁর শ্বাসপ্রশ্বাসে যেভাবে নিজেকে ভারতীয় সত্তায় প্রকাশমুখর করেছিলেন, দেশভাগের বিষাক্ত আবহে তাই শ্বাসকষ্টের আধার হয়ে ওঠে। ১৯৪৮- এ তাঁকে মুম্বাই ছেড়ে পাকিস্তানে চলে যেতে হয় । অথচ সেখানে তাঁর সাহিত্যে দেশভাগের নেপথ্যে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের বিদ্বেষসঞ্জাত অন্ধত্ব তাঁকে গ্রাস করতে পারেনি, বরং অবাঞ্ছিত দেশভাগের করুণ পরিণতির পাশাপাশি ভাগের মায়ের গঙ্গা না- প্রাপ্তির কথাও উঠে এসেছে। সেদিক থেকে মান্টোর দৃষ্টি স্মৃতিতে আটকে থাকেনি, সত্তাতে প্রখর অন্তর্দৃষ্টির প্রাধান্য লাভ করেছে। সেখানে তাঁর শিল্পীসুলভ সংবেদী অন্তর্দৃষ্টি আমাদের শুধু স্মৃতিসুধায় বিদ্বেষী করে তোলে না, সত্তার অন্তঃস্থিত পরিসরে সজোরে জাগিয়ে তোলে। মান্টোর লেখনী তাতে অমোঘ সত্যসন্ধানী, বিস্ময়কর অনপেক্ষ।

পাকিস্তানে আশ্রয় নিলেও তাঁর নির্মোহ অন্তর্দৃষ্টি তাঁকে শুধু দেশভাগে ধর্মান্ধতা থেকে বিরত করেনি, সেইসঙ্গে সেই ধর্মীয় অসারতা দেখিয়ে তার অমানবিক প্রকৃতিকে প্রকট করে তুলেছে। বাংলার মতো পাঞ্জাবেও দেশভাগের বিধ্বংসী ঝড় বয়েছিল। সেই পাঞ্জাবের লুধিয়ানার সোমরালা গ্রামে মান্টো জন্মেছিলেন। ৪৭-এর ধর্মীয় আধারে বিভাজিত দেশভাগের বিদ্বেষী আবহ তাঁর জীবনকেও ছিন্নমূল করে তীব্র অস্থিরতায় সামিল করেছিল। যে-কারণে পাকিস্তানে গিয়ে তাঁর স্বদেশের শান্তিবোধ ফিরে আসেনি, বরং অবাঞ্ছিত দেশভাগই তাঁর মননে বাকী জীবনজুড়ে সক্রিয় ছিল। মান্টোর সাহিত্যে তার পরিচয় নিবিড় হয়ে উঠেছে। সেখানে দেশের ধর্ম পারস্পরিক সহাবস্থানে সম্প্রীতির আত্মীয়তা কীভাবে ধর্মের দেশে পরবোধে শত্রু হয়ে ওঠে, তার পরিচয় আমাদের আপন করে নেয় । এজন্য অবশ্য তাঁকে কম মূল্য চুকাতে হয়নি। অশ্লীলতার অভিযোগ থেকে সাম্প্রদায়িকতার দায়ে তাঁকে মামলার শিকার থেকে স্বসম্প্রদায়েরই রোষানলে পড়তে হয়েছে। অথচ মান্টো ছিলেন মানবিক আদর্শে অবিচল। তাঁর সেই সাহিত্যচর্চার মণিমুক্তোর আলো উর্দু ভাষায় সীমানা ছেড়ে ইংরেজিতে অনুবাদের মাধ্যমে বেশিদূর প্রসারিত হতে পারেনি। অথচ সেগুলির আবেদন শুধু শিল্পরূপেই নয়, দেশভাগের মননশীল ইতিহাস হিসেবেও অস্তিত্বমুখর।

১৯৩০- এ মাঝামাঝি আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার সময়ে মান্টো সাহিত্যচর্চার পরিসরে আসেন। সাহিত্যের উন্মেষপর্বে তিনি অনুবাদেও সামিল হয়েছিলেন। সময়ান্তরে সেই সময়ের অনুবাদেও তিনি যে সার্থকাম হয়েছিলেন, তা তাঁর সাহিত্যচর্চাতেও প্রতিফলিত হয়। সমাজের প্রান্তিক শ্রমজীবী মানুষের দহনপীড়িত আকাঁড়া জীবনের অভিজ্ঞতাকে তাঁর গল্পে নিবিড় ভাবে তুলেধরেছেন মান্টো। সেখানে মানুষের অস্তিত্বের মধ্যেই জীবনদর্শন প্রতিফলিত হয়েছে। সেখানে আদিমতার অমোঘ আকর্ষণই স্বাভাবিক মনে হয়। বিত্তের চেয়ে চিত্তের দাবিই প্রাধান্য লাভ করে। মান্টোর ‘গন্ধ’ গল্পে বিত্তশালী তরুণ ভিজে কাপড়ের মজদুরনিকে আশ্রয় দিয়ে সঙ্গমে লিপ্ত করে যে ঘাম আর ভিজে কাপড়ের উগ্র গন্ধে মাতোয়ারা হয়েছিলেন, তা সে জেলাশাসকের গ্রাজুয়েট মেয়েকে বিয়ে করে বাসরঘরে ফিরে পাননি। এই না-পাওয়াটাই সত্য । সেই সত্যসন্ধানী মান্টোই যখন দেশভাগের মর্মান্তিক আঘাতে ছিটকে গিয়ে দেশান্তরে পাড়ি দিতে বাধ্য হয়েছিলেন, তথন তার স্বরূপ উনমোচনে ব্রতী হন। তাঁর মনে হয়েছিল ৪৭- এর সহিংসতা সেখানেই শেষ হয়নি, শেকড় গেড়েছে— ডালপালা মেলে বৃক্ষে পরিণত হবে। এজন্য তার মূলে পৌঁছানোর সদিচ্ছায় তার নানা পরত, বিবিধ পরিসরকে নিয়ে মান্টোর গল্প এগিয়েছে।

সাদাত হাসান মান্টো দেশভাগের ধর্মীয় পরিসরে মানুষের আত্মপরিচয়ের সংকটকে নিবিড় করে তুলেছেন। সেখানে মানবিক অস্তিত্বকে দেশভাগের বিধ্বংসী আঘাতে ধর্মীয় বিদ্বেষকে যেভাবে মূলধন করে নিঃস্ব করে তুলেছে, তার আকাঁড়া পরিচয় সজীব হয়ে উঠেছে। পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েও তাঁর দেশকালের পক্ষপাতহীন অন্তর্দৃষ্টি দেশভাগের ধর্মীয় উন্মাদনার মধ্যে মানবিকতাবোধের অবক্ষয়িত সভ্যতাবিমুখতার প্রতি বারবার আলো ফেলেছে। মান্টোর ‘ঠান্ডা গোস্ত’, ‘টোবা টেক সিং’, ‘তামাশা’ ‘কালি সালোয়ার’, ‘খালি বোতল’, ‘ধোঁয়া’ প্রভৃতি গল্পে তার পরিচয় সহজবোধ্য হয়ে উঠেছে । শুধু তাই নয়, দেশভাগের নেপথ্যে যে তত্ত্ব সক্রিয় ছিল, তা নিয়েও মান্টো কত গভীরে ভেবেছিলেন, তার পরিচয় তাঁর অসাধারণ গল্প ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব’- এর মধ্যেই প্রতীয়মান । পাকিস্তানে লেখা গল্পটির মধ্যে গল্পকার সেই তত্ত্বকে প্রেমিকপ্রেমিকার রূপকের মাধামে উপস্থাপিত করেছেন । হিন্দু বালিকা শারদার সঙ্গে মুসলিম কিশোর মুখ্তারের প্রেম স্বাভাবিক ভাবেই ধর্মে আটকে পড়ে । শেষে প্রেমের ধর্মে তা পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হয় । সেখানে প্রেমিকের ‘ প্রেমের ধর্মের কাছে আর সব ধর্মই তুচ্ছ’র ঘোষণা অচিরেই নীরবতা পালন করে। নব বিবাহিত বধূকে স্বীয় ধর্মে ধর্মান্তরিত করার চাপ দেওয়ার প্রয়াসে প্রেমিকের ছদ্মবেশ বেরিয়ে পড়ে। স্বাভাবিক ভাবেই মিলনের শঠতা বিচ্ছেদের মাধ্যমে স্বতন্ত্রতা লাভ করে । মানবিক সত্তার চেয়ে ধর্মীয় স্বতন্ত্রতার আবেদন কত আগ্রাসী এবং কত হিংস্র, তা মান্টো তাঁর এই গল্পের মধ্যে প্রকট করে তুলেছেন। সেখানে হিন্দু- মুসলমানের ধর্মীয় পরিচয়ের মধ্যে দুই দেশের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব কীভাবে দাঁড়িয়ে আছে, তা আমাদের বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না। মান্টো তাঁর শৈল্পিক সততায় তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন।

অন্যদিকে দেশভাগের ধর্মান্ধতায় পাশবিক উল্লাস শুধুমাত্র দাঙ্গার মধ্যে নিস্তেজ হয়ে পড়ে না, ধর্মীয় অস্তিত্বকে সরিয়ে রেখে বিকৃত লালসাতে সক্রিয় হয়ে ওঠে । সেখানে নারীর দেহসম্ভোগের তীব্র লালসা দেশভাগের দ্বন্দ্বমুখর প্রতিশোধস্পৃহার শিকারকে নারকীয় বীভৎসতায় আত্মদহনের আধার করে তোলে । অথচ সেই নারকীয়তার প্রদর্শনেই মান্টো থেমে থাকেননি, তার মানবিক মুখের হাহাকারও লক্ষ্যভেদী অর্জুনের মতো স্বীয় অভীষ্টে উপনীত হয়েছেন। ‘ঠান্ডা গোস্ত’- এর পাঞ্জাবি ঈশ্বর সিং দেশভাগের দাঙ্গায় বিধর্মীদের রক্তে হাত রাঙিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, বিধর্মী নারীসম্ভোগেও মেতে ওঠে। জনৈক মুসলিম বালিকাকে সম্ভোগ করতে গিয়ে তার কোনোরকম প্রতিক্রিয়া না পেয়ে শেষে সে আবিষ্কার করে সেই মেয়েটি আসলে মৃত । এজন্য সে তার বিবেকী ক্ষরণে কামচেতনাও হারিয়ে ফেলায় প্রেমিকার কাছে ফিরে গিয়ে অনুতাপে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। আবার দেশভাগের ধর্মীয় দাঙ্গায় ধর্মবোধ উবে গিয়ে দাঙ্গার শিকারীদের কাছে নারীদের শরীর কীভাবে ভোগ্যপণ্যে অমানবিক হয়ে ওঠে, তার পরিচয়েও মান্টোর লেখনী সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তাঁর ‘ফিরে দেখা’ গল্পে দেশভাগের দাঙ্গায় স্ত্রী হারানো সিরাজুদ্দিনের পরমা সুন্দরী কন্যা সাকিনাও হারিয়ে যায় । তার জন্য নানাভাবে সন্ধান চালিয়ে ব্যর্থ হয়ে সিরাজুদ্দিনের সব হারানোর বেদনা তীব্রতা লাভ করে।

অবশেষে হসপিটালে তার হারানো মেয়ের সন্ধান পেলেও সেই বেদনা আরও ঊর্মীমুখর হয়ে ওঠে । অন্ধকার ঘরে আলো আসার জন্য ডাক্তারের ‘খুলে দাও’ আজ্ঞায় সিরাজুদ্দিনের জানালা খোলার পরিসরে শায়িত সাকিনা শালোয়ারের দড়ি আলগা করে দু- পা ফাঁক করে দেয় । ইতিমধ্যে সে দাঙ্গাকারীদের মধ্যে থেকে বিধর্মী হিন্দু- স্বধর্মী মুসলমান নির্বিচারে ধর্ষিত হওয়ায় ‘খুলে দাও’- এর মধ্যে দেহদানের প্রস্তুতির প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সেখানে মান্টোর লেখনী ধর্মীয় চেতনার অন্তরালে মানবিক মূল্যবোধে আঘাত হেনে তার ক্ষরণ ঘটিয়েছেন । বিচ্ছিন্নতার আবেশে ধর্মীয় মেরুকরণ দেশভাগের আধার হলেও তার বিধ্বংসী লীলায় কারও নিস্তার নেই। এই অবাঞ্ছিত দেশভাগ শুধু মানুষকেই ভাগ করেনি, মানবতাকেও নিঃস্ব করে তুলেছে। সেখানে মান্টো সেই হৃত মানবিকবোধকে তাঁর গল্পে জাগিয়ে তোলায় সচেষ্ট হয়েছিলেন। এজন্য তাঁর গল্পে দেশভাগে ধর্মীয় প্রতিশোধের আগুন জ্বলে ওঠে না, বিশ্বজনীন মানবিক আবেদন মুখরিত হয়ে ওঠে। প্রতিশোধস্পৃহাও আত্মসমীক্ষার প্রতিষেদকে রূপান্তরিত হয়।

আসলে মাণ্টোর সাহিত্যে দেশভাগের পরিচয় যেভাবে মানবিকতাবোধে তীব্র আবেদনক্ষম হয়ে ওঠে, তাতে দেশভাগের নামে মানুষভাগের হিংস্র উন্মাদনার পরেও মূল্যবোধে আত্মসমীক্ষার পরিসরটি ব্রাত্য হয়ে পড়েনি । বরং আত্মসমীক্ষার সোপানে তা প্রতিশোধস্পৃহাকে আত্মমূল্যায়নে সক্রিয় করে তোলে । সেদিক থেকে দেশভাগের সাহিত্যে মাণ্টোর নিরপেক্ষ আবেদন আরও বেশি মর্মস্পর্শী হয়ে ওঠে। ধর্মীয় মেরুকরণের প্রতাপও সেখানে মানবিক প্রেমের উদার হাতছানি বয়ে আনে। তাঁর স্বল্পায়তনের গল্প ‘তিক্তফলনʼ(‘শরীফন’ নামেও অনুবাদিত)-এর মধ্যেই তার পরিচয় নিবিড় হয়ে উঠেছে। ঘরে ফিরে কাশিম দেখে তাঁর মেয়ে শরিফান ধর্ষিত ও নিহত হয়েছে। এতে তাঁর কুঠার হাতে হত্যালীলা পাশবিক হয়ে ওঠে । বিমলা নামে একটি হিন্দু মেয়েকে কাশিম ধর্ষণ করেন। আবার সেই ধর্ষকই চৈতন্যলাভের পর ধর্ষিতার মধ্যে নিজের মেয়েকে খুঁজে পেয়ে কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে পড়েন। ভূলুন্ঠিতা বিমলাকে ফাঁপা স্বরে কাশিম বলে ওঠেন ‘শরিফান। সেখানে বিমলা আর শরিফান একাত্ম হয়ে ওঠে। দেশভাগের সাহিত্যে মাণ্টোর এই একাত্মবোধের অভাব সময়ান্তরে আরও সজীব, আরও সবুজ হয়ে উঠেছে। মাণ্টোকে সেখানে সংবেদী বিবেক মনে হয়। তাঁর ‘ টোবা টেক সিং’ (১৯৫৫) সাড়া জাগানো গল্পে অবাঞ্ছিত দেশভাগে কীভাবে ছিন্নমূল জীবনের মূলে প্রাণরসের আর্তি কীভাবে দেশের বাইরে নীরবতা লাভ করে, তার পরিচয় পাঠকের সংবেদী চিত্তে বাকশক্তিহীন বিস্ময়কর আবহ বয়ে আনে। দেশভাগের পর দুই দেশের মধ্যে পাগলদের বিনিময়ে পাকিস্তানের টোবা টেক সিং গ্রামের বিষেণ সিং দীর্ঘ দিন পাগলদের হসপিটালে ভর্তি রয়েছেন, হিন্দু বলে ঠাঁই তাঁর ঠাঁই হয়েছে ভারতে। অথচ সেখানে তিনি যেতে চান না।

অবশেষে জোরজবরদস্তি করে নাছোড় বিষেণ সিংকে দেশান্তর করা সম্ভব হয় না। দীর্ঘ পনেরো বছর ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকা বিষেণ সিং দুই দেশের মাঝে নো ম্যানস ল্যান্ডে তাঁর টোবা টেক সিংকে খুঁজে নিয়ে মুখ থুবড়ে আত্মত্যাগ করেন। দুই দেশে যে তাঁর টোবা টেক সিংকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। দেশভাগ শুধু স্বদেশে পরবাসী করেই তোলে না, নতুন দেশেও প্রবাসীর পরিচয়ে সামিল করে। স্বাধীনতার একাত্তর বছর পরেও দেশে তার প্রকট অস্তিত্ব বর্তমান। সেদিক থেকে মান্টোর ক্রান্তদর্শী অন্তর্দৃষ্টি যে দেশভাগের পরিসরে সীমাবদ্ধ ছিল না, তা তাঁর মানবিক আবেদনমুখর গল্পগুলিই সপ্রমাণ করে তুলেছে। আসলে তাঁর গল্পগুলির অভিমুখ সময়ের অনুবাদেই সীমিত থাকেনি, চিরন্তন মূল্যবোধে মানবিক হয়ে উঠেছে। সেক্ষেত্রে তাঁর রচিত সাহিত্য দেশভাগের সাহিত্যকে অতিক্রম করে অনায়াসেই সাহিত্যে দেশভাগের পরিচয়ে মহার্ঘ আভিজাত্য লাভ করেছে। অন্যদিকে তা জাগিয়ে রাখে চিরন্তন মানবতাকে, ধর্মীয় পরিচয়ের চেয়ে মানুষের পরিচয় বড় হয়ে ওঠে।