আমেরিকায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে শিল্পপতি গৌতম আদানির বিরুদ্ধে। আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই, জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট এবং সিকিওরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন-এই তিনটি সংস্থার যৌথ তদন্তে, বরাত পেতে ঘুষ দেওয়ার চাঞ্চল্যকর অভিযোগে অভিযুক্ত আদানিরা। বিষয়টি সামনে আসার পর থেকেই ধস নেমেছে ভারতের শেয়ার বাজারে। আর সেই আবহেই আদানি গোষ্ঠীকে দেওয়া বিমানবন্দর চুক্তি বাতিল করেছে কেনিয়া।
রীতিমত বিবৃতি দিয়ে আদানি গোষ্ঠীর সঙ্গে চুক্তি বাতিলের ঘোষণা করেন কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম রুটো। তিনি জানিয়েছেন, দেশের মূল বিমানবন্দরটি পরিচালনার জন্য যে চুক্তি হয়েছিল আদানিদের সঙ্গে, তা বাতিল করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি, গত মাসে ৭৩.৬ কোটি ডলারের যে বিদ্যুৎ সরবরাহের লাইন তৈরির চুক্তি হয়েছিল আদানিদের সঙ্গে, তাও বাতিল করা হয়েছে। আমেরিকা থেকে যে তথ্য সামনে এসেছে আদানিদের নিয়ে, তার জেরেই এমন সিদ্ধান্ত বলে জানান তিনি। হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টের পর, গত দু’বছরে এই নিয়ে পর পর দু’বার বড় ধাক্কা খেল আদানি গোষ্ঠী। কিন্তু এবারে আদানিদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে, তা অত্যন্ত গুরুতর। আমেরিকার তদন্তকারী সংস্থাগুলি জানিয়েছে, সরকারি প্রকল্পের বরাত পেতে ভারতের আধিকারিকদের ২০০০ কোটি টাকার বেশি ঘুষ দিয়েছিল আদানি গোষ্ঠী, যা থেকে ২০ হাজার কোটি মুনাফা ঘরে তোলার লক্ষ্য ছিল তাদের।
আর এর মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি উৎপাদনকারী সংস্থা সোলার এনার্জি কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়ার বরাত নিয়েই সবচেয়ে বড় অভিযোগ সামনে এসেছে।বলা হয়েছে,ওই কর্পোরেশনকে ১২ গিগাওয়াট সৌরবিদ্যুৎ প্রদান করা হবে। কিন্তু আদানি গোষ্ঠীর সঙ্গে চুক্তি হয়ে গেলেও, কোনও গ্রাহক খুঁজে পায়নি সোলার কর্পোরেশন। কারণ যে দামে সৌরশক্তি বিক্রির কথা বলা হয়, তাতে পোষায়নি কোনও রাজ্যের। এরপরই আদানি গোষ্ঠী বেশ কিছু রাজ্যের আধিকারিকদের ঘুষ দিয়ে সৌরবিদ্যুৎ বিক্রির চেষ্টা করে বলে অভিযোগ। কিন্তু আমেরিকার যে সমস্ত ব্যাঙ্ক এবং বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ওই প্রকল্পবাবদ হাজার হাজার কোটি টাকা তুলেছিল আদানি গোষ্ঠী, তাদের গোটা বিষয়টি সম্পর্কে অন্ধকারে রাখা হয়। শুধু তাই নয়, আদানি গ্রীন এনার্জির প্রাক্তন সিইও বিনীত জৈন দুর্নীতির বিষয়টি লুকিয়ে ঋণ এবং বন্ড বাবদ বাজার থেকে ৩০০ কোটি ডলার তোলেন বলে অভিযোগ সামনে এসেছে। গৌতম আদানির ভাইপো সাগর আদানি-সহ মোট আট জনের নামে দুর্নীতি, জালিয়াতির অভিযোগ সামনে এসেছে। আদানিরা অভিযোগ অস্বীকার করলেও, তাঁরা এখন কোথায়, জানা যায়নি। বাকি অভিযুক্তের মধ্যে আছেন আদানি গ্রিন এনার্জি লিমিটেডের সিইও বিনীত জৈন, রঞ্জিত গুপ্ত, রুপেশ আগরওয়াল, অস্ট্রেলিয়া ও ফ্রান্সের নাগরিক সিরিল ক্যাবানেস, সৌরভ আগরওয়াল ও দীপক মালহোত্র।
জালিয়াতি, দুর্নীতি, ঘুষ দেওয়ার মারাত্মক সব অভিযোগ এদের বিরুদ্ধে সামনে এনেছে আমেরিকার তদন্তকারী সংস্থাগুলি। বিষয়টি সামনে আসতেই আদানি গোষ্ঠীর বিভিন্ন সংস্থার শেয়ারে যেমন পতন দেখা দিয়েছে, তেমনই ভারতের রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাঙ্ক, ভারতীয় জীবনবিমা সংস্থা এলআইসি-র শেয়ারেও ধস নেমেছে।আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ ওঠার পরই আদানি গোষ্ঠীর শেয়ারের দাম ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে।পরিণামে গৌতম আদানির ব্যক্তিগত সম্পদের মূল্য কমেছে। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আদানি গ্রিন এনার্জির যে বন্ড ছাড়ার কথা ছিল, তা স্থগিত করা হয়েছে।ফোর্বস ম্যাগাজিন জানিয়েছে একটা সময়ে একদিনে গৌতম আদানির সম্পদমূল্য কমে যায় ১২ দশমিক ৪ বিলিয়ন বা ১ হাজার ২৪০ কোটি ডলার। তবে পরে শেয়ারের দাম কিছুটা বৃদ্ধি পাওয়ায় সম্পদমূল্য হ্রাসের পরিমাণ কিছুটা কমে ১০ দশমিক ৫ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৫০ কোটি ডলারে নেমে আসে। এমন পরিস্থিতিতে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, আদানি গোষ্ঠী ডোবার অর্থ, মধ্যবিত্তের ভরসা এলআইসি, স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ারও পতন। আগামী দিনে আদানি গোষ্ঠী আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে, সাধারণ মানুষও সর্বস্বান্ত হতে পারেন। কারণ এই সংস্থাগুলি আদানিগোষ্ঠীতে বিনিয়োগ করেছে, হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। সাম্প্রতিকতম পরিসংখ্যানের নিরিখে, আদানি গোষ্ঠীর সাতটি সংস্থায় এলআইসি-র বিনিয়োগ রয়েছে। ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বরের হিসাব অনুযায়ী, আদানি গোষ্ঠীর সব সংস্থার প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি শেয়ার কিনেছে এলআইসি আদানি গোষ্ঠী ধাক্কা খাওয়ার পর একদিনে এলআইসি-র প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার লোকসান হয়েছে। অর্থাৎ আগামী দিনে আদানি গোষ্ঠী আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে, সাধারণ মানুষ কষ্ট করে এলআইসি-র মতো যে সব সংস্থায় টাকা রাখেন, তারাও ধাক্কা খেতে পারে। আর তাতে আখেরে বিপদে পড়তে পারেন দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণি।
আদানির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের ধাক্কা লেগেছে ব্যাঙ্কগুলিতেও। কারণ একাধিক রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাঙ্ক আদানিদের হাজার হাজার কোটি কোটি টাকার ঋণ দিয়েছে। আদানির টাকা ডোবার অর্থ, সেই টাকা ফেরত আসা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে। সেই অনিশ্চয়তা থেকেই রাষ্ট্রায়াত্ত ব্যাঙ্কগুলির শেয়ারের গ্রাফও নীচের দিকে নেমেছে। যে যে ব্যাঙ্ক থেকে আদানি গোষ্ঠী ঋণ নিয়েছে, সেই তালিকায় রয়েছে বহু ব্যাঙ্ক।এর মধ্যে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া, পঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক এবং ব্যাঙ্ক অফ বরোদা থেকে আদানি গোষ্ঠীর মোট ঋণের অঙ্ক প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এসবিআই সবচেয়ে বেশি টাকা ঋণ দিয়েছে আদানিদের, প্রায় ২৭০০০ কোটি টাকা, পিএনবি ৭০০০ কোটি এবং ব্যাঙ্ক অফ বরোদা ৫৩৮০ কোটি। সাধারণ মানুষ টাকা জমা রাখতে যে এসবিআই-এর ওপর সবচেয়ে বেশি ভরসা করেন, তাদের শেয়ার দর একদিনে প্রায় ৫ শতাংশ কমেছে। ব্যাঙ্ক অফ বরোদার শেয়ারে ৭ শতাংশ, পঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কের শেয়ার দরে ৬ শতাংশ, কানাড়া ব্যাঙ্কের শেয়ারে ৫ শতাংশ ধস নেমেছে। ব্যাঙ্ক নয় এমন অর্থনৈতিক সংস্থাগুলিও আদানিদের মোটা টাকা ঋণ দেয়। ব্যাঙ্ক এবং সেই সংস্থাগুলি আদানি গোষ্ঠীকে সব মিলিয়ে ৮৮০০০ কোটি টাকার ঋণ দিয়েছে। একদিনে আদানি গোষ্ঠীর শেয়ারে প্রায় ২০ শতাংশ ধস নেমেছে। একদিনে প্রায় ২.২ লক্ষ কোটি টাকা ডুবে গিয়েছে তাদের। তাই আদানিরা যদি ঋণ পরিশোধ করতে না পারে, তাতে কী হবে, ভেবে আশঙ্কিত অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে, আদানি গোষ্ঠীর এই ধাক্কা সামলাতে গিয়ে আগামী দিনে ফিক্সড ডিপোজিট-সহ অন্য সঞ্চয় প্রকল্পে সুদ কমিয়ে দেওয়া হবে না তো? ফলে সাধারণ মানুষের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
এরই মধ্যে মার্কিন প্রেসিডেন্টের দপ্তরের দাবি, আদানির বিরুদ্ধে যাই অভিযোগ উঠুক না কেন তাতে ভারত-আমেরিকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নাকি অবনতি হবে না। কারণ দুই দেশের সম্পর্ক যথেষ্ট মজবুত।এই ঘটনায় উঠে এসেছে এক রহস্যময় ব্যক্তির নাম। তাঁর নাম ‘ফরেন অফিশিয়াল #১’। জানা গিয়েছে, তিনি অন্ধ্রপ্রদেশের এক উচ্চপদস্থ সরকারি আধিকারিক। ২০১৯ সালের মে মাস থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত তিনি ওই পদে ছিলেন। আর তাঁকেই মোট ঘুষের অঙ্কের ১৭৫০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছিল। স্বাভাবিক ভাবেই জল্পনা বাড়ছে এই ব্যক্তিকে। এহেন পরিস্থিতিতে গোটা বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছেন হোয়াইট হাউসের প্রেস সচিব কারিন জ্যাঁ-পিয়ের। তিনি বলেছেন যে, আদানির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে সেটা তাঁরা নাকি জানেন। তবে এই নিয়ে বিচার দপ্তর বিশদে জানাতে পারবে। তিনি শুধু এটুকু বলতে পারেন যে, ভারত এবং আমেরিকার সম্পর্ক খুবই দৃঢ় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নানা বিষয়ে দুই দেশ একে অপরের সহযোগী। আদানি ইস্যুতে ভারত-আমেরিকার কূটনৈতিক সম্পর্কে কোনও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না বলেই আশাবাদী হোয়াইট হাউস। কেন হোয়াইট হাউস আগ বাড়িয়ে এমন বিবৃতি দিল তা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন।
২০২৩ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত হয় হিনডেনবার্গ রিসার্চের প্রতিবেদন। সেই প্রতিবেদনে আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শেয়ার দরে কারচুপির অভিযোগ ওঠে। ধস নামে আদানির বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার দরে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আদানির সখ্যের জেরে ভারতের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও তখন আদানিদের বিরুদ্ধে সরব হয়।অনেকে বলতে শুরু করেন, আদানির সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছে। রাতারাতি এই গোষ্ঠীর বাজার মূলধন কমে যায়। যাদের বাজার মূলধন ছিল ১৯ লক্ষ কোটি টাকা, তা প্রায় ৭ লক্ষ কোটি হারিয়ে সাড়ে ১২ লক্ষ কোটি টাকায় নামে। এক বছর পর পরিস্থিতি কিন্তু অনেকটাই সামলে নিয়েছিলেন আদানি। হারানো আসন অনেকটাই ফিরে পেয়েছিলেন, যদিও বিতর্ক পিছু ছাড়ছিল না তাঁকে। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের জন্য প্রস্তাবিত ডলারভিত্তিক বন্ডের বিষয়ে অগ্রসর না হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে গ্রিন এনার্জি। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ৬০ কোটি ডলার মূল্যের বন্ড ছাড়ার কথা ছিল আদানি গ্রিন এনার্জির। আদানির ব্যবসায় যে জালিয়াতিই একমাত্র মূলধন তা আরও একবার প্রমাণিত হল।