‘বউমা নাতিকে স্নান করিয়ে দিয়ে গরম গরম ভাত খাইয়ে দাও’। আমার ১০২ জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। আর আমার মা’কে কথাগুলো বলছেন অবনী ডাক্তার। আমি তখন বছর ছয়। বহরমপুর। সালটা ১৯৭৩। আমার ঠাকুরদা ঈশানচন্দ্র কর পুরকায়স্থ, শশাঙ্ক শেখর স্যানাল আর অবনী ডাক্তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। বাবা তখন বহরমপুরে পোস্টেড। সেই সূত্রে অবনী দাদুর আমাদের গোরাবাজারের বাড়িতে যাতায়াত। ওনার কথা শুনে ওই তিয়াত্তর সালে আমার মা হতবাক, বলেন কি কাকাবাবু। আমার গা না ছুঁয়ে শুধু আমাকে দেখে অবনীদাদু বলেছিলেন, যা বলছি, তা করো।বলেই দু’টো বড়ি লিখে দিয়ে চলে গেছিলেন।দু’ দিনে আমার জ্বর গায়েব। আজকের ডাক্তাররা হলে, টেস্টের পর টেস্ট করিয়ে টাকার শ্রাদ্ধ করে বুঝতে পারতেন, আসলে কি হয়েছে। তারপর তো চিকিৎসা। তাই, অবনী ডাক্তারদের মত প্রবীণ মানুষদের কথা আজ বড় বেশি করে মনে পড়ে।
আজ আরেক জনের কথা মনে পড়ছে। সাদামাটা মানুষ। সাদা পায়জামা অথবা জিন্সের ওপর মামুলি একটা পাঞ্জাবী। সঙ্গে শান্তিনিকেতনী ব্যাগ। তাতে বৌদির করে দেওয়া ডিনার। রোজ কাগজ ছেড়ে রাত দশটায় নিয়ম করে প্রেসক্লাবে আসেন। আর আমি ওনার জন্য বসে থাকি। অন্তত সপ্তাহে একদিন। আমার পাশে বসেন ইন্ডিয়ান জার্নালিস্ট এসোসিয়েশনের প্রাণপুরুষটি। সাম্প্রতিক ঘটনাবলি নিয়ে আলোচনা হয়। লেখালেখি নিয়ে মৃদু ধমক খাই। আবার অগাধ স্নেহে মাথার চুলে বিলি কেটে দেন। যার প্রশ্রয় আর উৎসাহে আমার এই লেখালিখি। আমার ভয় আর অপার শ্রদ্ধার এক মানুষ। মনে হয় এই প্রবীণ মানুষগুলো আছেন বলেই এই আজ এই সাংঘাতিক পরিবেশের মধ্যেও বাঁচতে ইচ্ছে করে।
আর এঁদের জন্যই ১ অক্টোবর পালিত হয় ‘আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস’। সারা বিশ্বে বয়স্ক ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক দিবস হিসাবে পালিত হয়। ইউনাইটেড নেশনস ১৪ ডিসেম্বর ১৯৯০ তারিখকে বয়স্কদের জন্য ‘আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস’ হিসাবে ঘোষণা করার প্রস্তাব করেছিল। পরে এই দিনটি ১ অক্টোবর ১৯৯১ থেকে প্রবীণদের জন্য আন্তর্জাতিক দিবস হিসাবে পালিত হয়।
যেকোনো দেশেই মোট জনসংখ্যার একটি বিরাট অংশজুড়ে থাকে প্রবীণ জনগোষ্ঠী। সব ব্যক্তিকেই বার্ধক্যের স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। তাই প্রবীণদের অবহেলা না করে তাদের সুরক্ষা এবং অধিকার নিশ্চিতের পাশাপাশি বার্ধক্যের বিষয়ে বিশ্বব্যাপী গণসচেতনতা সৃষ্টিই দিবসটি পালনের মূল উদ্দেশ্য।
২০২০ থেকে ২০৩০ – এই দশকটিকে ‘সুস্বাস্থ্যের বার্ধক্যের দশক’ বলে একটি কর্মসূচি ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। বিভিন্ন জাতীয় স্বাস্থ্য কর্মসূচিতে একই লক্ষ্যে কাজ করা হল এই দশক পালনের মূল লক্ষ্য।
ভারতে প্রবীণ নাগরিকরা মোট জনসংখ্যার বড় শতাংশ জুড়ে রয়েছেন এবং তাঁদের বিভিন্ন কল্যাণমূলক প্রকল্পের জন্য ‘লংগিচিউডিনাল এজিং স্টাডি ইন ইন্ডিয়া’ কর্মসূচির সূচনা হয়েছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘ এ বছরের আন্তর্জাতিক প্রবীণ নাগরিক দিবসের মূল ভাবনা হিসেবে, আমরা কিভাবে বয়স্ক মানুষদের সমস্যাগুলো এবং বার্ধক্যের মোকাবিলা করব, তা নিয়ে কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। সরকার এই সমস্যার সমাধানে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। রাজ্য সরকারগুলোকে প্রবীণ নাগরিকদের জন্য প্রয়োজনে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ওষুধের ব্যবস্থা করার পরিকাঠামো গড়ে তোলার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
বয়স্ক মানুষের সংখ্যা (৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সী হিসাবে সংজ্ঞায়িত) ১৯৮০ সালে প্রায় ২৬০ মিলিয়ন থেকে ২০২১ সালে ৭৬১ মিলিয়নে তিনগুণ বেড়েছে। ২০২১ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে, বয়স্ক জনসংখ্যার বৈশ্বিক অংশ ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে অনুমান করা হয়েছে। প্রায় ১৭ শতাংশ।
বার্ধক্য জনসংখ্যার সমাজে, বিভিন্ন ধরণের কার্যকরী ক্ষমতার অধিকারী বয়স্ক ব্যক্তিদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যার সাথে সামঞ্জস্য করা অপরিহার্য হয়ে ওঠে। অত্যাবশ্যকীয় কাজ সম্পাদন করার এবং দৈনন্দিন ক্রিয়াকলাপে অংশ নেওয়ার ক্ষমতা শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির অন্তর্নিহিত ক্ষমতা দ্বারা প্রভাবিত হয় না। বরং তারা যে সামাজিক এবং শারীরিক পরিবেশে থাকে তার দ্বারাও প্রভাবিত হয়। সহায়ক পরিবেশগুলো বয়স্ক ব্যক্তিদের বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে তাদের কার্যকলাপের মাত্রা এবং স্বাধীনতা বজায় রাখতে সহায়তা করার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এই দিনে, আমাদের সকলের কেবল প্রবীণদের প্রতি উদার হওয়ার শপথ নেওয়া উচিত নয়, প্রবীণদের যত্ন নেওয়ার দায়িত্বও বোঝা উচিত। এই দিবসটি উদযাপনের অন্যতম উদ্দেশ্য হল বয়স্কদের প্রতি বৈষম্য ও অশোভন আচরণ দূর করা। বর্তমান জীবনধারা এবং ছোট পারিবারিক সংস্কৃতিতে বয়স্কদের সুস্থ ও সুখী রাখা আগের চেয়ে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়েছে।
রাষ্ট্রসংঘের জনসংখ্যার সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৫ সাল নাগাদ ভারতে প্রবীণদের জনসংখ্যা ১৫ কোটিতে পৌঁছোবে। এমন পরিস্থিতিতে তাঁদের যত্নের প্রয়োজন হবে আগের চেয়ে বেশি। এই সময়ে তাঁদের যত্ন নেওয়ার জন্য কয়েকটি কথা মাথায় রাখা দরকার।
শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকার ফলে শরীরে বয়সের প্রভাব কমে যায়। বয়স্কদের জন্য কিছু ব্যায়াম করা জরুরি। কারণ এটি হৃদস্পন্দন বাড়ায় এবং সঠিক রক্তপ্রবাহ বজায় রাখতে সাহায্য করে। শারীরিক ক্রিয়াকলাপের ফলে ঘাম হয়, যা শরীর থেকে ক্ষতিকারক পদার্থ বের করে দেয়। এতে যা হয় তা হলো শরীর ভারসাম্য বজায় রাখে এবং মন ভালো চিন্তা করতে সক্ষম হয়। নিয়মিত ব্যায়াম করলে শরীরে ডায়াবিটিস, আলজাইমার এবং ডিমেনশিয়া হওয়ার আশঙ্কাও কমে।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বয়স্কদের ঘুমের সমস্যা দেখা যায়। এই বয়সে ঘুমের অভাবে হার্ট ও মস্তিষ্ক সংক্রান্ত নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই ডাক্তারের পরামর্শেই ঘুমের ওষুধ খান এবং সম্ভব হলে শরীরচর্চা করুন, যোগব্যায়াম করুন, ধ্যান করুন, গান শুনুন, হাঁটাহাঁটি করুন।
একটি ভালো সামাজিক জীবন বয়স্কদের মানসিক, শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উপর ভালো প্রভাব ফেলে। একটি সমীক্ষা অনুসারে, সামাজিক ব্যস্ততা বয়স্কদের ইতিবাচক মেজাজ বজায় রাখে। যেমন, পার্কে বয়স্ক মানুষের দল তৈরি, সমবয়সীদের সঙ্গে তাস খেলা, খবরের কাগজ পড়ার সময় আলোচনা করা। এর সঙ্গে যা হয় তা হল প্রবীণরা নিজেদের সক্রিয় রাখতে অনুপ্রাণিত হয়। যেখানে একাকিত্ব বয়স্কদের স্বাস্থ্যের উপর অনেক প্রভাব ফেলে। অতএব, অবসর নেওয়ার পরেও, আপনার সামাজিক জীবন বজায় রাখুন, যাতে আপনি এটিকে পরেও এগিয়ে নিতে পারেন।
বয়স্কদের গুরুতর রোগের ঝুঁকি কমাতে তাদের সুষম খাদ্য দিতে হবে। তার মানে তাঁদের খাবার যেন খুব বেশি ভারী না হয়, তাতে কম স্যাচুরেটেড ফ্যাট আইটেম (ঘি-তেল-মাখন-বিস্কুট-মাংস) এবং ফাইবার সমৃদ্ধ আইটেমের পরিমাণ বেশি হওয়া উচিত। তাঁদের পরিপাকতন্ত্র যেন সুস্থ থাকে। বয়স্ক ব্যক্তিদের তাজা খাবার খেতে হবে এবং বেশি করে জল ও তরল পান করতে হবে। বয়স্কদের উপযুক্ত পরিমাণে ফল, সবজি এবং গোটা শস্য দিতে হবে।
যদি বাড়িতে বয়স্করা থাকেন, তাহলে তাঁদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত যে কোনও জরুরি অবস্থা মোকাবেলার জন্য একটি পরিকল্পনা করা গুরুত্বপূর্ণ। ঘরে অক্সিমিটার, বিপি মেশিন, সুগার টেস্টিং মেশিন, নেবুলাইজার, থার্মোমিটার ইত্যাদির ব্যবস্থা থাকতে হবে। ডাক্তারদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন, নিয়মিত আপনার রক্তচাপ এবং সুগার পরীক্ষা করাতে থাকুন। জরুরি পরিস্থিতিতে কী করতে হবে তার জন্য প্রস্তুত থাকুন, যাতে সময়মতো সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। সেই সঙ্গে হাজারো কাজের ফাঁকে দশ মিনিট হলেও বাড়ির প্রবীণ মানুষটিকে সময় দিন।
আজ এই আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসে সমস্ত প্রবীণদের প্রণাম। গুরুদেবের কথায়, ‘আজি প্রণমি তোমারে চলিব, নাথ, সংসারকাজে’…।