‘আমিই একমাত্র লোক, যার নামে পাশাপাশি সীতা আর রাম আছেন’

সীতারাম ইয়েচুরি (Photo: IANS/Kuntal Chakrabarty)

২০১৭ সালের ১০ অগস্ট। রাজ্যসভায় সেটাই ছিল সীতারামের শেষ দিন। সিপিএম সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, দু’টি মেয়াদের বেশি কাউকে রাজ্যসভায় মনোনয়ন দেবে না। ২০০৫ থেকে সীতারাম ছিলেন রাজ্যসভায় সাংসদ। দু’বারই নির্বাচিত হয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গ থেকে। ২০১৭ সালে বাংলায় বিরোধী দল ছিল কংগ্রেস। বামেদেরও জনা ৩০ বিধায়ক ছিলেন। কংগ্রেস চেয়েছিল সীতারামকে সংসদের উচ্চকক্ষে পাঠাতে। রাজি হয়নি সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটি।

কারণ, তত দিনে তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক হয়ে গিয়েছেন। দু’হাতের দশটা আঙুল পরস্পর জড়িয়ে। সেই মুঠোর উপর থুতনি রেখে রাজ্যসভায় বসেছিলেন সীতারাম ইয়েচুরি। মুখ গম্ভীর। পরনে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি। পাশে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করছেন সমাজবাদী পার্টির নেতা রামগোপাল যাদব। ছোট বক্তৃতায় রামগোপালের দু’টি অভিব্যক্তি দেখা গিয়েছিল। সীতারামের উদ্দেশে অভিমান-মেশানো ক্ষুণ্ণ গলায় রামগোপাল বলেছিলেন, ‘‘ভারতের সংবিধানও সংশোধন হয়, আর আপনি আপনার পার্টির সংবিধান পাল্টাতে পারছেন না?’’ তার পরেই অভিব্যক্তিতে বদল।

গলার স্বর নামিয়ে সমাজবাদী পার্টির নেতা বলেছিলেন, ‘‘সীতারাম ইয়েচুরি, আপনাকে আমি কখনও ভুলব না। কভি নহি!’’ বলতে বলতে গলা বুজে এসেছিল রামগোপালের। সীতারাম বসেছিলেন থম মেরে। রামগোপালকে ভেঙে পড়তে দেখে রাজ্যসভার চেয়ারম্যান বলেছিলেন, ‘‘আপনি বসুন। নিজেকে সামলান প্লিজ়!’’ রামগোপালকে সামলাতে সরকার পক্ষের বেঞ্চ থেকে ছুটে এসেছিলেন বিজেপির সাংসদ মুখতার আব্বাস নকভি। সে দিন রামগোপালের গলা বুজে আসা, গুলাম নবি আজাদের আক্ষেপই বুঝিয়ে দিয়েছিল, দলের বাইরে সীতারামের ‘গ্রহণযোগ্যতা’ কতটা।


জাতীয় রাজনীতিতে যখন বিপন্ন সিপিএম, সেই বিপন্নতাকে আরও কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়ে চলে গেলেন সীতারাম ইয়েচুরি। যাঁকে বলা হত, দলে হরকিষেণ সিংহ সুরজিৎ ঘরানার শেষ নেতা। যিনি অ-বিজেপি সমস্ত দলের সমস্ত নেতার কাছে ছিলেন গ্রহণযোগ্য। জাতীয় রাজনীতির উঠোনে সেই ভূমিকা নেওয়ার মতো আর কোনও নেতা রইলেন কি সিপিএমে? দলের নেতারাও মানছেন, না। রইলেন না। অ-বিজেপি শিবিরও মানছে, সীতারামের চলে যাওয়া সামগ্রিক ভাবে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির পরিসরে বিরাট ক্ষতি।

ইএমএস নাম্বুদিরিপাদ, বাসব পুন্নাইয়া, পি সুন্দরাইয়ার মতো নেতারা সিপিএমের পলিটব্যুরোয় থাকাকালীনই পরের প্রজন্মের নেতৃত্বকে দলের অন্দরে তুলে আনতে চেয়েছিলেন। তারই ফলস্বরূপ সীতারাম, প্রকাশ কারাট, বাংলার বিমান বসু, অনিল বিশ্বাস, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যদের কেন্দ্রীয় কমিটি এবং পরবর্তী কালে পলিটব্যুরোতেও অন্তর্ভুক্তি। সীতারাম ছিলেন সিপিএমের দ্বিতীয় প্রজন্মের নেতাদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। সিপিএমের গঠনতন্ত্র ‘সময়োপযোগী’ করার ক্ষেত্রেও ভূমিকা নিয়েছিলেন তিনি।

দলীয় পরিসরে সীতারাম ছিলেন এক আড্ডাবাজ নেতা। যাঁর ছোট ছোট কথায় হেসে লুটিয়ে পড়তেন সকলে। বাংলার এক ছাত্রনেতা যেমন বলেন, ‘‘এসএফআইয়ের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য থাকাকালীন এক বার কেরলের রাজ্য সম্মেলনে গিয়েছিলাম। সেই সম্মেলনে অনেক নেতা বলেছিলেন, আগের কমিটি ধার রেখে গিয়েছে। তাই সংগঠনের তহবিল মজবুত করা যায়নি। শুনে সীতারাম বলেছিলেন, উত্তরাধিকার নেবেন আর হাঁপানি নেবেন না, তা তো হতে পারে না!’’

রসিকতা করে বলতেন, ‘‘আমিই একমাত্র লোক, যার নামে পাশাপাশি সীতা আর রাম আছেন।’’ ২০১২ সালে হুগলি জেলায় সিপিএমের একটি কর্মসূচিতে সীতারাম ছিলেন মূল বক্তা। তখন জেলা সম্পাদক ছিলেন প্রাক্তন উচ্চশিক্ষামন্ত্রী সুদর্শন রায়চৌধুরী। শ্রীরামপুর রবীন্দ্র ভবনে সেই বক্তৃতা হয়ে যাওয়ার পরে মঞ্চের পাশেই গোল করে আড্ডার আসর বসেছিল। চায়ে চুমুক দিতে দিতে সীতারাম পাঞ্জাবির পকেট থেকে তাঁর পছন্দের ব্র্যান্ডের সিগারেট বার করেন।

সুদর্শন বলে ওঠেন, ‘‘এ বার এটা ছাড়ো!’’ ঠোঁটে সিগারেট নিয়ে দেশলাই জ্বালিয়ে প্রথম টানের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তেই সীতারামের জবাব ছিল, ‘‘আপনি বুদ্ধদাকে (বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য) কখনও এটা বলেছেন?’’ শরীরের কারণে বুদ্ধদেবকে ধূমপান ছাড়তে হয়েছিল। কিন্তু সীতারাম হাসপাতালে যাওয়ার আগে পর্যন্ত সিগারেট ছাড়েননি। ঘটনাচক্রে, চোখে অস্ত্রোপচারের কারণে বুদ্ধদেবের শেষযাত্রায় থাকতে পারেননি সীতারাম। নিউমোনিয়ার চিকিৎসার জন্য গত ১৯ অগস্ট থেকে এমসে চিকিৎসাধীন ছিলেন সিপিএম সাধারণ সম্পাদক। হাসপাতাল থেকেই বুদ্ধদেবের স্মরণসভার জন্য ভিডিয়োবার্তা পাঠিয়েছিলেন।

হাসপাতাল থেকে আর একেজি ভবনে ফেরা হল না সীতারামের। বরাবরই সীতারাম ছিলেন বাংলার লাইনে চলা নেতা। জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রিত্বের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। পরবর্তী কালে কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতার প্রশ্নেও বাংলার নেতাদের বরাভয় দিয়েছিলেন তিনিই। যে কারণে বাংলার অনেক নেতাই ঘরোয়া আলোচনায় সীতারামকে ‘বঙ্গবন্ধু’ বলে সম্বোধন করতেন। পার্টি লাইন ভেঙে ২০১৬ সালে বাংলার সিপিএম যে কায়দায় কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতা করেছিল, তা নিয়ে দলে ঝড় বয়ে গিয়েছিল।

একার হাতে তা সামাল দিয়েছিলেন সীতারাম। হয়তো সেই ঝড়ের আভাস পেয়েই ২০১৬ সালে সিঙ্গুরের একটি সভায় মঞ্চে যতক্ষণ অধীর চৌধুরী ছিলেন, ততক্ষণ অদূরে একটি চায়ের দোকানে বসেছিলেন সীতারাম। অধীর মঞ্চ ছাড়ার পরেই তিনি মঞ্চে উঠেছিলেন। তা নিয়েও কম আলোচনা হয়নি। দলের হয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রকের সঙ্গে সমন্বয় রাখা, বিদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাম ও সমাজতান্ত্রিক দলগুলির সঙ্গে যোগাযোগ রাখার দায়িত্ব দীর্ঘ দিন ধরেই পালন করতেন সীতারাম। তাঁর মৃত্যুর পরে সেই কাজেও দলের ক্ষতি হল বলে মনে করছেন সিপিএম নেতৃত্ব।

সীতারামের জমানাতেই বাংলায় সিপিএম শূন্যে পরিণত হয়েছে, ত্রিপুরায় গদিচ্যুত হয়েছে। আবার তাঁর সময়েই কেরলে রেকর্ড ভেঙে পর পর দু’বার সরকার গড়েছে সিপিএম নেতৃত্বাধীন বাম-গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট। ইউপিএ-১ সরকারের সময়ে অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচির খসড়া রূপায়ণের কাজ যৌথ ভাবে করেছিলেন কংগ্রেসের পি চিদম্বরম এবং সিপিএমের সীতারাম। ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে বিজেপি-বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র শুরুর দিকেও সীতারাম নানা ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন।

সংসদীয় রাজনীতিকে কৌশলে ব্যবহার করতে চাইতেন সীতারাম। যা নিয়ে দলে তাঁর বিরোধিতাও হয়েছে বার বার। বেশ কয়েক বছর হল সিপিএমে বিভিন্ন স্তরে সম্পাদক থাকার ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের’ বিলোপ ঘটানো হয়েছে। দলের গঠনতন্ত্রে সংশোধন এনে সিপিএম স্থির করেছে, কোনও স্তরে কোনও একজন ব্যক্তি তিনটি মেয়াদের বেশি সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। দলের সাধারণ সম্পাদক পদে সীতারামের তিনটি মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার কথা ছিল আগামী এপ্রিলে।

মাদুরাইয়ে অনুষ্ঠিতব্য দলের পার্টি কংগ্রেসের আগে গত কয়েক মাস ধরেই আলোচনা হচ্ছিল, সীতারামের পরে কে? দিল্লির নেতারা ঘরোয়া আলোচনায় জানাচ্ছিলেন, গঠনতন্ত্র মেনে নবনির্বাচিত কেন্দ্রীয় কমিটির তিন-চতুর্থাংশের সমর্থন নিয়ে সীতারামকেই ফিরিয়ে আনা যায় কি না, তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা চলছে। এমনকি, কারাটও রাজি ছিলেন। কিন্তু সে সব করার আর সুযোগই রাখলেন না সীতারাম।জাতীয় স্তরে সকলকে সঙ্গে নিয়ে চলার মতো আর কোনও নেতা রইলেন কি দলে? সীতারামের মৃত্যুতে আপাতত এই প্রশ্নের গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খাচ্ছে সিপিএম।

১৯৫২ সালের ১২ অগস্ট সীতারামের জন্ম হয় চেন্নাইয়ের (তৎকালীন মাদ্রাজ) তেলুগুভাষী পরিবারে। বাবা সর্বেশ্বরা ইয়েচুরি পেশায় ছিলেন অন্ধ্রের রাজ্য পরিবহণ সংস্থার ইঞ্জিনিয়র। মা-ও ছিলেন অন্ধ্রের পদস্থ সরকারি কর্মচারী। সীতারামের স্কুলের পড়াশোনা শুরু হায়দরাবাদের অল সেন্ট হাইস্কুলে। ১৯৬৯ সালে তেলঙ্গানা আন্দোলনে যখন উত্তাল অন্ধ্র, সেই সময়ে সীতারামকে দিল্লিতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন বাবা-মা। ভর্তি হন দিল্লির প্রেসিডেন্ট এস্টেট স্কুলে। সেখান থেকেই সিবিএসই দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষায় সারা দেশের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন তিনি।

স্কুলের পরীক্ষায় দেশের সেই ফার্স্ট বয় পরবর্তী কালে তাঁর দল সিপিএমের ‘ফার্স্ট বয়’ হয়ে ওঠেন। স্কুলের পড়াশোনা শেষের পর সীতারাম অর্থনীতি নিয়ে ভর্তি হন সেন্ট স্টিফেন্স কলেজে। তার পর স্নাতকোত্তরের জন্য ভর্তি হন দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় (জেএনইউ)-এ। জেএনইউয়ে পড়ার সময়েই সিপিএমের ছাত্র সংগঠন এসএফআইয়ে যোগ দেন তিনি। ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সভাপতিও। ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থার সময়ে সীতারাম জেএনইউয়ের পড়ুয়া। সেই সময়ে জেলেও যেতে হয়েছিল তাঁকে। বেশ কিছু দিন আত্মগোপনও করতে হয় তাঁকে। সেই সময়েই ছাত্র আন্দোলনে উত্তাল হয়েছিল জেএনইউ।

জরুরি অবস্থার পরেও জেএনইউ ছাত্র আন্দোলনে সরগরম থেকেছে। সীতারামের নেতৃত্বে ছাত্রেরা দাবি তুলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী তথা আচার্য ইন্দিরা গান্ধীকে স্মারকলিপি গ্রহণ করতে হবে। সেই দাবি মেনে ইন্দিরা তাঁর বাসভবনে ডেকেছিলেন ছাত্রনেতাদের। সেখানে গিয়ে ইন্দিরাকে সেখানে দাঁড় করিয়ে স্মারকলিপি পাঠ করেছিলেন সীতারাম। নরেন্দ্র মোদী জমানায় যখন বারংবার জেএনইউ ছাত্র আন্দোলনে উত্তাল হয়েছে, তখন একাধিক বার সীতারাম উল্লেখ করতেন ইন্দিরা কীভাবে সে দিন পড়ুয়াদের ডেকে নিয়েছিলেন।

সীতারাম ছিলেন সিপিএমে ‘নরমপন্থী’ লাইনের নেতা। অর্থাৎ প্রকাশ কারাটদের উল্টো দিকে। কংগ্রেসের সঙ্গে সমন্বয় রেখে চলার পক্ষপাতী ছিলেন সীতারাম। দ্বিতীয় ইউপিএ সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের বিরোধী ছিলেন তিনি। একইভাবে দলের মধ্যে তিনি বিরোধিতা করেছিলেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্তেরও। দিল্লির রাজনীতিতে কথিত, কারাটেরা যখন মনমোহন সিংহ সরকারের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের বিষয়ে একরোখা হয়ে গিয়েছিলেন, তখন অধুনাপ্রয়াত প্রণব মুখোপাধ্যায় সীতারামকে ডেকে বুঝিয়ে বলেছিলেন, ওই ঘটনা ঘটলে বাংলায় সিপিএমের ‘বিপদ’ হবে। এটা যেন তিনি কারাটকে বোঝান।

সীতারাম অনেক চেষ্টাতেও তা পারেননি। অপারগতার কথা জানিয়েও দিয়েছিলেন প্রণবকে। সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পরে সীতারাম চেষ্টা করেছিলেন সোমনাথকে দলে ফেরাতে। এক বার শ্যামল চক্রবর্তীকে নিয়ে সোমনাথের শান্তিনিকেতনের বাড়িতেও গিয়েছিলেন সেই প্রস্তাব দিতে। সীতারামদের পোস্তর বড়া, আমোদী মাছ ইত্যাদি খাইয়ে সোমনাথ সেই প্রস্তাব বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। মাতৃভাষা তেলুগু হলেও সীতারাম মোট আটটি ভাষা জানতেন। সেই তালিকায় হিন্দি, ইংরেজির সঙ্গে রয়েছে তামিল, মালয়ালমও। বলতে পারতেন বাংলাও।