মানব শিকার আধুনিক পৃথিবীর নতুন দাস ব্যবসা

মহম্মদ শাহাবুদ্ধিন

এখনও চলেছে দাস ব্যবসা। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার মতে প্রায় সাড়ে চার কোটি মানুষ এখন এই দাসত্বের শিকার। গরিব দেশগুলি থেকে স্বচ্ছলতার স্বপ্নে হাজার হাজার ছেলে মেয়ে জড়িয়ে পড়ছে মানব পাচার চক্রের জালে। জীবন বাঁধা পড়ছে শ্রম দাসত্বের মধ্যে। আগের মতো এখন আফ্রিকা থেকে মানুষ বোঝাই জাহাজ আটলান্টিকে ভাসে না, কিন্তু রাতের অন্ধকারে সাগরের ঢেউ ভেঙে সস্তার শ্রমিকে বোঝাই নৌকা ভেসে যায়। ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ইতালীর বন্দরে, লোহিত সাগর ধরে আরব উপকূলে। মানুষ ভরা নৌকা ভাসে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার এক দ্বীপ থেকে আর এক দ্বীপে। নতুন শতকে পৃথিবীর নানা ঘাটে মাথা চাড়া দিয়েছে মানুষের শ্রমবাজার। মানব বাণিজ্যের এ এক নতুন চেহারা। লুকিয়ে চলছে তারুণ্যে ভরা মানব পণ্যের পাইকারী হাট। মানব শিকারের পিছনে আছে বিভিন্ন দেশের দালাল চক্র। প্রলোভন দেখিয়ে ভিসা দিয়ে অন্য দেশে নিয়ে যাওয়া হয়। ভিসা পাওয়া দেশ থেকে গোপনে অন্যদেশে পাঠানোর পর শুরু হয় পাচারের আর এক পর্ব। ভিসা কথনও হয় ভ্রমণ ভিসা, কখনও ওয়ার্কিং ভিসা। মেয়াদ উত্তীর্ণ ভিসা নিয়ে আবৈধ ভাবে অন্য দেশে যেতে বাধ্য করা হয়। ভিসা পাওয়া দেশ থেকে অন্য দেশে পাঠানোর পর শুরু হয় ব্লাক মেইলিং। ফোনের পরিবারের কান্নার আকুতি শুনিয়ে চেষ্টা করা হয় মনোবল নষ্ট করার। শুরু হয় নতুন বন্দি দশা। দাসত্বের বন্দি জীবন থেকে ঋণবন্দি জীবন। বিপন্ন হয়ে পড়ে তাদের অস্তিত্ব।

মানবপাচারের মূল সংগঠকরা বিভিন্ন রাষ্ট্র থেকে তাদের এই অমানবিক ব্যবসা চালায়। শ্রমিকদের পাঠানো হয় বিভিন্ন রুটের বিমান পথে। ইয়োরোপীয় দেশগুলিতে নিয়ে যেতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় উত্তর আফ্রিকা ও পারস্য উপসাগরের দেশগুলি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উপসাগর পেরিয়ে যেতে হয় অন্য দেশে। নৌযানগুলি বোট অথবা বড় নৌকার। ভিড়ে ঠাসা এইসব যান মৃত্যুর তরণী হয়ে দাঁড়ায়। কখনও নৌকো উল্টে সাগরে তলিয়ে যায়। হারিয়ে যায় দেশে রেখে আসা সন্তানদের ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্ন। ২০১৯ এর ১৯ মের ঘটনা আমাদের অনেকেরই মনে আছে। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে ৮০ জন তাজা প্রাণের সলিল সমাধি হয়েছিল। লিবিয়া থেকে তারা চলেছিল ইতালীর ভূখণ্ডে।


আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থা ও ওয়ার্ক ফ্রি ফাউন্ডেশনের মতে পাচার হওয়া নারী ও কিশোরের সংখ্যা ৫০ শতাংশেরও বেশি। অনেক সময় বিদেশের বদলে স্বদেশের কোথাও তাদের চালান করা হয়। গোয়া, মুম্বই, গুজরাটের উপকূল এলাকার কাজে লাগানো হয় মাদক পাচারে। অনেক মেয়ের ঠিকানা হয় যৌনপল্লীতে। শ্রম সংস্থার রিপোর্টে জানা যায় বিশ্বজুড়ে মানব শিকারের ফাঁদ পেতে শিকারীরা বছরে আয় করে ১৬০ বিলিয়নেরও বেশি ডলার। এর মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি ডলার আসে নারী পাচার ও যৌনপেশায় ঠেলে দেওয়ার মাধ্যমে। জীবিকার প্রয়োজনে মানুষ শিকারের ফাঁদে পা দিয়ে বিদেশে তারা পাচ্ছেন নিম্নমানের কাজ। আরব দেশগুলিতে বেশির ভাগ কাজ পশুপালন, উট চালানো কিংবা খেজুর বাগান তদারকীর। কখনও তাদের ঠেলে দেওয়া হচ্ছে পাথর কাটা নয়তো গাড়িতে বালি বোঝাইয়ের কাজে।

আমাদের উপমহাদেশের প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে গিয়ে কাজে লাগানো হচ্ছে ভিক্ষাবৃত্তিতে। তাদের ভিসা পাসপোর্ট আটকে রেখে বন্দি জীবনের মতো করে রাখা হয় বন্ডেড লেবারের বেড়াজালে। শ্রম কারাগারের অন্ধকার থেকে তারা পালাবারও চেষ্টা করে কিন্তু পথ পায় না। তখন কপালে জোটে অকথ্য অত্যাচার। পুরানো ঘটনা লক্ষ্য করলে গা শিউরে উঠবে। ২০১৫ সালে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে পাওয়া গিয়েছিল বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গাদের গমকবর। এই ঘটনা গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়ে উঠেছিল। মালয়েশিয়ার শঙ্খলা প্রদেশের সাদাও অঞ্চলেও খোঁজ মিলেছিল মানব পাচারের ফাঁদে পড়া মানুষের কঙ্কাল।

মানব শিকারের ব্যবসায় আন্তর্জাতিক দালালচক্র যেমন ফুলে ফেঁপে উঠছে। তেমন দেশীয় দালালরা তাদের ছত্রছায়ায় অঢেল টাকা রোজগার করে চলেছে সেই সাথে নিজের দেশের স্বপ্ন দেখা তরুণ মুখগুলিকে ঠেলে দিচ্ছে প্রতারণার অন্ধকারে।
মানববানিজ্য এখন নতুন ক্রীতদাস ব্যবসা। এই ব্যবসার জাল ছড়িয়ে যাচ্ছে দেশের অভ্যন্তরে, সেখান থেকে তারা জড়িয়ে পড়ছে মানব শিকারের বড় আন্তর্জাতিক ফাঁদে। অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি সমুদ্র শান্ত থাকার সময় চলে অবৈধ গণপাচারের জোয়ার। আমাদের উপমহাদেশ, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলিতে এখনও গড়িয়ে চলেছে মানব শোষণের এই চাকা। মানব শিকারের মৃগয়া ক্ষেত্র ছড়িয়ে আছে ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান, ইরাক, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার পরিসংখ্যানের বাইরে মানব পাচারের শিকারে আসা মানুষের সংখ্যা সঠিকভাবে জানা যায় না। করোনা সংকটের পরে বিশ্বের চার কোটি সত্তর লক্ষের বেশি মানুষ এই শিকারের জালে জড়িয়ে আছে। এর বেশির ভাগটাই আমাদের উপমহাদেশের মানুষ। ‘অস্ট্রেলিয়ান ওয়াকফ্রি ফাউন্ডেশন’ জানাচ্ছে এখন বিশ্বে প্রায় ৪৭ মিলিয়ন মানুষকে বাধ্যতামূলক শ্রমিক,