• facebook
  • twitter
Tuesday, 25 March, 2025

অরণ্যের সঙ্গে মানুষের সংঘাত, আদপে ক্ষতি হচ্ছে মানুষেরই

ভারতের মতো দেশে সমস্যা হল, অরণ্যের নিকটবর্তী এলাকায় যাঁরা থাকেন, তাঁরা অনেক সময়েই বঞ্চনার শিকার হন। আবার তাঁদের অরণ্যের উপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় থাকে না।

ফাইল চিত্র

হীরক কর

মোগলির কথা কে না জানি। জঙ্গলের মাঝে জন্তু-জানোয়ারদের মধ্যে মানুষ হওয়া এক মানব শিশু। ছেলেবেলায় মোগলির কাজ কারবার টিভির পর্দায় দেখতে সকলের ভালো লাগত। কিন্তু বাস্তবে আর মোগলি নেই। কারণ মানুষ কবেই প্রকৃতিকে শাসন করতে করতে অরণ্যকে বশ করে ফেলেছে। তাই পরের সুনামি যদি পৃথিবীর কোথাও হয়, অরণ্য স্রেফ মাথা নিচু করে ভবিতব্য মেনে নেবে। না হলে গানের কলিটাই হয় তো বদলে গিয়ে হবে, ‘রোদন ভরা এ অরণ্য’!
রুডইয়ার্ড কিপলিং আর বুদ্ধদেব গুহের মাধ্যমেই আমাদের অনেকেরই প্রথম জঙ্গলের সঙ্গে পরিচয়। ১৯৭১ সালে, ইউরোপীয় কৃষি কনফেডারেশনের ২৩তম সাধারণ অধিবেশনে ‘বিশ্ব বন দিবস’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। রাষ্ট্রসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা প্রতি বছর ২১ মার্চ দিবসটি উদযাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। গাছের গুরুত্ব সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা তৈরির জন্য এই অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।

২০১২ সালে, ২৮ নভেম্বর, আন্তর্জাতিক বন দিবস প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ২১ মার্চ এটি উদযাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরবর্তীতে, রাস্ট্রসংঘের সাধারণ পরিষদ দুটি আন্তর্জাতিক স্মারক, অর্থাৎ বিশ্ব বন দিবস এবং আন্তর্জাতিক বন দিবসকে একত্রিত করে প্রতি বছর ২১ মার্চ উদযাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। বন, গাছ এবং উদ্ভিদের মূল্য বোঝা প্রয়োজন। কারণ এগুলো কাঁচামাল সরবরাহ করে, স্থানীয় কর্মসংস্থান প্রদান করে আয়ের উৎস তৈরি করে। ২০২৫ সালের থিম: ‘বন এবং খাদ্য’ মানুষের বেঁচে থাকা এবং পরিবেশগত ভারসাম্যের জন্য বন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ অরণ্য অক্সিজেন সরবরাহ করে, কার্বন সঞ্চয় করে এবং জীববৈচিত্র্যকে সমর্থন করে। এর উদ্দেশ্য, খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি, জীবিকা এবং জলবায়ু কর্মকাণ্ডে বনের ভূমিকা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।

১৮৯৪ সালে প্রকাশিত হয়েছিল রুডইয়ার্ড কিপলিং-এর ‘দি জাঙ্গল বুক’ বইটি। আর সেই গল্প সংগ্রহের মধ্যে থাকা মোগলি চরিত্রটি অবাক করেছিল সারা পৃথিবীর মানুষকেই। জঙ্গলে একদল পশুপাখির ছত্রছায়ায় মানুষ হয়েছে সেই ছেলেটি। আর এই বই প্রকাশিত হওয়ার ঠিক পরের বছরেই ঘটে যায় একটি মৃত্যু। মৃতের নাম দিনা সানিচার।
আপাতদৃষ্টিতে এই দুই ঘটনার কোনো যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু এখন যদি বলি, এই দিনা সানিচার আসলে লেখকের মোগলি চরিত্রটির অনুপ্রেরণা? হ্যাঁ, বেশিরভাগ গবেষক অন্তত তেমনটাই মনে করেন। সালটা ১৮৬৭।

উত্তরপ্রদেশের বুলন্দশহর জেলার একটি জঙ্গলে অদ্ভুত জানোয়ারের সন্ধান পান গ্রামবাসীরা। আর তার পিছনে ধাওয়া করেই পৌঁছে যান একটি গুহার কাছে। কিন্তু ধোঁয়ার সাহায্যে সেই গুহা থেকে যখন প্রাণীটিকে বের করে আনা হল, তখন অবাক হলেন প্রত্যেকেই। কারণ প্রাণীটা অন্য কিছু নয়, একটি মানুষ। বছর ছয়েকের একটি বালক। অথচ সভ্য জীবনের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগই নেই। ছোট থেকেই সে মানুষ হয়েছে এই জঙ্গলে একদল নেকড়ের মধ্যে।

ছেলেটিকে যখন গ্রামবাসীরা ধরতে এসেছিল, তখন স্বাভাবিকভাবেই বাধা দিয়েছিল সেই নেকড়ের দল। কিন্তু তাদের প্রত্যেককেই হত্যা করে ছেলেটিকে নিয়ে আসেন গ্রামবাসীরা। তারপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় আগ্রার সিকান্দ্রা মিশনের একটি অনাথ আশ্রমে। সেখানেই তাঁর নাম রাখা হয় সানিচার। উর্দু ভাষায় যার অর্থ শনিবার। কারণ এই দিনেই তাকে আশ্রমে নিয়ে আসা হয়েছিল।

এরপর সেই অনাথ আশ্রমই হয়ে ওঠে তার বাসস্থান। কিন্তু সেখানেও কারোর সঙ্গে মেলামেশা করত না সেই ছেলেটি। কেবল একটি বন্ধু ছিল। তাকেও এক জঙ্গল থেকেই উদ্ধার করে আনা হয়েছিল। কিন্তু সেই ছেলেটি স্বাভাবিক জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছিল। মানাতে পারেনি দিনা। তাকে মানুষের ভাষা শেখানো যায়নি। এমনকি মৃত্যুর দিন পর্যন্ত কাঁচা মাংস খেতেই আগ্রহ দেখা গিয়েছিল। সেইসঙ্গে মাংসের হাড় ঘষে দাঁতে শান দিত সে। পোশাক পরাতেও বেশ বেগ পেতে হত। দীর্ঘ ২৮ বছরের চেষ্টাতেও স্বাভাবিক জীবনে ফেরানো যায়নি দিনাকে।

এই পৃথিবীতে অবশ্য এমন ঘটনার কথা অনেকগুলো জানা যায়। অনেকেই ছোটোবেলায় পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বড় হয়েছেন জঙ্গলের মধ্যে। ইংরেজিতে তাঁদের বলা হয় ‘ফেরাল চাইল্ড’। বাংলায় কী বলা যায়? ‘বুনো শিশু’? অবশ্য উত্তরপ্রদেশের সেই বালকের সঙ্গে মোগলি চরিত্রটির কোনো প্রত্যক্ষ যোগাযোগের কথা অবশ্য লেখক রুডইয়ার্ড কিপলিং কোথাও উল্লেখ করেননি। কিন্তু যে লেখকের জন্ম এই দেশে, জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন এখানে জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে, তাঁর গল্পের অনুপ্রেরণা তো এদেশেই লুকিয়ে থাকবে। তাই গবেষকরাও মনে করেন দিনা সানিচারের কথা জানতে পেরেই এই চরিত্রটিকে গড়ে তোলেন লেখক। আর দিনা নিজে সভ্য জীবনে ফিরে আসতে না পারলেও সভ্য মানুষ আপন করে নিয়েছে সেই বন্য শিশুকে। অবশ্য সেটা তো গল্পের চরিত্র। বাস্তবের মোগলি কি আদৌ যথেষ্ট সাহায্য পেয়েছিল এই সমাজ থেকে?

ফলে শুধুমাত্র বন্যপ্রাণীদের জন্য নয়, মানুষের জন্যও অরণ্য রক্ষা করা প্রয়োজন। রাষ্ট্রসঙ্ঘের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, বনাঞ্চল ঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে তবেই জলবায়ু পরিবর্তনকে রুখে দেওয়া যেতে পারে। সাম্প্রতিক ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্যও এটি জরুরি। দিন দিন বেড়েই চলেছে পৃথিবীর উষ্ণতা। একই সঙ্গে বেড়ে চলেছে গাছ কাটার প্রবণতা। এদিকে গাছ যত কমবে ততই বাড়বে গ্রিন হাউস গ্যাস। মানুষের বসবাসের অযোগ্য হবে পৃথিবী। সে কথা মনে করিয়ে দিতেই পালন করা হয় এই বিশেষ দিনটি। বনাঞ্চলকে পৃথিবীর ফুসফুস বললেও ভুল বলা হয় না। বনাঞ্চল বাতাসের দূষিত কণাকে অধঃক্ষিপ্ত করে। জলকে পরিষ্কার রাখে। আর শ্বাসবায়ুকে বিশুদ্ধ করে দেয়।

রাষ্ট্রসঙ্ঘের তথ্য অনুযায়ী, একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও ১.৬ বিলিয়নেরও বেশি মানুষ সরাসরি অরণ্য থেকে নিজেদের জীবিকার রসদ জোগাড় করে বেঁচে থাকেন। খাবার, ওষুধ, আশ্রয়, অর্থ উপার্জন এই সব বনাঞ্চল থেকেই তাঁরা পান। বড় বড় বন ধ্বংস করার ফলে তাঁদেরও প্রভূত ক্ষতি হচ্ছে। এছাড়াও পরোক্ষভাবে বিপদে পড়ছে সারা পৃথিবীর জলবায়ু ও প্রাণীজগত।

পৃথিবীতে গড়ে প্রতি বছর ০.৯ শতাংশ ক্রান্তীয় বনভূমি অবলুপ্ত হচ্ছে। গত শতাব্দীর মধ্যভাগের পর থেকে ৫০ শতাংশের বেশি ক্রান্তীয় অরণ্য ধ্বংস হয়েছে। কৃত্রিম উপগ্রহ মারফত অপসৃয়মাণ অরণ্যের যে ছবি পাওয়া গেছে, তা বিশ্লেষণ করে বলা হয়, পৃথিবীতে প্রতি বছর ১.৭ থেকে দু’ কোটি হেক্টর অরণ্য অদৃশ্য হচ্ছে। আরও সহজ করে বলা যেতে পারে, প্রতি মিনিটে চারটি ফুটবল মাঠের আয়তনের সমান অরণ্য পৃথিবী থেকে চিরতরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।

ভারতসহ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার মতো অঞ্চলে বনাঞ্চল জনসংখ্যার চাপে দ্রুত সঙ্কুচিত হচ্ছে। অরণ্যের এই ক্রমবর্ধমান অবক্ষয় রোধের জন্য ভারতব্যাপী বেশ কিছু সামাজিক বনসৃজন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। অরণ্যের ব্যাপক অবক্ষয়ের ফলে পৃথিবীতে বিশাল সংখ্যক উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতির জীবন আজ বিপন্ন, তাদের সংখ্যা দ্রুত কমে যাচ্ছে, তারা অবলুপ্তির পথে চলেছে। প্রাণীদের মধ্যে পাখি, স্তন্যপায়ী, সরীসৃপ ও উভচর প্রাণীদের জীবন বেশি বিপন্ন অন্যান্য পর্বের প্রাণীদের থেকে। পৃথিবীতে অতি দুর্গম পার্বত্য অঞ্চল, সমুদ্রবেষ্টিত দ্বীপ অথবা শীতল তুন্দ্রা অঞ্চলে এমন কিছু বিরল প্রজাতির উদ্ভিদ ও প্রাণী বাস করে, পৃথিবীর অন্য কোথাও যাদের দেখা পাওয়া যায় না, এদের ‘এন্ডেমিক’ জীব বলে। যেমন, হিমালয়ের তুষার চিতা, ব্রহ্মকমল, নীল অর্কিড, তুন্দ্রা অঞ্চলে ভালুক (পোলার বিয়ার) বা গ্যালাপাগোস দ্বীপের উভচর সরীসৃপ ইগুয়ানা। ভারতের আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে এমন অনেক প্রজাতির এন্ডেমিক উদ্ভিদ ও প্রাণী আছে। এদের বাস্তুতন্ত্র আজ বিপন্ন, নিজেদের বাসভূমি থেকে এরা উত্খাত হলে পৃথিবী থেকে এরা সম্পূর্ণ অবলুপ্ত হয়ে যাবে। এই সংকটের বিষয়ে সাধারণ মানুষের সচেতনতা বাড়াতেই আজ ২১ মার্চ বিশ্ব অরণ্য দিবস পালন করা হয়।

স্বাধীনতার পর থেকে ভারতের জনসংখ্যা তিনগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেলেও, এর এক-পঞ্চমাংশ ভূমি ধারাবাহিকভাবে বন দ্বারা আচ্ছাদিত। দ্বিবার্ষিক বন প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ভারতের বনভূমি ৩,৫৭৬ বর্গ কিলোমিটার বা ০.৫৬% বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৭ সাল থেকে, প্রতিবেদনে ঘন বনাঞ্চলে (৭০% এর বেশি ছাউনি ঘনত্ব সহ ব্যতিক্রমী ঘন বন এবং ৪০-৭০% এর মধ্যে পুরুত্ব সহ মাঝারি ঘন বন) ১,২৭৫ বর্গ কিলোমিটার বৃদ্ধি রেকর্ড করা হয়েছে। ভারতের মোট বন ও বৃক্ষরোপণ ছিল ৮০.৯ মিলিয়ন হেক্টর, যা দেশের ভৌগোলিক এলাকার ২৪.৬২%। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে ১৭টি রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ৩৩% এরও বেশি এলাকা বনভূমির আওতায় রয়েছে। মধ্যপ্রদেশে সবচেয়ে বেশি বনভূমি ছিল, তারপরে অরুণাচল প্রদেশ, ছত্তিশগড়, ওড়িশা এবং মহারাষ্ট্র।

মোট ভৌগোলিক এলাকার শতকরা হিসাবে বনভূমির দিক থেকে শীর্ষ পাঁচটি রাজ্য হল মিজোরাম (৮৪.৫৩%), অরুণাচল প্রদেশ (৭৯.৩৩%), মেঘালয় (৭৬%), মণিপুর (৭৪.৩৪%) এবং নাগাল্যান্ড (৭৩.৯০%)।  পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ ভূমি বন দ্বারা আচ্ছাদিত, যা জলবিদ্যুৎ চক্র বজায় রাখতে, জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ করতে এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

পশ্চিমঘাট পর্বতমালার বন দক্ষিণের রাজ্যগুলোর জলচক্র নিয়ন্ত্রণ করতে এবং মাটির ক্ষয় থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। ভারত বিভিন্ন ধরণের উদ্ভিদ এবং প্রাণর আবাসস্থল, যার মধ্যে অনেকগুলো কেবল দেশের বনাঞ্চলে পাওয়া যায়।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বঙ্গোপসাগরের সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্য, রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল।
দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য বনও গুরুত্বপূর্ণ। অরণ্য ৮৬ মিলিয়নেরও বেশি পরিবেশবান্ধব কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেয়। পৃথিবীর প্রত্যেকেরই বনের সাথে কোনো না কোনো যোগাযোগ রয়েছে। অরণ্যগুলো উপজাতি সম্প্রদায়েরও আবাসস্থল। পরিবেশগত ও অর্থনৈতিকভাবে এগুলো বন পরিবেশের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। উদাহরণ হিসেবে, মধ্যপ্রদেশের গোণ্ড উপজাতি এবং পশ্চিমবঙ্গের শবরদের কথা উঠে আসে।

অরণ্য বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহ করে, যেমন রেশম পোকা পালন, খেলনা তৈরি, পাতার প্লেট তৈরি, প্লাইউড, কাগজ এবং পাল্প ইত্যাদি। অরণ্য প্রধান এবং গৌণ বনজ পণ্যও সরবরাহ করে। সরবরাহ করে বাঁশ, মশলা, ভোজ্য ফল এবং শাকসবজির মতো গৌণ পণ্য।

ভারতের জাতীয় বননীতি অনুসারে, পরিবেশগত স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য বনভূমির আদর্শ শতাংশ কমপক্ষে ৩৩% হওয়া উচিত। তবে, বর্তমানে এটি দেশের মাত্র ২৪.৬২% ভূমি জুড়ে রয়েছে এবং দ্রুত সংকুচিত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট বনের বিপর্যয়, যার মধ্যে রয়েছে পোকামাকড়ের প্রাদুর্ভাব, জলবায়ু-চালিত অভিবাসনের কারণে আক্রমণাত্মক প্রজাতি, দাবানল এবং ঝড়, বনের উৎপাদনশীলতা হ্রাস করে এবং প্রজাতির বন্টন পরিবর্তন করে। ২০৩০ সালের মধ্যে, ভারতের ৪৫-৬৪% বন জলবায়ু পরিবর্তন এবং ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রার প্রভাব অনুভব করবে। স্থানীয় সম্প্রদায়ের স্বার্থ এবং বাণিজ্যিক স্বার্থের মধ্যে প্রায়শই দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। যেমন ওষুধ শিল্প বা কাঠ শিল্প।

বন সংরক্ষণে বন সুরক্ষা এবং ফলপ্রসূ ব্যবস্থাপনার সমস্ত উপাদান অন্তর্ভুক্ত করা উচিত যেমন, বন-আগুন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, সময়োপযোগী জরিপ, উপজাতি-নিবেদিত নীতি, মানুষ-প্রাণী দ্বন্দ্ব হ্রাস এবং স্থায়ী বন্যপ্রাণী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। বন্যপ্রাণীদের নিরাপদ আন্তঃরাজ্য এবং আন্তঃরাষ্ট্র যাতায়াতের পথ খোলা রাখা। যে কোনো বহিরাগত প্রভাব থেকে তাদের আবাসস্থলকে রক্ষা করার জন্য নিবেদিতপ্রাণ বন করিডর রক্ষণাবেক্ষণ করা যেতে পার, যা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের বার্তা দেয়। অনাবিষ্কৃত বনাঞ্চলে সম্ভাব্য রিসোর্স ম্যাপিং করা যেতে পারে এবং ঘনত্ব এবং বনের স্বাস্থ্য বজায় রেখে বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা এবং স্থায়ী রিসোর্স আহরণের আওতায় আনা যেতে পারে।

মানবজীবনের সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত অরণ্য। অবণ্য যে শুধু যে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের যোগান দেয় তা নয়, অরণ্যের ওপর নির্ভর করে প্রচুর জীবিকা। অসংখ্য পরিবারের জীবিকা নির্ভর করে অরণ্যের ওপর নির্ভর করে। তাই অরণ্য ধ্বংস করা উচিত নয়। তেমনই আমাদের সুস্বাস্থ্য নির্ভর করে অরণ্যের ওপর। গাছ বায়ুদূষণ দূর করে। এর শুভ প্রভাব পড়ে শরীরে। তাই সুস্থ জীবনযাপন করতেও পালন করুন ‘অরণ্য দিবস’।

অরণ্য রক্ষা করতে আপনিও বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে পারেন। যেমন সবার আগে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃক্ষচ্ছেদন রোধ করুন। বনভূমি ধ্বংস করা আটকাতে বন্ধ করতে হবে বৃক্ষচ্ছেদন। অপরিণত বৃক্ষচ্ছেদন বন্ধের দিকে জোর দিতে হবে। গাছ কাটার প্রয়োজন হলে কেবল পরিণত গাছ কাটাই উচিত। অপরিণত গাছ কাটা উচিত নয়। এই দিকে সকলের নজর দেওয়া প্রয়োজন।

দাবানল প্রতিরোধ করতে হবে। যাতে বনভূমিতে দাবানল না লাগে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। পুরুলিয়ার গ্রামগুলোতে এই গরমে দাবানল নিত্য ঘটনা। এর বড় কারণ এই অঞ্চলের আদিবাসীরা শুকনো পাতা, শুকনো ডাল জড়ো করে আগুন লাগিয়ে দেওয়া। সেই আগুন ছড়িয়ে পরে অরণ্যে। প্রাণসংশয় ঘটে বন্যপ্রাণীদের।

অরণ্য রক্ষা করতে পশুচারণের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। পশুচারণ নিয়ন্ত্রণ না করলে তারা অপরিণত গাছ নষ্ট করে দেয়। এতে অজান্তে আমাদেরই ক্ষতি হচ্ছে। তাই আজ এই বিশেষ দিনে প্রচার ঘটান এমন বিষয়ের। অনেক জায়গায় জ্বালানি কাঠের পরিবর্তে বিকল্প জ্বালানি ব্যবহারে জোর দিতে হবে। অনেক জায়গায় এখন গাছ কেটে ডাল জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কাঠের পরিবর্তে প্রাকৃতিক গ্যাস, জৈব গ্যাস, সৌর শক্তি ব্যবহারে জোর দেওয়া প্রয়োজন। এতে মিলবে উপকার। তেমন বৃক্ষরোপণ করুন। যে সব স্থানে গাছ নেই সেখানে গাছ লাগান। মানুষ সব সময় নিজের স্বার্থে অরণ্য ছেদ করে চলেছে। সেই কাজ বন্ধ করতে হবে। তাই অরণ্য দিবসে বৃক্ষরোপণের অঙ্গীকার করুন সকলে।

ভারতের মতো দেশে সমস্যা হল, অরণ্যের নিকটবর্তী এলাকায় যাঁরা থাকেন, তাঁরা অনেক সময়েই বঞ্চনার শিকার হন। আবার তাঁদের অরণ্যের উপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় থাকে না। এদিকে রাস্তা সম্প্রসারণ বা বিভিন্ন ‘উন্নয়নমূলক’ কাজের অজুহাতে অনেক সময়েই তাঁদের উৎখাত করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে নকশাল বা মাওবাদী সমস্যার দিকটিও কোনও না কোনওভাবে অরণ্যের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু অরণ্য নিয়ে যত অ্যাকশন প্ল্যান হোক না কেন, স্থানীয় মানুষদের বাদ দিয়ে কোনো প্রকল্পের বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।

নগর উন্নয়নের দৌড় পৌঁছে গিয়েছে অরণ্যে। তাই, জঙ্গলে দাঁড় করানো হচ্ছে একের পর এক মোবাইল টাওয়ার। গত দুই বছরে ভারতে এরকম অনেক ঘটনা ঘটেছে, যেখানে চিতাবাঘ বা নেকড়ে ঘন জনবসতিপূর্ণ এলাকায় ঢুকে গৃহপালিত পশুকে রাতের অন্ধকারে সাবাড় করে দিচ্ছে, স্থানীয় মানুষকে আক্রমণ করছে। ট্রেন লাইনে কাটা পড়েছে এরকম হাতির সংখ্যা নেহাত কম নয় খাস পশ্চিমবঙ্গে। উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্সে ট্রেনের ধাক্কায় বাঘও মারা পড়েছে। অরণ্যের সঙ্গে মানুষের সংঘাতপূর্ণ ব্যবহারে আদপে ক্ষতি হচ্ছে মানুষেরই। তবে এই বাস্তব মানতে রাজি নন অনেকেই।