প্রতিবাদ লিখে চলেছে গণতন্ত্রের নতুন ইতিহাস

১৫ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস পালিত হওয়ার সময় প্রতিবারই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিষয়টি সামনে আসে। পৃথিবীর কত শতাংশ মানুষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে জীবনযাপন করছেন, গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা, অধিকার তারা কতটা ভোগ করছেন, এই প্রশ্নই আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যামুয়েল ফিলিপস হান্টিংটন তাঁর ‘দ্য থার্ড ওয়েভ: ডেমোক্রেটাইজেশন ইন দ্য লেট টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি’ গ্রন্থে আধুনিক বিশ্বে গণতন্ত্রের তিনটি জোয়ারের কথা উল্লেখ করেছেন।

১৮১৮ থেকে পশ্চিমা দেশে গণতন্ত্রর বিকাশ এবং ১৯৯১-তে কম্যুনিস্ট দুনিয়ার ভাঙন অবাধ গণতন্ত্রের উত্থান পতন, তার প্রসারণ ও সংকটের কথা সমাজবিজ্ঞান ও অর্থনীতির নিরিখে তিনি বিশ্লেষণ করেছেন। দু-দু’টি মহাযুদ্ধ, রাশিয়া ও চিনের কম্যুনিস্ট বিপ্লব গণতন্ত্র চর্চায় কোন প্রভাব ফেলেছিল, এ বিষয়ে তিনি আলোকপাত করেছেন। তাঁর আলোচনায় ইউরোপ, আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, এশিয়া, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় বৃহৎ শক্তিগুলির ঔপনিবেশিক শাসনে গণতন্ত্র কীভাবে গড়ে উঠেছিল তার পরিচয় পাই। বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশগুলির রাজনৈতিক জীবন তাদের গণতান্ত্রিক সংকট হান্টিংটনের আলোচনায় স্থান পেয়েছে।

গত দু’শো বছর ধরে গণতন্ত্রের প্রসার ও প্রয়োগ দেখা দিয়েছে নানা ধরনের সংকট। একুশ শতকে গণতন্ত্র নীতি-দুর্নীতি রাজনীতির আবর্তে বারবার তার পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে। এই বিচ্যুতির রন্ধ্রপথে স্বাভাবিকভাবে সামাজিক অবক্ষয় প্রবেশ করেছে। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় আমরা জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম। স্বপ্ন দেখেছিলাম গণতান্ত্রিক স্বাধীনতার। ৪৭-এ অনেক স্বপ্নভঙ্গের বেদনা নিয়ে আমরা স্বাধীন হয়েছিলাম। সংবিধানকে পেয়েছিলাম সামাজিক অধিকারের রক্ষাকবচ হিসেবে। স্বাধীনতার পর সাতটি দশক পেরিয়ে গণতন্ত্র এখন ভোটবাক্স নিয়ন্ত্রণকারীদের হাতে। ক্ষমতা ও পুঁজির জোটবন্ধনে গণতন্ত্র মুষ্টিমেয়ের গণতন্ত্রে পর্যবসিত হতে চলেছে। আঘাত নেমে আসছে মুক্ত চিন্তা, মত প্রকাশের অধিকারের ওপর। মিডিয়াকে হাতে রাখতে চাইছে ক্ষমতাসীন দল।


স্বজন পোষণের রাজনীতি কেড়ে নিচ্ছে মানুষের প্রাপ্য। যে গণতন্ত্র মানুষের আস্থার জায়গা, বিশ্বাসের জায়গা, নির্ভরতার জায়গা, সেখানে ছেয়ে আছে দলতন্ত্রের মহোৎসব। জাতপাতের অহ্ক, পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি এখন আমাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রক। রাজনীতির ধর্মীয়করণ ঘটাতে জনসংখ্যাকে ধর্মের ভিত্তিতে জনগণনার যে প্রবণতা তা গণতান্ত্রিক আদর্শের পরিপন্থী। আমাদের দেশে দরিদ্র মানুষরাই তো সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাদের দুর্দশা দূর করতে ধর্ম নয়, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধই বড় কথা। ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে গণতন্ত্র সেজে উঠছে ধর্মের পোশাকে। ক্ষমতাসীনরা মনে করছেন ধর্মমোহের সিঁড়ি বেয়ে বারবার তাঁরা উঠে আসবেন ক্ষমতার অলিন্দে। ক্ষমতাপ্রিয় উচ্চভিলাষী রাজনীতিকদের জন্য গণতন্ত্র একটা কৌশল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তা এখন অবৈধ কাজ হাসিল করার মাধ্যম। যাঁরা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকতে চায়, যারা ক্ষমতার মোহে বিভোর হয়ে আছে, ক্ষমতারসাথে যাদের জীবিকা, তারা গণতন্ত্রকে ঢালের মতো ব্যবহার করছেন।

অনেক সাধারণ নির্বাচন ঘিরে অনেক ব্যালট পর্ব হয়েছে, কিন্তু অর্থনৈতিক দিক থেকে, জাতিগত দিক থেকে নীচুতলার জনগণের উন্নতি এখনও অনেক পিছিয়ে।
একটা রাষ্ট্র স্বাধীনতা পেলেও, তার গণতান্ত্রিক অধিকার পেলেও, দেশের মানুষ এই অধিকার কতটা পাচ্ছে, এটা একটা বড় প্রশ্ন। গত ৫০ বছরে এমন কোনও সাধারণ নির্বাচন হয়নি,যেখানে অরাজকতা দেখা দেয়নি, দলীয় সংঘর্ষ হয়নি। খবরের কাগজের পাতায় হেডিং থাকে ভোট লুঠ কিংবা কারচুপির। সামাজিক জীবনের অনেকটাই দলীয় রাজনীতির শক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় বিপন্ন হয়ে পড়ছে নাগরিকজীবন। গণতনতন্ত্রকে ঢাল করে চলছে মানুষের প্রতি লঞ্ছনা। রাজনতিকরা তাদের মতকে জোরকরে মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে চলেছে।

বড় বড় অপরাধ ঢাকতে মিথ্যা, বানানো ব্যাখ্যাকে এখন সত্য বলে বোঝানোর চেষ্টা চলে। যাঁরা মিথ্যা বলছেন, তাঁরা ভালো করেই জানেন, যাঁদের আমরা মিথ্যা বলছি, তাঁরাও এটা মিথ্যা বলে মনে করবে। তবুও মিথ্যা চলে। প্রতিবাদহীন নিঃশর্ত আনুগত্যের গণতন্ত্র তখন এটাকে মেনে নেয়। এটাও সত্য যে, গণতন্ত্রে মানুষের কণ্ঠকে কিছুদিন বন্ধ করে রাখা চলে। কিন্তু মানুষের সহনশক্তি চলে গেলে ক্ষোভের বিস্ফোরণ হয়। মানুষ তার বিশ্বাস, নির্ভরতা হারিয়ে ফেললে বেশিদিন চুপ করে বসে থাকে না। তখন প্রতিবদের ঝড় ওঠে। এ

ইসময়ে আরজি করের ঘটনা আমাদের অনেকটা চোখ খুলে দিয়েছে। এই ঘটনা শুধু একজন তরুণী ডাক্তারের খুন ও ধর্ষণের ঘটনা নয়, এই নারকীয় ঘটনা একটা ব্যবস্থার নগ্ন চেহারাকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। দেখিয়ে দিয়েছে যেখানে সরকারি পরিষেবার জায়গায় এই গণতান্ত্রিক দেশে এত বড় সংগঠিত ক্রাইম হতে পারে। তাই মেয়েরাই রাত্রি দখল করে বিচার পাওয়ার জন্য অন্ধকারের নীরবতা ভাঙছে। গণতন্ত্রের অবক্ষয়ের যুগে এই প্রতিবাদ লিখে চলেছে গণতন্ত্রের নতুন ইতিহাস। ভয়ঙ্কর অপরাধকে ঢাকতে অন্তঃসারশূন্য যুক্তির বিরুদ্ধে এত বড় প্রতিবাদ, এতো গণতন্ত্রেরই কণ্ঠস্বর। এই অধিকার সচেতনতাই তো গণতন্ত্রে কাম্য।

গণতন্ত্র মানুষের কাছে আস্থার তন্ত্র। এর কোনও ধরাবাধা পরিসর নেই। সমাজ ও রাষ্ট্রের কী কী উপাদান থাকলে তাকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বলা হবে তার সীমারেখা বড়। তার জন্য পরিসরও হয় বিশাল। গণতন্ত্র বহু কণ্ঠস্বর, বহুমতের মধ্যে দিয়ে সর্বশ্রেণির মানুষের সম্যক অংশগ্রহণ। দেশের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো এবং তারই সঙ্গে শিক্ষার অভাব গণতন্ত্রের বিকাশের সাথে সম্পৃক্ত। যেখানে যত বেশি অসাম্য বাড়ছে, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সঙ্গে মানুষ তত বেশি নিজেকে বিপন্ন ভাবছে. অর্থনীতিতে চলেছে ঘাটতির যুগ।

রেল, বিদ্যুৎ, সেচ, বন্দর, সড়ক সব ক্ষেত্রেই বিপুল ঘাটতি। রাষ্ট্রয়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিতে চেপে বসেছে অনাদায়ী ঋণের বোঝা। দরিদ্র পরিবারের বহু ছেলেমেয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষার দোরগোড়ায় পৌঁচতে পারছে না। অথচ চাকরির ক্ষেত্রে ন্যূনতম যোগ্যতা লাগে মাধ্যমিক শিক্ষা। দরিদ্র পরিবারে স্কুলছুটের সংখ্যা প্রতি বছর বাড়ছে। এর আড়ালে গ্রাম-শহরে বাড়ছে শিশু ও নারী শ্রমিক। আমাদের এই গণতান্ত্রিক আবহে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের ছবি প্রতি পরিসংখ্যানে স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

প্রতি ১৫ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবসের রাজনৈতিক বিশ্লেষণে গণতন্ত্রের সংকটের ছাপই দেখা যায়। এক সময় বামপন্থী রাজনীতির চর্চা গণতন্ত্রের প্রতি মানুষের বিশ্বাসকে অটুট রাখত। বাম ও গণতান্ত্রিক ভাবনা গড়ে ওঠা বিভিন্ন গণ আন্দোলন যে কল্যাণমুখী সমাজের লক্ষ্য দেখাতো, আজ তার বড়ই অভাব। এখন মানুষ সুরাহা খুঁজছে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির মধ্যে।

মানুষ বুঝেছে আজকের জীবনে জীবন-জীবিকা, চাকরি একইরকমভাবে চলবে না। বুঝেছে এখন চাকরি দীর্ঘস্থায়ী হয় সংস্থার টার্গেট পূরণের মধ্যে দিয়ে। আজকের অনিশ্চয়তা সমাজ ও ব্যক্তিজীবনে এনেছে চরম প্রতিদ্বন্দ্বিতা। নিজেকে ছাড়া মানুষ আজ কাউকে নিয়ে ভাবতে চাইছে না। মানবিক অনুভূতির তাই পতন ঘটে চলেছে। গণতান্ত্রিক ভাবনা মনে বাসা বাঁধবে কখন? মানবিকতার সংকট আজ গণতন্ত্রের মূল সংকট হয়ে দাঁড়িয়েছে।