মানবতার পূজারী লালনের জন্মভূমি আজ সাম্প্রদায়িক হিংসার আগুনে ঝলসে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সনাতনী জাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেপ্তার ও কারাগারে পাঠানোকে কেন্দ্র করে ঘিরে উত্তাল বাংলাদেশ। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, রংপুর জায়গায় জায়গায় অবরোধ বিক্ষোভ অশান্তির খবর। বিভিন্ন জায়গায় অগ্নিসংযোগের ছবিও সামনে এসেছে। আন্দোলনকারীদের উপরে নির্বিচারে অত্যাচার হচ্ছে বলেই অভিযোগ।
বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করা হয়েছে ইসকনের সাধু চিন্ময় কৃষ্ণ দাসসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে। ২৫ নভেম্বর বাংলাদেশের ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার করা হয় ইসকনের সাধু এবং সংখ্যালঘু আন্দোলনের অন্যতম মুখ চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে। এরপর থেকেই তাঁর মুক্তির দাবিতে বাংলাদেশে বিক্ষোভ-আন্দোলন শুরু হয়। চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে আদালত থেকে হেফাজতে নিয়ে যাওয়ার সময়ও তুমুল অশান্তি হয়। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে পুলিশের। ওই সংঘর্ষের মাঝেই সাইফুল ইসলাম নামে এক আইনজীবীর মৃত্যু হয়। এই ঘটনা যেন আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়েছে। বাংলাদেশ ইসকন কর্তৃপক্ষ কোনও এক অদৃশ্য কারণে জেলবন্দী চিন্ময় কৃষ্ণ দাস সম্পর্কে বারে বারে তাঁদের অবস্থান বদল করছে। বাস্তবে, দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া বাংলাদেশী হিন্দু তথা সংখ্যালঘুদের পরিত্রাতা মুখ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস।
হাসিনার প্রস্থানের পর, বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণির দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলো-য় সাম্প্রদায়িক আক্রমণের একটি সিরিজ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল। সেই রিপোর্টে উল্লেখ রয়েছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মন্দির, বাড়ি এবং দোকানে হামলার পাশাপাশি দেশের বেশ কয়েকটি জেলা জুড়ে লুটপাট ও হত্যার খবর। বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর আক্রমণ এই প্রথম নয়। ১৯৪৭ সালের ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের পর থেকে ধাপে ধাপে বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। একসময় জনসংখ্যার ২২ % ছিল, হিন্দুরা এখন বাংলাদেশে ৮ % এরও কম প্রতিনিধিত্ব করে। এভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ হিন্দুশূন্য রাষ্ট্রে পরিণত হবে। ঐতিহাসিকভাবে, হিন্দুরা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে তার ‘উদার ভাবমূর্তির’ জন্য সমর্থন করেছিল। কিন্তু অভ্যুত্থানের পর হাসিনা সরকার পতনের পর তাদের জন্য পরিস্থিতি ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়। শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে সংখ্যালঘু ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের ওপর হামলা বেড়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ ইউনুস এই ঘটনাগুলিকে খাটো করেছেন। একটি টেলিভিশন ভাষণে দাবি করেছেন, সহিংসতার বেশিরভাগ প্রতিবেদন অতিরঞ্জিত এবং রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সেপ্টেম্বরের একটি সাক্ষাৎকারে ইউনুস বলেছিলেন, হিন্দুদের উপর আক্রমণগুলি সাম্প্রদায়িক নয় বরং রাজনৈতিক ছিল।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তীব্রতায় শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ইউনুস সরকারের তত্বাবধানে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পুনরুজ্জীবিত হওয়ার বদলে ইসলামি মৌলবাদী শক্তির দাপাদাপি বেড়ে যায়। ইউনুস সরকারের নীরব প্রশ্রয়ে মৌলবাদীদের হুমকিতে বাংলাদেশকে ইসলামিক রাষ্ট্র ঘোষণার সাম্প্রতিক আহ্বান তীব্রতর হয়েছে। বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল মোঃ আসাদুজ্জামানের মত, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা এমন একটি জাতির সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ নয় যেখানে জনসংখ্যার ৯০% মুসলিম। বাংলাদেশের সংবিধানে ইসলাম ধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অস্থিরতা ও হিন্দুসহ অন্যান্য সংখ্যালঘুদের উপর চলমান হিংসার আবহ দেশের সেকুলার ফ্যাব্রিককে ক্ষয় করতে পারে। কিছু বিশ্লেষক বাংলাদেশের অস্থিরতাকে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করছেন। পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা আরও প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়। পাকিস্তানের সামরিক অভ্যুত্থানের ইতিহাস, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, হাইব্রিড শাসন এবং সামরিক প্রভাব পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বারে বারে ক্ষতিগ্রস্ত করে চলেছে। আশঙ্কা, অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে বাংলাদেশের ভবিষ্যত সেই দিকেই যাচ্ছে।
উগ্র ধর্মান্ধতা ও অশিক্ষার হাত ধরাধরি করে চললে দেশের সামগ্রিক অবস্থা কী ভয়ানক দিকে যেতে পারে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি সেটা আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশ গণতন্ত্র আর সেকুলার মতাদর্শ ছেড়ে পাকিস্থানের মতো ধর্মীয় গোঁড়ামি আর স্বৈরাতন্ত্রের দিকেই চলেছে। আধুনিক বিশ্বে গণতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষতাই একমাত্র উত্তরণের পথ। সব ধর্ম, ভাষা, অঞ্চলের জীবনের সার্বিক উন্নতি করতে পারলেই দেশ ও জাতির উন্নতি সম্ভব। প্রতিবেশী দেশে আগুন লাগলে তার আঁচ ভারতবর্ষে পড়বেই। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে এর বিরূপ প্রভাব পড়তে বাধ্য। ওপার বাংলায় হিন্দু বাঙালিদের অবস্থা পদ্মপাতায় জলের মতো। সমস্ত ভেদাভেদ ভুলে পশ্চিমবঙ্গসহ গোটা বিশ্বের হিন্দু বাঙালিদের একযোগে অত্যাচারিত বাংলাদেশী সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়ানোর সময় এসেছে। নাহলে আগামী দিন আরও ভয়ংকর। দিন থাকলে পথ না দেখলে হিন্দু বাঙালির অস্তিত্ব বিপন্ন হতে বাধ্য।
বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গসহ গোটা দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ভিত নড়বড়ে না হলেও মজবুত নয়। সেক্ষেত্রে এ বঙ্গের বুদ্ধিজীবী বিশেষ করে মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের সচেতনভাবে মুখে কুলুপ এঁটে থাকার প্রবণতা আখেরে এ রাজ্যের সম্প্রীতির ভিতকে আরও নড়বড়ে করে তুলবে। সেই সুযোগ কাজে লাগাবে উগ্র হিন্দুত্ববাদী শক্তি। এ যেন ঘুঁটে পোড়ে গোবর হাসে, এরকম অবস্থা। সেকুলার ধ্বজাধারী হিন্দুদের একাংশ বাংলাদেশের হিন্দুদের উপর চলমান অত্যাচারে চোখে ঠুলি পড়ে আছেন। প্রগতিশীল কথার বুলি কপচানো বামপন্থীদের অবস্থানও প্রশ্নের মুখে। ধরি মাছ না ছুঁই পানি, বামপন্থীদের এধরণের ভূমিকাকে হিন্দু বাঙালিরা আর ভালো চোখে দেখছে না। বাংলাদেশের হিন্দুদের উপর অত্যাচারের ঘটনায় বামপন্থীদের অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। বিশ্বের নানা প্রান্তে মানবতার লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে বামপন্থীদের প্রতিবাদের ঢেউ কলকাতার রাজপথে আছড়ে পড়ে। এবং সঙ্গতকারণেই আছড়ে পড়ে। কিন্তু প্রতিবেশী দেশের একই সংস্কৃতি বহনকারীদের প্রতি চরম অমানবিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে দায়সারাভাবে বামনেতাদের বক্তব্য হতাশাজনক। আর কতদিন বামপন্থীরা শীতঘুমে থাকবেন?
উপমহাদেশে শান্তি ও স্থিতাবস্থা অর্জনের জন্য বড়ো ভাই হিসাবে ভারতকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। ভারত সরকারের তরফে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেফতারি এবং জামিন মঞ্জুর না হওয়ার ঘটনা ও সংখ্যালঘুদের উপরে চলমান হিংসার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে ক্ষান্ত হলে চলবে না। ভারতের একাত্মবোধের মূল সুরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রাজনৈতিক মত বিরোধকে দূরে সরিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, বাংলাদেশের বর্তমান অস্থিরতায় তিনি কেন্দ্রের পাশেই আছেন। এমতাবস্থায় দেশের প্রধানমন্ত্রী বা বিদেশমন্ত্রীকে আন্তর্জাতিক স্তরে সোচ্চার হয়ে ইউনুস সরকারকে কড়া বার্তার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়াতেই হবে। নতুবা ভাবীকাল ক্ষমা করবে না। একই সঙ্গে বাংলাদেশের প্রগতিশীল শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সংগঠন ও মানুষদের এগিয়ে আসতে হবে। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমঝে দেওয়া দরকার, ভারতের জাতীয় পতাকা মারালে আখেরে বাংলাদেশেরই ক্ষতি হবে। বাংলাদেশের সরকারকেও বুঝতে হবে, সাধারণের জীবনে শান্তি ফেরানো একটা সরকারের প্রাথমিক দায়িত্ব এবং তার জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত পদক্ষেপ নিতেই হবে। নইলে এই ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক রোষানলে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে।
যিনি শান্তির নোবেল পেয়েছেন, তাঁর সরকারের আমলেই এত অশান্তি। আর তিনি মুখ বুজে রয়েছেন। কোথায় সেই ছাত্র নেতারা, যারা আজ ইউনুস সরকারের উপদেষ্টা হয়ে বসে আছেন? কেন সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ বন্ধ করতে সক্রিয় ভূমিকা নিতে দেখা যাচ্ছে না তাঁদের? মুক্তিযুদ্ধের সময় ইন্দিরা গান্ধীর ভূমিকা এ সময়ে বারে বারে চর্চায় আসছে। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের চরম সংকটে ভারতের বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের ধীরে চলো নীতিও প্রশ্নের মুখে। অনেকে প্রশ্ন, বাঙালি বলেই কি মোদী সরকারের এই গয়ংগচ্ছ মনোভাব? বাংলাদেশে হিন্দুসহ অন্যান্য সংখ্যালঘুদের উপর চলমান অত্যাচার বন্ধ করতে কী পদক্ষেপের পথে হাঁটবে মোদী সরকার সেটাই এখন দেখার।